বিজ্ঞাপন

আমি কি রকমভাবে বেঁচে আছি (ষষ্ঠ পর্ব)

April 10, 2024 | 3:19 pm

প্রিন্স আশরাফ

বাম্মু স্পাইন

বিজ্ঞাপন

ঢাকায় সামিউলের অদ্ভুত স্বভাব হলো, রিকশা দুরত্বের পথটুকু সে হেটেই যাতায়াত করে। তার মধ্যে যতটা না খরচ বাচানোর চিন্তা থাকে, তার চেয়ে হাঁটতে ভাল লাগে বলেই হাটে, পথে ছোট দোকান পড়লে দাড়িয়ে পড়ে চায়ে চুমুক দিয়ে সিগারেটে টান দেয়। সে কারণেই নিকেতনের অফিস থেকে যখন গুলশান-২ এর দিকে নতুন ক্লায়েন্টের বাসার ঠিকানা দিল, সে হাঁটতে শুরু করল।
গুলশান এক ও দুই এলাকাটা যে এতোটা বড় সামিউলের ধারণা ছিল না। বাসা খুজতে খুজতে এই প্রথম তার মনে হলো গুলশান সোসাইটির ভেতরে ঢুকে রিকশা নেওয়া উচিত ছিল। কিন্তু একবার যখন নেয়নি আর এতোটা পথ চলে এসেছে, তখন আর রিকশা নেবে না। একটা সিগারেট ধরিয়ে টানতে টানতে আবার নতুন উদ্যমে ঠিকানা খুজতে শুরু করল।
সূর্য মাথার উপর উঠে গেছে। মসজিদ থেকে জোহরের আজান ভেসে আসছে। তার ইন করা সাদা শাটের ভেতরের স্যান্ডো গেঞ্জি ঘামে ভিজতে শুরু করেছে। এর মধ্যে সে নিজে দুই বার ওই বাসায় ফোন দিয়েছে আবার বাসা থেকে দুইবার ফোন দিয়েছে।
শেষমেষ মারফিস লয়ের মতো একবারে শেষ প্রান্তের দিকে গাছপালায় ছাওয়া বিশাল পাচিলঘেরা, পাচিলে লতানো লতায় ঢেকে দেওয়ার কারণে বাড়ির নাম নাম্বার পড়া যায় না, এরকম একটা বাড়ির সামনে এসে দাড়াল সামিউল। আকাশী রঙের উর্দি পরা সিকিউরিটিজ কোম্পানির অল্প বয়সী দারোয়ান পকেট গেট খুলে দিয়ে ঝাঝালো কণ্ঠে বলল, ‘আপনার না আরো আগে আসার কথা।’
‘বাসা খুজে পাচ্ছিলাম না।’ সামিউল একটু ধাতস্ত হয়ে সত্যি কথাটাই বলল।
‘ঠিকই কইছেন স্যার, এই বাসা খুজে পাওন যায় না। পেরথম পেরথম আমিও পাইতাম না।’ দারোয়ান কোনরকম নাম রেজিস্ট্রিট্রি না করেই তাকে ভেতরে পাঠিয়ে দিয়ে কোথায় যেতে হবে বলে দিল, বোঝাই যাচ্ছে এই বাসায় খুব একটা কেউ আসে না।
বাইরের গেট পেরিয়ে লতাগুল্ম অযতেœ বেড়ে ওঠা ছোট্ট একটুখানি উঠোনের মতো জায়গা পেরিয়ে প্রশস্তে বেড়ে ওঠা দোতলা বাড়ি। দারোয়ানের কথামতোই সে এক পাশের একটা সিড়ি দিয়ে দোতলায় উঠে গেল। দোতলায় দরজা খোলাই ছিল, গাঢ় মেরুন রঙা ভারী পর্দা টানানো। সামিউল পর্দার এপাশে দাড়িয়ে ওই নাম্বারটাতে কল দেওয়ার জন্য মোবাইল হাতে নিতেই পর্দা সরিয়ে মুখে বলিরেখা ওঠা একজন শক্তসামর্থ্য বৃদ্ধ বেরিয়ে এলেন। প্রথমে সামিউল এই লোকটাকেই ক্লায়েন্ট ভেবেছিল, কিন্তু পরক্ষণেই বুঝতে পারল এই বুড়ো লোকটার সাথেই সে কথা বলেছিল। আর অফিস থেকে জানিয়েছে এই বৃদ্ধ ক্লায়েন্ট বিছানায় শয্যাশায়ী, হাটাচলা করতে পারেন না। বাশের শিরদাড়া নামে অদ্ভুত এক রোগে ভুগছেন তিনি।
বুড়ো কেয়ারটেকার দেরীর কারণ জিজ্ঞেস করল না, ইশারায় তাকে পথ দেখিয়ে ভেতরে নিল। প্রথমের রুমটা ড্রয়িংরুম গোছের হলেও বইয়ের আলমারীতে ভর্তি। সাদা থান কাপড় দিয়ে সোফা ঢেকে রাখা দেখে বুঝতে পারল এই সোফায় ক্উে বসে না। ড্রয়িংরুমের ওপাশে আরেকটা রুমের দরজা দেখা যাচ্ছে। তাতেও ভারী পর্দা টানা, ড্রয়িংরুমের অনুজ্জ্বল আলোর কারণে পর্দাটা কেমন যেন কালচেটে মনে হচ্ছে। পর্দার এপাশে দাড়িয়ে বুড়ো কেয়ারটেকার গলা পরিষ্কার করে নিয়ে বলল, ‘কর্তা, উনি এসেছেন, ভেতরে নিয়ে আসব কি?’
কর্তা ঘড়ঘড়ে নিচু গলায় যেন ভেতরের কাকে কি বললেন, তারপর গলা উচিয়ে বললেন, ‘মন্ডল, আয়, ওকে ভেতরে নিয়ে আয়।’ তারপর আবার নিচু গলায় বললেন, ‘তুমি এখন যাও, আমাদের এর মধ্যে তোমার থাকার দরকার নেই।’
পর্দা সিিরয়ে কেয়ারটেকারের পেছনে পেছনে রুমের ভেতরে ঢুকল সামিউল। এই রুমটাকে প্রায়ান্ধকারই বলা চলে, রুমের কোথাও একটা অনুজ্জ্বল বাতি ডিম লাইটের মতো মৃদুু আবছায়া আলো দিচ্ছে। তার মধ্যে সাদা একটা মূর্তি দেখে বাইরের উজ্জল রোদের ভেতর থেকে আসা সামিউল একটু চমকে গেল। একটু খেয়াল করেই বুঝতে পারল ওই সাদা মুর্তি আসলে এপ্রন পরা একজন নার্স, বৃদ্ধ বোধ হয় এতোক্ষণ নিচু গলায় এর সাথেই কথা বলছিলেন। ঘড়ঘড়ে গলাটা আবার শোনা গেল, ‘শিপ্রা, আমার মাথার কাছের আলোটা জে¦লে দিয়ে যাও। আমি ডাকলে তারপর এসো।’
মাথার কাছে আলো জ্বলতেই বৃদ্ধ ক্লায়েন্টকে দেখতে পেল সামিউল। প্রুাচীন ধাচের বিশাল পালংকের একবারে মাঝখানে শুয়ে আছে একটা কংকাল। কংকালই বলা ভাল, টিভিতে সোমালিয়া মোগাদিসুর কংকালসার মানুষদের ছবি দেখেছে একেবারে যেন অবিকল ওইরকমই, গায়ে মাংস বলতে কিছুই নেই বলতে গেলে, হাড়ের গায়ে চামড়া লাগিয়ে রাখলে যেমনটি হয় আর কি! শুধু শিরদাড়াই বাশ হয়ে যায়নি মনে হচ্ছে গোটা শরীরটাই বাশের খাচা মনে হচ্ছে।
বৃদ্ধ জ্বলজ্বলে চোখে সামিউলের দিকে তাকিয়ে কংকালসার হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, ‘বসো, আমার পাশেই খাটেই বসো, আমি কিছু মনে করবো না, তুমি তো আমার ছেলের মতোই!’ সামিউল একটু ইতস্তত করছে দেখে বললেন, ‘গায়ে কাপড়চোপড় রাখতে পারি না, সারা গা জ্বলে, আদিম মানুষের মতো অবস্থা হয়ে গেছে আমার, শুধু লজ্জাস্থানে কিছু না রাখলে আর লজ্জা থাকে আর কি!’
ঘরের মধ্যে খুব আরামদায়ক শীতল হাওয়া, হয়তো কোথায় এসি চলছে। গরমের মধ্যে হেটে এসে ভাল লাগছে সামিউলের। তার পাশ দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার আগে নার্স শিপ্রার দিকে তাকাল সামিউল। নার্সের সাদা পোশাক পরার কারণে কিনা কে জানে, মেয়েটাকে বেশ ফর্সা, সুন্দরী রহস্যময়ী লাগল। শিপ্রাই বেরিয়ে যাওয়ার আগে একবার সামিউলের দিকে তিরছি নজরে তাকাল, সেই তাকানোর মধ্যে কেমনযেন একটা রহস্যময়তা ছিল।
শিপ্রা বেরিয়ে যেতেই বৃদ্ধ ঘড়ঘড়ে গলায় বললেন, ‘মন্ডল, ওকে একটু ঠান্ডা বেলের শরবত করে দাও। বাইরে রোদেপুড়ে ঘেমে নেয়ে এসেছে।’ বৃদ্ধের মুখের কথা শেষ হওয়ার আগেই কেয়ারটেকার বেরিয়ে গেল। বৃদ্ধর বাড়ানো হাতের দিকে তাকিয়ে পাশে বসে বৃদ্ধর হাত ধরল। কি শীতল কাঠ কাঠ হাত! তখনই বৃদ্ধ একটা অদ্ভুত কথা বললেন, ‘এই কড়া রোদের মধ্যে এতোটা পথ হেটে হেটে আসার কি দরকার ছিল?’

সামিউল চমকে উঠলেও সেটা সামলে নিল, হয়তো বুড়ো কেয়ারটেকারই বৃদ্ধকে হেটে আসার কথাটা জানিয়েছে। নিকেতন থেকে গুলশান আসতে এতোটা পথ নিশ্চয় হেটে আসতেই লেগে যায়, এরকমটি ধারণা করে নিয়েছে।
বৃদ্ধ তখনও সামিউলের হাত ধরে রেখেছেন, ‘এখন থেকে তুমি আমার গাড়িতেই যাতায়াত করবে। যেখানে যেতে চাও নিয়ে যাবে। আমি মন্ডলকে বলে দেব।’
কাঠের ট্রে হাতে মন্ডল ঢুকল, তার মধ্যে গ্লাসে বরফ কুচি দেওয়া হলদেটে ঘোলাটে রঙের শরবত। বৃদ্ধ হাতে ছেড়ে দিয়ে বললেন, ‘নাও, বেলের শরবত খাও। ভাল লাগবে। আর তুমি আমার ছেলের মতো, ছোট ছেলের মতো। তোমাকে সেজন্যই তুমি করে বলছি, তাছাড়া তুমি তো আমার ছেলের দায়িত্ব নিতেই এসেছো তাই নয় কি?’ বৃদ্ধ এবার বেশ টনটনে গলায় বললেন। তারপর মন্ডলের দিকে হাত ইশারা করে মাথার কাছে আলো অফ করে দিতে ইঙ্গিত দিলেন। সামিউলের শরবত গলাধকরণ করার জন্য অপেক্ষা করলেন, শেষ হলে পরে ইশারা ট্রে নিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার ইশরা করলেন। সামিউল বুঝতে পারলেন যে মানুষটি তার সাথে এতখানি কথা বলতে পারছে সেই মানুষটিই আবার কেন নি¤œপদস্থ কর্মচারীদের সাথে ইশারা ইঙ্গিতে কথা সারছে। এটা কি ধনাঢ্য ব্যক্তিদের একটা উন্মাসিকতা? ধনী গরীবের সাথে ইশারা ইঙ্গিতে কথা বলে বিভেদটা বুঝিয়ে দেওয়া যে তুমি ছোটলোক, তোমার জন্য মুখের দামী কথা খরচ করা বাতুলতা!
ধনী গরীবের বিভেদ নিয়ে একটা কবিতা মাথার মধ্যে তৈরি হওয়া টের পাচ্ছিল সামিউল।
সামিউল মন্ডলের চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছে দেখে বৃদ্ধ বললেন, ‘মন্ডল খুব ভাল লোক। আমার বন্ধু মানুষ আবার আমার ডানহাতও বলতে পারো। সেই কৈশোর থেকেই ও আমার সাথে সাথেই আছে। আমাদের বাড়িতে এক সময় কামলার কাজ করতো। আমিই ওকে আমার বই থেকে একটু একটু করে পড়িয়ে পড়াশুনাটাতে সড়গড় করিয়েছি যাতে আমার সব কিছু ও দেখভাল করতে পারে। মন্ডলই তোমাকে সবকিছু বুঝিয়ে দেবে।’
কি বুঝিয়ে দেবে সামিউল বুঝতে পারল না, তবে একটু বুঝতে পারল শক্তপোক্ত শরীরের ওই বয়স্ক লোকটার হাতে অনেক কিছুর চাবিকাটি আছে, কিন্ত সেসব খোঁজখবরে তার লাভ কি। কারোশি কেয়ারের অফিসের নিয়মে কোন ক্লাইয়ে›টের কাছে আট ঘন্টা থাকার নিয়ম, তারপর বেশি সময় থাকলে অভার টাইম এবং ঘন্টা প্রতি তার বিল ধরা হয়ে থাকে। তবে আট ঘন্টা বাসায় পৌছানোর পর থেকেই শুরু হয়, অনেকে আবার ম্যানেজ করে তিন চার ঘন্টার মধ্যেই দায়িত্ব শেষ করে চলে আসতে পারে।
বৃদ্ধ বললেন, ‘তোমাকে আমার এখানে পাঠানো হয়েছে আমার ছেলেদের হয়ে আমাকে কিছুটা সঙ্গ দিতে। কি অদ্ভুত কথা তাই না? কেউ কি কারোর স্থলাভিষিক্ত হতে পারে? এ কি কোন পদ? কোন চেয়ার? যে একজনের বদলি হয়ে গেল আরেকজন এসে বসল? বাবা-মায়ের কাছে সন্তানের স্থান কেউ নিতে পারে না!’
সামিউল একটু চুপ করে রইল। এই ব্যাপারটা সে নিজেও ভেবেছে। জাপান দেশের লোকগুলোর মাথায় মনে হয় ছিট আছে, সেই ছিট তারা এ দেশের মানুষের মধ্যেও ছড়িয়ে দিতে চাইছে। না হলে আসলেই তো, ছেলের প্রক্সি দিতে সে বাবার কাছে এসেছে অথচ বলতে গেলে বিদেশ প্রবাসি এইসব ছেলেদের সমন্ধে সে বলতে গেলে কিছুই জানে না। তবে মিরপুর ডিওএইচএসের বৃদ্ধার সাথে সময় কাটিয়ে সে যেমন বৃদ্ধার ছেলেমেয়ের সমন্ধে খুটিনাটি খানাখাদ্য পছন্দ অপছন্দ সবই জেনে ফেলেছিল তেমনি হয়তো কয়েকদিনে এই বৃদ্ধর কাছ থেকেও সব জেনে যাবে। হয়তো বা নাও জানতে পারে, মায়েরা যেমনভাবে সন্তাানের সব খুটিনাটি মনে রাখে এবং অন্যদের কাছে বলতে পছন্দ করে বাবারা হয়তো অভিমানের কারণেই তা করে না। মায়েদের চেয়ে বাবাদের অভিমান বেশিই দেখা যায়।
সামিউল বিনীত স্বরে বলল, ‘আমি আপনার পাশে বসে আপনার কথা শুনব, জীবনের কথা শুনব। কিছুটা সঙ্গ দেব। এর বেশি আমি আর কি করতে পারি?’
‘এর বেশি আমিও কিছু করতে বলি না। শোন, আমার কিন্তু সেইভাবে সঙ্গ দেওয়ার লোকের খুব একটা অভাব আছে তা নয়। আমার এই অদ্ভুত অসুখের দেখভালের জন্য একজন ডাক্তার প্রায় প্রতিদিনই একবার এসে চেক-আপ করে যায়। নার্স মেয়েটাকে তো তুমি দেখেছোই, দিনের বেলায় ওও মোটামুটি ডিউটি করে। তাছাড়া মন্ডল আছে আমার সর্বক্ষণের সহচর। কিন্তু একটা ব্যাপার কি জানো, সবার কাছে না মন খুলে সব কথা বলা যায় না। এমনকি আমার ছেলেরা এলেও তাদের কাছে বলতে পারতাম না। বাবা ছেলের মাঝে একটা দুরত্ব থেকেই যায়। শুধু দুরত্ব থাকে না বন্ধুদের মাঝে। আমি তোমাকে ছেলের মতো নয়, বন্ধুর মতোই পেতে চাই। এই জীবনে আমার বলতে গেলে তেমন কোন বন্ধু নেই।’
সামিউল একটু অস্বস্তি বোধ করল, এই ঘাটের মড়ার সাথে কি বন্ধুত্ব করবে সে? বন্ধুত্ব হয়তো কোন বয়স মানে না, কিন্তু তারও তো একটা লিমিট থাকে? পয়ত্রিশের সাথে সত্তরের বন্ধুত্ব হয়তো হয়ও, কিন্তু তাতেও দুজন মানুষের কিছুটা অবদান থাকে, যে মানুষটার কাছে সে টাকার জন্য গলগ্রহী তার সাথে বন্ধুত্ব হয় না। তাও সে আমতা আমতা করে বলল, ‘ঠিক আছে স্যার, আমি আমার সাধ্যমত চেষ্টা করল।’
বৃদ্ধ হেসে ফেললেন, ‘এদিকে বলছো বন্ধ’ হওয়ার চেষ্টা করবে আবার স্যার ডাকছো, ব্যাপারটা কেমন হয়ে গেল না? বিদেশে হলে আমাকে হয়তো বন্ধুত্বের খাতিরে নাম ধরে ডাকতে বলতাম, কিন্তু আমাদের দেশে সেটা সম্ভব না। সেটা যেমন দৃষ্টিকটু দেখাবে তেমনি আমার নিজের কাছেও অস্বস্তি লাগবে। তুমি আমাকে স্যার ট্যার না ডেকে বরং চাচা ডাক, তাতে বাবা-ছেলের সম্পর্কের একটা ফিল যেমন আসবে আবার তেমনি বন্ধুত্বের ব্যাপারটাও সহজ হবে।’ বৃদ্ধ একটু নড়াচড়া করলেন, ‘আমার খাটের মাথার পিছনে একটা লম্বা বালিশ টাইপের জিনিস আছে, ওইটা আমার পিঠের মেরুদন্ডের নিচে দিয়ে একটু হেলান মতো দিয়ে দাও। শিরদাড়া সোজা হয়ে যাওয়ার পর আর বসতে পারি না, হয় একবারে চিৎ হয়ে শুয়ে থাকতে হয়, না হলে পিঠের নিচে ওইটা দিয়ে আর উচু করে কিছুটা হলেও হেলান দেওয়ার ভঙ্গিমায় বসতে পারি। চিৎ হয়ে শুয়ে কারোর সাথে কথা বলে আরাম পাই না, মনে হয় শূন্যের সাথে কথা বলছি।’
সামিউল বৃদ্ধের কথামতো বৃদ্ধকে আধশোয়া করে দিল। বৃদ্ধের হাত ধরার সময় যেরকম অদ্ভুত শীতল একটা অনুভূমি চর্মকংকালসার নগ্ন শরীরটাকে ধরে পিঠের নিচে বালিশটাকে দিতে গিয়ে একইরকম অনূভুতি হলো। এ অনুভুতি বলে বোঝানো যাবে না।

বৃদ্ধের সাথে সামিউলের বন্ধুত্ব গড়ে উঠতে সপ্তাহখানিকও লাগল না, প্রথমে কিছুটা দ্বিধাদ্বন্ধ থাকলেও বৃদ্ধের আগ বাড়িয়ে বন্ধুত্বের আহবানে সামিউল সাড়া দিল। ভেবেছিল, চাকরির খাতিরেই বৃদ্ধের সাথে অভিনয় চালিয়ে যাবে, কিন্তু খুব একটা অভিনয় করতে হলো না, কয়েকদিনের মধ্যেই সামিউল বুঝতে পারল অভিনয় ছাড়াই বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে তাদের মধ্যে।
আর বন্ধুত্বের বন্ধন গাঢ় হলো সামিউলের লেখালেখির সূত্র ধরে। বৃদ্ধের সাথে কথোপকথনের মধ্যে যখন জানতে পারলেন সামিউল লেখালেখি করে বিশেষত কবিতা লেখে, জাতীয় দৈনিক সমূহের সাহিত্য সাময়িকীতে তার কবিতা গল্প নিয়মিতই প্রকাশিত হয়, তখন বৃদ্ধ গড়গড় করে বলেন, এক সময় তারও কিছুটা লেখালেখির শখ ছিল, তবে শুধু কবিতাই লিখেছেন, গল্প উপন্যাস তেমন কিছু লেখেননি, তিনি মজা করে বলেন, একজন মানুষের জীবনের মধ্যে নাকি ১০০ কবিতা, ৪টি উপন্যাস, আর কটি জানি নাটকটাটক থাকে। তবে তিনি এক জীবনে একশর বেশি কবিতা লিখেছেন। তবে তা কোথাও প্রকাশ করেননি, কবিতার খাতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ আছে।
সামিউল বন্ধুত্বের সুরেই বলল, ‘আপনার তো টাকাপয়সার অভাব নেই। আর এখন দেশে টাকা দিয়ে বই করায় এরকম প্রকাশকেরও অভাব নেই। তাহলে কবিতার বই বের করেননি কেন, একশ কবিতা দিয়ে তো অন্তত তিনটে কবিতার বই বের হয়, নিদেনপক্ষে একটা কবিতা সমগ্র তো বের করতে পারতেন।’
বৃদ্ধ মৃদু হেসে বললেন, ‘এক জীবনে আমি শুধু অর্থই উর্পাজন করে গেছি, আর কিছুই করিনি। জীবনের এই শেষবেলায় এসে মনে হয় এক জীবনে এতো অর্থ উর্পাজনের পিছনে না ছুটে যদি জীবনটা উপভোগ করতে পারতাম, যদি এক জীবনে মনে মনে যা করতে চেয়েছি তা করতে পারতাম তাহলে বোধ হয় মরণটা সুখের মরণ হতো। কিন্তু হায়, জীবনটাকে কখনও আবার ফিরে পাওয়া যায় না।’
‘আপনি কিন্তু এখনও ইচ্ছে করলে কবিতার বই প্রকাশ করতে পারেন। আমার পরিচিত প্রকাশক আছে। তাকে দিয়ে রিজনেবল প্রাইসে করিয়ে দিতে পারব।’ সামিউল তার সাথে যোগাযোগ করা প্রকাশকের কথা বলল, ‘আমার কবিতার বই বের করতে চেয়েছিল, কিন্তু এখনও বই বের করার মতো উৎকৃষ্ট মানের কবিতা লিখে উঠতে পারিনি বলে সময় নিচ্ছি।’ সামিউল কবি হিসাবে নিজের ভাব বজায় রাখার চেষ্টা করল।
‘নারে ভাই, এই বয়সে এসে অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়ে থেকে আর কবিতার বই বের করে লোক হাসাতে ইচ্ছে করে না। আমাকে কেউ চেনে না, জানে না, কবি হিসাবে সামান্যতম পরিচিতি নেই, শুধু টাকার জোরে বই ছাপিয়ে ফেললাম, ব্যাপারটা ঠিক আমার সাথে যায় না। তাছাড়া জীবনে এতো এতো অসমাপ্ত কাজ রয়ে গেছে যে কবিতার বই বের করা নিয়ে আপাতত মাথা ঘামাচ্ছি না। তবে মাথার মধ্যে অন্য একটা চিন্তা এসেছে। জানি, হাস্যকর চিন্তা। কিন্তু অসুস্থ শয্যাশায়ী বৃদ্ধের চিন্তা তো। একবার মাথার মধ্যে ঢুকে গেলে বের করা সমস্যা।’
‘কি চিন্তা?’
‘বদলী হজ্জ্বের মতো বদলী জীবন!’ বৃদ্ধ ঘোরলাগা চোখে বললেন, ‘যে জীবন আমি যাপন করতে পারিনি, অথচ করতে চেয়েছি, আমার বদলে সেই জীবন আরেকজন যাপন করে দিবে আর আমি অসুস্থ অবস্থায় বিছানায় শুয়ে শুয়ে সেই অযাপিত জীবন উপভোগ করব!’ বৃদ্ধ হঠাৎ সামিউলের হাত চেপে ধরে বললেন, ‘তুমি করবে? আমার সেই জীবন? বদলে নেবে আমার সাথে? পারবে না?’

বিজ্ঞাপন

চলবে…

সারাবাংলা/এসবিডিই

Tags: , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন