বিজ্ঞাপন

গরমজনিত রোগব্যাধি বাড়ছে, হাসপাতালে চাপ

April 17, 2024 | 10:17 pm

ইমরান চৌধুরী, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট

চট্টগ্রাম ব্যুরো: তীব্র তাপপ্রবাহে নাভিশ্বাস তৈরি হয়েছে জনজীবনে। অতিরিক্ত গরমে নানা রোগব্যাধিতেও আক্রান্ত হচ্ছে বন্দরনগরী চট্টগ্রামের বিভিন্ন বয়সী লোকজন। বিশেষ করে শিশুদের মধ্যে আক্রান্তের সংখ্যা বেশি। তাতে চট্টগ্রামের হাসপাতালগুলোতে বেড়েছে রোগীর চাপ। সর্দি, জ্বর-কাশি, শ্বাসকষ্ট, নিউমোনিয়া, চর্মরোগ ও ডায়রিয়ার উপসর্গ নিয়ে হাসপাতালে আসছে দূর-দূরান্তের মানুষ। হাসপাতালের বহির্বিভাগেও রোগীর দীর্ঘসারি দেখা গেছে।

বিজ্ঞাপন

চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, তীব্র গরমে শরীর থেকে প্রচুর লবণ ও পানি বের হয়ে যায়। অতিরিক্ত তাপপ্রবাহের কারণে শিশুদের শরীর থেকে প্রচুর ঘাম বের হয়ে পানিশূন্যতা তৈরি হচ্ছে। এ ছাড়া অতিরিক্ত গরমে টাইফয়েড, পানিবাহিত হেপাটাইটিস বা জন্ডিসের প্রবণতাও বাড়ছে। হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীদের বেশিরভাগই চার থেকে পাঁচ বছর বা তারও কম এবং ৬০ বছরের বেশি বয়সি।

পতেঙ্গা আবহাওয়া অধিদফতরের তথ্যানুযায়ী, বুধবার (১৭ এপ্রিল) চট্টগ্রামে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৩৪ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস, যা স্বাভাবিকের চেয়ে প্রায় ২ দশমিক ৬ ডিগ্রি বেশি।

পতেঙ্গা আবহাওয়া অফিসের পূর্বাভাস কর্মকর্তা জহিরুল ইসলাম সারাবাংলাকে জানান, পরবর্তী ২৪ ঘণ্টাতেও চট্টগ্রামের আবহাওয়ার সামান্য পরিবর্তন হতে পারে। আকাশ আংশিক মেঘলাসহ অস্থায়ীভাবে মেঘাচ্ছন্ন থাকতে পারে। সেই সঙ্গে কিছু জায়গায় বৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা আছে। বৃষ্টির পরিমাণ বাড়লে তাপমাত্র কমে যাবে।

বিজ্ঞাপন

চমেক হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ডে শয্যার বিপরীতে শিশুর সংখ্যা বেশি। ফলে শয্যায় থাকতে হচ্ছে একাধিক শিশুকে। অনেককে থাকতে হচ্ছে মেঝেতেও। ছবি: শ্যামল নন্দী/ সারাবাংলা

বুধবার দুপুরে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতাল এবং আগ্রাবাদ মা ও শিশু হাসপাতালে দেখা যায়, চমেকে হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ড রোগীর ভিড়ে ঠাসা। স্থান সংকুলান না হওয়ায় একেকটি শয্যায় দুই-তিনজন করে শিশুকে রেখেও চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। আবার মেঝেতেও বিছানা পেতে রাখা হয়েছে আক্রান্ত শিশুদের।

একদিকে অসুস্থতায় কাতরাচ্ছে এসব শিশু, তার ওপর ঘনঘন লোডশেডিং বাড়তি যন্ত্রণা হয়ে দেখা দিয়েছে। দুপুর ১২টা থেকে ১টা পর্যন্ত এক ঘণ্টায় চমেক হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ডে অন্তত ছয়বার বিদ্যুৎ যেতে দেখা গেছে। এ সময় প্রচণ্ড গরমে শিশু ও তাদের অভিভাবকদের হাঁসফাস করতে দেখা গেছে।

সাতকানিয়া উপজেলার চুনতি ইউনিয়ন থেকে ডায়রিয়া আক্রান্ত চার বছর বয়সী মেয়েকে নিয়ে রোববার (১৪ এপ্রিল) চমেক হাসপাতালে এসেছিলেন জাহানারা বেগম। তিন দিন ধরে মেয়ে রোকসানাকে নিয়ে হাসপাতালে থাকলেও এখনো কোনো উন্নতি হয়নি। ডাক্তার আরও সাত দিন হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে নির্দেশ দিয়েছেন।

বিজ্ঞাপন

জাহানারা বেগম সারাবাংলাকে বলেন, ‘দুই মেয়ের মধ্যে রোকসানা ছোট। বড় মেয়ের বয়স ১২ বছর। তিন দিন ধরে মেয়েকে নিয়ে হাসপাতালে আছি। আমার শাশুড়িও আমার সঙ্গে আছেন। স্বামী চাকরি করায় আসতে পারেন না। মেয়ে অনেক দুর্বল হয়ে গেছে। কথা বলতে পারছে না। ডাক্তার আরও সাত দিন থাকতে বলেছে। এরপরও উন্নতি না হলে মেয়েকে ঢাকায় বা চট্টগ্রামের ভালো কোনো প্রাইভেট হাসপাতালে ভর্তি করাব।’

একই শয্যায় চিকিৎসা নিচ্ছিল ডায়রিয়ায় আক্রান্ত সাত বছর বয়সী শিশু আবদুল ওয়াহাব। দুই দিন আগে ভর্তি হলেও সিট না পাওয়ায় মেঝেতে জায়গা হয়েছিল ওয়াহাবের। আজ (বুধবার) সকালে এক শিশু সুস্থ হয়ে সিট ছেড়ে দিলেই বেডে জায়গা পেয়েছে।

ডায়রিয়া, নিউমোনিয়াসহ চর্মরোগে আক্রান্ত রোগী বেশি আসছে হাসপাতালগুলোতে। ছবি: শ্যামল নন্দী/ সারাবাংলা

ওয়াহাবের বাবা আবদুল মালেক সারাবাংলাকে বলেন, ‘রোববার সকাল থেকে ছেলের পাতলা পায়খানা শুরু হয়। স্যালাইন খাওয়ানোর পরেও থামছিল না। ২৪ ঘণ্টাতেও অবস্থার উন্নতি না হলে মেডিকেলে চলে আসি। এখানে পর্যাপ্ত সিট না থাকায় প্রথমে মেঝেতে দুই দিন কাটাতে হয়েছে। আজ (বুধবার) সকালে একটি বেডে জায়গা হয়েছে। তাও আরেকজনের সঙ্গে ভাগাভাগি করতে হচ্ছে।’

চমেক হাসপাতালের শিশু স্বাস্থ্য বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ডা. এ কে এম রেজাউল করিম জানান, মঙ্গলবার (১৬ এপ্রিল) পর্যন্ত শিশু স্বাস্থ্য বিভাগের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের ৭০টি শয্যার বিপরীতে রোগী ভর্তি ছিলেন ১৬৪ জন। এদের বেশির ভাগই ডায়রিয়া, নিউমোনিয়া ও খিঁচুনি রোগী। এ ছাড়া একই বিভাগের অধীনে আট নম্বর ওয়ার্ডে ২০ শয্যার বিপরীতে রোগী ছিলেন ৪০ জন। আর আইসিইউতে ভর্তি আছেন ১০ জন।

বিজ্ঞাপন

ডা. রেজাউল সারাবাংলাকে বলেন, ‘গরমের সময় শিশুরা বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকে। কারণ তাদের শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম। আমাদের ওয়ার্ডে বেশ কয়দিন ধরেই রোগীর চাপ বেড়েছে। আমরাও সর্ব্বোচ্চটা দিয়ে সবাইকে সেবা দেওয়ার চেষ্টা করছি।’

শিশু ওয়ার্ডের দায়িত্বে থাকা ডা. ফারহানা জেরিন সারাবাংলাকে জানান, হাসপাতালের সব শয্যাতেই রোগী রয়েছে। নতুন কোনো রোগী ভর্তি করা যাচ্ছে না। অধিকাংশ রোগীই ডায়রিয়া ও নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত। বুধবার সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত ৩০টি নতুন শিশু ভর্তি হয়েছে। এদের মধ্যে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত ১৪ জন, থ্যালেসামিয়া ৯ জন, নিউমোনিয়া ছয়জন ও শ্বাসকষ্ট নিয়ে ভর্তি হয়েছে একজন।

জানতে চাইলে চমেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার শামীম আহসান সারাবাংলাকে বলেন, এক সপ্তাহ ধরে অনেক গরম পড়ছে। শিশু ও বৃদ্ধদের অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তির হার বেশি। হাসপাতালে চাপও বেড়েছে। শিশু ওয়ার্ডে স্বাভাবিক সময়েও চাপ থাকে। সবসময় সবাইকে সিট দেওয়া যায় না। এখন চাপ একটু বেশি। সবচেয়ে বেশি ডায়রিয়া ও নিউমোনিয়ার রোগী।

চিকিৎসকরা এই সময়ে শিশুদের প্রতি বাড়তি যত্ন নেওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন। ছবি: শ্যামল নন্দী/ সারাবাংলা

চমেক হাসপাতালের মেডিসিন ওয়ার্ডেও গত ২৪ ঘণ্টায় ভর্তি হওয়া ৪০ রোগীর মধ্যেই ২৮ জনই ডায়রিয়ায় আক্রান্ত। ওয়ার্ডের বাইরেও রোগীদের সেবা নিতে দেখা গেছে।

স্বাভাবিক পরিমাণের চেয়ে বেশি শিশু রোগী ভর্তি আছে চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতালেও। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, মঙ্গলবার রাত পর্যন্ত ২৬২টি শিশু বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে এ হাসপাতালে ভর্তি হয়ে আছে।

আর চট্টগ্রাম জেলা সিভিল সার্জনের কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, মঙ্গলবার চট্টগ্রামে ১৬২ জন ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এর মধ্যে মীরসরাইয়ে ১৯ জন, সীতাকুন্ডে ১৬ জন, সন্দ্বীপে আটজন, ফটিকছড়িতে ১৪ জন, হাটহাজারীতে সাতজন, রাঙ্গুনিয়ায় ১২ জন, বোয়ালখালীতে ১৫ জন, আনোয়ারায় ১৩ জন, পটিয়ায় ১৬ জন, বাঁশখালীতে ১৯ জন, কর্ণফুলীতে দুজন, চন্দনাইশে ১১ জন, সাতকানিয়ায় ছয় ও লোহাগাড়ায় চারজন ডায়রিয়ায় আক্রান্ত ছিলেন, যার মধ্যে ১২৫ জন সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে গেছেন।

জেলা সিভিল সার্জন ইলিয়াছ চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, ‘অতিরিক্ত গরম পড়ায় অনেকেই ফ্রিজ থেকে ঠান্ডা পানি বের করে খেয়ে নেন। আবার রাস্তার খোলা খাবার, পানি, শরবত ও কেটে রাখা ফলও খান। এসব থেকে বিরত থাকতে হবে। কারণ দূষিত খাবার ও পানি থেকেই জন্ডিস, টাইফয়েড, ডায়রিয়া আর হেপাটাইটিসের মতো রোগ ছড়ায়। গরমে ডায়রিয়া থেকে বাঁচতে সাধারণ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। খাবার আগে, টয়লেটে যাওয়ার পরে হাত ভালো করে সাবান দিয়ে ধুতে হবে।’

এদিকে হাসপাতালে ঘন ঘন বিদ্যুৎ বিভ্রাটের কারণে বহির্বিভাগে আসা রোগীদের গরম ও অন্ধকারের মধ্যেই সেবা নিতে হচ্ছে। বুধবার (১৭ এপ্রিল) খোদ পরিচালকের রুমেই প্রায় আধা ঘণ্টা বিদ্যুৎ ছিল না।

এদিকে হাসপাতালগুলোতে বারবার লোডশেডিংয়ে আরও বেশি নাকাল হচ্ছে শিশু রোগী ও তাদের অভিভাবকরা। ছবি: শ্যামল নন্দী/ সারাবাংলা

পরিচালক শামীম আহসান বলেন, ‘নতুন ভবনে ইউপিএস ও জেনারেটর একটু সমস্যা করছে। তাই বিদ্যুৎ চলে গেলে লোড নিতে পারছে না। তাই একটু সমস্যা হচ্ছে। তবে মূল ভবনে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ দেওয়া হচ্ছে। কারণ হাসপাতালের ৮০ শতাংশ রোগীই সেখানে।’

বেড়েছে চর্মরোগীর সংখ্যা

তীব্র গরমে চমেক হাসপাতালে চর্মরোগীর সংখ্যাও বেড়েছে। এর বেশির ভাগই ছত্রাকজনিত রোগে আক্রান্ত। সরেজমিনে দেখা যায়, চর্ম ও যৌন রোগ বিভাগে রোগীদের ভিড় লেগে আছে।

জানতে চাইলে চমেক হাসপাতালের চর্ম ও যৌন রোগ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. শেখ মো. ফয়সাল সারাবাংলাকে বলেন, ‘অন্য স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় গরমের সময় কমপক্ষে ৩০ শতাংশ চর্মরোগী বেশি থাকে। অতিরিক্ত গরমে মানুষের শরীরে ঘাম বেশি হয়। ঘামের সঙ্গে শরীর থেকে খারাপ বা বর্জ্য পদার্থ বের হয়ে আসে। এগুলো দীর্ঘ সময় চামড়ার ওপর জমে থাকলে নানা ধরনের সমস্যা তৈরি হয়।’

‘বেশি ঘেমে গেলে আমাদের সাবান অথবা শ্যাম্পু দিয়ে গোসল করে শরীরকে শুষ্ক রাখতে হবে। তা না হলে ব্যাকটেরিয়া বা ছত্রাকজাতীয় চর্মরোগের সংক্রমণ ঘটতে পারে,’— বলেন শেখ মো.ফয়সাল।

সারাবাংলা/আইসি/টিআর

Tags: , , , , , , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন