বিজ্ঞাপন

হাস শেষে মেল- এবার কোন চমক!

May 11, 2024 | 3:49 pm

মোস্তফা কামাল

যথানিয়মে যথামসয়ে চলে যাচ্ছেন ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাস। তার জায়গায় আসছেন ডেভিড স্লেটন মেল। মাইলাম, টমাস, হাস, মেল, মিলার, মজিনারা আসলে যান না, আসেন। একজনের জায়গায় আরেকজন আসেন। তাদের কাজ প্রায় অভিন্ন। কখনো কখনো যাত্রা যোগে এজেন্ডা বাড়ে-কমে মাত্র। পেশাদার-ক্যারিয়ারস্টি কূটনীতিক তারা সবাই। বলা হয়ে থাকে, তাদের মধ্য থেকে বাছাইকৃতদেরই বাংলাদেশে পাঠায় যুক্তরাষ্ট্র । এবার আসতে যাওয়া মেল কূটনীতির ময়দানে একজন চীনা বিশেষজ্ঞ। প্রেসিডেন্ট বাইডেন প্রশাসন একজন চীনা বিশেজ্ঞকে বাংলাদেশে রাষ্ট্রদূত মনোনীত করলেন- এ নিয়ে কূটনীতিক এবং রাজনীতিক মহলে নানা বিশ্লেষণ আছে। বিশেষ বিশেষ জায়গায় কথার খইও ফুটতে শুরু করেছে।

বিজ্ঞাপন

ডেভিড মেল, মন্ত্রী-কাউন্সেলর পদমর্যাদার সিনিয়র ফরেন সার্ভিসের একজন সদস্য। বর্তমানে আছেন চীনের বেইজিংয়ে মার্কিন দূতাবাসে ডেপুটি চিফ অফ মিশন হিসেবে। সেখানে অন্তর্বর্তীকালীন চার্জ ডি অ্যাফেয়ার্স হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। এই দায়িত্ব পালনের আগে, তিনি ছিলেন ডিপার্টমেন্টের ব্যুরো অফ ইকোনমিক অ্যান্ড বিজনেস অ্যাফেয়ার্সের ট্রেড পলিসি অ্যান্ড নেগোসিয়েশনের উপ-সহকারী সচিব। নিষেধাজ্ঞা নীতি ও বাস্তবায়ন ব্যুরোর পরিচালকও ছিলেন। বাংলাদেশে তিনি নতুন নন। এক সময় ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাসের ডেপুটি চিফ অফ মিশনের দায়িত্ব পালন করেছেন। সেইসূত্রে বাংলাদেশের পথঘাট, রাজনীতির নানান গলি, বিভিন্ন দলের নেতাদের রগ-শিরা ভালো মতোই চেনেন।মেল। এছাড়া ওয়াশিংটন, ডিস্ট্রিক্ট অফ কলম্বিয়ার ফরেন সার্ভিস ইনস্টিটিউটের লিডারশিপ অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট স্কুলের সহযোগী ডিন; ইউক্রেনের কিয়েভে মার্কিন দূতাবাসে অর্থনৈতিক বিষয়ের পরামর্শদাতা; অর্থনৈতিক ব্যুরোতে মুদ্রা বিষয়ক অফিসের উপ-পরিচালক; এবং চীন, হংকং, তাইওয়ান, গিনি এবং ওয়াশিংটনেও বিভিন্ন পদে দায়িত্বও। ফরেন সার্ভিসে যোগদানের আগে, মেলে স্প্রিন্ট টেলিকমিউনিকেশনে কর্পোরেট ফাইন্যান্সের উচু পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন।

তিনি এম.এস. ন্যাশনাল ডিফেন্স ইউনিভার্সিটির আইজেনহাওয়ার স্কুল থেকে, টুলেন ইউনিভার্সিটি থেকে এমবিএ এবং বিএ ডিগ্রি অর্জন করেন। ডেলাওয়্যার বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও তিনি ডিগ্রি নিয়েছেন । তার বায়োডাটা বেশ মোটা। অসামান্য অবদানের জন্য মেল ডেপুটি চিফ অফ মিশনের হিসেবে বেকার-উইলকিন্স পুরস্কার পেয়েছেন। ভালো দখল আছে চীনা, ইউক্রেনীয় এবং ফরাসি ভাষার ওপর। ঢাকা থেকে বিদায়ের সুর বাজতে থাকা পিটার ডি হাসের ক্যারিয়ারও বর্ণাঢ্য। সেই সুবাদেই ঢাকায় পোস্টিং পেয়েছিলেন। ঢাকায় অস্বাভাবিক পরিস্থিতির মধ্যে পিটার ডি হাস বাংলাদেশে রাষ্ট্রদূত হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করায় তাকে এখন আরো ভালো জায়গায় পদায়ন করা হচ্ছে।

এমন এক সময় হাস যাচ্ছেন, আর মেল আসছেন যখন বাংলাদেশের রাজনীতিতে যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্য এবং দৃঢ় অবস্থান অনেকটাই টলটলয়মান। পিটার ডি হাস বাংলাদেশে রাষ্ট্রদূত হিসেবে আসেন ২০২২ সালে ১৫ মার্চ। দায়িত্ব গ্রহণের পরেই বাংলাদেশের নির্বাচন, গণতন্ত্র এবং মানবাধিকার ইত্যাদি বিষয় নিয়ে তিনি সোচ্চার ছিলেন। এ নিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সঙ্গে তার এক ধরনের প্রকাশ্য বৈরিতা দেখা দেয়। রীতিমতো প্রতীপক্ষ হয়ে যান তিনি। তাই তাকে হ্যানস্ত করতে একটু্ও ছানি সরকার ও সরকারি দল। কিন্তু এ সব উপেক্ষা করে পিটার হাস তার কাজ চালিয়েই যেতে থাকেন। বিএনপির সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা ছাড়াও সুষ্ঠু-অবাধ নির্বাচনের তাগিদ দিতে ক্লান্তও হয়ে পড়েন। তার প্রতি বিরক্ত হয়ে পেটানো এবং হাসকে জবাই করে খেয়ে ফেলার হুমকিও দেয়া হয় ক্ষমাতীন আওয়ামী থেকে। সেটা ছিল ঢাকায় তারজন্য চরম তিক্ত অভিজ্ঞতা। আর্ল মিলারের স্থলে ঢাকায় আসার আগে অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি অব স্টেট এবং অর্থনীতি ও বাণিজ্য বিষয়ের প্রিন্সিপাল ডেপুটি অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি অব স্টেট হিসেবে কাজ করার অভিজ্ঞ ব্যাক্তিটির জন্য তা ছিল চরম অপমানের। ভারতের মুম্বাইসহ বিদেশের আরও চারটি মিশন ও কন্স্যুলার সার্ভিসে কাজ করেছেন তিনি। ইংরেজির পাশাপাশি হাস ফরাসি ও জার্মান ভাষায় দক্ষ।

বিজ্ঞাপন

ঢাকা এসে দম নিতে পারেননি হাস। টানা নানান কর্মযজ্ঞের মাঝে ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে আরো ব্যস্ত হয়ে পড়েছিরেন। শেষ চেষ্টা হিসেবে আওয়ামী লীগ, বিএনপি এবং জাতীয় পার্টির নেতাদের কাছে ডোনাল্ড লু’র চিঠি নিয়ে ছুটে বেড়িয়েছেন। যখন শেষ পর্যন্ত নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হয় তখন তিনি ছুটিতে চলে যান। একে ধরা হয়েছিল পিটার হাসের বাংলাদেশের মিশন ব্যর্থ হয়েছে বলে। বাংলাদেশে একজন মার্কিন রাষ্ট্রদূত সাধারণত তিন বছরের মেয়াদে দায়িত্ব পালন করেন এবং এই তিন বছর মেয়াদ পূর্তির পরই নতুন রাষ্ট্রদূত নিয়োগ দেওয়া হয়। কোনো কোনো রাষ্ট্রদূত তিন বছরের বেশি সময় দায়িত্ব পালন করেছিলেন। পিটার ডি হাসের আগে যিনি বাংলাদেশে রাষ্ট্রদূত ছিলেন আর্ল আর মিলার তিনি ২৯ নভেম্বর ২০১৮ সালে দায়িত্ব গ্রহণ করে ২১ জানুয়ারি ২০২২ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে মার্কিন রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। মার্শা বার্নিকাট ২০১৫ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি দায়িত্ব পালন করে ২০১৮ সালের ২ নভেম্বর তাঁর দায়িত্ব শেষ করেন। তিন বছরের কিছুটা বেশি সময় দায়িত্বে ছিলেন বার্নিকাট। একইভাবে ড্যান মজিনাও ২০১১ সালের ২৪ নভেম্বর থেকে ১৫ সালের ১২ জানুয়ারি পর্যন্ত ঢাকায় দায়িত্ব শেষ করে চলে যান।

কোনো কোনো রাষ্ট্রদূত তার মেয়াদের কম সময়েও দায়িত্ব পালন করেছেন এবং তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন হ্যারি কে টমাস। ২০০৩ সালের ১৪ আগস্ট থেকে দুই বছরের কম সময়ের আগেই ২০০৫ সালের ২ জুলাই বিদায় নেন তিনি। এখন ঢাকা ছাড়ার প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছেন।আলোচিত পিটার হাস। ঢাকায় নিযুক্ত হওয়ার পর থেকে এক উপাখ্যান হয়ে ওঠেন তিনি। গেল নির্বাচনের আগে আকস্মিক ঢাকা ছেড়েছেন নির্বাচনের তপশিল ঘোষণার পরদিন। কোথায় গেছেন তা জানতো কেবল পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এটাই নিয়ম। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে জানিয়েই যেতে হয়। বিদেশি কোনো রাষ্ট্রদূত, হাইকমিশনার বা মিশনপ্রধান ছুটিতে নিজ দেশে বা অন্য কোথাও গেলে তা হোস্ট কান্ট্রির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে অবহিত করতে হয়। পিটার হাসও তা করেছেন। তপশিল ঘোষণার আগ পর্যন্ত তার অন্তহীন খাটাখাটুনি, নির্বাচন সুষ্ঠু ও অবাধ করা নিয়ে বিভিন্ন সময়ে মন্তব্য এবং দফায় দফায় বৈঠক করে ঢাকার রাজনীতি-কূটনীতিতে টক অব দ্য ডিপ্লোম্যাটে পরিণত হওয়া হাসকে নিয়ে তখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে জোর গুজব রটেছিল, ওয়াশিংটনে তলব করা হয়েছে হাসকে। তবে গুজবটি বেশি সময় স্থায়ী হয়নি। হালে পানিও পায়নি। এ সময়ে কেন গেছেন, এ নিয়ে নানা প্রশ্নের কোনো হিল্লা হয়নি। পরে জানা গেছে দীর্ঘ ক্লান্তি কাটাতে অবকাশে শ্রীলঙ্কার রাজধানী কলম্বোতে গেছেন, যা আগেই থেকেই ঠিক করা ছিল। ঢাকায় তার শেষ কাজ ছিল নিঃশর্ত সংলাপের তাগিদসহ যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লুর চিঠি আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টির কাছে হস্তান্তর করা। আওয়ামী লীগের কাছ থেকে সংলাপের টাইম ওভার হয়ে যাওয়ার বার্তার পর তার কাজের আওতা কমে যায়। এক পর্যায়ে ওই সময়টায় তাকে দিল্লিতে ডাকা হয়েছে বলে গুজব চাউর হয়। অথচ তিনি ঢাকাতেই ছিলেন। এখন সত্যি সত্যিই হাস ঢাকা ছাড়ছেন। সেইসঙ্গে অপেক্ষার ডেভিড স্লেটন মেলের জন্য। তিনি কী করেন, হাসের ফলো আপ না অন্য কিছু সেটাও পরেরটা আরেক অপেক্ষার বিষয়।

লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট, ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন

বিজ্ঞাপন

সারাবাংলা/এসবিডিই

Tags: , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন