বিজ্ঞাপন

ভূমিধসের ঝুঁকিতে ৫০ হাজার রোহিঙ্গা, ১২৩ একর জমি বরাদ্দ

May 26, 2018 | 9:04 am

।। জান্নাতুল ফেরদৌসী ও জাকিয়া আহমেদ ।।

বিজ্ঞাপন

কক্সবাজার থেকে: কক্সবাজারের ত্রিশটি রোহিঙ্গা ক্যাম্প এরইমধ্যে খাদ্য, বাসস্থান, চিকিৎসা, নিরাপত্তাসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার আয়ত্তে আনা গেলেও ক্যাম্পগুলোতে এখন আতঙ্ক আসন্ন বর্ষা মৌসুম নিয়ে। ক্যাম্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ২৫ হাজার মানুষ চরম ঝূঁকিপূর্ণ অবস্থাতে থাকলেও সেখান থেকে এরইমধ্যে ১৮ হাজার মানুষকে তুলনামূলক নিরাপদ এলাকাতে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। তবে সব মিলিয়ে এখনও ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে ৫০ হাজার মানুষ। তাদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিতে সরকার ১২৩ একর জমিও বরাদ্দ দিয়েছে। এই বরাদ্দকৃত জমিতে অগ্রাধিকার ভিত্তিকে কাজ চলছে।

চলতি মাসে পাহাড় ধসে একটি শিশুর মৃত্যু হয় এবং ছয় শিশু আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি রয়েছে। তাই ক্যাম্পগুলোতে এখন বর্ষা মৌসুম সামনে রেখে আতঙ্ক বিরাজ করছে।

ক্যাম্পের বাসিন্দা আবেদা খাতুন দুই সন্তান আর ছেলে বউকে নিয়ে গত আগস্টে পালিয়ে আসেন বাংলাদেশে। উখিয়ার মধুরছাড়া ক্যাম্পে এখন তার বাস ১৮ ফুট দৈর্ঘ্য ও ১২ ফুট প্রস্থ একটি ঘর। বাঁশ আর ত্রিপল দিয়ে তৈরি এই ঘরটি।

বিজ্ঞাপন

  

আবেদা খাতুন বলেন, দুই সপ্তাহে পানি-জঙ্গল পেরিয়ে পরিবার নিয়ে আসার সময়ে ভয় ছিল আবারও রাখাইন সেনাদের হাতে পড়ার। নিরাপদে ঠিকমতো পৌঁছাতে পারব কি না সে শঙ্কাও ছিল মনে। কিন্তু এখানে আসার পর প্রথম দিকে কষ্ট থাকলেও সে কষ্ট দূর হয়েছে এখন। মাছ-মাংস পাতে না জুটলেও ডাল -ভাত খেতে পারছেন, মাথা গোঁজার জায়গাও পেয়েছেন। কিন্তু নতুন আতঙ্ক এখন বৃষ্টির মৌসুম আর ভূমিধস ।

বিরামহীন বৃষ্টি হলে বাঁশের তৈরি ঘরটি ভেঙে যেতে খুব বেশি সময় নেবে না। আর পাহাড় ধসে কার না জানি মরণ হয়-মন্তব্য করে আবেদা খাতুন বলেন, ‘বর্ষা আসছে ভেবে ভয়ে থাকি। তখন কী হবে?’ পাহাড়ের পাদদেশের সে আশঙ্কায় বুক কাঁপে আবেদার মতো ক্যাম্পের অন্যান্য বাসিন্দাদেরও।

বিজ্ঞাপন

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, টানা বৃষ্টি হলে শিবিরের ১৫ শতাংশ এলাকা প্লাবিত হতে পারে। ইন্টার সেক্টর কো-অর্ডিনেশন গ্রুপ (আইএসসিজি) বলছে, আসন্ন বর্ষা মৌসুমে ভুমিধস, বন্যা, ভূমিকম্প, বৃষ্টিসহ অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগে ঝুঁকিতে রয়েছে দুই লাখ মানুষ। যার মধ্যে চরম ঝুঁকিতে রয়েছে ২৫ হাজার, এর মধ্যে ১৮ হাজার ৪০৮ জনকে অন্য জায়গায় সরিয়ে নেওয়া হয়েছে, বাকি ৬ হাজার ৪৪০ জনকে সরিয়ে নেওয়া প্রক্রিয়াধীন। আর এই প্রাকৃতিক দুর্যোগ এড়াতে না পারলে প্রায় ৬৫ হাজার রোহিঙ্গা স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়বে বলেও জানান তারা।

আইএসসিজি’র ন্যাশনাল পাবলিক ইনফরমেশন অফিসার সালমা রহমান সারাবাংলাকে বলেন, ‘ভূ-প্রকৃতির কারণে এমনিতেই এ পাহাড়বেষ্টিত এলাকা ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। উপরন্তু রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ঘন বসবাসের জন্য পাহাড় কাটার ফলে সেটি আরও ঝুঁকিপূর্ণ হয়েছে। বাংলাদেশ সরকার, জাতিসংঘের সহযোগী সংস্থাগুলো এখন এ ঝুঁকি মোকাবিলা করতে কাজ করে যাচ্ছে।’

রোহিঙ্গাদের রিলোকেশন (পুনর্বিন্যাস) করাটা ছিল অন্যতম কাজ। সেখানে আমরা কাজ শুরু করেছি এবং বর্ষা মৌসুমের প্রস্তুতি হিসেবে ক্যাম্পগুলোর সুয়ারেজ ব্যবস্থার সংস্কার এবং ঢালু এলাকার পানি যেন আটকে না থাকে সে বিষয়েও কাজ শুরু করছে তারা।

বিজ্ঞাপন

শরণার্থী ত্রাণ ও পুনর্বাসন কমিশনার আবুল কালাম আজাদ সারাবাংলাকে বলেন, এখন ‘প্রায়োরিটি’ ভিত্তিতে কাজ চলছে আসন্ন বর্ষা মৌসুমে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর নিরাপত্তা নিয়ে।

তিনি বলেন, ‘পাহাড়ধসের প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকে রোহিঙ্গাদের রক্ষা করার কাজ শুরু হয়ে গেছে। ঝুঁকিপূর্ণ রোহিঙ্গাদের সরিয়ে সম্প্রসারিত কুতুপালং ক্যাম্পের পশ্চিমপাশে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এরইমধ্যে নিরাপদে সরিয়ে নেওয়া শুরু হয়েছে।’

কিন্তু এ জন্য তাদের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করা প্রয়োজন জানিয়ে তিনি বলেন, ‘রোহিঙ্গারা এখনো বোঝে না পাহাড় ধসের ঝুঁকি কী। এর ফলে নিরাপদে সরিয়ে নেওয়াও কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।’

‘উখিয়া-টেকনাফসহ মোট ক্যাম্পগুলোতে প্রায় ১ লাখ ১৫ হাজারের মতো বাসিন্দা চরম ঝুঁকিতে ছিল এবং এরাই ছিল আমাদের টার্গেট গ্রুপ। এর মধ্যে পাহাড়ের চূড়ায়, খাদে এবং বন্যাকবলিত স্থানে ছিল প্রায় ২৫ হাজার মানুষ। তাই রিলোকেশন করাটাই ছিল আমাদের প্রধান চ্যালেঞ্জ। এর মধ্যে ৩৫ হাজারের মতো সরিয়ে নিতে পেরেছি’-বলেন কুতুপালং বালুখালী ক্যাম্প ১ এর ইনচার্জ রেজাউল করিম।

তিনি বলেন, ‘সরকার ১২৩ একর জায়গা জায়গা দিয়েছে এদের স্থানান্তরের জন্য। জাতিসংঘর শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা (ইউএনএইসসিআর) সেখানে কাজ করছে। এই জায়গাটুকু ছাড়া আরও আশেপাশের কিছু জমিতে কাজ চলছে মোট প্রায় ৪০০ থেকে ৫০০ একর জমিতে তাদেরকে সরিয়ে নিয়ে আসার পরিকল্পনা রয়েছে।’

ক্যাম্প-৪ এর সম্প্রসারিত এই ১২৩ একর জমিকে তৈরি করা হয়েছে ভিন্নভাবে। যদিও পাহাড় কাটা নিষিদ্ধ কিন্তু এই মানুষগুলোর নিরাপত্তা চিন্তা করে সেটা করতে হয়েছে আমাদের। ইউএনএইচসিআর আমাদের কাছে এই জমি হস্তান্তর করেছে, এখন বাকি মানুষগুলোকেও খুব শিগগির স্থানান্তর করতে পারব। কিছু কিছু ক্যাম্প আগে থেকে নির্ধারিত থাকলেও সেখানে জনবসতি ছিল না, সেখানও মানুষদের সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।

রোহিঙ্গাদের ভেতরে ভূমিধসের এই ঝুঁকি নিয়ে সচেতনতা কম মন্তব্য করে রেজাউল করিম বলেন, ‘তারা জানে এলাকাটা রিস্কি। তারপরও তারা সেখান থেকে সরতে চান না। মরলে এখানেই মরবো-ভাবনাটা তাদের এমন।’

তাই রোহিঙ্গাদের সরিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে তাদেরকে বেগ পেতে হচ্ছে। নিজের ঘর ছাড়তে চায় না। বারবার কাউন্সিলিং করার পরও যখন কাজ হয় না তখন তাদেরকে ফোর্স করা ছাড়া আমাদের উপায় থাকে না বলেন রেজাউল করিম। কারণ, সে হয়তো তার রিস্ক নিয়ে সচেতন না, কিন্তু আমাকে তো সচেতন হতে হবে-আমি তো একজন মানুষকেও মরতে দিতে পারি না।

বালুখালিতে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা বেশি জানিয়ে তিনি বলেন, ‘ওখানে পরিবার বেশি হওয়াতে ওই এলাকা থেকে মানুষ সরিয়ে নিতে হবে আগে। তবে আশার কথা হচ্ছে, বাস্তবে যত মানুষ ঝুঁকিতে রয়েছে-তার চেয়েও বেশি সংখ্যা ধরে আমরা কাজ করছি।’

এতে করে আমাদের কাজ করতে সুবিধা হচ্ছে এবং যারা আমাদের ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার ক্রাইটেরিয়াতেও নেই, তাদের জন্যও আমরা কাজ করতে পারছি আমরা বলেন রেজাউল করিম।

সারাবাংলা/জেডএফ/জেএ/একে

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন