বিজ্ঞাপন

তাপে পুড়ল দেশ, ‘সুরক্ষার উপায়’ থাকল ফাইলবন্দি

May 2, 2024 | 11:50 pm

সৈকত ভৌমিক, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা: অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে ইতিহাসের উষ্ণতম এপ্রিল মাস কাটিয়েছে বাংলাদেশ। এই প্রথম দেশের ইতিহাসে এপ্রিলের প্রথম দিন থেকে শেষ দিন পর্যন্ত টানা বিরাজ করেছে তাপপ্রবাহ। মাসের শেষ দিনে যশোরে ৪৩ দশমিক ৮ ও চুয়াডাঙ্গায় ৪৩ দশমিক ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়, যা স্বাধীনতার পর দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা। কোনো কোনো জেলায় দুই-তিন দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ তাপমাত্রাও রেকর্ড করা হয়েছে। খোদ রাজধানী ঢাকায় গেল এপ্রিলের সর্বোচ্চ তাপমাত্রার গড় ছিল এর আগের সর্বোচ্চ তাপমাত্রার গড়ের চেয়ে ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি!

বিজ্ঞাপন

টানা তাপপ্রবাহ পরিস্থিতিতে সারা দেশ থেকে বেশ কয়েকজনের হিট স্ট্রোকে মৃত্যুর খবর এসেছে। হাসপাতালে হাসপাতালে বেড়েছে রোগী। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে একাধিক দফায় বাড়াতে হয়েছে ছুটি। অথচ এ রকম তীব্র তাপপ্রবাহ পরিস্থিতিতে করণীয়, সম্ভাব্য রোগ মোকাবিলার প্রস্তুতি, চিকিৎসা নির্দেশনা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য অনুসরণীয় নানা নির্দেশনা নিয়ে একটি জাতীয় গাইডলাইন প্রণয়ন করা হলেও সেটি পড়ে রয়েছে ফাইলবন্দি হয়ে! স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য অধিদফতর ও ইউনিসেফের যৌথ উদ্যোগে আরও আগেই প্রণীত ‘ন্যাশনাল গাইডলাইন অন হিট রিলেটেড ইলনেস’ শীর্ষক খসড়াটি আলোর মুখ দেখেনি উষ্ণতার রেকর্ড ছাড়ানো মাসটি পেরিয়ে গেলেও।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যেকোনো বিশেষ পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রয়োজন পরিকল্পনা। সেই পরিকল্পনা আগে থেকে করা না গেলে তা জনজীবনে দুর্ভোগ বয়ে আনে। এ বছর রেকর্ড ছাড়ানো তাপপ্রবাহ পরিস্থিতিতেও সেটিই দেখা গেছে। আর পরিকল্পনা করেও যদি সেটি বাস্তবায়নের উদ্যোগ না নেওয়া হয়, তার চেয়ে দুঃখজনক আর কিছুই হতে পারে না। তারপরও অন্তত মৌসুম শেষ হওয়ার আগে হলেও যেন এটি প্রকাশ পায়, সেই প্রত্যাশা করছেন তারা।

স্বাস্থ্য অধিদফতর বলছে, ‘ন্যাশনাল গাইডলাইন অন হিট রিলেটেড ইলনেস’ প্রস্তুত। তবে বাস্তবতা বিবেচনায় কিছু পরিবর্তন করা হচ্ছে। এরই মধ্যে চিকিৎসকদের মধ্যে এ সংক্রান্ত বার্তা পৌঁছানো হয়েছে। স্বাস্থ্যমন্ত্রীর সায় পেলে গাইডলাইন প্রকাশ করা হবে খুব দ্রুতই।

বিজ্ঞাপন

স্বাস্থ্যমন্ত্রীও বলছেন, এরই মধ্যে এই গাইডলাইন অনুযায়ী চিকিৎসকদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। গাইডলাইনের খসড়াটি প্রকাশ করে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

‘ন্যাশনাল গাইডলাইন অন হিট রিলেটেড ইলনেস’ কী?

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বৈশ্বিক উষ্ণতা বাড়ছেই। এর মধ্যে এশিয়ার দেশগুলো জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাবের ব্যাপক ঝুঁকিতে রয়েছে। ঝড়, বন্যা বা তাপপ্রবাহের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের পাশাপাশি রয়েছে স্বাস্থ্যগত ঝুঁকিও।

বিশ্ব ব্যাংক গ্রুপের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে ১৯০১ সাল থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত সময়ে শুষ্ক মৌসুম বলে পরিচিত এপ্রিল থেকে জুলাই মাসে বাংলাদেশে গড় তাপমাত্রা ছিল ২৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস, যা ৩৫ থেকে ৩৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বাড়ত। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশের পশ্চিম-দক্ষিণপশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোতে নিয়মিতই তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ঘর পেরিয়ে যাচ্ছে। সদ্য শেষ হওয়া এপ্রিলে চুয়াডাঙ্গা, যশোর ও পাবনা জেলায় নিয়মিতই বয়ে গেছে অতি তীব্র তাপপ্রবাহ, যেটি শুরু হয় তাপমাত্রা ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস পেরিয়ে গেলে। খুলনা, রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের অন্যান্য জেলায় এ মাসে নিয়মিতই তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি ছাড়িয়েছে।

বিজ্ঞাপন

এদিকে ২০২২ ও ২০২৩ সালে দুটি আলাদা গবেষণাপত্রে দেখা যায়, বাংলাদেশে ১৯৮৯ থেকে ২০১১ সালে অধিক তাপপ্রবাহ মাত্রার দিনগুলোতে ২২ শতাংশ বেশি মানুষের মৃত্যুবরণের ঘটনা ঘটেছে। শুধুমাত্র ২০০৩ সাল থেকে ২০০৭ সালে গরমের কারণে মৃত্যুহার বেড়েছে এক থেকে তিন শতাংশ। এর বাইরে এই উচ্চ তাপমাত্রার প্রভাব রয়েছে জনস্বাস্থ্যেও। কর্মদক্ষতা কমে যাওয়ার পাশাপাশি দেখা দিচ্ছে নানাবিধ স্বাস্থ্য সমস্যা। এমন অবস্থায় তীব্র তাপপ্রবাহে জনস্বাস্থ্যের ঝুঁকি বিবেচনায় নিয়ে পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য করণীয় নিয়েই তৈরি করা হয়েছে ‘ন্যাশনাল গাইডলাইন অন হিট রিলেটেড ইলনেস’। কেবল তাপপ্রবাহজনিত রোগ নয়, তাপপ্রবাহ ঘিরে জনস্বাস্থ্য ঝুঁকির প্রায় সব দিকই অন্তর্ভুক্ত রয়েছে এই গাইডলাইনে।

কী আছে এই গাইডলাইনে?

তাপপ্রবাহের মাত্রার ওপর ভিত্তি করে শিশু, গর্ভবতী, বয়স্ক ও অন্যান্য ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর কী কী ধরনের শারীরিক অসুস্থতা দেখা দিতে পারে, সেসব অসুস্থতা ও তা প্রতিরোধের পরিকল্পনা রয়েছে ন্যাশনাল গাইডলাইন অন হিট রিলেটেড ইলনেসে। তীব্র তাপপ্রবাহের সময় দেশের স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলোতে কীভাবে সেবা দেওয়া হবে, তার দিকনির্দেশনাও রয়েছে।

হজের সময় তীব্র গরমের হাত থেকে রক্ষা পেতে ও অসুস্থ রোগীকে সহযোগিতায় করণীয় সম্পর্কে এই গাইডলাইনে নির্দেশনা রয়েছে। তীব্র তাপপ্রবাহে শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর করণীয়ও তুলে ধরা হয়েছে। এ ছাড়াও রাজশাহী ও খুলনা বিভাগের বিভিন্ন জেলাসহ দেশের যেসব জেলার মানুষ তীব্র গরমের কারণে ঝুঁকিতে বসবাস করছেন, সেসব জেলায় স্বাস্থ্য-কৃষি-শিক্ষা বিভাগসহ সরকারের বিভিন্ন দফতর ও বেসরকারি সংস্থাগুলোকেও কীভাবে সচেতনতা তৈরিসহ নানা কাজে ব্যবহার করা যায়, সেগুলো গাইডলাইনে বিস্তারিত আকারে তুলে ধরা হয়েছে।

গাইডলাইন কেন জরুরি?

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও স্বাস্থ্য অধিদফতরের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ সারাবাংলাকে বলেন, স্বাস্থ্যসেবা সংশ্লিষ্ট যেকোনো বিষয়ে গাইডলাইন থাকা জরুরি। এতে কেবল স্বাস্থ্যসেবা সংশ্লিষ্টরাই নয়, বরং রোগীদের জন্যও নির্দেশনা দেওয়া থাকে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে পরিবেশগত প্রভাবের কারণে কী কী স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়তে পারে, তা নিয়ে আগে থেকেই জনসচেতনতা তৈরি জরুরি। পাশাপাশি হাসপাতালের ব্যবস্থাপনায় পূর্বপ্রস্তুতি নেওয়ার ক্ষেত্রেও গাইডলাইনের প্রয়োজনীয়তা অনেক।

বিজ্ঞাপন

এই জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের অভিমত, হেলথ ইমার্জেন্সির বিষয়টি অনেক সময়েই প্রাধান্য পায় না। অথচ অতি গরমে হিট স্ট্রোক কেন হচ্ছে, তার প্রতিকার কীভাবে করা যায়, সেটা থেকে বাঁচতে কী করা জরুরি— এগুলো নিয়ে নির্দেশনা সম্বলিত গাইডলাইন থাকা জরুরি। একটা গাইডলাইনে সবকিছু সবার জন্য প্রয়োজনীয় না। এ ক্ষেত্রে যাদের জন্য যতটুকু প্রয়োজন সেগুলো তাদের কাছে পৌঁছানোটা জরুরি। সেটার ওপর নির্ভর করে সংশ্লিষ্টরা যেন কাজ করতে পারেন।

ডা. বে-নজির আরও বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের নানা প্রভাব পড়ছে পরিবেশ-প্রতিবেশে। ডা. বে-নজির বলেন, এই প্রভাবের কথা সবাই যদি জেনে থাকে, তাহলে দেশের স্বাস্থ্য বিভাগ কেন জানবে না? কিন্তু আমাদের দেশে কোনো দূরবর্তী পরিকল্পনা নেওয়ার কথা স্বাস্থ্য বিভাগ ভাবে না, ভাবতেও পারে না। আর তাই গাইডলাইন প্রস্তুত হলেও সেটা আলোর মুখ দেখতে দেখতেই দেখা যায় মৌসুম শেষ হয়ে যাচ্ছে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সহযোগী অধ্যাপক ও গাইনি বিশেষজ্ঞ ডা. রেজাউল করিম কাজল সারাবাংলাকে বলেন, আবহাওয়াজনিত কারণে সেবাদাতা ও সেবা গ্রহীতা দুজনেরই নানা সমস্যা দেখা দিতে পারে। সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোতে পরিবেশ ঠিক রাখার বিষয়টা গুরুত্বপূর্ণ। ধরুন, একজন গর্ভবতী নারী চেকআপ করতে এসেছেন কড়া রোদ পেরিয়ে। তার জন্য বসার স্বস্তিপূর্ণ একটি স্থান নিশ্চিত করাটা জরুরি। রোগীর বসার জায়গা, পানি খাওয়ার ব্যবস্থাসহ গরমে জরুরি বিষয়গুলো স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে রোগীর কাছে নিশ্চিত করা জরুরি।

রোগীর কাছেও এ রকম তীব্র খরতাপে করণীয় সম্পর্কে স্বাস্থ্য-শিক্ষা সচেতনতামূলক বার্তা থাকা জরুরি বলে মনে করেন ডা. রেজাউল। তিনি বলেন, এই তীব্র গরমে রোগীরা কী করবের, সেই বিষয়ে তাদের জানানো জরুরি। গর্ভবতীদের নিজেদের এবং গর্ভের সন্তানের জন্যও এই সময়ে বাড়তি সতর্কতা নিতে হয়। পর্যাপ্ত পানি পান করা, অতিরিক্ত ঘেমে গেলে স্যালাইন খাওয়া, ফলের রস খাওয়া— এসব বিষয়ে কিন্তু সবাইকে সচেতন করে তোলা প্রয়োজন। হাসপাতালগুলোকেও গরমে বাড়তি কী সতর্কতা নিতে হবে, কী প্রস্তুতি নিতে হবে— সেটি নির্দেশনা আকারে থাকলে সবার জন্যই ভালো। এই গাইডলাইন থাকলে হাসপাতাল, চিকিৎসক, রোগী সবাই প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে পারে।

তাপপ্রবাহ পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্য সেবা প্রতিষ্ঠানের অবস্থা কী?

দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে প্রতিদিনই বাড়ছে রোগীর সংখ্যা। গত ২৯ এপ্রিল পর্যন্ত দেশে হিট স্ট্রোকে প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত ১০ জন। তীব্র তাপপ্রবাহের কারণে শ্বাসকষ্ট, সর্দি, ঠান্ডা, নিউমোনিয়া ও ডায়রিয়ায় আক্রান্ত বিভিন্ন বয়সী রোগী ভর্তি হচ্ছেন হাসপাতালে। প্রায় সব হাসপাতালেই শয্যার চেয়ে বেশি রোগী ভর্তি থাকায় সেবা দিতে হিমশিম খাচ্ছেন চিকিৎসকসহ সংশ্লিষ্টরা।

স্বাস্থ্য অধিদফতর জানিয়েছে, এরই মধ্যে দুই বিভাগে চিকিৎসক ও সংশ্লিষ্ট অন্যদের খসড়া ন্যাশনাল গাইডলাইন অনুযায়ী প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। ধীরে ধীরে সারা দেশেই এই প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। তবে ঢাকাসহ একাধিক বিভাগের স্বাস্থ্য খাতের সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তারা কোনো প্রশিক্ষণ পাননি।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পরিস্থিতি কী?

‘ন্যাশনাল গাইডলাইন অন হিট রিলেটেড ইলনেসে’ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নিয়েও নানা ধরনের দিকনির্দেশনা রয়েছে। তবে প্রকাশ না পাওয়ার কারণে সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোতে কোনো সমন্বিত পদক্ষেপ দেখা যায়নি।

চট্টগ্রাম সরকারি কলেজিয়েট উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজের প্রধান শিক্ষক মুহাম্মদ সিরাজুল ইসলাম সারাবাংলাকে জানিয়েছেন, গরমে কোনো শিক্ষার্থী অসুস্থ হয়ে পড়লে জরুরি চিকিৎসায় কী করণীয়, সে বিষয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা (মাউশি) বিভাগের কোনো নির্দেশনা নেই। তবে সর্বশেষ নির্দেশনায় স্কুল-কলেজ কর্তৃপক্ষকে শিক্ষার্থীদের প্রতি যত্নবান হওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। নির্দেশনা না থাকলেও মাউশি থেকে ক্লাস চলাকালীন সময়ে বারবার মনিটরিং করা হয়েছে।

সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের স্কুলেই প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থা আছে। রেড ক্রিসেন্টের টিম আছে। এরপরও কোনো শিক্ষার্থী গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে আশপাশে সিটি করপোরেশনের হাসপাতাল, ক্লিনিক, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, সরকারি জেনারেল হাসপাতাল আছে। যেহেতু শহরের স্কুল, দ্রুততম সময়ের মধ্যে হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হবে।’

নগরীর মোমিন রোডের কদম মোবারক সিটি করপোরেশন উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক টিংকু ভৌমিক সারাবাংলাকে বলেন, ‘মাউশির এ বিষয়ে নির্দেশনা নেই। তবে আমরা স্কুল খোলার কয়েকদিন আগে থেকে হোয়াটস অ্যাপ গ্রুপে অভিভাবকদের সচেতন করেছি। ছেলেদের স্কুলে পাঠানোর সময় ছাতা, বিশুদ্ধ পানি ও ঘরে তৈরি খাবার দিতে বলেছি। বাইরে যেন ছাত্ররা ঘোরাঘুরি না করে সেটা আমরা কঠোরভাবে মনিটরিং করছি। কেউ যদি বাসায় অসুস্থবোধ করে তাকে স্কুলে না পাঠাতে বলা হয়েছে। সে ক্ষেত্রে আমরা তার উপস্থিতির বিষয়টি স্যাক্রিফাইস করব।’

তিনি বলেন, ‘আমরা সিটি করপোরেশনের প্রতিষ্ঠানগুলো মাউশির নির্দেশনা অনুসরণ করি। মাউশি কোনো নির্দেশনা না দিলেও আমরা নিজস্ব উদ্যোগে দুজন শিক্ষকের তত্ত্বাবধানে রেড ক্রিসেন্টের একটি টিম রেডি রেখেছি। প্রচুর স্যালাইন আমরা মজুত রেখেছি। কেউ যদি গরমে ক্লান্ত বোধ করে কিংবা অন্য কোনো সমস্যা দেখা দেয়, প্রাথমিক চিকিৎসা আমরা দিতে পারব। এরপর কাছেই সরকারি জেনারেল হাসপাতাল। সেখানে আমরা নিয়ে যেতে পারব দ্রুত। আশা করি সমস্যা হবে না।’

সীতাকুণ্ডের সৈয়দপুর ইউনিয়নের শেখেরহাট উচ্চ বিদ্যালয়ের তিন ছাত্রী গত সপ্তাহে স্কুল চলাকালে অসুস্থ হয়ে পড়ে। প্রধান শিক্ষক আবু বকর সারাবাংলাকে বলেন, ‘মাউশির কোনো নির্দেশনা পাইনি। তবে খাবার পানি, ছাতা ও খাবার নিয়ে শিক্ষার্থীদের স্কুলে আসতে বলেছে মাউশি। আমার স্কুল একেবারে বাজারের পাশে। সেখানে সরকারি কমিউনিটি ক্লিনিক আছে। তাদের সঙ্গে আমাদের কথা হয়েছে। বাজারে এমবিবিএস ডাক্তার প্রাইভেট প্র্যাকটিস করেন। তাদের সঙ্গেও আমার কথা হয়েছে। কেউ যদি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন, আমাদের দুই-তিন মিনিট লাগবে সেখানে নিতে।’ গত সপ্তাহে অসুস্থ হয়ে পড়া তিন শিক্ষার্থীকে চিকিৎসকের কাছে নেওয়ার প্রয়োজন হয়নি বলে নেওয়া হয়নি— এমনটিই জানান এই প্রধান শিক্ষক।

এ রকম চিত্র সারা দেশেই। অথচ খসড় গাইডলাইনে এ সংক্রান্ত সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। তাতে বলা আছে, প্রতিটি স্কুলকে নিকটস্থ হাসপাতাল বা স্বাস্থ্য সেবাকেন্দ্রের সঙ্গে আগে থেকেই যোগাযোগ করে রাখতে হবে। সেই হাসপাতাল বা কেন্দ্রের সঙ্গে যোগাযোগের ঠিকানা-মোবাইল নম্বরও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন স্থানে দৃশ্যমানভাবে টাঙিয়ে রাখতে হবে। গাইডলাইনটি অনুমোদন ও বাস্তবায়ন হলে এ ধরনের পরিস্থিতিতে তা যথেষ্টই কাজের হতো বলে মন্তব্য শিক্ষক-অভিভাবকদের।

কী বলছে স্বাস্থ্য অধিদফতর?

ন্যাশনাল গাইডলাইনের খসড়া প্রণয়নের কাজে যুক্ত ছিলেন স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিকল্পনা ও গবেষণা বিভাগের কর্মকর্তা ডা. আব্দুল আলীম প্রধান। জানতে চাইলে তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা এরই মধ্যে সবকিছু চূড়ান্ত করেছি। খুব দ্রুতই সেটি প্রকাশ করা হবে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী সময় পেলেই আমরা গাইডলাইনটি উদ্বোধন করব।’

স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (পরিকল্পনা ও গবেষণা) অধ্যাপক ডা. মীরজাদি সেব্রিনা ফ্লোরা সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমি ফেব্রুয়ারি মাসে দায়িত্ব গ্রহণ করার পর দেশের তীব্র তাপপ্রবাহ বিবেচনা করে এই গাইডলাইনটি প্রস্তুত করার উদ্যোগ গ্রহণ করি। খসড়া প্রস্তুত হলেও কিছু সংযোজন-বিয়োজন করা হচ্ছে। প্রয়োজনীয়তার পাশাপাশি বাস্তবতার নিরিখে কিছু পরিবর্তন আনা হচ্ছে গাইডলাইনে। সে কারণেই কিছুটা দেরি হচ্ছে।’

খসড়া তৈরি হয়ে গেলেও উষ্ণতম মাস এপ্রিলে গাইডলাইন কেন চালু করা সম্ভব হলো না— এমন প্রশ্নের উত্তরে অধ্যাপক ডা. ফ্লোরা বলেন, এটা তো আর এক মৌসুমের জন্য করা হচ্ছে না। দীর্ঘমেয়াদে যেন দেশের উপকার হয়, সে বিবেচনাতেই গাইডলাইনটা প্রস্তুত করা হচ্ছে। দুই বিভাগের চিকিৎসকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। স্বাস্থ্যমন্ত্রীও নানা নির্দেশনা দিয়েছেন। সবকিছু ঠিকঠাক করে আশা করছি আগামী সপ্তাহে গাইডলাইনটি প্রকাশ করা যাবে।

কী বলছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী?

জানতে চাইলে স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেন সারাবাংলাকে বলেন, ন্যাশনাল গাইডলাইন অন হিট রিলেটেড ইলনেসের খসড়া প্রস্তুত করা হয়েছে। খুব দ্রুতই সেটি প্রকাশ করা হবে। তবে তার জন্য তো আর চিকিৎসাসেবা বন্ধ থাকবে না। সংশ্লিষ্ট সব কর্তৃপক্ষের পাশাপাশি চিকিৎসাকেন্দ্রগুলোকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়াও জনসচেতনতা বাড়াতেও কাজ করা হচ্ছে।

মন্ত্রী বলেন, তাপপ্রবাহ পরিস্থিতিতে সারা দেশের হাসপাতালের পরিচালক ও সিভিল সার্জনদের সঙ্গে ভার্চুয়াল সভা করা হয়েছে। হাসপাতালগুলো প্রতিকূল পরিবেশের জন্য প্রস্তুত রাখা হয়েছে। আমার কয়েকটা নির্দেশনা ছিল, তার মধ্যে একটা হলো— বয়স্ক ও শিশুরা প্রয়োজন ছাড়া যেন বাসার বাইরে না যায়। হাসপাতালগুলোতে কোনো কোল্ড কেস, অর্থাৎ এক মাস পর অপারেশন করলে অসুবিধা হয় না— এমন রোগীদের এখন ভর্তি না করতে বলেছি। ওরাল স্যালাইনেরও কোনো ঘটতি নেই। প্রকৃতির ওপর তো কারও হাত নেই। তাই সবাইকে প্রস্তুতি রাখার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়াও মহাখালীর ডিএনসিসি কোভিড হাসপাতালে শিশু ও বয়স্কদের জন্য আলাদা শয্যা রাখতে বলা হয়েছে।

গাইডলাইন কবে প্রকাশ পাবে— এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য জানতে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালকের সঙ্গে যোগাযোগের পরামর্শ দেন মন্ত্রী। তবে একাধিকবার চেষ্টা করেও স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এ বি এম খুরশীদ আলমের বক্তব্য পাওয়া সম্ভব হয়নি।

বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও স্বাস্থ্য অধিদফতরের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ বলেন, গাইডলাইন মন্ত্রীকে উদ্বোধন করতে হবে, এটা ঠিক না। আমার ধারণা, মন্ত্রীরাও এমনটি চান না। এটা আসলে এক ধরনের তৈলমর্দন সিস্টেমের অংশ। তবে হ্যাঁ, যদি সংযোজন-বিয়োজনের বিষয় থাকে, সেক্ষেত্রেও পুরোটা প্রকাশ না করে প্রয়োজনীয় অংশগুলো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আকারে প্রকাশ করা যেতে পারে।

পূর্ণাঙ্গ গাইডলাইন প্রকাশে দেরি হলেও হিট স্ট্রোকের চিকিৎসা ও প্রতিরোধ কিংবা তাপপ্রবাহ থেকে গর্ভবতী নারী, শিশু ও ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর সুরক্ষার মতো জরুরি বিষয়গুলোকে সামনে আনা প্রয়োজন ছিল বলে অভিমত এই বিশেষজ্ঞের।

আরেক জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ আবু জামিল ফয়সাল সারাবাংলাকে বলেন, আমাদের দেশে পরিকল্পনা গ্রহণের জন্য প্রথমে সময়ক্ষেপণ করা হয়। এরপরে সেটা গ্রহণ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। এরপরে পরিকল্পনা করার জন্য সময় ক্ষেপণ করা হয়। আর যখন পরিকল্পনা প্রস্তুত করা হয়, তখন সেটা বাস্তবায়নের জন্য আরও সময় ক্ষেপণ করা হয়। ফলে দেখা যায় যে সময় যে পরিকল্পনা কার্যকর করা প্রয়োজন সেটা আর করা সম্ভব হয় নাই।

চলতি মৌসুমের তীব্র তাপপ্রবাহ মোকাবিলায় সরকারের প্রস্তুতিতে ঘাটতি ছিল বলে মনে করছেন আবু জামিল ফয়সাল। তিনি বলেন, এর অন্যতম কারণ সমন্বিত উদ্যোগের অভাব। গ্রীষ্ম মৌসুম শুরুর আগেই গাইডলাইন প্রকাশ নিশ্চিত করা প্রয়োজন ছিল। আমরা বলেছি, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও বলেছে। কিন্তু সংশ্লিষ্টদের কানে পৌঁছাতে পৌঁছাতে প্রাণহানি পর্যন্ত ঘটে গেছে। তবু স্বাস্থ্য বিভাগকে ধন্যবাদ দিতে হয়। কারণ তারা অন্তত একটা গাইডলাইন তৈরি করেছে।

গাইডলাইনটি দ্রুত প্রকাশ হবে আশাবাদ জানিয়ে এই জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ বলেন, স্বাস্থ্য বিভাগ তাদের ওয়েবসাইটে খসড়াটা প্রকাশ করে জনস্বাস্থ্যবিদদের মতামত নিতে পারত। কিন্তু এ ধরনের সংস্কৃতি তো আমাদের দেশে নেই। তাই এখন আমরা আশা করছি, রেকর্ড তাপমাত্রার এপ্রিল মাস চলে গেলেও অন্তত মৌসুম শেষ হওয়ার আগে যেন গাইডলাইনটা প্রকাশ করা হয়।

সারাবাংলা/এসবি/টিআর

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন