বিজ্ঞাপন

‘কখনো ভাবতে পারিনি, এতদূর আসতে পারব’

May 12, 2024 | 10:30 pm

ইমরান চৌধুরী, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট

চট্টগ্রাম ব্যুরো: বয়স তখন পাঁচ বছর। ভুল করে মায়ের একটি ওষুধ খাইয়ে দিলে শিশু নারগিসের একটি চোখ পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যায়। আরেক চোখ দিয়ে কোনোভাবে দেখতে পেলেও লেখা বুঝতে কষ্ট হতো তার। কিন্তু যার মনে সারা দিন খেলা করে ঝলমলে, চোখের আলোর ঘাটতি কি আর তাকে দমিয়ে রাখতে পারে!

বিজ্ঞাপন

দমিয়ে রাখা যায়নি কিশোরী নারগিসকেও। ঝাপসা দৃষ্টি নিয়েই সে চালিয়ে গেছে পড়ালেখা। শেষ পর্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে এসএসসির গণ্ডিও পেরিয়েছে এই কিশোরী। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধকতা জয়ের আত্মবিশ্বাসটাও পোক্ত হয়েছে। এখন উচ্চ মাধ্যমিক আর স্নাতকের গণ্ডি পেরিয়ে স্বপ্নটা বিস্তৃত হয়েছে বিসিএস পরীক্ষা পর্যন্ত।

এসএসসি ফলাফল প্রকাশ হওয়ার পর রোববার (১২ মে) বিকেলে কথা হয় নারগিসের সঙ্গে। তার চোখেমুখজুড়ে তখন খেলা করছিল সাফল্যের আনন্দ। সেখান থেকে যেন ঠিকরে পড়ছিল বিশ্বজয়ের স্বপ্ন!

নগরীর হামজারবাগে শাহজাহান হাউজিং সোসাইটি এলাকায় দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের একটি হোস্টেলে থাকেন নারগিস আক্তার। দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের সংগঠন পরশের ব্যবস্থাপনায় হেপা (হেলথ এডুকেশন অ্যান্ড পোভার্টি অ্যালিভিয়েশন) ও নাবিক স্ত্রী কল্যাণ সমিতির ‘উপলা’ নামে দুটি সংগঠনের অর্থায়নে এ হোস্টেলটি পরিচালিত হয়।

বিজ্ঞাপন

নগরীর ঝাউতলায় বঙ্গবন্ধু বাংলা বিদ্যাপীঠ উচ্চ বিদ্যালয়ের মানবিক বিভাগ থেকে নারগিস জিপিএ ৪ দশমিক ৫০ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছে। ছোটবেলা থেকেই পড়ালেখার প্রতি আগ্রহ ছিল নারগিসের। তবে তার জীবনটা সমৃণ ছিল না। বলা যায়, ছোটবেলা থেকেই জীবনযুদ্ধের প্রতিকূলতা অতিক্রম করেই বড় হতে হয়েছে তাকে।

এসএসসির ফলাফলের পর নারগিসের চোখে অশ্রু। তবে তা বেদনার নয়, আনন্দের। ছবি: শ্যামল নন্দী/ সারাবাংলা

নারগিসের বয়স যখন এক বছর, তার বাবা মুক্তার হোসেন স্ট্রোক করে মারা যান। তিন বোনের মধ্যে নারগিস সবার ছোট। বাড়ি রাঙ্গামাটির বাঙ্গালহালিয়াতে। পাঁচ বছর বয়সে বড় বোন জেসমিন আক্তার ভুল করে মায়ের ওষুধ নারগিসকে খাইয়ে দেন। এর প্রতিক্রিয়ায় নষ্ট হয়ে যায় তার একটি চোখ। অন্য চোখ পুরোপুরি নষ্ট না হয়ে গেলেও দেখতে অসুবিধা হয় নারগিসের।

আর দশজন সাধারণ মানুষের মতো চোখের দৃষ্টি না থাকায় সাধারণ স্কুলে পড়ার সু্যোগ হয়নি নারগিসের। তবে মেয়ের পড়ালেখার প্রতি আগ্রহ দেখে নগরীর মুরাদপুরে দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের জন্য বিশেষায়িত স্কুলের প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি করিয়ে দেন মা সুফিয়া বেগম। নারগিসের ঠাঁই হয় ওই স্কুলের মেয়েদের হোস্টেলে। সবার ছোট হওয়ায় নারগিসকে বেশি আদর করতেন সুফিয়া বেগম। তাই আর বাড়ি ফিরে যাননি। থেকে যান নারগিসের সঙ্গে। ওই হোস্টেল রক্ষণাবেক্ষণের কাজ নেন তিনি।

বিজ্ঞাপন

তিন বছর পর অবশ্য বাড়িতে চলে যেতে বাধ্য হন সুফিয়া। বিশেষায়িত স্কুলের সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত ব্রেইল পদ্ধতিতে শিক্ষা পাওয়ার পর নারগিস ভর্তি হয় ঝাউতলার বঙ্গবন্ধু বিদ্যাপীঠে। সেখান থেকেই পরীক্ষা দিয়ে সাফল্যের সঙ্গে এবার এসএসসি উত্তীর্ণ হলো নারগিস।

সারাবাংলার সঙ্গে কথোপকথনে এ পর্যন্ত পৌঁছানোর নানা লড়াই ও সংগ্রামের কথাই বারবার উঠে আসছিল নারগিসের কণ্ঠে। তার ভাষ্য, ‘আমার পড়তে ও লিখতে খুব অসুবিধে হতো। কিন্তু পড়ালেখা করতে খুব ভালো লাগত। সেটা দেখে আম্মু আমাকে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেন। এখান থেকেই আমার সংগ্রাম শুরু। কখনো ভাবতে পারিনি এতদূর আসতে পারব। আমি আরও পড়ালেখা করতে চাই। বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হয়ে দেশের সেবা করতে চাই।’

নিজের এই সাফল্যের পেছনে মায়ের অবদানকেই সব কৃতিত্ব দিতে চায় নারগিস, ‘আমার যখন এক বছর বয়স, তখন বাবা মারা যান। তিনি কৃষি কাজ করতেন। বাবা মারা যাওয়ার পর পুরো সংসার আমার আম্মু খুব কষ্ট করে চালিয়েছেন। আমার বড় দুই বোনকে পড়ালেখা করিয়ে বিয়ে দিয়েছেন। এখনো কষ্ট করে যাচ্ছেন। আমার এতটুকু আসার পেছনে সব অবদান আমার আম্মুর।’

চোখের দৃষ্টিতে সীমাবদ্ধতা থাকলেও নারগিসের মনের দৃষ্টি প্রসারিত হতে চায় বহু দূর। মাধ্যমিকের সাফল্য তাকে সেই বহু দূরের পথে এগিয়ে যাওয়ার সাহস জোগাচ্ছে, দিচ্ছে অনুপ্রেরণা। ছবি: শ্যামল নন্দী/ সারাবাংলা

দৃষ্টি প্রতিবন্ধী হওয়ায় নারগিসকে স্বাভাবিকভাবেই এসএসসি পরীক্ষার হলে ‘রাইটার’ বা শ্রুতিলেখকের সহযোগিতা নিতে হয়েছিল। ফলাফলে খুশি হলেও কিছুটা আক্ষেপ তার রয়ে গেছে, ‘ফলাফল আরও ভালো হতে পারত। কিন্তু গণিত পরীক্ষা ভালো হয়নি। আমার সহযোগী যে রাইটার ছিল, তাকে হয়তো আমি ভালো করে বুঝিয়ে বলতে পারিনি বা সে বুঝতে পারেনি। না হলে ফলাফল আরও ভালো হতো আমার। তবুও যা হয়েছে, আলহামদুলিল্লাহ।’

বিজ্ঞাপন

উত্তেজনায় সারা রাত ঘুম হয়নি জানিয়ে নার্গিস বলল, ‘ফলাফলের তারিখ দেওয়ার পর থেকেই মনে একটি ভয় ঢুকে গিয়েছিল। উত্তেজনাও কাজ করছিল। গতকাল সারা রাত ঘুমাইনি। আম্মুকে কিছুক্ষণ পরপর কল দিয়ে বিরক্ত করেছি, রুমমেটদের বিরক্ত করেছি। সকালে উঠে নামাজ পড়েছি। ফলাফল পেয়ে প্রথমে আম্মুকে কল দিয়ে মজা করে বলি, এক বিষয়ে খারাপ করেছি।’

‘এরপর তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করেন, বিয়ে দেবে নাকি ভালো করে পড়ালেখা করে সামনের বার আবার পরীক্ষা দেবো! পরে আমি হেসে উঠি। আম্মু বুঝতে পারে, আমি তার সঙ্গে দুষ্টুমি করেছি। পাস করেছি বলার পরপরই আম্মু এলাকার সবাইকে মিষ্টি বিতরণ করবে জানিয়ে কল কেটে দেয়,’— মায়ের প্রসঙ্গে কথা বলতে বলতে যেন উচ্ছ্বাস একটু বেশিই কাজ করছিল নারগিসের।

এত কষ্ট করে পড়ালেখা করে এসএসসিতে ভালো ফলাফল। তারপরও কোনো কষ্ট বা খারাপ লাগার কিছু আছে কি না— এমন প্রশ্নে নারগিসের উত্তর, ‘আমাদের যেহেতু লিখতে কষ্ট হয়, তাই আমরা আমাদের সঙ্গে একজন সহযোগী রাখি, যারা লিখে দেয়। সহযোগীকে অবশ্য আমাদের থেকে দুই বছরের ছোট হতে হয়। টেস্ট পরীক্ষায় আমার সহযোগী পেতে খুব বেগ পেতে হয়েছে। কেউ একটাতে আসে তো আরেকটাতে আসে না। এ কারণে আমাকে কয়েকজন সহযোগীর সহযোগিতা নিতে হয়েছে। এ কারণে ইতিহাস পরীক্ষার দিন আমাকে স্কুলের শিক্ষকরা খুব বকা দিয়েছিলেন। সেদিন খুব খারাপ লেগেছিল। কান্নাও করেছিলাম।’

এখন অবশ্য এসব কষ্টের কথা ভুলে সামনের দিকেই দৃষ্টি প্রসারিত নারগিসের। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক-স্নাতকোত্তরের স্বপ্নটাও এখন অবাস্তব মনে হয় না তার কাছে। তবে আপাতত লক্ষ্যটা স্থির রাখছেন উচ্চ মাধ্যমিকে। এই ধাপেও মাধ্যমিকের মতো সাফল্য ধরে রাখতে হবে— স্বপ্ন পূরণে আগের মতোই সব প্রতিবন্ধকতাকে ছাপিয়ে আপাতত এটাকেই সংকল্প হিসেবে নিয়েছেন নারগিস।

সারাবাংলা/আইসি/টিআর

Tags: , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন