বিজ্ঞাপন

আইসিটি খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে কর অব্যাহতির ঘোষণা এখনই দেওয়া উচিত

April 29, 2024 | 10:44 am

দেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (বেসিস) নির্বাচন আগামী ৮ মে। এই নির্বাচনে এবার ১১ পদে প্রার্থী ৩৩ জন। ‘টিম স্মার্ট’, ‘ওয়ান টিম’ ও ‘টিম সাকসেস’ নামের তিন প্যানেল থেকে প্রার্থীরা নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন। নির্বাচন সামনে রেখে প্যানেল ও প্রার্থীরা বিভিন্ন প্রতিশ্রুতি দিয়ে আসছেন। নির্বাচনের আগে বারবার উঠে আসছে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে কর অব্যাহতি বহাল রাখার দাবি। একই দাবির প্রতি সহমত পোষণ করছেন বেসিসের সাবেক সভাপতি সৈয়দ আলমাস কবীর।

বিজ্ঞাপন

সারাবাংলার সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে আলমাস কবীর বলছেন, দেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাত এখন নানা সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে কর অব্যাহতির ঘটনা এখনই আসা উচিত। সাক্ষাৎকারে খোলামেলা আলাপে উঠে এসেছে এই খাতের অন্য আরও সব বিষয়ও। সারাবাংলার পক্ষ থেকে সাক্ষাৎকার নিয়েছেন তথ্যপ্রযুক্তি খাতের আরেক উদ্যোক্তা ফিরোজ মুহাম্মাদ জাহিদুর রহমান। সাক্ষাৎকারের চুম্বক অংশ তুলে ধরা হলো পাঠকদের জন্য।

সারাবাংলা: দেশের আইসিটি শিল্প খাত এখন কী অবস্থায় আছে? এই খাতের ভবিষ্যত সম্ভাবনা কী?

আলমাস কবীর: দেশের আইসিটি খাতের যাত্রা শুরু গত শতকের আশির দশকের শেষ ভাগে। পরে নব্বইয়ের দশকে আমরা সফটওয়্যার নিয়ে কাজ শুরু করি। বেসিসের শুরুটাও তখনই, ২৭ বছর আগে। এই সময়ে আমরা অনেক কিছুতে এগিয়েছি। আবার হওয়ার মতো এমন অনেক কিছু ছিল, যা হয়নি। আমরা এখন দেড় বিলিয়ন ডলারের মতো রফতানি করছি। স্থানীয় বাজারও প্রায় দেড় বিলিয়ন ডলারের মতো, যদিও অনেক বিদেশি সফটওয়্যার আসছে। রফতানি বা দেশীয় বাজার আরও বড় হওয়ার কথা ছিল। কয়েকটি কারণে হয়নি। এর প্রধান কারণ, দক্ষ মানবসম্পদের ঘাটতি। আমাদের প্রযুক্তি জ্ঞানসমৃদ্ধ লোকজন হয়তো নেতৃত্বে নেই। সত্যিকার অর্থে প্রযুক্তি জেনেবুঝে কাজ করেন, এমন মানুষ হয়তো নেতৃত্বে আসছে না। ফলে আমরা যে গতিতে এগুতে চাইছি, সেটি পারছি না।

বিজ্ঞাপন

এর আরেকটি কারণ, আমাদের দক্ষ জনবল নেই। এটি তৈরির জন্য যে আমরা পদক্ষেপ নেব, সেটিও কিন্তু আমরা করিনি। শুধু আইসিটির ক্ষেত্রে যে এমন, তা নয়। প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই একই অবস্থা। জাতীয় পর্যায়েও দক্ষ জনবল গড়ে তুলতে আমরা পর্যাপ্ত পদক্ষেপ নিইনি। এটি আরও ২০ বছর আগে করা উচিত ছিল। ২০ বছর আগে যদি আমরা করতাম, তার সুফল এখন আমরা নিতে পারতাম। ভারত সেটা করেছে। ষাটের দশকে তারা আইআইটি করেছে। তার সুফল তারা ২০০০ সালে নিয়েছে। এই কাজগুলো আমরা করতে পারিনি। কোনো সময় নষ্ট না করে স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে সেই পদক্ষেপ যদি এখনো নিতে না পারি, তাহলে কিন্তু আমরা কিছুই করতে পারব না।

বেসিস নির্বাচনে প্যানেল পদ্ধতি ব্যক্তিগতভাবে পছন্দ করেন না বলে জানিয়েছেন সৈয়দ আলমাস কবীর। ছবি: সুমিত আহমেদ/ সারাবাংলা

সারাবাংলা: সামনে বেসিস নির্বাচন। নির্বাচনে প্যানেল, ফটোশুট ও প্রচার খুব বেশি হয়ে যাচ্ছে কি না?

আলমাস কবীর: ফটোশুট ও ডিজিটাল মার্কেটিং হচ্ছে, নানা রকম প্রমোশনাল ভিডিও হচ্ছে। যেহেতু প্রযুক্তি এখন খুব সুলভ, এগুলো করাটা সহজ হয়ে গেছে। ১০/১৫ বছর আগে আমরা যখন নির্বাচন করেছি, তখন আমরা ফটোশুট করেছি। কিন্তু এত ডিজিটাল মার্কেটিং করতে পারিনি। প্রযুক্তি এত হাতে হাতে ছিল না। এখন প্রযুক্তি সুলভ বলেই সেগুলো হচ্ছে।

বিজ্ঞাপন

তবে এখানে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো প্যানেল। ব্যক্তিগতভাবে আমি প্যানেল পদ্ধতির বিপক্ষে। আমি এটা পছন্দ করি না। তার প্রধান কারণ, যখনই প্যানেল হয়ে যায়, দেখা যায় দুটি বা তিনটি প্যানেল— যে ভেদাভেদ বা রেষারেষি হয়, সেটা নির্বাচনের পরেও রয়ে যায়। মুখে যতই বলি না কেন নির্বাচনের পরে সবাই এক, প্রকৃতপক্ষে সেটি হয় না। মনের মধ্যে দলাদলির ব্যাপারটা রয়ে যায়। এ কারণে প্যানেল পদ্ধতির বিপক্ষে আমি।

এমন যদি হতো, সভাপতি, সহসভাপতি ও পরিচালক পদে আলাদা আলাদা নির্বাচন, তাহলে হয়তো প্যানেল হতো না। আবার প্যানেলের পক্ষেও কিন্তু যুক্তি আছে। আমি যদি একই রকম মানুষদের সঙ্গে বোর্ড গঠন করতে না পারি, তাহলে সেই বোর্ড রান করবে না। কারণ আমার চিন্তাধারা একরকম, আরেকজনের চিন্তাধারা আরেকরকম। তারপরও আমার মনে হয়, এই যে দলাদলি-রেষারেষি, প্যানেল পদ্ধতিতে এটি আরও বেড়ে যায়।

সারাবাংলা: বেসিসে নেতৃত্ব কেমন হওয়া দরকার?

আলমাস কবীর: যে বা যারা নেতৃত্বে থাকবে, তাদের কিন্তু এই খাতের লোক হতে হবে। এই শিল্পে প্রত্যক্ষ সংযোগ থঅকতে হবে। না হলে কিন্তু তিনি সমস্যাগুলো বুঝতে পারবেন না, অনুভব করতে পারবেন না। সমস্যা যাদের হচ্ছে, তাদের যে কষ্ট হচ্ছে, কষ্টটা অনুভব করতে পারবেন না। তাই সেই নেতৃত্ব প্রয়োজন, যে নেতৃত্ব এই খাতকে ভেতর থেকে জানে। আমাদের প্রযুক্তি জানা মানুষ যেমন প্রয়োজন, তেমনি ভালো ব্যবস্থাপনা বুঝে নেতৃত্ব দিতে পারে, তেমন মানুষও প্রয়োজন। বেসিসে সামনে যারা আসবে, ভবিষ্যতে যারা আসবে তারা এভাবেই চিন্তাভাবনা করবে, এটাই প্রত্যাশা। ভোটাররাও যাদের ভোট দেবেন, তারা নেতৃত্বের গুণাবলি চিন্তাভাবনা করে যেন ভোট দেন।

বিজ্ঞাপন

আইসিটি খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে এখনই কর অব্যাহতির ঘোষণা দেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন বেসিসের সাবেক এই সভাপতি। ছবি: সুমিত আহমেদ/ সারাবাংলা

সারাবাংলা: ট্যাক্স, ক্যাশ ইনসেটিভ, বিদেশি সফটওয়্যারের ওপর আরোপিত ট্যাক্স— এ বিষয়গুলো কীভাবে দেখেন? কী হওয়া উচিত?

আলমাস কবীর: কিছু বিদেশি সফটওয়্যার আছে, যা আমাদের প্রয়োজন। ধরুন, মাইক্রোসফট উইন্ডোজ। এই অপারেটিং সিস্টেম তো আমরা এখানে তৈরি করছি না। উইন্ডোজ আসতে হবে। আমার যে ডেভেলপমেন্ট টুলস— ওয়ার্ড, এক্সেল— এগুলো তো আমি এখানে তৈরি করছি না। এগুলোর ওপর যদি খুব উচ্চ কর বসিয়ে রাখি, তাহলে আমি কিছু কাজ করতে পারব না। কিছু বিদেশি সফটওয়্যার অছে, যেগুলোকে আমাদের স্বাগত জানাতে হবে। কিন্তু যেগুলো বাংলাদেশে তৈরি হচ্ছে, যেমন— ইআরপি স্টিস্টেম বা অ্যাকাউন্টিং সিস্টেম, এগুলো ট্যাক্স ফ্রি রাখার দরকার নেই। এগুলো আমদানিতে কিছুটা কর বসানো যেতে পারে।

সারাবাংলা: সামনে আমাদের কর অব্যাহতি উঠে যাওয়ার কথা। প্রণোদনাও কমছে। সবাই এটি নিয়ে কথা বলছে…

আলমাস কবীর: সামনের জুনের পর থেকে আমাদের করপোরেট কর দিতে শুরু করতে হবে। কোম্পানিগুলোর ওপর ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ করের বোঝা চাপানো হবে। আমি কখনো বলিনি বা বলতে চাই না যে আইসিটি ইন্ড্রাস্ট্রি কখনো ট্যাক্স দেবে না। তবে আমি মনে করি, করপোরেট কর দেওয়ার সময় এখনো আসেনি। করোনা মহামারি ও করোনা পরবর্তী সময়ে আমাদের অনেক কোম্পানি বন্ধ হয়ে গেছে। আইসিটি খাতের কোম্পানিগুলো সবেমাত্র ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে, ঘুরে দাঁড়াচ্ছে কোম্পানিগুলো। এই সময়ে যদি আবার ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ করের বোঝা আসে, তখন আইসিটি খাতের অগ্রযাত্রা হোঁচট খাবে।

২০২১ সাল থেকেই আমরা এই কথা বলতে শুরু করি। আমরা তখন বলেছিলাম, আমাদের ১০ বছরের একটি সময় দেওয়া হোক, ২০৩১ সাল পর্যন্ত কর অব্যাহতি দেওয়া হোক। তাহলে কোম্পানিগুলো ভালো করে ঘুরে দাঁড়াতে পারবে।

আমাদের এই শিল্পে বড় সমস্যা হচ্ছে বিনিয়োগ। বাইরে থেকে বিনিয়োগ আসে না। দেশি ও বিদেশি বিনিয়োগকারীরা যখন দেখবে আমি ১০ বছরের একটি ট্যাক্স হলিডে পাচ্ছি, তখন কিন্তু তারা বাংলাদেশের আইসিটি খাতে বিনিয়োগ করতে ঝুঁকবে। বিনিয়োগ বাড়লে ইন্ড্রাস্ট্রির আকার বাড়বে। তখন এই খাতে কর্মসংস্থানও বাড়বে। আমি মনে করি, ২০৩১ সাল পর্যন্ত আইসিটি খাতে কর অব্যাহতি দেওয়া উচিত এবং এটার ঘোষণা এখনই দেওয়া উচিত। এক বছর পর পর ‘আরও এক বছরের জন্য বাড়ানো’র ঘোষণা দিলে হবে না। আমাকে দীর্ঘমেয়াদি চিন্তা করে এখনই ২০৩১ সাল পর্যন্ত কর অব্যাহতির ঘোষণা দিতে হবে।

একইভাবে ২০২৫ সালের মধ্যে আমাদের ৫ বিলিয়ন ডলারের রফতানির লক্ষ্য রয়েছে। করোনার সময় কিন্তু রফতানি প্রায় বন্ধ ছিল। ফলে লক্ষ্য পূরণে আমরা বলেছিলাম, প্রণোদনা ১০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ বা ২০ শতাংশ করা হোক, সেটিও কেবল দুই থেকে তিন বছরের জন্য। কিন্তু দেখা গেল, ১০ শতাংশ থেকে কমিয়ে প্রণোদনা ৮ শতাংশ করে দেওয়া হয়েছে। বাড়ানো তো হলোই না, বরং প্রণোদনা কমিয়ে দেওয়া হলো। ২০২৬ সালের পর থেকে বা এলডিসি থেকে উত্তরণ ঘটলে এমনিতেও আর প্রণোদনা দেওয়া যাবে না। এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের আগ পর্যন্ত আইসিটি ইন্ড্রাস্ট্রিকে যতটা এগিয়ে নেওয়া যায়, ততটা এগিয়ে নেওয়া দরকার। এখন থেকেই যদি ঘোষণা দিয়ে দেওয়া হয়, ২০২৬-এর পর আর প্রণোদনা হবেই না, আইএমএফ আমাকে এটা করতে দেবে না, তখন কিন্তু সবাই বুঝতে পারবে যে যা করার ২০২৫ সালের মধ্যেই করতে হবে। সেভাবে যদি একবার খুব বেশি এগিয়ে যাই, তাহলে সেই গতিতেই চলতে থাকব। আমি মনে করি, ২০২৫ পর্যন্ত আইসিটি খাতের রফতানি প্রণোদনা তো কমনোই উচিত না, বরং ১০ শতাংশ থেকে বাড়ানো উচিত।

সারাবাংলা: বেসিস নির্বাচন সামনে রেখে যদি আর কিছু বলতে চান…

আলমাস কবীর: সামনে বেসিস নির্বাচন। নতুন নেতৃত্ব আসবে। ওই যে ‘ভেদাভেদ ভুলে’— এই ব্যাপারটি খুব গুরুত্বপূর্ণ। যারা আসবে তাদের যেন ৩৬০ ডিগ্রি একটি অভিজ্ঞতা থাকে, অথবা এক্সপোজার থাকে। এর বাইরে যদি কেউ নেতৃত্বে আসে, তাহলে সে কিন্তু সবার সমস্যা বুঝতে পারবে না এবং সমস্যা নিয়ে কাজও করতে পারবে না। ভোটাররা ভোট দেওয়ার সময় খেয়াল রাখবেন, কেউ একজন ম্যানেজম্যান্টে ভালো বা মার্কেটিংয়ে ভালো, শুধু সেটা হলে কিন্তু হবে না। তাকে প্রযুক্তির মানুষ হতে হবে; একইসঙ্গে মার্কেটিং বুঝতে হবে, ম্যানেজম্যান্ট বুঝতে হবে, ফ্যাইন্যান্স বুঝতে হবে। এ রকম নেতৃত্ব যাদের থাকবে, তাদেরই ভোট দেওয়া উচিত। তাহলেই বেসিসে সঠিক নেতৃত্ব আসবে।

সারাবাংলা: সারাবাংলাকে সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।

আলমাস কবীর: সারাবাংলাকেও ধন্যবাদ।

সারাবাংলা/ইএইচটি/টিআর

Tags: , , , , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন