বিজ্ঞাপন

আ.লীগ নেতাকে চিকিৎসা দিতে দেরি— ডাক্তারকে বেদম পিটুনি

April 11, 2024 | 9:49 pm

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট

চট্টগ্রাম ব্যুরো: চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলায় মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় আহত আওয়ামী লীগ নেতাকে চিকিৎসা দিতে ‘দেরির’ অভিযোগ তুলে একটি হাসপাতালে ঢুকে চিকিৎসককে বেধড়ক পেটানো হয়েছে। দলটির উপজেলা কমিটির এক নেতা ও সাবেক ইউপি চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে এ ঘটনা ঘটে বলে অভিযোগ করেছেন হাসপাতালের কর্মকর্তারা।

বিজ্ঞাপন

বুধবার (১০ এপ্রিল) রাতে পটিয়া পৌরসভায় বেসরকারি ‘পটিয়া জেনারেল হসপিটাল লিমিটেডে’-এ ঘটনা ঘটে। যার একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও ছড়িয়ে পড়েছে।

হাসপাতালে ঢুকে চিকিৎসককে মারধরের ঘটনা শুনে স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেন চট্টগ্রামের সিভিল সার্জনকে তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দিয়েছেন।

আক্রান্ত ডা. রক্তিম দাশ (২৯) ঘটনার সময় পটিয়া জেনারেল হাসপাতালের জরুরি বিভাগে দায়িত্ব পালন করছিলেন।

বিজ্ঞাপন

ঘটনায় নেতৃত্বদাতা হিসেবে অভিযুক্ত মোহাম্মদ ছৈয়দ পটিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি। তিনি দক্ষিণ ভূর্ষি ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান।

জানা গেছে, বুধবার রাতে পৌরসভার ইন্দ্রপোল এলাকায় মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় আহত হন সাইফুল্লাহ পলাশ নামে এক ব্যক্তি। তিনি পটিয়া পৌরসভা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এবং উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক। খবর পেয়ে স্থানীয় নেতাকর্মীরা ঘটনাস্থলে গিয়ে তাকে নিয়ে পটিয়া জেনারেল হাসপাতালে যান।

ডা. রক্তিম দাশ তাকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে সেলাইয়ের জন্য অপারেশন থিয়েটারে (ওটি) নেওয়ার পরামর্শ দেন। পরে সাইফুল্লাহ পলাশকে ওটিতে অপেক্ষমাণ রেখে রক্তিম কাছকাছি সময়ে হাসপাতালে আসা আরও চার রোগিকে চিকিৎসা দেন। এদের মধ্যে দু’জন হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ও একজন বিষাক্ত হারপিক পানে অসুস্থ হয়ে আসা রোগী ছিলেন। এ ছাড়া, নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত এক শিশুও ছিল।

বিজ্ঞাপন

রক্তিম সারাবাংলাকে বলেন, ‘ওটিতে বাইক দুর্ঘটনায় আহত রোগিকে রেখে আমি কেন বাকি চার রোগি দেখলাম, সেটা নিয়ে প্রায় ৩০ জন লোক আমার রুমে ঢুকে তুলকালাম শুরু করে দেয়। অশ্রাব্য ভাষায় প্রথমে আমাকে গালিগালাজ করে। এরপর কয়েকজন মিলে আমাকে সমানে কিলঘুষি মারতে থাকে। আমি মাথায় মারাত্মক আঘাত পাই। এর পর সঙ্গে সঙ্গেই আমি বমি করে দিই। পরে আমাকে গালিগালাজ করতে করতে তারা রোগি নিয়ে হাসপাতাল ছেড়ে যায়।’

সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ছৈয়দের নেতৃত্বে হাসপাতালে অপ্রীতিকর ঘটনাটি ঘটেছে বলে অভিযোগ রক্তিম দাশের। অন্যদিকে, এ ঘটনায় হাসপাতালের নির্বাহী পরিচালক এস এইচ খাদেমী বাহাদুর পটিয়া থানায় লিখিত অভিযোগ দিয়ে মামলা হিসেবে গ্রহণের আবেদন জানিয়েছেন। এতে চিকিৎসককে মারধরের পাশাপাশি হাসপাতালের সরঞ্জাম ভাংচুরের অভিযোগ করা হয়েছে।

আবেদনে মোহাম্মদ ছৈয়দ (৫৫) ছাড়া আরও দুজনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। এরা হলেন- মোহাম্মদ মুকুল (৪৫) ও মোহাম্মদ টিপু (৪৫)। এছাড়া অজ্ঞাতনামা আরও ১০/১২ জনের নামে অভিযোগ দাখিল করা হয়েছে।

জানতে চাইলে পটিয়া থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) জসিম উদ্দিন সারাবাংলাকে বলেন, ‘সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ছৈয়দের নেতৃত্বে হাসপাতালে ঢুকে চিকিৎসককে মারধরের একটি অভিযোগ পেয়েছি। অভিযোগকারী উনার জাতীয় পরিচয়পত্রের (এনআইডি) কপি জমা দেননি। মামলা নিতে হলে উনার এনআইডি প্রয়োজন। উনাকে এনআইডির কপি নিয়ে আসতে বলা হয়েছে। সেটি জমা দিলেই মামলা রেকর্ড করা হবে। এরপর অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’

বিজ্ঞাপন

জানতে চাইলে মোহাম্মদ ছৈয়দ সারাবাংলাকে বলেন, ‘মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় আহত সাইফুল্লাহ পলাশ পৌরসভা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক। তিনি উপজেলা আওয়ামী লীগের সেক্রেটারি ছিলেন। গুরুতর আহত অবস্থায় আমরা উনাকে হাসপাতালে নিয়ে যাই। ঈদের ছুটির কারণে হাসপাতালে ডাক্তার ছিল কম। পলাশকে জখমের স্থানে সেলাই দিতে হবে বলে ওটিতে ঢোকানো হয়। আমরা বাইরে অপেক্ষা করতে থাকি।’

‘আমরা ভেবেছিলাম, ভেতরে সেলাই চলছে। কিন্তু ৪৫ থেকে ৫০ মিনিট অপেক্ষা করার পর দেখি ডাক্তার নিজের কক্ষে বসে আছেন, ওটিতে যাননি। পলাশের ঠোঁট, মুখ থেকে রক্ত ঝরছিল। ডাক্তার তার চিকিৎসা না করে রুমে বসে আছেন দেখে লোকজন ক্ষুব্ধ হয়। তখন ডাক্তার বলেন যে, তাকে শহরের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য। সেটা যদি আগে বলতো, তাহলে সমস্যা হতো না। কিন্তু ডাক্তারের কথা শুনে সবার মধ্যে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। এ সময় বাকবিতণ্ডা হয়েছে। পরে আমরা তাকে সেখান থেকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাই,’ বলেন মোহাম্মদ ছৈয়দ।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডা. রক্তিম দাশ সারাবাংলাকে বলেন, ‘উনার (সাইফুল্লাহ পলাশ) শুধু ঠোঁট এবং থুতনিতে সামান্য কেটে গিয়ে রক্ত ঝরছিল। আমি দেখে নার্সকে ফার্স্ট এইড দিয়ে রক্তক্ষরণ বন্ধ করার নির্দেশ দিই। এরপর মাথায় কোনো আঘাত আছে কি না সেজন্য এক্সরে করতে পাঠাই। এক্সরে করে আসার পর দেখি মাথায়ও কিছু হয়নি। তখন ওনাদের বলি যে, দুটি ছোট সেলাই লাগবে, সেজন্য যেন ওটিতে যায়। এরপর মাথায় মেজর কোনো আঘাত আছে কি না বা বড় কোনো জখম আছে কি না, সেটা তারা ইচ্ছে করলে শহরে নিয়ে নিউরো স্পেশালিস্টের পরামর্শ নিতে পারেন।’

‘রোগিকে ওটিতে নেওয়ার ফাঁকে আমি আরও চার জন গুরুতর রোগি দেখে নিজের কক্ষে বসে ব্যবস্থাপত্র লিখছিলাম। ওটিতে যেতে মাত্র ১০মিনিট দেরি হচ্ছে কেন, সেজন্য উনারা আমার রুমে ঢুকে আমাকে হেনস্থা করে মারধর করেছেন। আমি মাথায় আঘাত পেয়েছি। চিকিৎসা নিয়ে এখন বাসায় বিশ্রামে আছি,’ বলেন রক্তিম দাশ।

এদিকে স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. সামন্তলাল সেনের নির্দেশে বৃহস্পতিবার (১১ এপ্রিল) বিকেলে ওই হাসপাতালে যান চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. মো. ইলিয়াছ চৌধুরী। তিনি মারধরের শিকার চিকিৎসকসহ হাসপাতালের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলেন।

সিভিল সার্জন ডা. মো. ইলিয়াছ চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, ‘বাইক দুর্ঘটনায় একজন ব্যক্তির ঠোঁট ও থুতনিতে এক-দেড় ইঞ্চির মতো কেটে যায়। ডাক্তার উনাকে সেলাই করার জন্য ওটিতে নিয়ে যেতে বলেন। এর আগে, রক্তক্ষরণ বন্ধ করে তাকে এক্সরে করে নিয়ে আসা হয়। কয়েকজন সিরিয়াস রোগি দেখে ডাক্তারের ওটিতে যেতে ১০ মিনিটের মতো লেগেছিল। তাতেই একজন পলিটিক্যাল লিডারের নেতৃত্বে ডাক্তারকে মারধর করা হয়েছে। এটা খুবই দুঃখজনক এবং অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটেছে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী স্যার প্রতিবেদন চেয়েছেন। আমি লিখিত প্রতিবেদন পাঠিয়ে দেব।’

সারাবাংলা/আরডি/পিটিএম

Tags: , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন