বিজ্ঞাপন

কাছিমের ডিম পাড়ার জায়গা কমেছে ৩৭%, সচেতনতা বাড়ানোর তাগিদ

May 16, 2024 | 8:30 am

ওমর ফারুক হিরু, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট

কক্সবাজার: দেশের পর্যটন তীর্থ কক্সবাজারে সমুদ্রের ঝাড়ুদার খ্যাত কাছিমের ডিম পাড়ার জায়গা দিন দিন সংকীর্ণ হয়ে আসছে। পরিবেশ সংগঠনগুলোর তথ্য বলছে, দুই বছর আগেও সোনাদিয়া থেকে সেন্টমার্টিন পর্যন্ত সমুদ্র সৈকতের ৫৪টি বালিয়াড়ি পয়েন্টে কাছিম ডিম পাড়ত। এখন সেই সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে ৩৪টিতে।

বিজ্ঞাপন

পরিবেশ অধিকার কর্মীরা বলছেন, কাছিমের ডিম পাড়ায় জায়গায় পর্যটকদের অবাধ বিচরণ, জেলেদের কাছিম নিধন, অসচেতনতা, কুকুর-শিয়ালের দৌরাত্ম্য ও একটি গোষ্ঠীর ডিম-কাছিম সংগ্রহের প্রবণতার কারণে কাছেমের ডিম পাড়ার জায়গা কমে গেছে। সেই সঙ্গে কমেছে কাছিমের সংখ্যাও। এ অবস্থায় কাছিম নিয়ে সব ধরনের মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানোর দিকে গুরুত্ব দিতে আহ্বান জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

কাছিম সংরক্ষণ ও প্রজননে সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিতে যৌথভাবে কাজ করছে পরিবেশ ও বন বিভাগ এবং ন্যাচার কনজারভেশন ম্যানেজমেন্ট (নেকম)। কাছিম নিয়ে সচেতনতা বাড়ানো, কাছিমের নিরাপদ বিচরণ, ডিম পাড়ার সুষ্ঠু পরিবেশ ও সমুদ্রে বাচ্চা অবমুক্ত করার মতো বিষয়গুলো নিশ্চিত করতে চলছে যৌথ উদ্যোগের এই কর্মকাণ্ড।

নেকমের ব্যবস্থাপক আব্দুল কাইয়ুম সারাবাংলাকে বলেন, ‘সাগরে মাছের পোনা খেয়ে ফেলা জেলিফিশ, পাথরে জমে থাকা ফোম খাওয়াসহ ক্ষতিকর আর্বজনা পরিষ্কারের মধ্য দিয়ে সাগরের জীববৈচিত্র্য রক্ষায় বড় ভূমিকা রাখে কাছিম। কিন্তু মানবসৃষ্ট নানা প্রতিকূলতার কারণে আজ কাছিম হুমকির মুখে। দিন দিন সংকীর্ণ হয়ে পড়ছে তাদের ডিম পাড়ার জায়গা।’

বিজ্ঞাপন

ডিম থেকে বাচ্চা ফোটানোর পর অবমুক্ত করা হয় সাগরে। ছবি: সারাবাংলা

আব্দুল কাইয়ুম ২০২১-২২ সালের নেকমের জরিপের তথ্য তুলে ধরে জানান, সোনাদিয়া থেকে সেন্টমার্টিন পর্যন্ত বালিয়াড়ির ৫৪টি পয়েন্টে কাছিম ডিম পাড়ত। এ রকম বালিয়াড়ি পয়েন্ট এখন কমে দাঁড়িয়েছে ৩৪টিতে। সে হিসাবে দুই বছরের ব্যবধানেই প্রায় ৩৭ শতাংশ তথা তিন ভাগের এক ভাগ থেকেও বেশি ডিম পাড়ার পয়েন্ট কমে গেছে কাছিমের জন্য।

এ পরিস্থিতিও নেকম কাছিম সংরক্ষণে সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। গত পাঁচ বছরে সংরক্ষিত ৫০ হাজার ডিম থেকে প্রায় ৪০ হাজার কাছিম সমুদ্রে অবমুক্ত করেছে সংগঠনটি। এ বছর এরই মধ্যে তারা কাছিম অবমুক্ত করেছে প্রায় আট হাজার, যা এক বছরে কাছিম অবমুক্ত করার রেকর্ড।

গতকাল বুধবারও (১৫ মে) দুপুরে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের পেঁচারদ্বীপে ‘সামুদ্রিক কাছিম সংরক্ষণ ও প্রজনন কেন্দ্র’সংলগ্ন পয়েন্টে ২৫০টি কাছিম অবমুক্ত করা হয়। দেখা যায়, বুকের ওপর ভর দিয়ে একটু একটু করে হামাগুড়ি দিয়ে বালিয়াড়ি থেকে সমুদ্রের দিকে ছুটছে কাছিমের ছানা। তারা হয়তো হাজার হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে সমুদ্র পরিষ্কার করে ফের ফিরে আসবে সাগরের পাড়ে।

বিজ্ঞাপন

আব্দুল কাইয়ুম বলেন, ‘পরিবেশ, বন বিভাগ ও নেকম যৌথভাবে ২০ বছর ধরে কাছিম সংরক্ষণ ও প্রজনন নিয়ে কাজ করছে। গত পাঁচ বছরে ৫০ হাজার ডিম থেকে প্রায় ৪০ হাজার বাচ্চা সমুদ্রে অবমুক্ত করা হয়েছে। এ বছর ১৫ হাজার ডিম থেকে আট হাজার বাচ্চা অবমুক্ত করা হয়েছে। এসব ডিম সংগ্রহ করা হয়েছে সোনাদিয়া, পূর্ব পাড়া, পশ্চিম পাড়া, মাদার বনিয়া, পেঁচারদ্বীপ, শিলখালী, শাহপরীর দ্বীপ ও সেন্টমার্টিন থেকে।

সাগরে অবমুক্ত করা হচ্ছে বাচ্চা কাছিম। ছবি: সারাবাংলা

কাছিমের সুরক্ষায় স্থানীয় সব শ্রেণিপেশার মানুষকে ব্যাপকভাবে সচেতন করে তেলা প্রয়োজন বলে মনে করেন আব্দুল কাইয়ুম। সরকারি সংস্থাগুলোর সঙ্গে সেই কাজটিও নেকম করে যাচ্ছে। পাশাপাশি স্থানীয়দের প্রশিক্ষণও দেওয়া হচ্ছে কাছিম নিয়ে। এর কিছু সুফলও স্থানীয়ভাবে মিলছে।

সমুদ্রের পাড়ের করাচিপাড়া গ্রামের বাসিন্দা ওসমান গণি বলেন, ‘আমরা আগে কাছিম সম্পর্কে জানতাম না। আমি নিজেই কাছিমের ডিম ও বাচ্চা উপজাতিদের (ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী) বিক্রি করেছি। কুকুর-শিয়ালেরা কাছিমের ডিম-বাচ্চা নষ্ট করলেও তেমন গুরুত্ব দিতাম না। এখন কাছিমের গুরুত্ব বুঝতে পেরে কাউকে নষ্ট করতে দেই না। ডিম পেলেই হ্যাচারিতে দিয়ে আসছি।’

আব্দুল লতিফ নামে স্থানীয় আরেকজন বলেন, ‘আট-দশ বছর আগেও কাছিমকে অপয়া মনে করে মেরে ফেলতাম। পরে নেকমের কাছ থেকে ট্রেনিং নিয়ে জানতে পারলাম, কাছিম পরিবেশের বন্ধু। এখন কাছিমের ডিম সংরক্ষণ করি। নিরাপত্তা, যত্ন ও সাগরে অবমুক্ত নিয়ে নেকমের হয়ে কাজ করছি।’

বিজ্ঞাপন

হিমছড়ি বিট কর্মকর্তা কামরুজ্জামান শোভন সারাবাংলাকে বলেন, কাছিমের ব্যাপারে স্থানীয়দের সচেতন করছে বন বিভাগ। ডিম সংরক্ষণ করে হ্যাচারিতে পৌঁছানো, সংরক্ষিত ডিম ৬০ দিন পর সাগরে অবমুক্তি করায় সহযোগিতা, অসাধু চক্র ও শিয়াল-কুকুরের হাত থেকে ডিম রক্ষা করতে টহল জোরদার, ডিম পাড়তে আসা মা কাছিমের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতেও আমরা কাজ করছি।

পরিবেশ অধিদফতরের উপপরিচালক মো. নুরুর আমিন বলেন, মানবসৃষ্ট নানা প্রতিকূলতার কারণে দিন দিন কাছিম কমে যাচ্ছে, যা পরিবেশের জন্য হুমকির কারণ। পরিবেশ-প্রকৃতি রক্ষায় কাছিমকে উপযুক্ত পরিবেশ দিতে হবে। এর জন্য সব স্তরে সচেতনতা ছড়িয়ে দিতে হবে। কাছিমকে বাঁচাতে সবাই সচেতন হয়ে সম্মিলিত প্রচেষ্টার বিকল্প নেই। সবাই মিলে কাজ করলেই কেবল কাছিমকে তাদের উপযোগী পরিবেশ ফিরিয়ে দেওয়া যাবে। তখনই কাছিম রক্ষার পাশাপাশি রক্ষা পাবে সমুদ্রের জীববৈচিত্র্য।

সারাবাংলা/টিআর

Tags: , , , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন