বিজ্ঞাপন

ঝরা পাতা

April 9, 2024 | 5:08 pm

মাহমুদুর রহমান

বারো বাই বারো ফুটের দুটো কামরা পাশপাশি। এক কামরার সঙ্গে আরেক কামরার যোগাযোগের জন্য মাঝে দরজা। একটা ঘরের দুই দেয়ালে বুকশেলফে কিছু বই, মাঝে পত্রিকা ছড়িয়ে থাকা গোল টেবিল ঘিরে চেয়ার, ১০-১২টা। এটা সামনের ঘর। ভেতরের ঘরটা প্রায় খালি। এক দেয়ালঘেঁষে কয়েকটা টুল, আরেক দেয়ালঘেঁষে একটা বেঞ্চি। তার সঙ্গে ঠেস দিয়ে রাখা দুটো ক্যারাম-বোর্ড।
জেলা সড়কের পাশ দিয়ে গেছে একটা সরু রাস্তা। কিছুদিন হলো ইট ফেলা হয়েছে। সেই রাস্তার সঙ্গেই এই ঘর। দেখলে কিছুটা বেখাপ্পা মনে হয়। কিন্তু আরেকটু তলিয়ে দেখলে ঠিক বেখাপ্পা না। খানিকটা দূরে বাজার— কত হবে, দুইশ গজের মতো। উলটো পাশে মসজিদ, জমায়েত করার জন্য উপযুক্ত জায়গা। কোনো রাজনৈতিক দলের পার্টি অফিস হতে পারত সহজেই। সাধারণত সেই প্রকারই হয়, কিন্তু এ ক্ষেত্রে খানিকটা ভিন্ন।
এ হলো চয়নদের ক্লাব। কিছুটা পুরনো ধারারই বলা চলে। ওরা কয়েকজন মিলে করেছে। চয়ন, জহির, কবির, রেজা, জাহিদ— এই পাঁচজন মূল উদ্যোক্তা।
ক্লাবের কোনো নাম নেই। নাম দেওয়ার প্রয়োজন মনে করেনি কেউ। কারণ আদতে ক্লাব করার পরিকল্পনা ছিল না। একরকম হয়ে গেছে আর কী। কেননা ঘরটা মূলত চয়নের দাদার। তিনি ছিলেন জাঁদরেল মানুষ। জমিজমা ছিল অনেক। সেসব দেখাশোনা করতেন আর যারা জমিতে কাজ করত তাদের নিয়ে মাঝে মাঝে বসতেন পরিকল্পনা করতে। অনেকটা সেই কারণেই এই ঘর তৈরি করা। অবশ্য পেছনে আরও একটু ইতিহাস আছে।
জমিজমা করা মানুষ সাধারণত তাদের কাজের পরিকল্পনা করতে বসেন কাছারিঘরে। চয়নের দাদা তা করেননি। কেননা তার মতে, কাছারি মূলত বাড়ির একটা অংশ। সেখানে তিনি কাজের আলাপ তুলতে রাজি না। কাছারি তার ছিল, কিন্তু সেখানে থাকত লজিং মাস্টার কিংবা দূর থেকে আসা হাঁটুরে, মুসাফির, ফকির, কবিরাজ ঘরানার মানুষ।
চয়নের দাদা আলিমুদ্দিন এককালে এলাকায় নাম কামিয়েছিলেন। সৎ বলে তার সুনাম ছিল। কখনো ঠকাননি কাউকে। লোকে তাই সম্মান করত। আবার প্রয়োজনে ল্যাজা ধরে গ্যাঞ্জামে সবার সামনেও থাকতে পারতেন। তাই লোকে মান্যও করত। এরপর যা হয়, নানা সামাজিক কাজে না চাইতেও জড়াতে হয়েছিল। সেইসব কাজকর্মের জন্য তৈরি করেছিলেন দুটি ঘর। প্রথমে ছিল বাঁশের বেড়া আর ছনের ছাউনি। কালক্রমে তাতে এসেছিল টিন, এখন আধা পাকা।
আলিমুদ্দিনের এ ছিল প্রৌঢ় বয়সে কীর্তি। তখন মোটামুটি আশেপাশের তিন গ্রামের মধ্যে মাতব্বর তিনি। নতুন তোলা ‘বড় কাছারি’তে আড্ডা হতো, সালিশ হতো, কখনো মারফতি গান হতো, এমনকি হতো ওয়াজ-নসিহত। কিছুতেই আপত্তি ছিল না আলিমুদ্দিনের। আবার বাড়াবাড়িও পছন্দ করতেন না। তিনি চলে গেলে চয়নের বাবা এসব ধরে রাখেননি। কিন্তু ঘরটারও কিছু করেননি।
কিন্তু চয়ন ঘরটাকে আগলে রাখে। দাদার রেখে যাওয়া টিনের ঘরটাকে মেরামত করেছিল কলেজ জীবনেই। তারপর অনেক বলে-কয়ে মেঝে পাকা করেছে। চয়নের মা আসিয়া বেগমের মতে, দাদার মতো মাথায় ছিট আছে চয়নের। দাদার কোলে বসে তার টুপি নিয়ে নাকি খেলত সে ছোটবেলায়। দাদার কাছে নানা রকম গল্প শুনত। চয়ন এখন দাদার মতোই হাঁটে। হাসির ধারাও নাকি দাদারই মতো। সেদিনের চয়ন বড় হয়েছে আর চয়নের দাদার ‘বড় কাছারি’ হয়েছে আজকের ক্লাব।
এ কালে এসে ক্লাব মানে হই-হুল্লোড়, লাউড মিউজিকে গান বাজানো আর সময়ে-অসময়ে চাঁদা তোলা। গ্রামের মধ্যে নিজেদের ক্ষমতা দেখানোর একটা সুযোগ। শহরে তো আরও বড় বিষয়— রীতিমতো সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজি। কিন্তু চয়নরা এসব করে না। ইউনিভার্সিটির শেষ বর্ষের ছাত্র চয়ন তার বন্ধুদের নিয়ে এখানে আড্ডা দেয় সন্ধ্যায়। ক্যারাম-দাবা খেলে। পরিচিত ছোট ভাইয়েরা আসে। তাদের সঙ্গে নানা বিষয়ে আলাপ-আলোচনা করে। খেলাধুলা, পাঠচক্রের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকতে চায়।
অবশ্য এর মধ্যে কখনো কখনো অনিবার্যভাবে আসে রাজনীতি। চয়নরা রাজনীতি নিয়ে বাড়াবাড়ি করতে চায় না। আবার শহরের চায়ের হোটেলের মতো ‘রাজনৈতিক আলোচনা নিষেধ’ করতেও ইচ্ছুক না। কেননা নব্বইয়ের এই মাঝামাঝি সময়ের রাজনীতি নিচ্ছে নতুন মোড়। তাদের কথায় অবধারিতভাবে আসে গণতন্ত্রের বর্তমান অবস্থা, ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক, এশিয়ার খাদ্য সংকটে আমেরিকা-রাশিয়ার কূটনীতির প্রভাব। তবে পড়ার বিষয়ে বেশি মনোযোগ দিয়ে চায় চয়ন। নিজে পড়ে এবং অন্যদের পড়তে উৎসাহ দেয়।
চয়নের বাবা ছিলেন কলেজের প্রফেসর। ঘরে ছোটখাটো একটা লাইব্রেরি ছিল। সেটা এখন ক্লাবে নিয়ে এসেছে চয়ন। যারা চায়, সেখানে বসে, বা বাড়িতে বই নিয়ে পড়তে পারে। সঙ্গে সঙ্গে একটা পত্রিকা বের করে চয়ন আর তার বন্ধুরা— ত্রৈমাসিক ‘সংকলন’। এ নিয়ে কিছু কাজ হয়েছে, কিন্তু লোকবল আর অর্থবলের অভাবে ইচ্ছাটা এখনো পূর্ণ হয়নি। কয়েকজন দেয়াল পত্রিকার কথা বলেছিল। কিন্তু রাজি হয়নি চয়ন। সে আরও বড় পরিসরে কাজ করতে চায়। তা নিয়ে কথা বলে বন্ধুদের সঙ্গে। কথা প্রসঙ্গে আসে ক্রিকেট, ব্যান্ডের গান।
এমনই একদিন, এক বিকেলে ঝালমুড়ি খেতে খেতে চয়ন আর জহির বসে ‘ভারতের দর্শন’ নিয়ে আলাপ করছিল। সেই আলাপের মধ্যেই একে একে উঠে এলো দেশভাগ, পাকিস্তান, মুক্তিযুদ্ধ। ওরা দুজন মাঝে মাঝেই এরকম তর্কে মাতে। এক প্রসঙ্গ থেকে চলে যায় সম্পূর্ণ ভিন্ন আরেক প্রসঙ্গে। দুজনেই ভালো বক্তা। জহির আবার বিতর্ক করত স্কুলে। জমে ওঠে আলাপ, আর ওদের কথা শুনতে তাই ক্যারাম ছেড়ে চলে আসে কবির, রেজা, জাহিদ আর শিমুল। তর্ক তুঙ্গে, সিগারেট সঙ্গে। ঘরটা ধোঁয়ায় ভরে উঠেছে।
জহির সমাজতন্ত্রের সমর্থক। সে বলছিল, ‘দেশের এই অবস্থা হইত না যদি যুদ্ধ আরও বেশিদিন চলত। এই যুদ্ধ হঠাৎ শুরু হয় নাই। কিন্তু স্বাধীনতা আসছে হঠাৎ। এত সহজে স্বাধীনতা পাওয়ায় দেশের মানুষ স্বাধীনতার মানে বোঝে নাই। মূল্য বোঝে নাই।’
চয়ন কিছু একটা বলতেই যেত, এমন সময় হঠাৎ সিগারেট ফেলে দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে সালাম দিলো। ব্যপারটা ধরতে সমস্যা হলো না কারও। তারা অভ্যস্ত।
সাদা দাঁড়ি, পাকা চুলের এক বৃদ্ধ দাঁড়িয়ে আছেন দরোজায়। সবাই চুপ করে গেল। চয়ন হাত নেড়ে ধোঁয়া সরানোর ব্যর্থ চেষ্টা করল। কিন্তু কোনো লাভ হলো না। ওদিকে বৃদ্ধ হেসে বললেন, ‘সিগারেট খাও, তা তো আমি জানি। ধোঁয়া তাড়ানোর দরকার নাই। বসো বসো।’
কাঁধ থেকে পাটের ব্যাগটা নামিয়ে টেবিলে রেখে বসলেন তিনি। খেয়াল করে দেখলে বোঝা যায় লোকটি বৃদ্ধ হলেও অশক্ত নয়। ছোটখাটো মানুষ। মাথার সামনের দিকের চুল কমে এসেছে। হাতের শিরা বেরিয়ে এসেছে। লোকটির চোখ ঘোলা কিন্তু চোয়াল কঠিন। চয়নের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘কই? শুরু করো, যেখানে থামছিলা।’
ততক্ষণে কবির, রেজা আর জাহিদ কেটে পড়েছে, সঙ্গে নিয়ে গেছে শিমুলকে। শিমুল এখানে নতুন। বয়সে চয়নদের বছর তিনেকের ছোট। কবিতা লেখার বড় শখ। তাই এসে জুটেছে এদের সঙ্গে।
শিমুল বুঝতে পারল, আগন্তুককে খুব একটা পছন্দ করে না এরা। অনেকটা আপদের মতো আর কী। কিন্তু সরাসরি বাতিলও করতে পারে না। তাই গলা নামিয়ে রেজাকে জিজ্ঞেস করে শিমুল, ‘ইনি কে?’
শিমুলের মতোই গলা নামিয়ে রেখে জবাব দেয় জাহিদ, ‘মনোয়ার হোসেন। চয়ন ভাইয়ের বাপের বন্ধু। একসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ করছে।’
‘তো, সবাই এমন চলে আসলেন কেন? কথা শুনতাম…’, শিমুল একটু আফসোস করে। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে শিমুলের খুব আগ্রহ। মাঝে মাঝে সে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে পড়ালেখা করে। ‘আগুনের পরশমণি’ সিনেমা দেখেছে কিছুদিন আগে। শুনেছে, বদি নামে সত্যিই এক মুক্তিযোদ্ধা নাকি ছিল। তার সম্পর্কে জানতে চাচ্ছে, কিন্তু খুব একটা পারছে না। জহির অবশ্য বলেছিল, ‘ক্ষমতা পরিবর্তন হইলে দেখবি মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে নতুন করে কথাবার্তা শুরু হবে। এখন হবে না।’
তাই মনোয়ার হোসেনের পরিচয় শুনে শিমুলের আশা জাগল, তার কাছ থেকে হয়তো অনেক কিছু জানা যেত।
কিন্তু জাহিদ মাছি তাড়ানোর মতো হাত নাড়িয়ে বলে, ‘আরে, এই লোকের এখন মাথা পুরাপুরি ঠিক নাই। মাঝে মাঝে এইখানে আইসা বসে। দুই একটা বই টই পড়ে। জ্ঞান দেয়। নিজের মনে কথা কয়। চলতি ভাষায় কথা বলতে বলতে সাধু শুরু করে। মাঝে মাঝে লাইব্রেরির বই নিয়া আর ফেরত দেয় না। মহা মসিবত।’
যদিও বিষয়টা এমন কোনো মসিবত বলে শিমুলের মনে হয় না। এর মধ্যে রেজা বলে, ‘চয়নের বাপের বন্ধু, তাই সামনে বিড়ি খাওয়া যায় না।’
শিমুল বুঝল, নিজেদের মতো করে ক্লাবে আড্ডা দিতে না পারাই আসলে বিরক্তির কারণ। এমন অবশ্য হয়। বয়সের ফারাক থাকলে সেখানে না চাইলেও সম্মান দিতে হয়। এর কারণে ক্লাব বা এরকম জায়গায় আরাম করে কিছু করা যায় না। শিমুল ক্যারামে মন দিতে চাইল। কান রইল পাশের ঘরের দিকেও।
সেখান থেকে তখন শোনা যায় মনোয়ার সাহেব বলছেন, ‘এই যে তোমরা, কী জানি বলে পত্রিকায়? হ্যাঁ, নতুন প্রজন্ম। তোমাদের জানাশোনা কতদূর?
তোমরা জানো, চাঁদে যেতে হলে কত বেগে নভোযান চালাতে হবে। তোমরা এ-ও জানো যে আমেরিকার বার্ষিক প্রবৃদ্ধি কত। দেখতে চাও ধুমাধুম যুদ্ধের সিনেমা। কিন্তু তোমরা কি জানো, এলএমজি থেকে গুলি ছুড়লে কী রকম শব্দ হয়? বারুদের গন্ধ কেমন হয়, তোমরা বুঝবা না।’
জহির মাঝখানে কী একটা প্রসঙ্গে বলেছিল, তারা অনেক কিছু নিয়েই খোঁজ রাখে। তার জবাবেই এসব কথা বলতে শুরু করেছেন মনোয়ার। আর বলে যাচ্ছেন নিজের মতো করে। থামাথামি নাই। তিনি বলছেন, ‘তোমরা তো সারাদিন তর্ক করো, দেশ দেশ করো। মার্ক্স পড়ো, লেলিন জানো। পৌরনীতি-অর্থনীতি বুঝো। দেশ কী বস্তু, উহা তোমরা আমাদিগ হইতে উত্তম জানো। আমরা কিন্তু দেশের সংজ্ঞা শিখি নাই। কিন্তু আমরা মাটিকে ভালোবাসিতাম।’
জহির এর মধ্যেই আবার বলে ওঠে, ‘আপনারা দেশের জন্য যুদ্ধে যান নাই?’
মনোয়ার যেন কিছু শুনতেই পাননি। তিনি বলছেন, ‘মাটিকে বাঁচাইতে ছুটিয়া গিয়াছিলাম। তোমরা গণতন্ত্রের কথা কহ না? আমি গণতন্ত্র বুঝিতাম না। আমার পাশে যুদ্ধ করতে করতে যে রজব আলী মারা গেল গলায় গুলি লেগে, সে গণতন্ত্র জানত না। দেশ জানত না। মানচিত্র কী, আন্তর্জাতিক সীমানা কী, সে বুঝত না। সে জানত কীভাবে ভুঁই রুইতে হয়। ও বুঝত দেশ মানে ওর কয়েক বিঘা জমির ধান। জমির মিয়াঁ এখন ঢাকায় কোথায় যেন পান-বিড়ির দোকানদার। একটা পা হারাইছিল। ও বুঝত, স্বাধীনতা মানে মাঠে গরু চড়তে দিয়া শেফালির বাড়ির সামনে ঘোরাঘুরি করা।
বৃদ্ধের কথা শুনতে শুনতে চয়নের মনে একটা খটকা লাগে। আসলেও তো, সে এমন করে কখনো চিন্তা করেনি। সেই একাত্তর সালে কে বুঝত যে দেশ আসলে কী? অনেক মানুষ তো যুদ্ধে গিয়েছিল খেত ফেলে রেখে। তারা ওই তেভাগার মতো ফসলই হয়তো চেয়েছিল। স্বাধীনতা কী বিষয়, তাদের জানা ছিল না।
মনোয়ার একাই বলে যাচ্ছেন। তিনি বলছেন, ‘আমার কাছে দেশ ছিল সবুজ খ্যাতের ওপরে বিশাল আকাশ। আমরা বাবা দেশ বুঝতাম না। না বুইঝাই অস্ত্র ধইরা খানসেনাদের সামনে খাড়াইছিলাম। আর বুঝছিলাম, ওগো আমাদের সীমানায় ঢুকতে দেওয়া যাবে না। ঢুকতে দেই নাই, জিততে দেই নাই। মারছি, মরছি, অঙ্গ বিসর্জন দিছি। সেসবের মর্ম আর কেউ রাখে নাই।’
‘কে রাখে নাই?’, প্রশ্নটা জহিরই করল। সাধারণত বৃদ্ধ বহু কথা বলবেন সন্দেহে তাকে কখনো কেউ প্রশ্ন করে না। পারলে এড়িয়ে যায়। কিন্তু আজ জহিরের মনে হয়েছিল প্রশ্নটা করা উচিত। তার সে প্রশ্ন কানে যেতেই মনোয়ার সাহেবের চোখ জ্বলে ওঠা দেখল দুজনেই। অবশ্য কয়েক সেকেন্ড, তারপর নিভে গেল।
তিনি বললেন, ‘যুদ্ধ করছিলাম পাশাপাশি দাঁড়াইয়া, যেন আমরা আলাদা কেউ না, সবাই এক। কিন্তু যুদ্ধ শেষে দেখলাম, সবাই সবার মতো। আলাদা। যারা একদিন পাশাপাশি দাঁড়াইছিলাম, তাদেরই একদিন শত্রুর মতো মুখামুখি দাঁড়াইতে হইছিল। এখনো দাঁড়াইয়া আছি।’
কিছুক্ষণ চুপ থেকে মনোয়ার বললেন, ‘আশা ছিল তোমাদের নিয়া। তোমরা তো বাবা আমাদের চেয়ে ভালো জানো, বুঝো। তাহলে তোমাদের মধ্যে সাড়া কই? দেশ দেশ শুধু তো মুখে মুখে। মাটি তোমরা চিনলা না, অবশ্য আমরাও পারি নাই চিনাইতে। যে স্রোত আমরা আইনা দিছিলাম, তাই হয়তো তোমাগো ভাসাইয়া নিয়া আসছে অনেক দূর। তোমরা নিজেদের চিনতে পারো নাই এখনো, গতকাল পর্যন্ত আমার তা-ই মনে হইছিল। এখন মনে হয়, আমরাই কি আসলে আমাদের চিনতে পারছিলাম?’
চয়ন কিছু একটা চিন্তা করে বলল, ‘তাহলে আপনিও জহিরের মতোই বলছেন, স্বাধীনতা সময়ের আগেই এসেছিল?’
বৃদ্ধ এবার হাসলেন। বললেন, ‘স্বাধীনতা তখনই আসছিল, যখন তার আসার কথা ছিল। ভিয়েতনামের কথা বলো আর যা-ই বলো, আমাদের সম্মুখযুদ্ধ ৯ মাসের হইলেও আসল যুদ্ধটা চলছিল আরও আগে থেকে। শেখ সায়েব সেই যুদ্ধরে টাইনা তুলছিলেন। তার সঙ্গে কাঁধ মিলাইছিলাম আমরা। যুদ্ধ কিন্তু চলিয়াছিল পাকসেনাদের আত্মসমর্পণের পরও। শেখ সায়েবের দেশের ফিরিয়া আসার পরও। কিন্তু ওই যে কহিলাম, আমরা সেই যুদ্ধ সম্মুখ সমরের পর আর করিলাম না। বুঝিতে পারি নাই বহু কিছু।’
ক্লাবঘরের সামনে একটা বারান্দা। সেখানে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছে চয়ন। পাশে দাঁড়িয়ে শিমুল। সে এসে দাঁড়িয়েছে কিছুক্ষণ হলো। মনোয়ার হোসেনের সব কথাই শুনেছে সে। অন্যরাও শুনেছে। ক্যারাম থেকে গিয়েছিল কিছুক্ষণের জন্য। রেজা দেখেছে, শিমুলের মধ্যে নানা রকম প্রশ্ন তৈরি হচ্ছে। সদ্য কলেজ পাস করা শিমুলের আবেগ ওদের চেয়ে বেশি। এর মধ্যে সে অনেক কিছুই জিজ্ঞাসা করে চয়নকে। চয়ন যথাসাধ্য জবাব দেয় সবসময়। আজ শিমুলকে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে চয়ন বোঝে, এতোসব কথা শুনে শিমুল বিভ্রান্ত।
চয়ন বলে, ‘মনোয়ার কাকা বাবার বন্ধু। বন্ধু বলতে, ঠিক বন্ধুও না। সেও একটা গল্পের মতো।’
শিমুলের কাঁধে হাত দিয়ে সে বলে, ‘মনোয়ার কাকার বাবা আমার দাদার ম্যানেজার গোছের ছিলেন। দাদার তখন জমি থেকে ভালো টাকা আসে। একটা দোকান দিছেন গঞ্জে। তখন একদিন কেমনে যেন মনোয়ার কাকার সঙ্গে পরিচয় হইছিল। তারপর তারে বহাল করেন হিসাব-কিতাব আর অন্যান্য কাজ দেখাশনায়। বাবা তো বরাবরই পড়ালেখা নিয়া থাকতেন। একটা লোক দরকার ছিল আসলেই।’
‘মনোয়ার কাকা আর বাবা এক বয়েসী দেখে খাতির জমে ভালো। কিন্তু দুজন বিপরীত। বাবা ছিলেন পড়ালেখা নিয়ে, আর মনোয়ার কাকা উড়নচণ্ডী। পড়ালেখা তেমন হয় নাই। কিন্তু হিসাব ভালো বুঝতেন। কামলাদের দিয়ে কাজ করায়ে নিতে পারতেন। কিন্তু কেবল পাগলা স্বভাব তার। মাঝে মাঝে বেরিয়ে পড়তেন। ফিরে আসতেন দুই তিন মাস পর। তারপর একদিন ফিরলেন বৌ নিয়ে। সেটা একাত্তরের এপ্রিল। একমাসের মাথায় বৌ রেখে চলে গেলেন যুদ্ধে। বাবা নিষেধ করেছিলেন, শোনেননি। দাদা, সবাইকে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন গ্রামের আরও গভীরে। যুদ্ধের আঁচ তাদের গায়ে লাগেনি।’
চয়ন বলতে থাকে, মনোয়ার কাকার স্ত্রী মৃত সন্তান প্রসব করেছিলেন। তাকে দেখার কেউ ছিল না। এর কিছুদিন পর রাজাকারদের হাতে পড়েন চাচি। তার আর খোঁজ পাওয়া যায়নি।
বাবার কাছে শুনেছি, শত্রুর বিপক্ষে দাঁড়াতে কখনো পেছপা হননি মানুষটি। কিন্তু ফিরে এসে শূন্য ঘরের বিভীষিকা সহ্য করতে পারেননি। এক রকম পাগলই হয়ে গেছেন। এরপর বহুবার চেষ্টা করেছেন দেশের নানা পরিস্থিতিতে কথা বলার। কিন্তু দেখেছেন, তার স্ত্রীকে তুলে নেওয়া রাজাকারই হয়েছে এলাকার চেয়ারম্যান। মেনে নিতে পারেননি। চলে গিয়েছিলেন গ্রাম ছেড়ে। এক রাতে বেলায়েত চেয়ারম্যানের বাড়িতে ডাকাত পড়ে। কোনো সম্পদ নেয়নি তারা। কেবল মারা পড়ে বেলায়েত। এর তিন মাস পর ফিরেছিলেন চাচা। বাবাকে নাকি একদিন বলেছিলেন, ‘কত বেলায়েত এখনো রইল। রাম তো এক রাবণ মারছিল। এদিকে রাবণের শেষ নাই।’
শিমুল দেখল, লাইব্রেরি থেকে মনোয়ার সাহেব বেরিয়ে আসছেন। মাথায় টুপি চাপাতে চাপাতে বললেন, ‘চয়ন, আমি নামাজে গেলাম। মন্টুর দোকানে চা আর জিলাপির কথা বলে যাইতেছি। একসঙ্গে চা খাব এসে।’
সিঁড়ি থেকে নেমে এগিয়ে যান তিনি। শিমুল তাকিয়ে দেখে, কাঁধে ধনুক নিয়ে ক্লাবঘরের পাশের পায়ে চলা পথে শুকনো পাতা মাড়িয়ে এগিয়ে যাচ্ছে এক পৌরাণিক পুরুষ।

বিজ্ঞাপন

সারাবাংলা/টিআর/এসবিডিই

Tags: , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন