বিজ্ঞাপন

এমপি আনোয়ারুল হত্যার প্রমাণ মিললেও লাশ মেলেনি— যা জানা গেল সবশেষ

May 22, 2024 | 11:55 pm

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা: ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনারের মরদেহ উদ্ধার নিয়ে ধোঁয়াশা দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশ ও ভারতের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলোর বিভিন্ন সূত্র বলছে, আনোয়ারুলকে খুন করা হয়েছে বলে তারা তথ্য পেয়েছেন। তবে তার মরদেহ এখনো পাওয়া যায়নি। মরদেহ উদ্ধারসহ এ হত্যাকাণ্ড নিয়ে তদন্তভার এখন চেপেছে পশ্চিমবঙ্গের কলকাতা পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) ওপর। এরই মধ্যে সংস্থাটি ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে তদন্তকাজ শুরু করেছে।

বিজ্ঞাপন

বুধবার (২২ মে) সকালে ভারতীয় বিভিন্ন গণমাধ্যম সূত্রে জানা যায়, সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনার কলকাতার নিউ টাউনে খুন হয়েছেন। তার মরদেহ নিয়ে তখনো নিশ্চিত করে কিছু জানানো হয়নি।

যা বললেন স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী

দুপুরের দিকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল সাংবাদিকদের বলেন, ভারতীয় পুলিশ নিশ্চিত করেছে যে আনোয়ারুল খুন হয়েছেন। তবে হত্যাকাণ্ডের মোটিফ স্পষ্ট নয়। গোটা ঘটনাটি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আরও বলেন, এমপি আনোয়ারুলকে হত্যার ঘটনাটি সুপরিকল্পিত। এ ঘটনায় ভারতীয় কেউ জড়িত নয়। আমাদের কাছে যা তথ্য আছে তাতে স্পষ্ট যে বাংলাদেশিরাই এ হত্যায় জড়িত। এ ঘটনায় তিন বাংলাদেশিকে গ্রেফতার করা হয়েছে বলেও জানান মন্ত্রী।

বিজ্ঞাপন

পরে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়ার পর সাংবাদিকদের বলেন, এমপি আনোয়ারুল আজীম আনারের হত্যাকাণ্ডটি অত্যন্ত দুঃখজনক, মর্মান্তিক ও অনভিপ্রেত। যে ফ্ল্যাটে তাকে হত্যা করা হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে, কলকাতা পুলিশ সেখানে ঢুকেছিল। কোনো লাশ সেখানে তারা পায়নি। তবে হত্যাকাণ্ডের মূল হোতা এবং জড়িত কয়েকজনকে ডিবি গ্রেফতার করেছে। কলকাতা পুলিশও দুজনকে গ্রেফতার করেছে।

আরও পড়ুন-

বিজ্ঞাপন

তদন্তের ভার কলকাতা সিআইডির ওপর

বিকেল নাগাদ ভারতীয় গণমাধ্যমগুলো থেকে জানা যায়, কলকাতা সিআইডিকে এ ঘটনার তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। আনোয়ারুল নিউ টাউনের যে বাসায় ছিলেন, সিআইডির আইজি অখিলেশ চতুর্বেদী সেই বাসা পরিদর্শনও করেছেন। পরে তিনি সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন।

অখিলেশ জানান, ১২ মে ভারতে চিকিৎসা করাতে যান আনওয়ারুল। প্রথমে ওঠেন বরাহনগরে তারই বন্ধু গোপাল বিশ্বাসের বাড়িতে। দিন দুয়েক সেখানে থাকেন তিনি। এরপর ১৪ মে ওই বাসা থেকে বের হয়ে আর ফেরেননি আনোয়ারুল। গোপালও তার সঙ্গে আর যোগাযোগ করতে পারেননি। যোগাযোগ করতে পারেননি এমপি আনোয়ারুলের পরিবারের সদস্যরাও। শেষ পর্যন্ত পরিবারে সঙ্গে কথা বলে ১৮ মে বরাহনগর থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন গোপাল।

সিআইডির আইজি অখিলেশ বলেন, নিখোঁজ ডায়েরির তদন্ত করতে একটি দল গঠন করে ব্যারাকপুর পুলিশ কমিশনারেট। সেই তদন্ত চলছিল। এর মধ্যে আজ (বুধবার) আমরা জানতে পারি, আনোয়ারুলকে খুন করা হয়েছে। শেষ বার যেখানে তাকে দেখা গিয়েছিল, সেই জায়গাটি খুঁজে বের করে স্থানীয় থানা। এর পরে সিআইডিকে তদন্তের ভার দেওয়া হয়।

আনন্দবাজারের খবরে বলা হয়, বুধবার ভোরে নিউ টাউন থানার পুলিশ এলাকার একটি অভিজাত হাউজিংয়ে হাজির হয়। ওইখানকার একটি ফ্ল্যাটে আনোয়ারুল ছিলেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। ওই ফ্ল্যাটে পুলিশ রক্তের দাগ পেয়েছে। পরে ওই ফ্ল্যাটটি ঘিরে রাখা হয়। ওই হাউজিংয়ে যাতায়াতেও কড়াকড়ি আরোপ করা হয়। সেখান থেকে প্রয়োজনমতো ফিঙ্গারপ্রিন্ট ও রক্তের দাগও সংগ্রহ করা হয়।

বিজ্ঞাপন

সিআইড কর্মকর্তা অখিলেশ বলেন, ১৮ মে দায়ের করা নিখোঁজ জিডির তদন্ত করতে গিয়েই নিউ টাউনের ফ্ল্যাটের খবর বেরিয়ে আসে। সেখান থেকে ফরেনসিক বিশেষজ্ঞদের মাধ্যমে সব ধরনের নমুনা, আলামত ও সূত্র সংগ্রহ করা হয়েছে। সেখানে রক্তের যে দাগ দেখা গেছে, সেটি আনোয়ারুলেরই কি না, তা খতিয়ে দেখা হবে।

হত্যার তথ্য আছে, মরদেহ উদ্ধারের তথ্য নেই

এনডিটিভি ও আনন্দবাজারসহ ভারতীয় গণমাধ্যমের খবর বলছে, বুধবার দিবাগত রাত ১১টা পর্যন্ত আনোয়ারুল আজীম আনারের মরদেহের সন্ধান পাওয়া যায়নি। তবে বিষয়টি নিয়ে কলকাতা সিআইডির আইজি অখিলেশ চতুর্বেদী ছাড়া অন্য কেউ গণমাধ্যমে কথা বলেননি। এ বিষয়ে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়েরও কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা একাধিক গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, এ বিষয়ে পুলিশই কথা বলবে।

এদিকে আনোয়ারুল নিউ টাউনের যে ফ্ল্যাটে ছিলেন, সেই ফ্ল্যাট নিয়েও ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে। আনন্দবাজারের খবর, সিআইডি সূত্র জানিয়েছে, ওই ফ্ল্যাটের মালিক সরকারি কর্মচারী জনৈক সন্দীপ। তিনি আখতারুজ্জামান নামে মার্কিন এক নাগরিককে ফ্ল্যাটটি ভাড়া দেন। এখন আখতারুজ্জামানের নামে ভাড়া নেওয়া ফ্ল্যাটে বাংলাদেশের এমপি আনোয়ারুল ছিলেন কীভাবে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। আখতারুজ্জামান বা সন্দীপের সঙ্গে আনোয়ারুলের সম্পর্ক কী— সে প্রশ্নও ঘুরপাক খাচ্ছে। এসব বিষয় নিয়ে সিআইডির আইজি অখিলেশকে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনিও কোনো জবাব দেননি।

অখিলেশ সর্বশেষ গণমাধ্যমকে যে বক্তব্য দিয়েছেন, সেখানে আনোয়ারুলকে হত্যার তথ্য নিশ্চিত হওয়ার কথা জানিয়েছেন। অখিলেশ বলেন, আমরা কিছু সুনির্দিষ্ট তথ্য পেয়েছি, যার ভিত্তিতে মনে করা হচ্ছে যে উনাকে (আনোয়ারুল) হত্যা করা হয়েছে। পুলিশের ফরেনসিক বিভাগ তদন্তের কাজ শুরু করেছে। তদন্তে অগ্রগতি হয়েছে।

বরাহনগর থেকে বের হওয়ার পর হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজ, পরে নিখোঁজ

চিকিৎসার জন্য গত ১২ মে ভারতে যান আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনার। উঠেছিলেন বন্ধু গোপাল বিশ্বাসের বরাহনগরের বাড়িতে। চিকিৎসকের কাছে যাবেন জানিয়ে ১৪ মে দুপুর ১টা ৪০ মিনিটের দিকে ওই বাড়ি থেকে বের হওয়ার পর আর তার সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি কারও পক্ষে। পরে গোপাল ১৮ মে বরাহনগর থানায় জিডি করেন।

জিডিতে গোপাল বিশ্বাস লিখেছেন, আনোয়ারুল চিকিৎসককে দেখানোর কথা বলে বের হওয়ার বলে যান, সন্ধ্যায় ফিরবেন। কিন্তু সেদিন সন্ধ্যায় ফেরেননি তিনি। এর বদলে তার ফোন থেকে গোপালের হোয়াটসঅ্যাপে একটি মেসেজ আসে। সেখানে লেখা ছিল, ‘বিশেষ কাজে দিল্লি চলে যাচ্ছি এবং পৌঁছে ফোন করব। তোমাদের ফোন করার দরকার নেই।’

এদিকে পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের অ্যান্টি-টেরোরিস্ট ইউনিটের কর্মকর্তারা বিবিসিকে জানিয়েছেন, তদন্তে নেমে তারা প্রথমে এমপি আনোয়ারুলকে বহনকারী ক্যাবচালককে আটক করেন। সেই ক্যাবচালক জানিয়েছেন, আনোয়ারুলকে তার গাড়িতে তোলার পর আরও তিনজন গাড়িতে ওঠেন। তাদের মধ্যে দুজন পুরুষ, একজন নারী। চারজনই কলকাতার নিউ টাউনের ওই বাড়িতে গিয়েছিলেন।

এর আগে গোপালকে হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ দিয়ে দিল্লিতে পৌঁছে জানানোর কথা বলা হলেও তার যোগাযোগ করা হয়নি আনোয়ারুলের পক্ষ থেকে। তবে পরদিন ১৫ মে আরেকটি মেসেজে বলা হয়, তিনি দিল্লি পৌঁছেছেন। সঙ্গে ভিআইপিরা আছেন। ফোন করার দরকার নেই। ওই মেসেজ গোপাল পরে আনোয়ারুলের পরিবারের সদস্যদের কাছেও ফরোয়ার্ড করেছেন।

মোবাইলের লোকেশন বিহার-আসামসহ বাংলাদেশ সীমান্তেও

আনোয়ারুলের মোবাইল ফোনের অবস্থান নিয়েও রয়েছে ধোঁয়াশা। এই সময়ের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, নিখোঁজ হওয়ার পর থেকে আনোয়ারুলের ব্যবহৃত দুটি মোবাইল ফোন প্রায় সময়ই বন্ধ পাওয়া গেছে। মাঝে মাঝে চালু হলেও সেগুলো ট্র্যাক করে খুব বেশি অবস্থানের তথ্য পাওয়া যায়নি। ভারতীয় পুলিশ জানিয়েছে, বরাহনগরের ওই বন্ধুর বাড়ি থেকে বের হওয়ার পর তার মোবাইলের লোকেশন একবার পাওয়া গেছে নিউমার্কেট এলাকায়। ১৭ মে বিহারের কোনো একটি জায়গায় সচল ছিল তার মোবাইল। এ ছাড়া আসাম, উত্তর প্রদেশ ও বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত এলাকাতেও অল্প অল্প সময়ের জন্য তার মোবাইলের লোকেশন ট্র্যাক করা গেছে।

ঢাকায় মামলা

এমপি আনোয়ারুলকে হত্যার এ ঘটনায় রাজধানীর শেরেবাংলা নগর থানায় হত্যা মামলা করেছেন এমপির মেয়ে মুমতারিন ফেরদৌস ডরিন। ঢাকা মহানগর পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার এইচ এম আজিমুল হক সারাবাংলাকে বলেন, ‘নিহত এমপি আনার সংসদ ভবন এলাকায় থাকতেন। সেখান থেকে তিনি ভারতে গেছেন। তাই তার মেয়ে ডরিন ডিবি প্রধানের পরামর্শে শেরেবাংলা নগর থানায় মামলা করেছেন।’

আনোয়ারুল হত্যাকাণ্ডটি নিবিড়ভাবে তদন্ত করা হচ্ছে জানিয়ে ডিবি প্রধান অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ হারুন-অর-রশীদ বলেন, ‘নিবিড়ভাবে ভারতীয় পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছি। কয়েকজন আমাদের কাছে আছে, তাদের কাছ থেকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাচ্ছি। ঘটনায় জড়িত বাকি যারা, তাদের প্রত্যেককেও আমরা আইনের আওতায় আনব। বিচারের মুখোমুখি করব। তদন্তের স্বার্থে আমরা সবকিছু বলতে পারছি না, কারও নাম প্রকাশ করতে চাচ্ছি না।’

আনোয়ারুলকে কী কারণে তাকে হত্যা করা হয়ে থাকতে পারে— এমন প্রশ্নের জবাবে ডিবি প্রধান বলেন, ‘এটা কী কারণে ঘটেছে, জানতে তদন্ত চলছে। এটা পারিবারিক, নাকি আর্থিক, নাকি এলাকায় কোনো দুর্বৃত্ত দমনের কারণে এমন ঘটনা ঘটেছে— সবকিছু আমরা তদন্তের মাধ্যমে বের করে আনব।’

ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য ছিলেন আনোয়ারুল। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এই আসন থেকে টানা তৃতীয়বারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন তিনি। ছিলেন কালীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতির পদেও।

সারাবাংলা/টিআর

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন