বিজ্ঞাপন

বিপ্লবী ও রেডিক্যাল হিউম্যানিস্ট কমরেড মানবেন্দ্রনাথ রায়

March 21, 2024 | 5:48 pm

সৈয়দ আমিরুজ্জামান

সারাবিশ্বে বিচরণকারী বিপ্লবী কমরেড মানবেন্দ্রনাথ রায় সর্ব ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠাতা ও রেডিক্যাল হিউম্যানিস্ট। মহান এই নেতার ১৩৭তম জন্মদিন আজ। তাঁর প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা নিবেদন করছি।

বিজ্ঞাপন

১৭৬ বছর আগে রচিত হয়েছিল ‘কমিউনিস্ট পার্টির ইশতেহার’ শীর্ষক ছোট্ট একটি পুস্তিকা। এটি দুনিয়াকে বদলে দেওয়ার শ্রমিক শ্রেণির মতাদর্শের এক অপ্রতিরোধ্য রাজনৈতিক হাতিয়ার। সারা দুনিয়ার কমিউনিস্ট বা ওয়ার্কার্স পার্টিসমূহের মহত্তম দলিল হিসেবে আজও স্বীকৃত। এমন কোনো জ্ঞানপিপাসু মানুষ পাওয়া যাবে না যিনি ইশতেহারের সঙ্গে বোঝাপড়া না করে অগ্রসর হতে পেরেছেন। কমিউনিস্ট বিপ্লবের উদ্দীপনার পেছনে এই গ্রন্থের ভূমিকা আজও সমপরিমাণে অটুট আছে।

ইশতেহার প্রকাশিত হওয়ার পর পরই সারা দুনিয়ায় চিন্তার জগতে তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছিল। এখনো পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষকে আলোকিত করে চলেছে এই ইশতেহার।

লেনিনের ভাষায়, “এই ছোট পুস্তিকাখানি বহু বৃহৎ গ্রন্থের সমতুল্য। সভ্য জগতের সমগ্র সংগঠিত ও সংগ্রামী প্রলেতারিয়েত আজও তার প্রেরণায় উদ্দীপ্ত ও অগ্রসর।”

বিজ্ঞাপন

কমিউনিস্ট ইস্তেহারের প্রথম ভাগের নাম “বুর্জোয়া ও প্রলেতারিয়েত”। এই ভাগে সামন্ততান্ত্রিক সমাজ থেকে পুঁজিবাদের জন্মের কাহিনী বলা হয়। মার্ক্স পুঁজিবাদের আকাশচুম্বী উৎপাদন ক্ষমতাকে যথাযথ স্বীকৃতি দেন। তবে পুঁজিবাদের ধ্বংসাত্মক ক্রিয়াকলাপ তিনি তার রচনায় উদ্ঘাটিত করেছেন। তার মতে অকল্পনীয় হারে পণ্যোৎপাদন বাড়লেও সমাজ থেকে দারিদ্র্য দূর হয়নি। তিনি পুঁজিবাদের অন্তর্বিরোধ এবং আর্থিক সংকটের বিশ্লেষন করেছেন। এই ইস্তেহারে ধনতন্ত্রের অন্ধকার দিক দেখিয়ে পরিবর্তে অন্য কোনো সমাজব্যবস্থার কথা বলা হয়নি। তবে বলা হয়েছে, প্রচলিত সমাজব্যবস্থার গতিশীলতা থেকেই ঘটনাক্রমে বিপ্লবাত্মক শক্তির জন্ম হবে।

কমিউনিস্ট ইস্তেহার-এর ভেতর যে মূলচিন্তা প্রবহমান তা এই যে ইতিহাসের প্রতি যুগে অর্থনৈতিক উৎপাদন এবং যে সমাজ-সংগঠন তা থেকে আবশ্যিকভাবে গড়ে উঠে, তাই থাকে সেই যুগের রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিগত ইতিহাসের মূলে। সুতরাং জমির আদিম যৌথ মালিকানার অবসানের পর থেকে সমগ্র ইতিহাস হয়ে এসেছে শ্রেণী সংগ্রামের ইতিহাস। আধুনিক বুর্জোয়া সম্পত্তির অনিবার্যভাবে আসন্ন অবসানের কথা ঘোষণা করাই ছিল এই বইয়ের লক্ষ্য।

সমাজ বদলের লড়াইকে অগ্রসর করার তাগিদ থেকে ইশতেহার রচিত হয়েছিল। এর রচয়িতা কার্ল মার্কস ও ফ্রেডরিক এঙ্গেলসের বন্ধুত্ব ছিল বিস্ময়কর ও অতুলনীয়। প্রতিভাদীপ্ত এই দুইজন বিপ্লবীর অসাধারণ বোঝাপড়া, চিন্তা ও অনুশীলনের ঐক্য ইশতেহার রচনার যৌথকাজে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।

বিজ্ঞাপন

কমিউনিস্ট পার্টির ইশতেহার শীর্ষক ছোট্ট পুস্তিকাটি প্রকাশিত হওয়ার ৭২ বছর, মার্কসের জীবৎকালে কেবল ডাস ক্যাপিটাল-এর প্রথম খণ্ড প্রকাশের ৫৩ বছর, ১৯১৭ সালে কমরেড ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিন ও বলশেভিকদের নেতৃত্বে কমিউনিস্টদের সমাজতান্ত্রিক রুশ বিপ্লবের তিন বছরের মাথায় শ্রেণিসংগ্রাম তরান্বিত করার জন্য বিপ্লবের ব্রত ও অঙ্গীকারে ১৯২০ সালে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের উজবেকিস্তানের রাজধানী তাসখন্দে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি গঠিত হয়েছিল। আমরা যে কমিউনিস্ট উত্তরাধিকার বহন করি তা এ বছর ১৭ অক্টোবর ১০৫ বছরে পদার্পন করবে। যদিও ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠাকাল নিয়ে ভারতের প্রধান দুটি কমিউনিস্ট পার্টি সিপিআই ও সিপিআই (এম)-এর মধ্যে মতভিন্নতা রয়েছে। সিপিআই (এম) ১৯২০ সালের ১৭ অক্টোবর ও সিপিআই ১৯২৫ সালের ২৬ ডিসেম্বরকে প্রতিষ্ঠা দিবস হিসেবে পালন করে।

১৯৫৯ সালের ১৯ আগস্ট অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির সম্পাদকমণ্ডলী ১৯২৫ সালের ২৬ ডিসেম্বরকে সর্বসম্মতভাবে পার্টির প্রতিষ্ঠা দিবস হিসেবে গ্রহণ করেছিল।

এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, গত শতাব্দীর বিশের দশকের শুরুতেই ভারত উপমহাদেশ তথা বর্তমান ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে কমিউনিস্ট আন্দোলন অঙ্কুরিত হয়েছিল। সেই বিবেচনায় ভারত উপমহাদেশে কমিউনিস্ট আন্দোলন তার এক শত চার বর্ষে পা রেখেছে। এ নিবন্ধে ভারত উপমহাদেশে কমিউনিস্ট আন্দোলনের উন্মেষকাল নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।

মার্কসবাদের সাথে ভারত উপমহাদেশবাসীর পরিচয়

বিজ্ঞাপন

১৮৭১ সালের ১৫ আগস্ট প্রথম আন্তর্জাতিকের সভার কার্যবিবরণী থেকে জানা যায় কলকাতা থেকে জনৈক ব্যক্তি প্রথম আন্তর্জাতিকের সম্পাদকের কাছে এক পত্রে ভারতবর্ষে আন্তর্জাতিকের শাখা প্রতিষ্ঠার ক্ষমতা চেয়েছেন। এ সভায় স্বয়ং কার্ল মার্কস ও ফ্রেডারিখ এঙ্গেলস উপস্থিত ছিলেন। ১৯০০ সালে ডন পত্রিকায় ফ্রেডারিখ এঙ্গেলসের একটি বই নিয়ে গুরুত্বের সাথে আলোচনা করা হয়। ১৯০৪ সালে আমস্টার্ডমে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকে যোগ দেন দাদাভাই নৌরজী। ১৯০৭ সালে স্টুটগার্টে আন্তর্জাতিক সমাজতান্ত্রিক সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন ভিকাজী রুস্তম কামা, সর্দ্দার সিং রাওজী রাণা ও বীরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়। ১৯১০ সালে মডার্ন রিভিউ পত্রিকায় একটি প্রবন্ধে ‘কমিউনিস্ট ইশতেহার’ থেকে উদ্ধৃতি দেয়া হয়। ১৯১২ সালে লালা হরদয়াল একই পত্রিকায় Karl Marx-A Morden Rishi নামে প্রবন্ধ লিখেন। ১৯১২ সালেই কে. রামকৃষ্ণ পিল্লাই কার্ল মার্কসের জীবনী গ্রন্থ রচনা করেন। মূলতঃ ১৯১৭ সালের রুশ বিপ্লব এবং ১৯১৮-২২ সালের ভারতের শ্রমিকশ্রেণির সংগ্রাম ভারতে মার্কসবাদের উদ্বোধন ঘটায়।

রুশ বিপ্লবের প্রভাব

ভারতীয় জাতীয় বিপ্লবীদের একটি অংশ যারা নানা কারণে দেশের বাইরে অবস্থান করছিলেন এবং দেশের স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করছিলেন ১৯১৭ সালের রুশ বিপ্লব তাদের অনেকের ওপর গভীর প্রভাব ফেলে। জার্মানিতে যারা অবস্থান করছিলেন তারা স্বদেশমুক্তির জন্য বার্লিন কমিটি’ গঠন করেছিলেন। ১৯২১ সালে কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের আমন্ত্রণে ইউরোপ থেকে বীরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়, ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত, গোলাম আম্বিয়া খান লোহানীসহ মোট নয় জন যোগ দেন। এদের মধ্যে স্বামী বিবেকানন্দের ছোট ভাই ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত ১৯২৫ সালে দেশে ফিরে এসে মার্কসবাদ প্রচারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।

নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য যিনি এম এন রায় নামে পরিচিত। তিনি ‘অনুশীলন সমিতি’র সদস্য ছিলেন। ১৯১৫ সালে দলের জন্য অস্ত্র সংগ্রহ করতে বিদেশ পাড়ি দেন। জাপান, চীন হয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যান। সেখানে মার্কসবাদী সাহিত্যের সাথে পরিচিত হন। আমেরিকান এভেলিনা ট্রেন্টকে বিয়ে করেন। মার্কিন পুলিশের নাজেহালের ভয়ে ১৯১৭ সালের গ্রীষ্মে মেক্সিকো চলে যান। সেখানে তিনি সমাজবাদী চিন্তায় আকৃষ্ট হন এবং সেখানকার সমাজবাদী দল ‘সোশ্যালিস্ট ওয়ার্কার্স পার্টি’তে যোগ দিয়ে তার সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯১৯ সালে রুশ কমিউনিস্ট নেতা মাইকেল বরোদিনের সাথে এম এন রায়ের পরিচয় হয়। কমরেড বরোদিনের কাছে রায় মার্কসবাদের শিক্ষা লাভ করেন। তিনি সোশ্যালিস্ট ওয়ার্কার্স পার্টিকেই মার্কসবাদী দলে রুপান্তরিত করেন এবং মেক্সিকোর কমিউনিস্ট পার্টি গঠনের মধ্য দিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের বাইরে পৃথিবীর প্রথম কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯২০ সালের ১৯ জুলাই-৭ আগস্ট পর্যন্ত অনুষ্ঠিত কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের দ্বিতীয় কংগ্রেসে যোগ দেন।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে ভারতের পাঞ্জাব ও হরিয়ানা থেকে প্রচুর শিখধর্মাবলম্বী পাঞ্জাবী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পানামায় গিয়েছিলেন। সেখানে তারা স্বাধীনতার লক্ষ্যে গদর পার্টি সংগঠিত করেন। রুশ বিপ্লবের প্রভাবে তারা মার্কসবাদ-লেনিনবাদে আকৃষ্ট হন। অনেকেই দেশে ফিরে এসে কমিউনিস্ট আন্দোলন সংগঠিত করেন।

প্যান ইসলামিক খেলাফত আন্দোলনে অংশ নেয়া মুসলিম জাতীয়তাবাদী বিপ্লবীরা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর হিজরত আন্দোলনে যোগ দিয়ে দেশত্যাগ করে সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্য এশিয়ার প্রদেশসমূহে অবস্থান গ্রহণ করেন। রুশ বিপ্লবের প্রভাবে তাদের অধিকাংশই মার্কসবাদ-লেনিনবাদকে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করেন।

১৯২২ সালে চৌরিচৌরায় পুলিশ হত্যার ঘটনায় গান্ধী কর্তৃক একতরফাভাবে অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যাহার করে নেয়ায় স্বাধীনতাকামী জাতীয়তাবাদী সশস্ত্র বিপ্লবীদের একাংশ কংগ্রেস রাজনীতির প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলেন এবং রুশ বিপ্লবের প্রভাবে মার্কসবাদ-লেনিনবাদকে মতাদর্শ হিসেবে গ্রহণ করেন। বাংলায় ধরণী গোস্বামীর নেতৃত্বে তাঁরা ইয়ং কমরেডস লীগের মাধ্যমে নিজেদের সংগঠিত করেন। এ গ্রুপে মণি সিংহ, গোপাল বসাক, গোপেন চক্রবর্তীসহ অনেকে ছিলেন। এছাড়া গণনায়ক পার্টি, সাম্যরাজ পার্টি, কারখানা গ্রুপ, লাল নিশান গ্রুপ ইত্যাদি মাধ্যমে সংগঠিত জাতীয় বিপ্লবীরা কমিউনিস্ট পার্টিতে শামিল হন।

এর পাশাপাশি এ সময়কালে শ্রমিকদের শক্তিশালী লড়াই কমিউনিস্ট আন্দোলনের ভিত্তি গড়তে সহযোগিতা করে। ১৯২০ সালের অক্টোবর মাসে মুম্বাইয়ে অল ইন্ডিয়া ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেস প্রতিষ্ঠিত হয়। পুরো ত্রিশের দশক ভারতের শ্রমিকশ্রেণি বড় বড় সংগ্রাম গড়ে তুলে। শুধু মাত্র বাংলার বিভিন্ন শিল্পাঞ্চল, আসামের চা বাগান ও বিহারের খনি এলাকায় অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক উভয়বিধ কারণে ১৯২০ সালে ১৩৭টি, ১৯২১ সালে ১৫০টি ও ১৯২২ সালে ৯১টি ধর্মঘট সংগঠিত হয়েছিল।

বিভিন্ন স্থানে কমিউনিস্ট চক্র বা গোষ্ঠীর উদ্ভব

কমিনটার্নের দ্বিতীয় কংগ্রেসের পরই এম এন রায় ১৯২০ সালের ১৭ অক্টোবর তাসখন্দে প্রবাসী ভারতীয় ও দুজন বিদেশিনীকে নিয়ে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি গঠন করেন। এরা হলেন ১) মানবেন্দ্র নাথ রায় (এম এন রায়), ২) এভেলিনা ট্রেন্ট রায় (এম এন রায়ের মার্কিন স্ত্রী), ৩) অবনী মুখার্জী, ৪) রোজা ফিটিংগোফ মুখার্জী (অবনী মুখার্জীর রুশ স্ত্রী), ৫) মুহম্মদ আলী (আহমেদ হাসান), ৬) এম প্রতিবাদী বায়াঙ্কার আচার্য (মান্ডায়াম পার্থ সারথি তিরুমারাই আচার্য), ৭) মুহম্মদ শফিক সিদ্দিকী। এই কমিটির সম্পাদক নির্বাচিত হন মুহম্মদ শফিক সিদ্দিকী। ১৯২০ সালের ১৫ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত কমিটির সভায় রায়, শফিক ও আচার্য এই তিন জনকে নিয়ে পার্টির ‘কার্যকরী কমিটি’ গঠিত হয়। ১৯২১ সালে এই কমিটি কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি লাভ করে। ১৯২২ সালের এপ্রিলে এম এন রায়ের বার্লিন গমনের সাথে সাথে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির হেড কোয়ার্টার বার্লিনে স্থানান্তরিত হয়। এম এন রায়ের সম্পাদনায় ১৯২২ সালের ১৫ মে ইংরেজি ভাষায় ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির প্রথম মুখপত্র পাক্ষিক ‘দি ভ্যানগার্ড অব দি ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেনডেন্স’ প্রকাশিত হয়। মাঝখানে পুলিশের নজরে এড়াতে ‘দি এডভান্স গার্ড’ নামে কয়েক সংখ্যা বের হলেও ১৯২৩ সালের ১৫ মে দ্বিতীয় বর্ষ প্রথম সংখ্যা ‘দি ভ্যানগার্ড’ নামে প্রকাশিত হয়। মাস্টার হেডের নীচে প্রথম বারের মত লেখা হলো ‘ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্র’ তার নীচে লেখা থাকতো ‘কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের অঙ্গীভূত’। এ সকল পত্রিকার মধ্য দিয়ে ভারতবর্ষে অনেক ব্যক্তি কমিউনিস্ট পার্টি ও মার্কসবাদের প্রতি আকৃষ্ট হন।

কলকাতা, বোম্বে (বর্তমানে মুম্বাই), লাহোর, মাদ্রাজ (বর্তমানে চেন্নাই) এ চারটি শহরে প্রথম পার্টি গড়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়। পৃথক চারটি শহরে প্রায় একসাথে পার্টি গড়ার কাজের সূত্রপাত হয়েছিল যার মধ্যবিন্দু ছিলেন কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক কর্তৃক দায়িত্বপ্রাপ্ত এম এন রায়। এ চারটি জায়গায় কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের সাথে স্বাধীনভাবে সংযোগ সৃষ্টি হয়েছিল এবং কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকই কোনো কোনো ক্ষেত্রে উদ্যোক্তাদের মধ্যে সংযোগ ঘটিয়ে দিয়েছিল। যেমন কোলকাতার মুজাফ্ফর আহমদের সাথে মুম্বাইয়ের শ্রীপাদ অমৃত ডাঙ্গের সংযোগ ঘটিয়ে দিয়েছিল। ১৯২১ সালে ডিসেম্বরের মধ্যেই ভারতবর্ষের অভ্যন্তরীস্থ নবদীক্ষিত কমিউনিস্টদের সাথে কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছিল। মুম্বাইয়ে এস এ ডাঙ্গে প্রথম মার্কসবাদে দীক্ষিত হন। ১৯২১ সালে তিনি ‘গান্ধী বনাম লেনিন’ নামে পুস্তক লিখেন। ১৯২২ সালে ‘সোশালিস্ট’ নামে পত্রিকা বের করেন এবং তাকে কেন্দ্র করে একদল তরুণ মাকর্সবাদী সাহিত্য পাঠ শুরু করেন। এদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন সচ্চিদানন্দ বিষ্ণু ঘাটে। চেন্নাই (মাদ্রাজ) এ কমিউনিস্ট পার্টির প্রতি আকৃষ্ট প্রথম ব্যক্তি হচ্ছেন শ্রমিক নেতা মায়লাপুরম সিঙ্গারাভেলু চেট্টিয়ার। লাহোর (পাঞ্জাব) এ তাসখন্দে গঠিত পার্টির সদস্য মুহম্মদ আলীর প্রভাবে তাঁর বন্ধু পেশোয়ারের এডওয়ার্ডস্ চার্চ মিশন কলেজের অর্থনীতির শিক্ষক গুলাম হুসায়ন চাকুরি ছেড়ে লাহোরে এসে পার্টি গড়ার জন্য রেলওয়ে ওয়ার্কার্স ইউনিয়নে যোগ দিয়েছিলেন। তিনি ‘ইনকিলাব’ নামে একটি উর্দু পত্রিকা প্রকাশ করেন।

১৯২১ সালের নভেম্বর মাসে মার্কসবাদী সাহিত্য ক্রয়ের মাধ্যমে কমিউনিজমের সাথে প্রত্যক্ষ যোগাযোগ ঘটে কলকাতায় বসবাসরত সন্দ্বীপের মুজাফ্ফর আহমদের। তাঁর ক্রয়কৃত বইগুলোর মধ্যে ছিল ‘বামপন্থি কমিউনিজমের শিশুসুলভ বিশৃঙ্খলা’ ও ‘পিপলস্ মার্কস’ (ক্যাপিটেলের সংক্ষিপ্তসার)। ১৯২১ সালের ডিসেম্বর মাসে তাঁর পরিচয় ঘটে এম এন রায়ের প্রেরিত নলীনি গুপ্তের সাথে। যিনি রায়ের নির্দেশে ভারতে এসেছিলেন জাতীয় বিপ্লবীদের সাথে যোগাযোগ করে তাঁদেরকে কমিউনিস্ট পার্টির প্রতি আকৃষ্ট করতে। নলিনী গুপ্তই হচ্ছেন এম এন রায় ও কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের সাথে মুজাফ্ফর আহমদের যোগসূত্র। কমিউনিস্ট আন্দোলনে নেমে মুজাফ্ফর আহমদের সাথে প্রথম সংযোগ হয় জাতীয় বিপ্লবী ভূপেন্দ্রকুমার দত্তের সাথে। দ্বিতীয় আবদুর রাজ্জাক খান এবং তৃতীয় আবদুল হালিম। রাজ্জাক এবং হালিম কমিউনিস্ট পার্টি গড়ায় মুজাফ্ফর আহমদের সহযোগী হলেও ভূপেন্দ্রকুমার দত্ত ফিরে গিয়েছিলেন তাঁর পুরোনো সশস্ত্র রাজনীতিতে। এদের সাথে যুক্ত হন শামসুল হুদা। এরাই বাংলার আদি কমিউনিস্ট।

কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র মামলা

উন্মেষকালেই ভারতবর্ষের কমিউনিস্ট আন্দোলনকে ধ্বংস করার জন্য ১৯২১ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর হতে ১৯২৭ সাল পর্যন্ত সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে ফিরে আসা কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে পাঁচটি ‘পেশোয়ার ষড়যন্ত্র মামলা’ দায়ের করা হয়।

১৯২৩ সালের মে মাস থেকে সারাদেশে কমিউনিস্টদের গ্রেপ্তার শুরু করা হয়। ১৩ জনের তালিকা তৈরি করা হয়। ১৯২৪ সালের ১৭ মার্চ থেকে মুজাফ্ফর অাহমদ, সওকত উসমানী, এস এ ডাঙ্গে ও নলিনী গুপ্ত এ চারজনের বিরুদ্ধে। ‘কানপুর কমিউনিস্ট ষড়যন্ত্র মামলা’ চালু করা হয়। মুজাফ্ফর আহমদ ও ডাঙ্গের চার বছর কারাদন্ড হয়। যক্ষা রোগে আক্রান্ত হওয়ায় মুজাফ্ফর আহমদ ১৯২৫ সালের ১২ সেপ্টেম্বর মুক্তি লাভ করেন।

ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির কানপুর সম্মেলন

কানপুর কমিউনিস্ট ষড়যন্ত্র মামলার প্রাথমিক অভিযুক্ত ১৩ জনের একজন উত্তরপ্রদেশের সত্যভক্ত ১৯২৫ সালের ২৫-২৮ কানপুরে কমিউনিস্ট সম্মেলন আহ্বান করেন। মাওলানা হসরৎ মোহানী ছিলেন অভ্যর্থনা কমিটির চেয়ারম্যান। ২৫ ডিসেম্বর ছিল উদ্বোধনী পর্ব। ২৬ ডিসেম্বর কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠার বিষয় আলোচনা হয়। সংখ্যাগরিষ্ঠতায় সিদ্ধান্ত হয় পার্টির নাম হবে ‘ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি’। অন্য সিদ্ধান্তে কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের সাথে সম্পর্ক দৃঢ় করার সিদ্ধান্ত গৃহিত হয়। সম্মেলনে ৩০ সদস্যবিশিষ্ট কমিটি গঠিত হয়। ১৬ জন সম্মেলনে নির্বাচিত হন। সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন এস ভি ঘাটে ও জে পি বাগেরহাট্টা।

ওয়ার্কার্স এন্ড পেজান্টস্ পার্টি

কমিউনিস্টরা ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির কার্যক্রমের পাশাপশি সারাদেশে ওয়ার্কার্স এন্ড পেজান্টস্ পার্টি সংগঠিত করার উদ্যোগ গ্রহণ করে। সেইমতে বাংলায় ১৯২৬ সালের ৬ ও ৭ ফেব্রুয়ারি কৃষ্ণনগরে অনুষ্ঠিত প্রথম সম্মেলনে ‘দি লেবর স্বরাজ পার্টি অফ দি ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস’র নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় পেজান্টস্ এন্ড ওয়ার্কার্স পার্টি অফ বেঙ্গল (বঙ্গীয় কৃষক ও শ্রমিক দল)। ১৯২৭ সালের ১৯ ও ২০ ফেব্রুয়ারি দ্বিতীয় সম্মেলন অতুলচন্দ্র গুপ্ত সভাপতি ও সৌম্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯২৮ সালের ৩১ মার্চ-১ এপ্রিল চব্বিশপরগনা জেলার ভাটপাড়াতে অনুষ্ঠিত তৃতীয় সম্মেলনে সংগঠনের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ওয়ার্কার্স এন্ড পেজান্টস্ পার্টি অফ বেঙ্গল (বঙ্গীয় শ্রমিক ও কৃষক দল)। সম্মেলনে অতুলচন্দ্র গুপ্ত সভাপতি ও মুজাফ্ফর আহমদ সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। এ সম্মেলনে ‘কল টু অ্যাকশন’ নামে কর্মসূচি গৃহিত হয়। দলের মুখপত্র হিসেবে প্রথমে ‘লাঙ্গল’ পরে ‘গণবাণী’ প্রকাশিত হয়।

১৯২৮ সালের ২১-২৩ ডিসেম্বর কলকাতার আলবার্ট হলে ওয়ার্কার্স এন্ড পেজান্টস্ পাটির সর্বভারতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। পৃথকভাবে গড়ে ওঠা বাংলা, বোম্বে, পাঞ্জাব, যুক্তপ্রদেশের ওয়ার্কার্স এন্ড পেজান্টস্ পার্টির নেতৃবৃন্দ ঐক্যবদ্ধভাবে অল ইন্ডিয়া ওয়ার্কার্স এন্ড পেজান্টস্ পাটি গঠন করেন। পাঞ্জাবের মোহন সিং জোশ ও মুম্বাইয়ের আর. এস. নিম্বকরকে সাধারণ সম্পাদক করে সর্বভারতীয় কমিটি নির্বাচিত করা হয়।

মীরাট ষড়যন্ত্র মামলা

সারা ভারতজুড়ে শ্রমিক আন্দোলনের প্রেক্ষিতে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টিকে ধ্বংস করার চক্রান্তের অংশ হিসেবে ভারতের গভর্নর জেনারেলের নির্দেশে ১৯২৯ সালের ২০ মার্চ সারা ভারতে ৩২ জন বিশিষ্ট কমিউনিস্ট, শ্রমিক-কৃষক পার্টির নেতা, ট্রেড ইউনিয়ন ও কৃষকনেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়। যাদের মধ্যে তিনজন ছিলেন ব্রিটিশ নাগরিক। ১৯২৯ সালের ১২ জুন মীরাট ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ‘মীরাট ষড়যন্ত্র মামলা’ শুরু হয়। ১৯৩৩ সালের ১৬ জানুয়ারি রায় হয়। মামলার রায়ে কমিউনিস্ট নেতাদের যাবজ্জীবন থেকে নানা মেয়াদের কারাদণ্ড দেয়া হয়।

বাংলায় পার্টির বিস্তার

১৯৩৪ সালের মধ্যে ছয়টি জেলা- কলকাতা, হাওড়া, হুগলী, বর্ধমান, যশোর, মেদিনীপুর পার্টির সাংগঠনিক কমিটি গঠিত হয়।

১৯৩০ সালে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার দখল এবং ১৯৩২ সালে কংগ্রেসের অসহযোগ আন্দোলনের ফলে অসংখ্য জাতীয় বিপ্লবী এবং কংগ্রেস কর্মী কারারুদ্ধ হন। এদের অনেকেই কারাগারে মার্কসবাদ-লেনিনবাদী মতাদর্শ চর্চা করেন এবং নিজেদের কমিউনিস্ট পার্টির কর্মী হিসেবে পরিচয় দেন। ১৯৩৭-৩৮ সালে তাঁরা মুক্ত হয়ে পার্টির সদস্যপদ লাভ করেন এবং বিভিন্ন জেলায় ছড়িয়ে পড়েন। ফলে ১৯৩৯ সালের মধ্যে দার্জিলিং ও কোচবিহার জেলা ছাড়া প্রতিটি জেলায় পার্টির সাংগঠনিক কমিটি গঠিত হয়।

চক্র বা গোষ্ঠী স্তর থেকে পার্টি স্তরে উত্তরণ

১৯৩৩ সালের ডিসেম্বর মাসে কলকাতায় ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সর্বভারতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এ সম্মেলনে বাংলার প্রতিনিধিত্ব করেন আব্দুল হালিম, রণেন সেন, সোমনাথ লাহিড়ী। মুম্বাই থেকে উপস্থিত ছিলেন ড. গঙ্গাধর অধিকারী, এস জি পাটকর, নাগপুর থেকে এম এল জয়মন্ত, পাঞ্জাব থেকে গুরুদিৎ সিং, উত্তর প্রদেশ থেকে পি সি যোশী। সম্মেলনে ড. গঙ্গাধর অধিকারী সর্বসম্মতিক্রমে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। সম্মেলনে উপস্থিত সকলকে নিয়ে কেন্দ্রীয় কমিটি গঠিত হয়। বড়লাটের নির্দেশে ১৯৩৪ সালের ২৮ জুলাই কমিউনিস্ট পার্টিসহ সারাদেশে অসংখ্য বামপন্থি সংগঠন বেআইনি ঘোষণা করা হয়। মুম্বাইয়ে সুতাকল শ্রমিকদের ধর্মঘট সংঘটিত করায় ১৯৩৪ সালে ডা. অধিকারীকে গ্রেপ্তার করে বিজাপুরে অন্তরীণ রাখা হয়। অধিকারীর পরে এস ভি ঘাটে সাধারণ সম্পাদক হন। একই বছর ঘাটে কারান্তরীণ হলে এস এস মিরাজকর সাধারণ সম্পাদক হন। এস ভি ঘাটে, এস এস মিরাজকর, সোমনাথ লাহিড়ী এই তিনজনকে নিয়ে পলিটব্যুরো গঠিত হয়। ১৯৩৫ সালে কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের সপ্তম কংগ্রেসে যোগদানের জন্য মস্কো যাওয়ার পথে সিঙ্গাপুরে গ্রেপ্তার হন মিরাজকর। তখন সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেয়া হয় সোমনাথ লাহিড়ীকে। ১৯৩৬ সালের শুরুতে লাহিড়ী মুম্বাইয়ে গ্রেপ্তার হয়ে যান। এসময় দুই বছর জেল খেটে বের হয়ে এসে পার্টির সদর দপ্তরের দায়িত্ব গ্রহণ করেন পি সি যোশী। ১৯৩৬ সালে লক্ষ্ণৌ কেন্দ্রীয় কমিটির সভায় অজয় ঘোষ, ভরদ্বাজ, ড. অধিকারী ও পি সি যোশীকে নিয়ে পলিটব্যুরো গঠিত হয় এবং পি সি যোশী সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। পার্টির গোপন সদর দপ্তর কলকাতায় স্থানান্তরিত হয়।

কমরেড এম এন রায়ের জীবন ও সংগ্রাম

মহান এই কমরেডের পিতা দীনবন্ধু ভট্টাচার্য পশ্চিমবঙ্গের চবিবশ পরগনা জেলার আড়বেলিয়া গ্রামো মাইনর ইংরেজি স্কুলের সংস্কৃত শিক্ষক ছিলেন। ১৮৮৭ সালের ২১ মার্চ মানবেন্দ্রনাথের জন্ম। তাঁর পিতৃ প্রদত্ত নাম নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য এবং ১৯১৬ সাল পর্যন্ত এ নামেই তিনি পরিচিত ছিলেন। বিপ্লবী কর্মকান্ডের প্রয়োজনে বিভিন্ন সময়ে সি. মার্টিন, হরি সিং, মি. হোয়াইট, ডি. গর্সিয়া, ড. মাহ্মুদ, মি. ব্যানার্জী প্রভৃতি নাম গ্রহণ করলেও তিনি মানবেন্দ্রনাথ রায় (এম.এন রায়) নামেই সমধিক পরিচিত। গ্রেফতার এড়াতে তিনি সানফ্রান্সিসকোতে এ নাম গ্রহণ করেছিলেন।

নরেন আড়বেলিয়ায় প্রাথমিক শিক্ষালাভ করেন। ১৮৯৮ সালে তাঁর পরিবার আড়বেলিয়া থেকে কোদালিয়ায় স্থানান্তরিত হয়। এখানে তিনি হরিনাভি অ্যাংলো-সংস্কৃত বিদ্যালয়ে ১৯০৫ সাল পর্যন্ত অধ্যয়ন করেন। সমাজসেবার প্রতি আগ্রহ থেকে তিনি মহামারী ও দুর্ভিক্ষপীড়িতদের পরিচর্যার জন্য একটি স্বেচ্ছাসেবী দল গঠন করেন। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ও স্বামী বিবেকানন্দের রচনা তাঁকে উৎসাহিত করে। বঙ্গভঙ্গের সূচনাকালে তিনি উগ্র জাতীয়তাবাদীদের সংস্পর্শে আসেন। ১৯০৫ সালে প্রধান শিক্ষকের আদেশ অমান্য করে সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জীর সংবর্ধনা সভায় উপস্থিতি এবং মিছিলে অংশগ্রহণের অপরাধে নরেন কয়েক জন সহপাঠীসহ স্কুল থেকে বহিষ্কৃত হন। পরবর্তীকালে তিনি অরবিন্দ ঘোষের অনুশীলন সমিতির সংস্পর্শে আসেন।

নরেন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় (অরবিন্দ ঘোষ কতৃক প্রতিষ্ঠিত) থেকে এন্ট্রান্স পাস করেন। তারপর তিনি বেঙ্গল টেকনিক্যাল ইনষ্টিটিউটে প্রকৌশল ও রসায়ন শাস্ত্রে অধ্যয়ন করেন। সে সময়ে তিনি তাঁর গুপ্ত বিপ্লবী দলসহ সুন্দরবন এলাকায় পরীক্ষামূলকভাবে বোমা তৈরি এবং গুলি চালানো চর্চা করেন।

কিছু সময় তিনি বাঘা যতীনের সঙ্গে অনুশীলন সমিতির মুখপত্র যুগান্তর এ কাজ করেন। তিনি তাঁর দলসহ হাওড়া-শিবপুর এলাকায় গুপ্ত কর্মকান্ডে লিপ্ত ছিলেন। ১৯১০ সালে তিনি গ্রেফতার হন এবং তাকে ‘হাওড়া-শিবপুর ষড়যন্ত্র মামলা’র আসামি করা হয়। দীর্ঘ এক বছরেরও বেশি সময় ধরে মামলার বিচার চলাকালে যতীন ও নরেন আটকাবস্থায় সারা ভারতে সশস্ত্র অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা করেন। কারামুক্তির পর নরেন ১৯১৪ সাল পর্যন্ত সন্ন্যাসী বেশে বিভিন্ন স্থানে বিপ্লবী সংগঠন স্থাপন করেন। বিপ্লবী সংগঠনসমূহ দূরপ্রাচ্য, পশ্চিম আমেরিকা ও জার্মানিতে ছড়িয়ে পড়ে। বার্লিনে ভারতীয় বিপ্লবী কমিটিও গঠন করা হয়।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে বাঘা যতীন ও নরেন জার্মান সরকারের কাছে সাহায্যের আবেদন জানান। তারা জার্মান সরকারের কলকাতাস্থ প্রতিনিধির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তিনি জার্মান সামরিক ও অর্থ সাহায্যের নিশ্চয়তা প্রদান করেন। তদনুযায়ী নরেন চার্লস মার্টিন ছদ্মনামে বাটাভিয়ায় জার্মান কনসাল জেনারেলের সঙ্গে আলোচনার জন্য প্রেরিত হন। অস্ত্রের চালান ও গোলা-বারুদ সুন্দরবন এলাকায় পাঠানোর বন্দোবস্ত হয়। নরেন যতীনকে লুকিয়ে রাখার উদ্দেশ্যে বালেশ্বেরে নিয়ে যান।

অস্ত্রের চালান না পৌঁছায় নরেন বাটাভিয়ায় ফিরে যান হরি সিং ছদ্মনামে এবং জার্মান কূটনীতিকদের অসহযোগিতা লক্ষ্য করেন। তিনি অস্ত্র ছাড়া ভারতে না ফেরার সিদ্ধান্ত নেন। তাই মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ইন্দো-চীন, ফিলিপাইন, কোরিয়া এবং জাপানে বিপ­বীদের সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যমে তাঁর অভিযান অব্যাহত রাখেন।

নরেন মি. হোয়াইট নামে টোকিওতে সহকর্মী বিপ্লবী রাসবিহারী বসুর সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য জাপান গমন করেন। সেখানে নির্বাসিত চৈনিক প্রেসিডেন্ট ডা. সান ইয়াৎ-সেনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তাঁদের মধ্যে সিদ্ধান্ত হয় যে, আসাম সীমান্তের নিকটে নরেন দুই চৈনিক গভর্নরের নিকট থেকে জার্মান সরকার কর্তৃক মূল্য পরিশোধিত গোলা-বারুদ গ্রহণ করবেন। নরেন চীন গমন করেন এবং পিকিং-এ জার্মান রাষ্ট্রদূত জার্মান কর্তৃপক্ষের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষরের জন্য নরেনকে বার্লিনে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেন। তিনি নরেনের জন্য ফাদার চার্লস মার্টিন নামে একটি পাসপোর্টের ব্যবস্থা করেন, যিনি নটরডেম বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্মতত্ত্ব বিষয়ে অধ্যয়নের জন্য আমেরিকা হয়ে ফ্রান্স যাবেন।

১৯১৬ সালের ১৪ জুন নরেন সানফ্রান্সিসকো পৌঁছান। পরের দিন প্রভাতী সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয় যে, ‘একজন বিপজ্জনক হিন্দু বিপ­বী, জার্মান গুপ্তচর, আমেরিকায় পদার্পণ করেছে।’ নরেন অনতিবিলম্বে হোটেল পরিত্যাগ করে স্টানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে যান। সেখানে তাঁর প্রখ্যাত বিপ্লবী সহকর্মী যদুগোপাল মুখোপাধ্যায়ের অনুজ অধ্যাপক ধনগোপালের আশ্রয় গ্রহণ করেন। ধনগোপাল অবিলম্বে তাঁর নাম পরিবর্তন করার উপদেশ দেন। তাঁরই উপদেশে নরেন, মানবেন্দ্রনাথ রায় (এম.এন রায়) নাম গ্রহণ করেন। সানফ্রান্সিসকো বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্টের মেয়েকে তিনি বিয়ে করেন। মানবেন্দ্র দম্পতি নিউইয়র্কে লালা লাজপত রায়ের আশ্রয় গ্রহণ করেন এবং নিউইয়র্ক পাবলিক লাইব্রেরিতে মার্কসবাদ অধ্যয়ন করেন।

১৯১৭ সালের এপ্রিল মাসে আমেরিকা জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে এবং আমেরিকার পুলিশ ভারতীয় বিপ্লবীদের জার্মান চর হিসেবে গ্রেফতার করা শুরু করে। গ্রেফতার এড়াতে ড. জর্ডনের নিকট থেকে একখানি পরিচয়পত্র নিয়ে মানবেন্দ্র মেক্সিকো যান। এই পত্রের বরাতে তিনি প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপতি কারাঞ্জা ও সমর মন্ত্রিসহ উচ্চ পর্যায়ের অফিসারবৃন্দ ও বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের সঙ্গে পরিচয়ের সুযোগ পান। রাষ্ট্রপতি তাঁকে নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দেন এবং একটি সম্মানজনক আবাস প্রদান করেন।

মানবেন্দ্র রায় অসংখ্য বক্তৃতা ও প্রবন্ধের মাধ্যমে ভারতের পক্ষে জনমত গঠন করেন। এ সময় তিনি স্প্যানিশ, ফরাসি ও জার্মান ভাষা শেখেন। রাষ্ট্রপতির আমেরিকা বিরোধী অবস্থানে রায় ছিলেন একজন বেসরকারি উপদেষ্টা। ১৯১৮ সালের আগস্ট মাসে মানবেন্দ্র রায় সাড়ম্বরে সোশ্যালিস্ট পার্টির সম্মেলন আয়োজন করেন। এ সময় বহু আমেরিকান সাংবাদিক, শিল্পি, কবি, বিজ্ঞানী ও দার্শনিক বাধ্যতামূলক সামরিক নিয়োগ এড়াবার জন্য মেক্সিকো পাড়ি জমান। রাষ্ট্রপতি কারাঞ্জা রায়ের জনপ্রিয়তায় খুশি হন। রায় এতো জনপ্রিয় ছিলেন যে, রাষ্ট্রপতি সোশ্যালিস্ট পার্টির প্রতিনিধিরূপে একজন শ্রমমন্ত্রী মনোনয়নের জন্য রায়কে অনুরোধ করেন।

সে সময় লেনিনের দূত মাইকেল বরোডিন (১৮৮৪-১৯৫৩) মেক্সিকো গমন করেন। তিনি রায় দম্পতির অতিথি হিসেবে মেক্সিকোর রাষ্ট্রপতির সঙ্গে পরিচিত হন। এর ফলে মেক্সিকো এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়। ফলশ্রুতিতে বরোডিন মেক্সিকোর সঙ্গে যোগাযোগ করতে সক্ষম হন এবং লেনিনের নিকট রায়ের কর্মকান্ডের বিস্তারিত বিবরণ তুলে ধরেন।

লেনিন ১৯২০ সালের জুলাই-আগস্ট মাসে মস্কোয় অনুষ্ঠিত কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের দ্বিতীয় বিশ্ব কংগ্রেসের অধিবেশনে যোগদানের জন্য রায়কে আমন্ত্রণ জানান। মস্কোর পথে বার্লিনে অবস্থানকালে রায় বিশেষ করে মার্কসবাদের আদর্শগত দ্বন্দ্ব সম্পর্কে মূল্যবান অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। তিনি জার্মান কমিউনিস্ট পার্টির ব্যর্থতা ও সামরিক শক্তির উত্থান প্রত্যক্ষ করেন।

মস্কোতে রায় লেনিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং তাঁর ‘On National and Colonial Question’ শীর্ষক তত্ত্বের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন। লেনিন রায়কে তাঁর নিজস্ব তত্ত্ব প্রদানের আহবান জানান। উভয় তত্ত্ব নিয়েই বিস্তারিত আলোচনা হয় এবং কংগ্রেস কর্তৃক উভয় তত্ত্বই একত্রে গৃহীত হয়।

কংগ্রেস অধিবেশনের পর রায় কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের এশিয়ান ব্যুরোর দায়িত্ব পান। এর সদর দফতর স্থাপিত হয় তাসখন্দে। তিনি গেরিলা যুদ্ধের মাধ্যমে ইরানের খোরাশান প্রদেশের রাজধানী মাশাদ থেকে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীকে বিতাড়িত করেন। রক্তপাতহীন বিপ্লবের মাধ্যমে বোখারায় সোভিয়েট সরকার গঠন করেন। খিলাফত আন্দোলনে ভারতীয় মোহাজেরদের পুনর্বাসিত করেন। তাদের মধ্য থেকে শিক্ষিতদেরকে সমাজতান্ত্রিক প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন এবং তাদের জন্য একটি সামরিক বিদ্যালয়ও স্থাপন করেন। তিনি ১৭ অক্টোবর ১৯২০ সালে তাসখন্দে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি গঠন করেন।

১৯২১ সালের আগস্টে রায় কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের তৃতীয় বিশ্ব সম্মেলনে যোগ দেন। ১৯২২ সালে কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক রায়ের India in Transition নামক গ্রন্থ চার ভাষায় প্রকাশ করে। রায় মস্কোতে শ্রমিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯২৩ সালে তিনি তাঁর সদর দফতর বার্লিনে স্থানান্তর করেন এবং ভারতের জন্য লেখনী বিপ্লব শুরু করেন। তিনি The Vanguard of Indian Independence পত্রিকা প্রকাশ করেন এবং ভারতে পাঠান। ভারত সরকার তাৎক্ষণিকভাবে এ পত্রিকা নিষিদ্ধ ঘোষণা করলে তিনি Advanced Guard শিরোনামে এটি পুনঃপ্রকাশ করেন। এটিও নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়। সর্বশেষে তিনি The Masses পত্রিকা প্রকাশ করেন এবং সেটিও নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়।

লেনিনের জীবদ্দশায় রায় কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের সকল উচ্চপদ লাভ করেন। ১৯২৪ সালে লেনিনের মৃত্যুর পর তিন বছর তা বজায় থাকে। কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের চৈনিক কমিশনের যুগ্ম-সচিব হিসেবে রায়কে কমিউনিস্টবাদী ও কু মিন তুং-এর মধ্যে বিবাদ নিরসনে আলোচনার জন্য চীনে প্রেরণ করা হয়। বিবাদ নিষ্পত্তিতে চীনের কমিউনিস্ট পার্টি ও বরোডিনের মতের সঙ্গে রায়ের মতভেদ হয়। ফলে চিয়াং কাই শেক কমিউনিস্ট আন্দোলনকে নির্মমভাবে দমন করেন। মস্কো ফিরে রায় অসুস্থ হয়ে পড়লে চিকিৎসার জন্য তাঁকে বার্লিনে নেওয়া হয়। ১৯২৯ সালের ডিসেম্বর মাসে রায়ের অনুপস্থিতিতে বিরোধী কমিউনিস্ট সংবাদপত্রে রচনা প্রকাশ করার অপরাধে কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক থেকে তাঁকে সরিয়ে দেওয়া হয়। রায় বার্লিনে অবস্থানকালে Revolution and Counter-Revolution in China এবং Decline and Fall of British Empire রচনা করেন।

এম.এন রায় ১৯৩০ সালে ড. মাহমুদ নামে ভারতে প্রত্যাবর্তন করেন। ১৯৩১ সালের জুলাই মাসে তিনি বোম্বাই শহরে গ্রেফতার হন এবং রাষ্ট্রদ্রোহী কর্মকান্ডে লিপ্ত থাকার অভিযোগে কানপুর জেলে বিচারে ১২ বছর সশ্রম কারাদন্ড হয়। আপিল করে কারাদন্ডের মেয়াদ ৬ বছর কমানো হয়। কারাগারে বসে তিনি Philosophical Consequences of Modern Science নামে একটি বিশাল গ্রন্থ রচনা করেন। জেলখানায় রচিত গ্রন্থের তথ্য অবলম্বনে ১৯৩৭ থেকে ১৯৪৫ সালের মধ্যে তাঁর নিম্নলিখিত গ্রন্থগুলি প্রকাশিত হয়: Materialism, The Historical Role of Islam, Heresies of 20th Century, Science and Superstition, Man and Nature, From Savagery to Civilization, Nationalism: An Antiquated Cult, The Philosophy of Fascism, The Ideal of Indian Womanhood, Letters from Jail, Memoir of a Cat, Science and Philosophy এবং India’s Message।

১৯৩৬ সালে কারামুক্তির পর রায় ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেসে যোগদান করেন এবং ‘দি লীগ অব র্যাডিক্যাল কংগ্রেসম্যান’ গঠন করেন। তিনি সুভাষচন্দ্র বসুকে ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেসের সভাপতি হতে সমর্থন জানান। কংগ্রেসের উচ্চ পর্যায়ের নেতৃত্বের সঙ্গে যুদ্ধনীতি নিয়ে তাঁর ও তাঁর অনুসারীদের মতানৈক্যের কারণে তিনি কংগ্রেস থেকে পদত্যাগ করেন। ১৯৪০ সালে তিনি গঠন করেন র্যাডিক্যাল ডেমোক্রাটিক পার্টি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে তিনি প্রবলভাবে মিত্র শক্তিকে সমর্থন করেন, কারণ তিনি অনুধাবন করেন যে, ক্ষয়িষ্ণু সাম্রাজ্যবাদ ফ্যাসিবাদের চেয়ে কম ক্ষতিকর।

১৯৪০ থেকে ১৯৪৬ সালের মধ্যে রায় কিছু গ্রন্থ রচনা করেন: India and War, Alphabet of Fascist Economy, Draft Constitution of Free India, People’s Freedom, Poverty or Plenty, The Problems of Freedom, INA and the August Revolution, Jawaharlal Nehru: The Last Battle for Freedom। তিনি দেরাদুনে ১৯৪০ সালে পাঠচক্র পরিচালনা করেন এবং The Scientific Politics নামক গ্রন্থ রচনা করেন। ১৯৪৬ সালে অন্য একটি পাঠকক্র পরিচালনা করে তিনি New Orientation রচনা করেন। Constituent Assembly গঠনের জন্য তিনি অরাজনৈতিক ভিত্তিতে নির্বাচনের সুপারিশ করেন। এই নির্বাচিত প্রতিনিধিরাই স্বাধীন ভারতের সংবিধান রচনায়কারী হবেন। তিনি ক্ষমতার পূর্ণবিকেন্দ্রীকরণ এবং দুর্নীতি দমনের একনিষ্ঠ সমর্থক ছিলেন।

রায় মার্কসবাদের সংশোধিত রূপ প্রকাশ করেন তাঁর Beyond Marxism ও New Humanism গ্রন্থে। ১৯৪৭ সালে রায় ১৯১৭ সাল থেকে রাশিয়ার ঘটনাক্রমসমূহ যথাযথভাবে বিশ্লেষণ করেন। ১৯৪৮ সালে র্যাডিক্যাল ডেমোক্রাটিক পার্টির বিলোপ সাধন করে তিনি ইন্ডিয়ান রেনেসাঁস ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করেন। Reason, Romanticism and Revolution তাঁর যুগান্তকারী রচনা। এরপর তিনি তাঁর জীবনস্মৃতিমূলক গ্রন্থ রচনা আরম্ভ করেন, যা তিনি সম্পন্ন করে যেতে পারেন নি।

মানবেন্দ্রনাথ রায়ের ১৯৫৪ সালের ২৪-২৫ জানুয়ারি মধ্যরাতে দেরাদুনে হূদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয়। অমৃতবাজার পত্রিকা তাঁকে ‘সারা বিশ্বে বিচরণকারী নিঃসঙ্গ সিংহ’ বলে উল্লেখ করে।

সুপ্রিয় পাঠক, কমিউনিস্ট বিপ্লবী ও রেডিক্যাল হিউম্যানিস্ট কমরেড মানবেন্দ্রনাথ রায়ের ১৩৭তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষ করে এই নিবন্ধটি লেখা হলেও মহান ও কীর্তিমান বিপ্লবীদের নিয়ে সব সময়ই লেখা যায়। পরিশেষে, সমাজতন্ত্র অভিমুখী অসাম্প্রদায়িক জনগণতান্ত্রিক ও বৈষম্যহীন ব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রত্যয়ে সমতা-ন্যায্যতার প্রশ্নে বাংলাদেশকে এগিয়ে নেওয়ার প্রয়োজনেই জনগণের নতুন ধারার এক আর্থসামাজিক বৈপ্লবিক ব্যবস্থা প্রবর্তনে বিশ্বজনীন মহান ও কীর্তিমান বিপ্লবীদের রাজনীতি, আত্মোৎসর্গ, জীবন সংগ্রাম, কীর্তি, ইতিহাস, তত্ত্ব ও অনুশীলন সম্পর্কে পাঠ প্রাসঙ্গিক ও জরুরী। কিংবদন্তী বিপ্লবী কমরেড মানবেন্দ্র নাথ রায় (এম এন রায়), কমরেড এভেলিনা ট্রেন্ট রায় (এম এন রায়ের মার্কিন স্ত্রী), কমরেড অবনী মুখার্জী, কমরেড রোজা ফিটিংগোফ মুখার্জী (অবনী মুখার্জীর রুশ স্ত্রী), কমরেড মুহম্মদ আলী (আহমেদ হাসান), কমরেড এম প্রতিবাদী বায়াঙ্কার আচার্য (মান্ডায়াম পার্থ সারথি তিরুমারাই আচার্য), কমরেড মুহম্মদ শফিক সিদ্দিকী, কমরেড মুজফফর আহমদ এবং অবিভক্ত ভারতবর্ষের কমিউনিস্ট পার্টির সকল বিপ্লবীসহ ইতিহাসের নির্মাতা ও চালিকাশক্তি জনগণের প্রতি আমাদের বিনম্র শ্রদ্ধা ও অভিবাদন!

লেখক: মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট

প্রিয় পাঠক, লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই ঠিকানায় -
sarabangla.muktomot@gmail.com

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত মতামত ও লেখার দায় লেখকের একান্তই নিজস্ব, এর সাথে সারাবাংলার সম্পাদকীয় নীতিমালা সম্পর্কিত নয়। সারাবাংলা ডটনেট সকল মতাদর্শের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তবে মুক্তমতে প্রকাশিত লেখার দায় সারাবাংলার নয়।

সারাবাংলা/এসবিডিই

Tags: , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন