বিজ্ঞাপন

যে কারণে ইসরাইলের উপর ইরানি হামলায় বাধা দিয়েছে জর্ডান

April 16, 2024 | 10:37 am

আন্তর্জাতিক ডেস্ক

ইরান যখন ইসরাইলে নজিরবিহীন আক্রমণ করে, তখন ইসরাইলের প্রতিরক্ষায় অন্যান্য মিত্রদের পাশাপাশি যোগ দেয় প্রতিবেশি জর্ডান। রোববার (১৪ এপ্রিল) ইসরাইলের উপর প্রথমবারের মতো নিজ ভূখণ্ড থেকে সরাসরি হামলা চালায় ইরান। কয়েক দশক ধরে ইরান হুমকি দিয়ে আসলেও এবারের সরাসরি হামলা যেমন আশ্চর্যজনক ঘটনা, তেমনই সেই আক্রমণ মোকাবিলায় ইসরাইলকে সাহায্য করতে মুসলিম প্রধান আরব দেশ জর্ডানের ভূমিকায় বিস্মিত সবাই। ইরানের ছোড়া তিন শতাধিক ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোনের অনেকগুলোই ইসরাইলের আকাশসীমায় প্রবেশ করার আগেই জর্ডান ধ্বংস করেছে। ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় হত্যাযজ্ঞ চালানো ইসরাইলের কঠোর নিন্দা ও সমালোচনা বরাবরই করে আসছে জর্ডান। তাই ইরানি আক্রমণ ঠেকাতে জর্ডানের ভূমিকা মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক গতিশীলতা বুঝতে একটি কেস স্টাডি হয়ে উঠেছে।

বিজ্ঞাপন

জর্ডানের বাদশাহ দ্বিতীয় আবদুল্লাহ ফিলিস্তিনিপন্থী সোচ্চার আরব নেতাদের মধ্যে অন্যতম। কিন্তু রোববার তার আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ও যুদ্ধবিমান ইসরাইলের পক্ষে লড়াই করেছে। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, জর্ডান ইসরাইলের বিরুদ্ধে বরাবর কথা বলে আসলেও বাস্তবে সামরিকভাবে দেশটি দুর্বল। জর্ডান একটি দরিদ্র দেশও। ফলে জর্ডানকে প্রতিবেশি, আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক খেলোয়াড়দের সঙ্গে একটি সূক্ষ্ম ভারসাম্যমূলক সম্পর্ক বজায় রাখতে হয়। বিশেষ করে শক্তিশালী প্রতিবেশির সঙ্গে যুদ্ধের কোনো ঝুঁকি নিতে পারে না জর্ডান।

অবশ্য জর্ডানের আনুষ্ঠানিক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, আম্মান তেল আবিবকে কোনো সাহায্য করেনি, বরং আত্মরক্ষার জন্যই আকাশ সীমায় প্রবেশ করা ইরানি ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র গুলি করে ভূপাতিত করা হয়েছে।

১৯৪৮ সালে আরব-ইসরাইল যুদ্ধের সময় জর্ডান অন্যান্য আরব দেশের সঙ্গে মিলে ফিলিস্তিন আক্রমণ করে। তখন ইহুদিবাদিরা ফিলিস্তিনের মধ্যে ইসরাইলি রাষ্ট্র ঘোষণা করায় এই যুদ্ধ শুরু হয়। যুদ্ধের পর পশ্চিম তীর ও ফিলিস্তিনের পূর্বাঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নেয় জর্ডান। ১৯৫০ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে অঞ্চলগুলোকে নিজের ভূসীমার সঙ্গে সংযুক্ত করে নেয় জর্ডান। দেশটির এমন পদক্ষেপের তীব্র সমালোচনা করে আন্তর্জাতিক মহল।

বিজ্ঞাপন

প্রায় ২০ বছর পর ফের মুখোমুখি হয় জর্ডান ও ইসরাইল। সেবার জর্ডান পরাজিত হয়। ফলে পশ্চিম তীর ও জেরুজালেম হাতছাড়া হয়ে যায়। অবশেষে ১৯৯৪ সালে ইসরাইলের সঙ্গে একটি শান্তি চুক্তি স্বাক্ষর করে জর্ডান। এর আগেই অবশ্য ১৯৯৩ সালে অসলো শান্তি চুক্তির মাধ্যমে ইয়াসির আরাফাতের নেতৃত্বে ইসরাইল ও প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গেনাইজেশনের মধ্যে শান্তি প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যায়।

শান্তি চুক্তি অনুযায়ী জর্ডান ও ইসরাইল তাদের সীমান্ত খুলে দেয়। এর পর থেকে জর্ডান ও ইসরাইল ভালো প্রতিবেশি হয়ে উঠে। আজ অবধি দুই দেশের যৌথ ৩০৯ কিলোমিটারের সীমানা ওই অঞ্চলে সবচেয়ে শান্ত একটি সীমানা। ইসরাইলের সামরিক বাহিনী এই সীমান্তে মাত্র তিনটি ব্যাটালিয়ন মোতায়েন করেছে। এমন একটি সামরিক উত্তেজনাপূর্ণ অঞ্চলের সীমান্ত মাত্র তিন ব্যাটালিয়ন মোতায়েনই বলে দেয় জর্ডাননিয়ে কোনো আশঙ্কা নেই ইসরাইলের।

জর্ডান-ইসরাইল সম্পর্ক

জিডিপির আকারে বিশ্বের ৮৯তম অর্থনীতির দেশ জর্ডান। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কারণে জর্ডান ও ইসরাইলের মধ্যে একটি চুক্তি হয়েছিল। এই চুক্তির ফলে ইসরাইলভিত্তিক কোম্পানিগুলো ব্যবহার করতে পারে এমন উপযুক্ত শিল্পাঞ্চল তৈরি হয়েছে জর্ডান। চুক্তি অনুযায়ী ইসরাইলি কোম্পানিগুলো জর্ডানে উৎপাদন করা পণ্য যুক্তরাষ্ট্রে শুল্কমুক্ত রফতানি করতে পারে। এসব শিল্পাঞ্চলে গত কয়েক বছরে ৩৬ হাজার কর্মসংস্থান হয়েছে। মাত্র এক কোটির বেশি জনসংখ্যার একটি দেশে এই কর্মসংস্থান উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন। জর্ডানের মাটিতে ইসরাইলি কোম্পানির জন্য শিল্পাঞ্চল বন্ধ করার দাবি করেন অনেকেই। কিন্তু এসব কোম্পানি কর্মসংস্থান সৃষ্টি করছে এমন যুক্তিতে কখনই শিল্পাঞ্চল ইসরাইলের জন্য বন্ধ করে না জর্ডান। এছাড়া ইসরাইলের সবচেয়ে শক্তিশালী মিত্র যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে বড় আকারের সাহায্য গ্রহণকারী দেশগুলোর অন্যতম জর্ডান।

বিজ্ঞাপন

তবে এ  ধরনের সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও গাজা ইস্যুতে ইসরাইলের কঠোর সমালোচক জর্ডান। গত ৭ অক্টোবর ইসরাইলে আকস্মিক হামলা চালায় ফিলিস্তিনের গাজাভিত্তিক সশস্ত্র সংগঠন হামাস। ইসরাইলের প্রায় ১২০০ মানুষকে হত্যা করে তারা। আরও প্রায় ২৪০ জনকে জিম্মি করে গাজায় নিয়ে যায় হামাস। হামাসের হামলার প্রতিক্রিয়ায় যুদ্ধ ঘোষণা করে ইসরাইল। ৭ অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া যুদ্ধে এ পর্যন্ত ৩৩ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনির মৃত্যু হয়েছে। অক্টোবরে হামলার পর ইসরাইলের পাল্টা হামলায় শুধু হামাস একা নয়, নির্দোষ ফিলিস্তিনিরাই শাস্তি পাচ্ছে বলে জর্ডানের বাদশাহ আবদুল্লাহ গাজায় ফিলিস্তিনিদের এমন সম্মিলিত শাস্তির নিন্দা করেছেন। জর্ডান ইসরাইলকে অভূতপূর্ব মানবিক বিপর্যয় তৈরি করার জন্য অভিযুক্ত করেছে। শুধু তাই নয়, তেল আবিব থেকে রাষ্ট্রদূতও প্রত্যাহার করেছে আম্মান।

জর্ডানের বাদশাহ গাজায় যুদ্ধবিরতির জন্য চাপ সৃষ্টি করে আসছেন। যুদ্ধবিরতিতে পশ্চিমা নেতাদের সমর্থন আদায়ের জন্য তিনি আবেদন জানিয়েছেন। ইসরাইলের সঙ্গে দৃঢ় বাণিজ্য সংযোগ থাকা সত্ত্বেও জর্ডানের এই রাজনৈতিক অবস্থান সেদেশের অর্থনৈতিক স্বার্থ এবং উল্লেখযোগ্য ফিলিস্তিনি জনসংখ্যার অনুভূতির ভারসাম্য বজায় রাখার একটি পথ।

ভারসাম্য নীতি

ইরানের হামলার আগেও বাদশাহ আবদুল্লাহ স্পষ্ট জানিয়েছিলেন, তিনি ইরাক, সিরিয়া এবং লেবাননের মতো ইরানিদের কোনো খেলা খেলতে দেবেন না। আরব মিডিয়া আউটলেট সঙ্গে একটি সাক্ষাৎকারে, বাদশাহ আবদুল্লাহ—ইরানের বিপ্লবী গার্ড কর্পস জর্ডানের বিরুদ্ধে ইরাকে ইরানপন্থী মিলিশিয়াদের যে নির্দেশ দিয়েছিল—সে বিষয়ে তার অসন্তোষ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, আঞ্চলিক সংঘাতে জড়িয়ে ইরাক ও সিরিয়া কী মূল্য দিয়েছে তা তিনি দেখেছেন। তাই তার দেশের সীমানার মধ্যে কোনো অস্থিতিশীলতা তিনি চান না।

বিজ্ঞাপন

ইরান যখন ইসরাইলের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নিতে ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন নিক্ষেপ করে, তখন বাদশাহ আবদুল্লাহ দ্রুত প্রতিক্রিয়ার জন্য তার সামরিক ও গোয়েন্দাদের সঙ্গে কাজ করছিলেন। ইসরাইলকে লক্ষ্য করে ছুঁড়া ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংসের জন্য জর্ডানি যুদ্ধবিমান আকাশে উড়াল দেয়। পরে ইসরাইল জানিয়েছিল, ইরানের ছোড়া ৯৯ শতাংশ ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র গুলি করে ধ্বংস করা হয়েছে। এর উল্লেখযোগ্য অংশ ধ্বংস করা হয়েছে ইসরাইলের আকাশে পৌঁছানোর আগেই।

সিএনএন-এর সঙ্গে আলাপে জর্ডানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আয়মান সাফাদি বলেছেন, এখন তার দেশের প্রধান মনোযোগ হচ্ছে পরিস্থিতির উত্তেজনা কমিয়ে আনা এবং সেদিকে প্রথম পদক্ষেপ হলো গাজায় আগ্রাসন এবং পশ্চিম তীরে অবৈধ পদক্ষেপ বন্ধ করা। তিনি বলেন, একমাত্র গাজায় অবৈধ পদক্ষেপ বন্ধের মাধ্যমে স্থায়ী শান্তির পথে যাত্রা শুরু করা সম্ভব হবে।

ইসরাইলকে লক্ষ্য করে ইরানের ছোড়া ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্রে বাধা দেওয়ার ব্যাপারে তিনি বলেন, আমরা ফায়ারিং রেঞ্জের মধ্যে আছি। জর্ডানে যে কোনো ক্ষেপণাস্ত্র বা প্রজেক্টাইল পড়ে গেলে ক্ষতি হবে। তাই আমাদের প্রতিরক্ষার জন্য যা করতে হয়েছে তাই করেছি। আমি খুব স্পষ্ট করে বলছি, ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্রগুলো ইসরাইল বা ইরান— যেখান থেকেই আমাদের আকাশ সীমায় আসুক না কেন, আমরা বাধা দেব।

তবে আম্মানের এমন ব্যাখ্যায় সন্তুষ্ট হচ্ছেন না ইসরাইলবিরোধীরা। ইসরাইলের বিরুদ্ধে ইরানের ছোড়া মিসাইল ধ্বংসে জর্ডানের যুদ্ধবিমানের তৎপরতা সবাইকে বেশ অবাক করেছে। তবে বাস্তবতা হলো, আম্মানের এমন ভূমিকাকে নিছক কূটনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে সমালোচনায় বিদ্ধ করা যুক্তিযুক্তও হবে না। আম্মান রাজনৈতিক অবস্থানের চেয়ে দেশের নিরাপত্তার বিষয়টিকে সত্যিকার অর্থেই বেশি প্রাধান্য দিয়েছে।

এই পদক্ষেপটির কারণে জর্ডানের বাদশাহ আবদুল্লাহ আরব বিশ্বে তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ইসরাইলি সামরিক ইউনিফর্মে বাদশাহর একটি মিম ভাইরাল হয়েছে।

সারাবাংলা/আইই

Tags: , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন