বিজ্ঞাপন

নির্বাচনে অংশ নিতে না দেওয়া কতটা গণতান্ত্রিক, কতটুকু নৈতিক?

April 18, 2024 | 3:06 pm

পলাশ আহসান

উপজেলা নির্বাচন নিয়ে হঠাৎই ভোল পাল্টালো বিএনপি ও জামায়াত। মনোনয়ন জমা দেওয়ার পর নেতা-কর্মীরা জানতে পারলেন, নির্বাচন করা যাবে না। বাধা না দেয়ার সিদ্ধান্ত এত দিন ছিল না। বিএনপি বলেছিল ব্যক্তিগতভাবে কেউ নির্বাচন করলে তাতে বলার কিছু নেই। জামায়াত বলেছিল, কেন্দ্রীয়ভাবে তারা কাউকে নির্বাচনে উৎসাহ দেবে না। উপজেলা নির্বাচন নিয়ে স্থানীয়ভাবে নেতা-কর্মীরা সিদ্ধান্ত নেবেন। পরে তারা কেন্দ্রীয়ভাবে সিদ্ধান্ত দিলেন, উপজেলা নির্বাচন করা যাবে না। অবশ্য সেটা না হয় নাই বললাম যে, যাদের নিবন্ধনই নেই তাদের আর কেন্দ্র কী? কারণ দেশের মানুষ জানে, তাদের একটা দল আছে, কাঠামো আছে, কর্মী আছে, সুতরাং সিদ্ধান্তও আছে। তাই যে কোনোভাবেই হোক সেটা চাপিয়ে দেয়ার ক্ষমতাও আছে।

বিজ্ঞাপন

১৫০ উপজেলা নির্বাচনে শুধু চেয়ারম্যান পদেই ৭০ জনের মতো বিএনপি জামায়াত নেতা মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। এরা প্রত্যেকেই দলের বিভিন্ন সাংগঠনিক শাখার প্রথম সারির নেতা। এখন তাদের দল সিদ্ধান্ত নিয়েছে, প্রথমে ব্যক্তিগতভাবে মনোনয়ন প্রত্যাহারের অনুরোধ করা হবে। না শুনলে তার বিরুদ্ধে দলীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে। এখন প্রথম প্রশ্ন হচ্ছে, এরকম সিদ্ধান্ত কতটা গণতান্ত্রিক? দ্বিতীয় প্রশ্ন- এরকম সিদ্ধান্তে লাভ কার? তৃতীয় প্রশ্ন- তৃণমূলে যিনি বিএনপির রাজনীতি করেন, তিনি আর কতদিন জনবিচ্ছিন্ন থাকবেন? চতুর্থ প্রশ্ন- এর পর কোনো সময় যখন ভোট চাওয়ার দরকার হবে, তখন ভোটাররা তাদের চিনবে তো?

প্রথমেই এমন সিদ্ধান্ত গণতান্ত্রিক কী না প্রশ্ন তুলছি। প্রথমত উপজেলা নির্বাচন কখনই দলীয় নির্বাচন ছিল না। এই নির্বাচনে দলের প্রতীক ব্যবহার করা যায় মাত্র। কিন্তু এই নির্বাচনী দর্শনে প্রতীক খুব একটা মুখ্য নয়। যে কারণে এবার আওয়ামী লীগ দলীয় প্রতীক ব্যবহার না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু জাতীয় পার্টির দলীয় প্রতীক লাঙ্গল ব্যবহার করবেন বহু প্রার্থী। চাইলে বিএনপিও ধানের শীষ প্রতীকটিকে ব্যবহার করতে দিতে পারতো প্রার্থীদের। এখানে প্রার্থী মুখ্য। সেই প্রার্থী নির্বাচিত হলে তার দলীয় কোনো কাজ নেই। কোনো দর্শন বাস্তবায়নের এজেন্ডা নেই। আছে শুধু আক্ষরিক অর্থেই কাজ। উপজেলায় নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাজ মূলত এলাকার প্রতিটি মানুষের জীবন মান সহজ ও উন্নত করা।

তাই একজন মানুষ যদি চান তিনি দলমত নির্বিশেষে তার নিজের এলাকার মানুষের জন্যে কাজ করবেন, তাকে নির্বাচন করতে না বলাটা খুবই অগণতান্ত্রিক। কারণ একজন মানুষ নিজের এলাকা উন্নত করতে চান বলেই নেতৃত্বে আসতে চান। তিনি একদিকে যেমন নেতৃত্বে আসতে চান অন্যদিকে একটি বিশেষ দর্শনও প্রতিষ্ঠা করতে চান। দর্শন প্রতিষ্ঠার জন্যে তাকে আইনপ্রণেতা বা সংসদ সদস্য হতে হয়, আর এলাকার মানুষের উন্নয়নে তাকে স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধি হতে হয়। একেকজনের কাছে একেকটা গুরুত্বপূর্ণ হয়। কিন্তু দুটো একসঙ্গে করতে পারেন না।

বিজ্ঞাপন

সাধারণত স্থানীয় সরকারের কঠোর পরীক্ষায় যিনি জনপ্রিয় হন, পরে তিনি আইনপ্রণেতা হতে চান। স্থানীয় সরকার হচ্ছে তার যোগ্যতা প্রমাণের সুযোগ। ব্যক্তিগত অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি বা অন্যকোনো কাজে না গিয়ে একজন মানুষ এলাকার মানুষের জন্যে সারাজীবন ধাপে ধাপে কাজ করতে চান। এর জন্যে তাকে সারা জীবন ধরে নানা ছাড় দিতে হয়। যেটা শুরু হয় সেই ছাত্রজীবন থেকে। এক পর্যায়ে তার সামনে পরীক্ষা আসতে থাকে, সেই পরীক্ষায় বসতে বাধা দেয়াটা আমার কাছে রীতিমত মানবাধিকার লংঘন মনে হয়। অনেকে বলেন ব্যক্তির চেয়ে দল বড়। কোনো সন্দেহ নেই। যে নির্বাচনে দল বা দর্শন বড় সেখানে দল আগে। কিন্তু যেখানে কোনো দর্শনের প্রশ্ন নেই সেখানে কেন এই শিবের গীত?

আসি দ্বিতীয় প্রশ্নে। কেন স্থানীয় নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত? এতে কার লাভ? তৃণমূলের কর্মীদের কোনো লাভ কী আছে? জাতীয় নির্বাচন বয়কটের যে সিদ্ধান্ত তা কখনই আমার অগণতান্ত্রিক মনে হয়নি। কারণ এতে ক্ষতিগ্রস্ত হন এলাকার রাজনীতিকরা। বহু এলাকায় এমন সব নেতা আছেন যারা দলমতের ঊর্ধ্বে উঠে ভোট পান। নির্বাচনে না গেলে তো আর ভোট পাওয়ার সুযোগ নেই। এতে ওই এলাকা যোগ্য মানুষের হাত থেকে ছুটে যায়। প্রার্থী না থাকার সুযোগে অযোগ্যরা নেতৃত্বে চলে আসেন। মোদ্দা কথা নির্বাচন বর্জন করলে ক্ষতি হয় তৃণমূলের। তাহলে কেন্দ্রে কোন লাভ হয়? আমি ঠিক জানি না। আপাত দৃষ্টিতে হওয়ার কথা নয়। কারণ দলে নেতৃত্ব সৃষ্টির পথ বন্ধ হলে ক্ষতিই হওয়ার কথা।

তৃতীয় প্রশ্ন করেছিলাম- বিএনপির তৃণমূলে যিনি রাজনীতি করছেন তিনি তো ক্রমশ জনবিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছেন। আর কতকাল বিচ্ছিন্ন থাকবেন? আমরা যদি ভোটের অর্থে হিসাব করি, দেখবো ভোট দেওয়া মানুষের অভ্যাস এবং একটি পরিচিত ধারাক্রম। এই অভ্যাস এবং ধারাক্রমে সংযোজন বিয়োজন হয়। কিন্তু ভোটার প্রার্থী সবাই ভোট নিয়ে একটি চক্রের মধ্যে ঘোরাফেরা করেন। বিষয়টা অনেকটা এরকম যে, কোন এলাকায় কারা ভোট দেবে, কারা কোন নির্বাচন করবে এর ৮০ভাগ মোটামুটি নিশ্চিত। আজকে যারা বিএনপি ও জামায়াতের সঙ্গে যুক্ত তারাও আছেন সেই চক্রে। কিন্তু দিনের পর দিন যখন নানা অজুহাতে ভোটে অংশ নিচ্ছেন না তারা কিন্তু অলক্ষ্যেই নির্বাচনী চক্র বিচ্ছিন্ন হচ্ছেন। এটা অবশ্য কেন্দ্রের রাজনীতিতে যারা থাকেন তারা ঢাকায় এসে বেমালুম ভুলে যান। যে কারণে নির্বাচনে অংশ নিতে না পেরে এর আগেও অনেকে ক্ষোভ জানিয়েছেন। কেউ রাজনীতি থেকে সরে গিয়ে অন্যান্য কাজে যুক্ত হয়েছেন।

বিজ্ঞাপন

চতুর্থ প্রশ্ন- এত বর্জন বর্জন করার পর বিএনপি জামায়াত নেতারা আবার কখনও যেতে পারবেন ভোটারদের কাছে? ভোটাররা যদি জিজ্ঞেস করেন আপনারা এতদিন কোথায় ছিলেন? কী বলবেন? কিংবা যদি চিনতেই না পারেন? যদি প্রশ্ন করেন আপনি যেন কে? সেদিন শুধু আওয়ামী লীগকে গালাগালি করে কী পার পাওয়া যাবে? বিএনপি বা জামায়াত কেউই তো এখনও সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের কথা বলেনি। আমরা তো এখন বলতেই পারি নির্বাচন ছাড়া আমাদের দেশে ক্ষমতার যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তাহলে নির্বাচনী অভ্যাস না থাকলে আজ যারা টানা নির্বাচন বর্জন করছেন তারা কীভাবে নির্বাচনে ফিরবেন? অবশ্য যদি নির্বাচন ছাড়া ক্ষমতা বদলের অন্য কোনো পথের কথা বিএনপি-জামায়াত ভেবে থাকে, সেটা ভিন্ন কথা। সেটা সম্ভব কী না তা নিয়ে কিছু বলতে চাই না, বলতে চাই সেটা আর যাই হোক গণতান্ত্রিক কিংবা নৈতিক হবে কী।

লেখক: গণমাধ্যমকর্মী

প্রিয় পাঠক, লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই ঠিকানায় -
sarabangla.muktomot@gmail.com

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত মতামত ও লেখার দায় লেখকের একান্তই নিজস্ব, এর সাথে সারাবাংলার সম্পাদকীয় নীতিমালা সম্পর্কিত নয়। সারাবাংলা ডটনেট সকল মতাদর্শের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তবে মুক্তমতে প্রকাশিত লেখার দায় সারাবাংলার নয়।

সারাবাংলা/আইই

Tags: ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন