বিজ্ঞাপন

উপজেলায় প্রার্থী হতে পারবেন না মন্ত্রী-এমপির সন্তান-স্বজনরা

April 18, 2024 | 6:58 pm

নৃপেন রায়, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা: স্বতন্ত্র মডেলে এবার আসন্ন উপজেলা পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এতে নিজ নিজ এলাকায় রাজনৈতিক বলয় নিজেদের কব্জায় রাখতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন আওয়ামী লীগের কিছু সংসদ সদস্যসহ মন্ত্রীরা। দলের হাইকমান্ড উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে কাউকে সমর্থন না দেওয়ার নির্দেশনা দিলেও এসবে কর্ণপাত করছেন না তারা।

বিজ্ঞাপন

কোনো কোনো সরকারদলীয় সংসদ সদস্যরা তাদের স্ত্রী, সন্তান ও আত্মীয়-স্বজনদের উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার নেপথ্যে কলকাঠি নাড়ছেন। নিজ দলের প্রভাবশালীদের এমন হস্তক্ষেপে এরইমধ্যে তৃণমূলে নানামুখী বিশৃঙ্খরা দেখা দিচ্ছে। তাই দলীয় হাইকমান্ড দলের এমন মন্ত্রী–সংসদ সদস্যদের নিজ পরিবারের সদস্য ও আত্মীয়-স্বজনদের উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদে ভোট করা থেকে নিরুৎসাহিত করার কৌশল নিয়েছে। অনেক মন্ত্রী বা সংসদ সদস্যকে দলের হাইকমান্ড যোগাযোগ করে এমন প্রার্থীদের প্রার্থিতা প্রত্যাহার বা নিরুৎসাহিত করার নির্দেশনা দেওয়া শুরু হয়েছে।

দলীয় সূত্র জানা গেছে— এরইমধ্যে প্রায় দলের আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর দুইজন সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী এবং একজন প্রভাবশালী সংসদ সদস্যকে দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক নেতারা যোগাযোগ করে তাদের সন্তান বা নিকটাত্মীয়দের প্রার্থিতা থেকে সরে দাঁড়ানোর নির্দেশ দিয়েছে। আজ থেকে দলটির দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদকেরা নিজ নিজ বিভাগের মন্ত্রী–সংসদ সদস্যদের দলের এ নির্দেশ জানাতে শুরু করেছেন।

দলীয় সূত্র জানায়, এরইমধ্যে প্রায় অর্ধশতাধিক দলীয় ও দলীয় স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ দলের হাইকমান্ডের কাছে জমা পড়েছে। অভিযোগগুলো খতিয়ে দেখা শুরু হয়েছে। কেউ কেন্দ্রীয় নির্দেশনা অমান্য করলে তাদেরকে শোকজ, সতর্কতা, তলবসহ বর্তমান দলীয় পদ থেকে বহিষ্কার করার চিন্তাভাবনা রয়েছে দলের হাইকমান্ডের।

বিজ্ঞাপন

আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক হুইপ আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন সারাবাংলাকে বলেন, ‘উপজেলা নির্বাচন অবাধ, নিরপেক্ষ ও উৎসবমুখর করার স্বার্থে মাননীয় মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যগণকে নিজ পরিবারের সদস্যদের প্রার্থী না হওয়ার জন্য অনুরোধ করা হয়েছে।’

এবার চার পর্বে দেশের ৪৮১ টি উপজেলা নির্বাচন হচ্ছে। আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী দলের প্রাথমিক সদস্য পদ থেকে বহিষ্কার না করলে সংসদ সদস্য পদ বহাল থাকবে। মন্ত্রী-সংসদ সদস্যদের স্বজনরা প্রার্থী হওয়া দোষের কিছু নয়। তবে স্বজনদের সমর্থন দেওয়া সাংগঠনিক সিদ্ধান্তবিরোধী। প্রথম ধাপের ভোট গ্রহণ হবে আগামী ৮ মে। এরইমধ্যে প্রথম ধাপে ১৫২টি ও দ্বিতীয় ধাপে দেশের ১৬১টি উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের তপসিল ঘোষণা করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। ২১ মে দ্বিতীয় ধাপের ভোট গ্রহণ হবে।

টানা চতুর্থ মেয়াদে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। তাই দীর্ঘদিন ধরে জেলা-উপজেলার আওয়ামী লীগের কমিটিতে গুরুত্বপূর্ণ পদগুলো নিজেদের পরিবারের দখলে রাখার চেষ্টার পাশাপাশি এবার সরকারদলীয় প্রভাবশালীদের চোখ পড়েছে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে। উপজেলায় একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন তারা। এমনকি স্বজনদের জিতিয়ে নিয়ে আসতে নানামুখী কৌশল অবলম্বন শুরু হয়েছে। এতে তৃণমূলের সাংগঠনিক শৃংখলা ভেঙে পড়তে শুরু হয়েছে। এদের মধ্যে কিছু স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যও রয়েছেন, যারা আওয়ামী লীগের পদধারী নেতা। এতে তৃণমূল আওয়ামী লীগে চরম ক্ষোভ বিরাজ করছে।

বিজ্ঞাপন

প্রসঙ্গত, ২০১৫ সালে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের আইন সংশোধন করে চেয়ারম্যান পদে দলীয় প্রতীকে প্রার্থী দেওয়ার বিধান যুক্ত করা হয়। ২০১৭ সালে প্রথমবারের মতো দলীয় প্রতীকে স্থানীয় সরকারের এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এখনো আইনে দলীয় প্রতীকে নির্বাচনের বিধান আছে। কিন্তু জাতীয় নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি দলীয়ভাবে নির্বাচন বর্জনের ধারাবাহিকতায় স্থানীয় নির্বাচনও বর্জনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তাই নির্বাচনকে প্রতিযোগিতামূলক করতে ক্ষমতাসীনেরা দলীয় প্রতীকে প্রার্থী না দিয়ে উন্মুক্ত প্রার্থীতার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এতে এবার নির্বাচন হতে হচ্ছে অনেকটা আওয়ামী লীগ বনাম আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের মধ্যে।

বিএনপি ৭ জানুয়ারির জাতীয় নির্বাচন বর্জন করায় ওই নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক দেখাতে দলের নেতাদের স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে উৎসাহ দিয়েছিল আওয়ামী লীগ। তখন সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হওয়া নিয়ে আওয়ামী লীগের তৃণমূলে বিরোধ তৈরি হয়েছিল। এর মাস তিনেকের মাথায় উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে সংসদ সদস্য ও মন্ত্রীদের পছন্দের ব্যক্তিদের প্রার্থী করা নিয়ে দলীয় বিরোধ আরও বেড়ে যাচ্ছে। যার রেশ এরইমধ্যে বিভিন্ন উপজেলায় শুরু হয়েছে।

এদিকে নোয়াখালীর সুবর্ণচরে নিজের ছেলেকে ভোট না দিলে উন্নয়ন কাজ না করার হুমকি দিয়েছেন স্থানীয় সংসদ সদস্য একরামুল করিম চৌধুরী। নাটোরে লুৎফুল হাবিবের বিরুদ্ধে প্রতিপক্ষ প্রার্থীকে অপহরণের অভিযোগ উঠেছে।

আওয়ামী লীগের দলীয় সূত্র বলছে— এসব খবরসহ নানা বিভেদের তথ্য দলের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃষ্টিগোচর হলে তিনি ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। এরপর দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরকে উপজেলা নির্বাচনে মন্ত্রী–সংসদ সদস্যদের সন্তান, পরিবারের সদস্য বা আত্মীয় স্বজনদের ভোট থেকে সরে দাঁড়ানোর নির্দেশনা দেন।

বিজ্ঞাপন

সে ধারাবাহিকতায় দলের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বৃহস্পতিবার দুপুরে ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার রাজনৈতিক কার্যালয়ে অনানুষ্ঠানিক বৈঠক করেন। বৈঠকে দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক, দপ্তর সম্পাদকসহ কয়েকজন সম্পাদক উপস্থিত ছিলেন।

এই সময় ওবায়দুল কাদের সাংগঠনিক সম্পাদক ও দপ্তরকে সারা দেশে মন্ত্রী–সংসদ সদস্যদের মধ্যে যাদের স্বজন ও পরিবারের সদস্য নির্বাচন করছেন, সেই তালিকা তৈরির নির্দেশ দেন। ওই সময় তাৎক্ষণিকভাবে মাদারীপুর সদরের সংসদ সদস্য ও দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য শাজাহান খান, সাবেক কৃষিমন্ত্রী ড, আবদুর রাজ্জাক এবং নোয়াখালীর একরামুল করিম চৌধুরীকে ফোন করে দলীয় সিদ্ধান্তের কথা জানান দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক।

আওয়ামী লীগের একজন দায়িত্বশীল নেতারা জানান, বিএনপিবিহীন নির্বাচনে দলের নেতাদের দাবির মুখে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় প্রতীক উন্মুক্ত রাখা হয়। যাতে সবার অংশগ্রহণে প্রভাবমুক্ত একটি অবাধ নিরপেক্ষ সুষ্ঠ নির্বাচন হয়। কিন্তু কোথাও কোথাও দেখা যাচ্ছে, মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যরা নিজের সন্তান, পরিবারের সদস্য ও নিকটাত্মীয়দের প্রার্থী করে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছেন। আমাদের দলীয় নেত্রী এবিষয়ে প্রভাবমুক্ত নির্বাচন করার নির্দেশনা দিয়েছেন।

আওয়ামী লীগ সূত্রে জানা গেছে, আগামী ২ মে সংসদের আগামী অধিবেশন বসছে। ওই অধিবেশনে আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলের বৈঠক ডাকা হতে পারে। ওই বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী নিজ দলের সংসদ সদস্যদের উপজেলা নির্বাচন বিষয়ে তার অবস্থান স্পষ্ট করে নির্দেশনা প্রদান করতে পারেন। এ ছাড়া শিগগিরই আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদেরও বৈঠক হতে পারে। সেখানেও বিষয়টি আলোচিত হবে।

এদিকে বৃহস্পতিবার দলের দফতর সম্পাদক ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়া স্বাক্ষরিত গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে দলের সাধারণ সম্পাদক বলেন, ‘বিএনপি নির্বাচন বিরোধী অবস্থান নেওয়ায় ভিন্ন প্রেক্ষাপটে আওয়ামী লীগকেও কৌশলগত অবস্থান গ্রহণ করতে হয়েছে। তাই বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এবার দলীয় প্রতীক বরাদ্দ দিচ্ছে না। দল ও দলের বাইরে জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি যেন নির্বাচিত হন সেটিই আওয়ামী লীগ প্রত্যাশা করে। উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে মন্ত্রী, এমপি ও দলীয় নেতারা যেন কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ করতে না পারে সেজন্য বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে কঠোর সাংগঠনিক নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে বলেও দাবি করা হয় বিবৃতিতে।

এতে আরও বলা হয়— প্রথম ধাপের নির্বাচন উপলক্ষে সারাদেশে প্রার্থীদের ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা এবং জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ পরিলক্ষিত হচ্ছে। দেশের জনগণ যখন নির্বাচনে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করছে বিএনপি নেতারা তখন বরাবরের ন্যায় দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার পাঁয়তারা চালাচ্ছে। বিএনপি নির্বাচনি ব্যবস্থাকে বাধাগ্রস্ত ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে ধ্বংস করতে চায়।

বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ নির্বাচনি ব্যবস্থা ও গণতন্ত্রকে সুসংহত করতে নিরন্তন সংগ্রাম চালিয়ে আসছে। আমরা বিএনপির গণতন্ত্রবিরোধী অপতৎপরতা সম্পর্কে সকলকে সচেতন ও সতর্ক থাকার জন্য অনুরোধ জানাচ্ছি। একই সঙ্গে অবাধ-সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠানে নির্বাচন কমিশনকে সর্বাত্মক সহযোগিতা প্রদানের জন্য সংগঠনের নেতাকর্মীদের প্রতিও অনুরোধ জানান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।

সারাবাংলা/এনআর/একে

Tags: , , , , , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন