বিজ্ঞাপন

সত্যজিৎ রায়ের ‘দেবী’ এবং এই ধর্মান্ধ সময়ের সংলাপ

May 2, 2024 | 5:01 pm

আসাদ জামান

১৯ ফেব্রুয়ারি, ১৯৬০ সালে মুক্তি পায় সত্যজিৎ রায়ের ‘দেবী’। প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের লেখা ছোটগল্প ‘দেবী’ অবলম্বনে নির্মিত হয় সিনেমাটি। ধর্মীয় গোঁড়ামি এবং ধর্মান্ধতা এই ছবির পশ্চাৎপট অথবা তারও বেশি কিছু। সেই সময় ত্রিশূল হাতে উগ্র হিন্দু সম্প্রদায় রীতিমত যুদ্ধ ঘোষণা করে সত্যজিতের বিরুদ্ধে। সিনেমাটি যদি আজ নির্মিত হত তাহলে কি বর্তমান ধর্মান্ধ বিজেপি সরকার মুক্তি দিতে দিত? সত্যজিৎ কি মাথা নিয়ে বাড়ি ফিরতে পারতেন? কিংবা বর্তমান সুশীল বাংলাদেশ রাষ্ট্রযন্ত্রের সময়েও কি দেবী বাংলাদেশে সার্ভাইভ করতে পারত? আশা করতে পারি না, কেননা ১৯৬০ এর যে ধর্মীয় উগ্রবাদ তা দক্ষিণ এশিয়ার প্রায় প্রতিটি দেশেই বাতাসের সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে কয়েকগুণ।

বিজ্ঞাপন

দেবী নিয়ে তৎকালীন এক পত্রিকা শিরোনাম করে “সময়ের গণশত্রু”। ছবির প্রেক্ষাপট বাংলাদেশের একটি জমিদার পরিবার আর এমন এক সময় যখন আমাদের ঐতিহ্যে যা কিছু অন্ধকার তাকে উনিশ শতকীয় আধুনিকতার আলোতে দেখা হচ্ছে। মধ্যযুগীয় সামন্ততান্ত্রিক-পুরুষপ্রধান সমাজে নবজাগরণের আলো এসে পড়ছে।

সিনেমার পর্দায় গ্রামের জমিদার কালীকিঙ্কর। ক্ষয়িষ্ণু সামন্ততান্ত্রিক সমাজের প্রতিনিধি। তার ছোটো পুত্র উমাপ্রসাদ শিক্ষিত নব্য যুবক। কলকাতাতে ইংরেজি পড়ে। জমিদার-পুত্র হয়েও, শিক্ষা শেষে দেশের বাইরে ক্যারিয়ারের স্বপ্নে বিভোর। কালীকিঙ্করের পুত্রবধূ তথা উমাপ্রসাদের স্ত্রী দয়াময়ী এই কাহিনির কেন্দ্রে। এক রাতে কালীকিঙ্কর স্বপ্ন দেখেন, দয়াময়ী স্বয়ং দেবী কালীর অবতার। এই স্বপ্নকে ঐশ্বরিক ইঙ্গিত ভেবে তিনি দয়াময়ীর আরাধনা শুরু করেন। তার উপর দেবীত্ব আরোপ করেন।

ফ্রয়েড পাঠ কিঞ্চিৎ না থাকলেও না থাকলেও দর্শকদের বুঝতে সমস্যা হয়না জমিদার কালীকিঙ্করের কালীভক্তি এবং পুত্রবধূর প্রতি অপার স্নেহ─এই দুয়ের মিশেলেই তিনি দয়াময়ীকে দেবী কালী রূপে স্বপ্নে দেখেন।

বিজ্ঞাপন

শ্বশুরের কাণ্ডকারখানায় হতবিহ্বল দয়াময়ীর জীবন যেন খাঁচায় বন্দী বানরের পর্যায়ে নেমে আসে। স্বামী উমাপ্রসাদের দারস্থ হলে প্রতিবাদ হয়, বাবার বিদ্যের যুগ আর ছেলের বিদ্যের যুগ যেন আসমান জমিন ব্যবধান তা স্পষ্ট হয়।

উচ্চশিক্ষার আলো, রামমোহনের ভাবাদর্শ, থিয়েটারে নবজাগরণ, আধুনিকতা তার চিন্তাকে তার বাবার প্রতিস্পর্ধী অবস্থানে নিয়ে আসে। “দেবী’তে উমাপ্রসাদ এবং ‘সমাপ্তি’তে অমূল্য দুই আধুনিক বিদ্যার্থী শহর থেকে গ্রামে ফেরে বহমান নদীপথে। তাদের নৌকার পাল বাতাসে কেঁপে ওঠে। নতুন মূল্যবোধ জন্ম নেয়। বিমানের শব্দ যেন প্রকাশ করে আধুনিক কালের।

সিনেম্যাটিক ম্যাজিক হিসাবেই কাকতালীয়ভাবে এক মৃত্যুপথযাত্রী কিশোর দয়াময়ীর পা ধোঁয়া পানি পান করে বেঁচে উঠে। এবার কালীকিঙ্করের ভ্রান্ত বিশ্বাসের ছত্রাক দয়াময়ীর মধ্যেও সংক্রামিত হয়। দয়াময়ীর মস্তিষ্কে অবিরাম বৃষ্টির মত একটা প্রশ্নই ঝরতে থাকে “আমি যদি দেবী হই?”

বিজ্ঞাপন

সিনেমায় চরিত্রবিন্যাসে আমরা দয়াময়ীকে পাই পাখির মত উচ্ছ্বল আর প্রাণময় কিন্তু যখন ই তার উপর দেবীত্ব আরোপ হয়, সে হারিয়ে ফেলে তার সমস্ত সজীবতা, তার একান্ত নিজস্ব আলো।

অন্ধ বিশ্বাস দয়াময়ীকেও বন্দী করে ফেলে, ফাঁদে পড়া বিপর্যস্ত সাদা বকের মত বিশাল আসমানের নিচে ছন্দহীন হয়ে যায়। তাই তো আদরের খোকাকে দয়াময়ী তার দেবীত্ব দিয়েও বাঁচিয়ে তুলতে পারে না। মিথ্যে হয়ে যায় দয়াময়ীর দেবীত্ব। শোকে বিলীন দয়াময়ী শেষ সিনে কুয়াশায় ঢাকা নদীতে বিলীন হয়ে যায়। সত্যজিৎ রায়ের দেবী সিনেমায় এক দেবীর বিসর্জনে গল্প শুরু আর আরেক দেবীর বিসর্জনে গল্পের শেষ।

অনেকে ‘দেবী’র সমাপ্তিকে ওপেন অ্যান্ডেড মনে করেন। নানা জনের নানা মত। আমার মনে হয়, যুক্তি এবং ধর্মের সংঘাতে সত্যজিৎ মানুষের পক্ষ নিয়েছেন, জীবনের পাশে দাঁড়িয়েছেন।

দেবী সিনেমায় সত্যজিৎ প্রথমবারের মত বিদ্রোহী হয়ে ওঠেন।কোনো প্রত্যক্ষ সমালোচনা বা বিরুদ্ধতা ছাড়াই সত্যজিৎ দেখিয়ে দেন সেই বিশ্বাস বা দৈবীলীলার চেহারাটা, বুঝিয়ে দেন ধর্মের ভুল ব্যাখ্যা বা স্বার্থসিদ্ধিচক্রের স্রোত কীভাবে মানুষের বিচারবুদ্ধিকে পঙ্গু করে দেয়।

বিজ্ঞাপন

দেবী মুক্তির অর্ধ শতাব্দী পেরিয়ে গেলেও এই সময়ে, এই সমাজে, এই সমাজের মানুষের বর্তমান মানসিকতা আর অবস্থানের বিরুদ্ধে সিনেমাটি আরও বেশি প্রাসঙ্গিক এবং তাৎপর্যবহ। দেবী কোন এক অদ্ভুত কারণে সত্যজিৎ রায়ের অন্য সিনেমাগুলোর তুলনায় কম বাহবা পায় অথচ এই সিনেমাটি ব্যক্তি সত্যজিৎ আর চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ উভয়ের জীবনেই এক অসামান্য সাহস আর আদর্শের প্রতীক।

লেখক: স্বাধীন চলচ্চিত্র নির্মাতা ও লেখক

সারাবাংলা/এজেডএস

Tags:

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন