বিজ্ঞাপন

‘ভাইয়া’ ডেকে আপন করেছিল যাকে, তার হাতেই গেল প্রাণ

April 2, 2024 | 8:09 pm

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট

চট্টগ্রাম ব্যুরো: সাত বছরের ফুটফুটে মেয়ে নাসরিন সুখী চট্টগ্রাম নগরীর আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদের সিঁড়িতে আপন মনে খেলত। তার মা বিলকিছ বেগম অদূরেই রাস্তাঘাটে পড়ে থাকা কাগজ, পলিথিন-বোতল সংগ্রহ করত। দেখতে-দেখতেই মা-মেয়ের সঙ্গে পরিচয় ভ্যানচালক যুবক মীর হোসেনের সঙ্গে। সে নিজেও পরিত্যক্ত জিনিসপত্র কুড়াতো। মীরকে ‘ভাইয়া’ বলে ডাকতে। বিপরীতে শিশু সুখীও তাকে আপন করে নিয়েছিল।

বিজ্ঞাপন

কিন্তু সেই ভাইয়াই নির্মম হন্তারক হয়ে সুখীর প্রাণ কেড়ে নিয়েছে। পাষণ্ড মীর তাকে ধর্ষণের পর শ্বাসরোধ করে খুন করেছে। এমন ঘটনায় হতবিহ্বল বিলকিছ। মীর এমন ঘটনা ঘটাবে, ভাবতেও পারছেন না।

রাস্তাঘাটে পড়ে থাকা কাগজ, পলিথিন-বোতল কুড়িয়ে চলে বিলকিছ বেগমের সংসার। অভাব-অনটন আছেই, তবুও সন্তানদের জন্য ভালোবাসা আর আবদার মেটানোর প্রাণান্ত চেষ্টার কমতি নেই তার। ক’দিন পরেই ঈদুল ফিতর। কাগজ কুড়িয়ে জমানো টাকায় মেয়ের জন্য কিনেছিলেন জামা-জুতা। সেই মেয়েকে এক পাষণ্ডের হাতে এভাবে প্রাণ দিতে হবে, ভাবতেও পারছেন না বিলকিছ। আক্ষেপ, কে পরবে জামা-জুতা?

বিলকিছের মেয়ে নাসরিন সুখীর লাশ সোমবার (১ এপ্রিল) রাতে নগরীর কোতোয়ালী থানার স্টেশন রোডে ফলমণ্ডির সামনে একটি ডাস্টবিন থেকে উদ্ধার করা হয়। পুলিশ লাশ উদ্ধারের সময়ই মেয়েটির যোনি এবং পায়ুপথে রক্তক্ষরণ চিহ্ন দেখে ধর্ষণের পর হত্যা সন্দেহ করেছিল।

বিজ্ঞাপন

মঙ্গলবার সকালে থানায় গেলে দেখা হয় বিলকিছের সঙ্গে। সদ্য মেয়েহারা এ নারী এসময় কান্নাজড়িত কণ্ঠে নিজের কথাগুলো তুলে ধরেন। মেয়ে সুখীর কপালে এত দুঃখ ছিল, ভেবে দিশেহারা মা।

নাসরিন সুখীর লাশ উদ্ধারের ঘটনায় পুলিশ মীর হোসেনকে (৩৭) গ্রেফতার করেছে। তার বাড়ি কুমিল্লা জেলায়। বাসা নগরীর বাকলিয়া থানার বৌবাজার এলাকায়।

বিলকিছ বেগমের বাসাও নগরীর বাকলিয়া থানার বৌবাজার এলাকায়। বাড়ি কুমিল্লার দেবীদ্বার উপজেলায়। স্বামী আব্দুর রাজ্জাক পেশায় ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চালক।

বিজ্ঞাপন

বিলকিছ জানালেন, পাঁচ মেয়ে ও দুই ছেলে তাদের। তিন মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। ১৩ বছর বয়সী বড় ছেলে দীর্ঘদিন ধরে নিখোঁজ। তার সঙ্গে যমজ এক মেয়ে দেবীদ্বারে নানীর সঙ্গে থাকেন। আরেক মেয়ে নাসরিন সুখী ও তিন বছর বয়সী ছেলে এবং স্বামীকে নিয়ে তিনি বাসায় থাকতেন। সকালে নগরীর রাজাপুকুর লেইনে এক ভবনে গৃহকর্মীর কাজ করতেন। সন্ধ্যার পর ছেলেকে বিবাহিতা এক মেয়ের কাছে রেখে সুখীকে নিয়ে বের হতেন কাগজ-বোতল কুড়াতে।

‘মেয়েকে আন্দরকিল্লা জামে মসজিদের সিঁড়িতে বসিয়ে রাখতাম। আমি ভাঙ্গারি জিনিস কুড়িয়ে হাসপাতালের (জেমিসন রেডক্রিসেন্ট মেটারনিটি) সামনে রাখতাম। রাত ১২টা, সাড়ে ১২টার দিকে সেগুলো নিয়ে মেয়েসহ বাসায় চলে যেতাম। তবে এখন রোজা হওয়ায় রাত তিনটা, সাড়ে তিনটা পর্যন্ত থাকি। মেয়ে মসজিদের সিঁড়িতে বসে খেলা করত। কখনও ইচ্ছে হলে লোকজনের কাছে টাকাপয়সা চাইতো। চেহারা দেখে কারও মায়া লাগলে ৫টাকা, ১০ টাকা দিতো।’

রোববার রাতে মেয়ে নিখোঁজ হওয়ার বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, ‘রাত ১২টার দিকে আমি হাসপাতালের সামনে এক দোকানে বসে চা খাই। এরপর মসজিদের ওখানে মেয়েকে গিয়ে বলি, মা তোমার কাছে যদি দশটা টাকা থাকে, আমাকে দাও, আমার কাছে তো টাকা নেই, চায়ের টাকা দিতে হবে। মেয়ের কাছে ছিল না, সেজন্য দিতে পারেনি। সে খেলছিল। রাত ১টার কিছু পরে আবার গিয়ে দেখি মেয়ে নেই। পাগলের মতো সব জায়গায় খুঁজছি। সাড়ে ৪টার দিকে বাসায় ফিরে যাই।’

নগর পুলিশের উপ-কমিশনার (দক্ষিণ) মোস্তাফিজুর রহমান সারাবাংলাকে বলেন, ‘সোমবার রাত ৯টার দিকে আমরা ডাস্টবিন থেকে মেয়েটির লাশ উদ্ধার করি। পরে তার মা এসে লাশ শনাক্ত করে। আমরা ঘটনাস্থলের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করে পর্যালোচনার মাধ্যমে যুবকের চেহারা নিশ্চিত হই। এরপর গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে আজ (মঙ্গলবার) ভোরে বাকলিয়ার বৌবাজার পুলিশ বিটের সামনে থেকে তাকে গ্রেফতার করি।’

বিজ্ঞাপন

সিএমপির সহকারী কমিশনার (কোতোয়ালী জোন) অতনু চক্রবর্তী সারাবাংলাকে বলেন, ‘জিজ্ঞাসাবাদে মীর হোসেন জানায়, গভীর রাতে জামে মসজিদের সামনে থেকে ফুসলিয়ে সুখীকে নিয়ে সে টাইগারপাস সংলগ্ন সিআরবির পাহাড়ে যায়। সেখানে মেয়েটিকে ধর্ষণ করে। একপর্যায়ে মেয়েটি অজ্ঞান হয়ে যায়। তখন মীর তার মুখ-নাক চেপে ধরে মৃত্যু নিশ্চিত করে। মীর হোসেনের সঙ্গে মেয়েটির মায়ের পরিচয় আছে। তার ভয় ছিল, যদি মেয়েটিকে বাঁচিয়ে রাখে, তাহলে সে তার মাকে ঘটনা বলে দিতে পারে।’

‘রোববার ভোররাতের দিকে মেয়েটিকে পাহাড়ে নিয়ে ধর্ষণের পর খুন করে। এরপর সেখানেই লাশ রেখে চলে আসে। পরে সে লাশ গুমের সুযোগ খুঁজতে থাকে। সোমবার ইফতারির সময় যখন রাস্তাঘাট একেবারে নির্জন ছিল, তখনই সে সুযোগ কাজে লাগায়। একটি চটের বস্তায় লাশ ভরে ফেলে দিয়ে যায় কাছেই ফলমণ্ডির সামনে ডাস্টবিনে। যদি সে লাশ সেখানে না ফেলত, তাহলে হত্যাকারীকে খুঁজে পাওয়া আমাদের জন্য দূরূহ হতো,’- বলেন অতনু চক্রবর্তী।

পূর্ব পরিচয়ের বিষয়ে বিলকিছ বেগম সারাবাংলাকে বলেন, ‘সে (মীর হোসেন) ভ্যান চালায়। আবার রাতে ভাঙ্গারি জিনিস কুড়ায়। সে জিনিসপত্র কুড়িয়ে আন্দরকিল্লা ব্যাংক এশিয়ার সামনে রাখে। আমি হাসপাতালের সামনে রাখি। আমি যে দোকানে জিনিস বিক্রি করি, সেখানেও তার সঙ্গে দেখা হতো, কথাবার্তা হতো। আমার মেয়ের সঙ্গেও কথা বলতো। তবে তার বাসা কোথায়, পরিচয় আমি জানতাম না।’

মেয়েকে নিয়ে যাওয়ার আগে একসঙ্গে বসে চা খেয়েছেন জানিয়ে তিনি বলেন, ‘রাত ১২টার দিকে আমি হাসপাতালের সামনে দোকানে বসে চা খাচ্ছিলাম। তখন সে-ও দোকানে আসে। একসঙ্গে বসে চা খাই, আলাপ করি। রাত ১টার কিছু আগে তাকে ব্যাংক এশিয়ার সামনে কুড়িয়ে আনা জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখতে দেখি। এরপর আমার মেয়েকে যখন পাচ্ছিলাম না, তখন তাকেও আর দেখিনি।’

নগর পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার নোবেল চাকমা সারাবাংলাকে জানান, গ্রেফতার মীর হোসেন ২০১২ সালে ধর্ষণের ঘটনায় কুমিল্লার ভাঙ্গুরাবাজার থানায় দায়ের হওয়া এক মামলার আসামি। নাসরিন সুখীকে খুনের ঘটনায় তার মায়ের দায়ের করা মামলায় মঙ্গলবার বিকেলে তাকে চট্টগ্রাম মহানগর হাকিম রোমানা আক্তারের আদালতে হাজির করা হয়। এসময় সে দায় স্বীকার করে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছে।

জবানবন্দিতে মীর হোসেন জানায়, পরিত্যক্ত জিনিস কুড়াতে গিয়েই বিলকিছের সঙ্গে তার পরিচয়। মেয়ে সুখী তাকে ভাইয়া ডাকতো। মাঝে মাঝে বিভিন্ন খাবার কিনে সে সুখীকে খেতে দিত। রোববার রাতে জামে মসজিদের সামনে সুখী একা দাঁড়িয়ে ছিল। দেখা হলে সুখী তাকে সিআরবির দিকে হাঁটতে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে। আগেও বিভিন্নসময় তারা হাঁটতে যেত।

রোববার রাতে আন্দরকিল্লা থেকে মোমিন রোডের কদম মোবারক মসজিদের সামনে পর্যন্ত হেঁটে গিয়ে তারা একটি রিকশায় উঠে কদমতলীতে যায়। সেখানে মীর সুখীকে একটি চিপস কিনে দেয় এবং নিজে চা-সিগারেট খায়। এরপর সুখীকে নিয়ে পলোগ্রাউন্ড পার হয়ে টাইগারপাসের দিকে সিআরবি পাহাড়ে ঝোপের মধ্যে ঢোকে। সেখানে সুখীকে ধর্ষণের চেষ্টা করলে সে চিৎকার দেয়। তখন মীর হোসেন তার নাকমুখ চেপে ধরে। তার ভাষায়, যতক্ষণ সুখীর নড়াচড়া ছিল ততক্ষণ সে তাকে ধর্ষণ করেছে।

নিঃশ্বাস পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাবার পর মীর হোসেন তাকে ছেড়ে দিয়ে রাস্তায় এসে আধাঘণ্টা হাঁটাহাটি করে। এরপর আবার গিয়ে লাশ একটি বস্তায় ভরে পাতা দিয়ে ঢেকে রেখে সেখান থেকে চলে যায়। সোমবার বিকেল ৫টার পর একটি ভ্যানগাড়ি নিয়ে সেখানে গিয়ে লাশ ভ্যানে তুলে এনে ডাস্টবিনে ফেলে দেয়।

জবানবন্দি গ্রহণের পর মীর হোসেনকে আদালতের নির্দেশে কারাগারে পাঠানো হয়েছে বলে জানান অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার নোবেল চাকমা।

সারাবাংলা/আরডি/একে

Tags: , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন