বিজ্ঞাপন

৫ কোটি টাকা চুক্তিতে এমপি আজীমকে হত্যা— নেপথ্যে বন্ধু শাহীন

May 23, 2024 | 9:32 am

উজ্জল জিসান, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা: ভারতে চিকিৎসা করাতে গিয়ে ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনারকে পরিকল্পিতভাবে খুন করা হয়েছে। আর এই পরিকল্পনার মূল নায়ক তারই ছোটবেলার বন্ধু ও ব্যবসায়ী পার্টনার যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী আক্তারুজ্জামান শাহীন। তিনি মূল পরিকল্পনায় হলেও হত্যার দায়িত্ব দেওয়া হয় চরমপন্থি নেতা আমানুল্লাহ আমানকে। আমান তার সহযোগীদের নিয়ে কলকাতায় শাহীনের ভাড়া বাসায় হত্যা মিশন সফল করেন। এমপি আনারকে বালিশ চাপা দিয়ে হত্যা করে তার মরদেহ অসংখ্য টুকরো করে ট্রলিব্যাগের মাধ্যমে অন্যত্র সরিয়ে ফেলেন।

বিজ্ঞাপন

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) ওয়ারী বিভাগ আলোচিত এই হত্যাকাণ্ডের রহস্য উন্মোচন করেছে। বুধবার (২২ মে) রাতে তদন্ত সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া যায়।

ডিবি সূত্র জানায়, এরইমধ্যে হত্যাকাণ্ডে সরাসরি অংশ নেওয়া চরমপন্থি নেতা (পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টি) আমানসহ তিনজনকে আটক করা হয়েছে। তাদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে এসব তথ্য বেরিয়ে এসেছে। তারা জানিয়েছে, হত্যাকাণ্ড সফল করতে শাহীন তাদের সঙ্গে পাঁচ কোটি টাকা চুক্তি করেন। কিলিং মিশন সফল করতে সেই টাকার একটি অংশও পরিশোধ করেছেন তিনি। তবে শাহীন কত টাকা পরিশোধ করেছেন সে বিষয়ে এখনও জানা যায়নি।

এর আগে, বুধবার (২২ মে) দুপুরে এমপি আজীমের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল সাংবাদিকদের বলেন, এমপি আনারকে পরিকল্পিতভাবে খুন করা হয়েছে। এ ঘটনায় ভারত জড়িত নয়। বাংলাদেশিরাই তাকে খুন করেছে। খুনের সঙ্গে জড়িত তিনজনকে আটক করা হয়েছে। তাদের পুলিশ হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। ভারত অত্যান্ত আন্তরিকতার সঙ্গে আমাদের সহযোগিতা করছে।

বিজ্ঞাপন

এরপর ডিবিপ্রধান হারুন অর রশীদ নিজ কার্যালয়ে সাংবাদিকদের বলেন, এটি একটি নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড। বিষয়টি নিয়ে আমরা নিবিড়ভাবে ভারতীয় পুলিশের সঙ্গে কাজ করছি।

কিলিং মিশনের পরিকল্পনা

তদন্তে জড়িত ডিবির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ব্যবসায়িক দ্বন্দ্বের জেরে অনেক দিন ধরেই এমপি আজীমকে হত্যার পরিকল্পনা করে যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী আক্তারুজ্জামান শাহীন। শাহীন ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুরের বাসিন্দা ও পৌর মেয়রের ছোট ভাই।

গত ৩০ এপ্রিল আক্তারুজ্জামান শাহীন কলকাতায় যান। তার সঙ্গে নেন চরমপন্থি নেতা আমান ও সিলিস্তা রহমান নামে এক বান্ধবীকে। এর আগেই কলকাতার নিউ টাউন এলাকার সঞ্জিভা গার্ডেনের একটি ডুপ্লেক্স ফ্ল্যাট ভাড়া করেন তিনি। সেই ফ্লাটেই ওঠেন তারা। ওই ফ্লাটে আগে থেকেই অবস্থান করছিলেন শাহীনের দুই সহযোগী সিয়াম ও জিহাদ। সেখানে বসে তারা এমপি আনারকে হত্যার চুড়ান্ত পরিকল্পনা করেন।

বিজ্ঞাপন

কিলিং মিশনের পুরো দায়িত্ব আমানকে বুঝিয়ে দিয়ে গত ১০ মে বাংলাদেশে চলে আসেন শাহীন। পরিকল্পনা অনুযায়ী আমান বাংলাদেশ থেকে আরও দুই ভাড়াটে কিলার ফয়সাল শাজী ও মোস্তাফিজকে গত ১১ মে নিয়ে যায় কলকাতায়।

কিলিং মিশন সমাপ্ত

আমানকে জিজ্ঞাসাবাদে প্রাপ্ত তথ্যের বরাতে গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানান, বেশ কিছুদিন ধরেই এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে এমপি সাহেব ১২ মে কলকাতায় যাবেন চিকিৎসার জন্য। শাহীনও জানার পরই মূলত হত্যার চুড়ান্ত পরিকল্পনা করেন। সেই অনুযায়ী এমপি আনারকে হত্যার জন্য প্রস্তুতি নিতে বলেন এবং ওই ফ্লাটে একাধিক চাপাতিও সংগ্রহ করে রাখে তারা।

গত ১২ মে চুয়াডাঙ্গার দর্শনা সীমান্ত দিয়ে কলকাতায় যান এমপি আনার। প্রথম দিন তিনি তার বন্ধু গোপালের বাসায় থাকেন। পরদিন ১৩ মে কৌশলে এমপি আনারকে নিউ টাউনের ওই ফ্ল্যাটে ডেকে নিয়ে যায় হত্যাকারীরা।

বিকেলের দিকে এমপি আনার সঞ্জিভা গার্ডেনের ওই ফ্ল্যাটে যান। এরপর আমান তার সহযোগী ফয়সাল, মোস্তাফিজ, সিয়াম ও জিহাদ মিলে এমপিকে চাপাতির মুখে জিম্মি করে। এ সময় এমপির কাছে শাহীনের পাওনা টাকা পরিশোধের কথাও বলে তারা। বিষয়টি নিয়ে তর্কাতর্কির একপর্যায়ে সবাই মিলে আনারকে জাপটে ধরে বালিশ চাপা দিয়ে হত্যা করে। হত্যার পর বিষয়টি শাহীনকে নিশ্চিত করেন আমান।

বিজ্ঞাপন

লাশ গুম করতে করা হয় অসংখ্য টুকরো

আমানের দেওয়া তথ্যের বরাতে গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানান, শাহীনের পরামর্শ মতো লাশ গুম করতে এমপি আনারকে কেটে টুকরো টুকরো করা হয়। এরপর ফ্ল্যাটের কাছেই শপিং মল থেকে আনা হয় দুটো বড় ট্রলিব্যাগ ও পলিথিন। এমপি আনারের মরদেহের টুকরোগুলো পলিথিনে পেঁচিয়ে ট্রলিব্যাগে ভরা হয়। এরপর ঘটনার রাতে লাশের টুকরোসহ দুটি ট্রলিব্যাগ বাসাতেই রাখা হয়। এরমধ্যে তারা বাইরে থেকে ব্লিচিং পাউডার এনে ঘরের রক্তের দাগ পরিষ্কার করে।

বুধবার কলকাতা পুলিশ ওই ফ্ল্যাট ও আশপাশের ভবনের সব সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করে দেখেছে, আমান ও তার সহযোগীরা মিলে ট্রলিব্যাগ আনা-নেওয়া করছে। এমপি আনারের বাইরে রাখা জুতা ভেতরে নেওয়ার দৃশ্যও দেখা যায়। এছাড়া বান্ধবী সিলিস্তা রহমান বাইরে থেকে পলিথিন ও ব্লিচিং পাউডার নিয়ে হাঁটছে এটাও দেখা যায়।

গোয়েন্দাদের কাছে আমানের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী, এমপি আনারকে হত্যার পর টুকরো টুকরো করে ১৪ মে বিকেলে একটি ট্রলিব্যাগ হাতে নিয়ে বাসা থেকে বের হন আমান। এরপর পাশের একটি শপিং মলের সামনে সেই ট্রলিব্যাগটি সিয়ামের হাতে তুলে দেন। সিয়াম সেই ব্যাগ নিয়ে তাদের আগে থেকেই ভাড়া করে রাখা গাড়ি নিয়ে অজ্ঞাত স্থানের দিকে চলে যান। তবে সেই গাড়িচালককে কলকাতা পুলিশ আটকের পর জানতে পেরেছে, গাড়ি কিছু দূর যাওয়ার পর ব্যাগটি নিয়ে নেমে যান সিয়াম।

আমান জানান, লাশের টুকরোসহ আরেকটি ব্যাগ বাসাতেই ছিল। সেই ব্যাগ থেকে দুর্গন্ধও ছড়ানো শুরু করে। পরে লাশের ওই টুকরোসহ ব্যাগটি সহযোগীদের অন্য কোথাও ফেলে দেওয়ার নির্দেশনা দিয়ে ১৫ মে সিলিস্তাকে নিয়ে ঢাকায় চলে আসেন আমান। আর আমানের দুই সহযোগী এমপি আনারের ব্যবহৃত দুটি মোবাইল নিয়ে দুই দিকে চলে যায়, যাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এমপি আনারের অবস্থান সম্পর্কে বিভ্রান্ত হয়। এরপর ১৭ মে মোস্তাফিজ ও ১৮ মে ফয়সাল বাংলাদেশে ফেরত আসেন।

পাঁচ কোটি টাকায় চুক্তি

জিজ্ঞাসাবাদে আমান জানিয়েছেন, এমপি আনোয়ারুল আজীম আনারকে হত্যার জন্য পাঁচ কোটি টাকা দিতে চেয়েছিলেন আক্তারুজ্জামান শাহীন। হত্যাকাণ্ডের আগে কিছু টাকা পরিশোধ করেন। বাকি টাকা হত্যার পর দেওয়ার কথা ছিল। হত্যার পর লাশ গুমের দায়িত্ব দিয়ে আমান ঢাকায় এসে শাহীনের সঙ্গে সাক্ষাত করে। তবে শাহীন তাকে কত টাকা দিয়েছেন সে বিষয়ে কোনো উত্তর দেননি আমান। ঢাকায় এসে মোহাম্মদপুরের বোনের বাসায় আত্মগোপনে ছিলেন আমান। সেখান থেকেই তাকে আটক করে গোয়েন্দা পুলিশ। এরপর আজীমকে খোঁজাখুঁজি শুরু হলে গত ১৮ মে ভারত চলে যান শাহীন।

গোয়েন্দারা জানিয়েছেন, ভারত থেকে শাহীন নেপালে যান। গত ২১ মে নেপাল থেকে দুবাই যান এবং সবশেষ ২২ মে দুবাই থেকে যুক্তরাষ্ট্রে গেছেন তিনি।

গোয়েন্দা পুলিশর ধারণা, এমপি হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে রয়েছে সোনা চোরাচালানের অর্থ ভাগাভাগিকে কেন্দ্র করে। শাহীন নিজেও একজন সোনা চোরাচালানকারী। এমপি আজীমের বিরুদ্ধেও সোনা চোরাচালানের অভিযোগ রয়েছে। কলকাতায় শাহীন ও আজিমের যৌথ ব্যবসা রয়েছে।

এ ঘটনায় ডিএমপির শেরেবাংলা নগর থানায় নিহত এমপি আজীমের মেয়ে ডরিন একটি হত্যা মামলা করেছেন। এমপি আজিম সংসদ ভবন এলাকায় থাকতেন এবং সেখান থেকেই ভারতে গিয়েছিলেন বলে এই  থানায় মামলা করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন তেজগাঁও বিভাগের উপ কমিশনার এইচ এম আজিমুল হক। এছাড়া কলকাতা পুলিশ বাদী হয়ে আরও একটি মামলা করেছে।

সারাবাংলা/ইউজে/ইআ

Tags: , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন