বিজ্ঞাপন

মুসলিমদের অনগ্রসর শ্রেণি সনদ বাতিলের রায় নিয়ে উত্তাল পশ্চিমবঙ্গ

May 24, 2024 | 10:00 am

আন্তর্জাতিক ডেস্ক

ভারতে চলমান লোকসভা নির্বাচনের মধ্যেই পশ্চিমবঙ্গের কলকাতা হাইকোর্ট এক রায়ে দেশটির অনগ্রসর শ্রেণির সংরক্ষণ সংক্রান্ত সনদ বাতিল করেছেন। আদার ব্যাকওয়ার্ড ক্লাস বা ওবিসি সংরক্ষণের এই সনদ বাতিলের রায় ঘিরে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে।

বিজ্ঞাপন

বিবিসির খবরে বলা হয়, রায়ের পর পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতাসীন তৃণমূল বলছে, মুসলিমদের সংরক্ষণ কেড়ে নিতে চায় বিজেপি সরকার। বামপন্থিদের অভিযোগ, পিছিয়ে পড়া সম্প্রদায়ের মানুষের উন্নয়নের জন্য যে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল তার অপব্যবহার করেছে তৃণমূল। অন্যদিকে হাইকোর্টের রায়কে স্বাগত জানিয়েছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।

কলকাতা হাইকোর্ট রায়ে বলেছেন, ২০১০ সালের পর থেকে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার অনগ্রসর শ্রেণি হিসেবে যাদের ওবিসি সার্টিফিকেট দিয়েছে, তার সবই বাতিল হিসেবে গণ্য হবে। এর ফলে ৭৭টি শ্রেণিকে দেওয়া প্রায় পাঁচ লাখ ওবিসি সনদ বাতিল হয়ে গেছে। এর মধ্যে বেশির ভাগই মুসলিম। সনদ বাতিল হলেও ওই সনদ ব্যবহার করে যারা কোরো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হয়েছেন বা চাকরি করছেন, তাদের ওপর রায়ের কোনো প্রভাব পড়বে না।

পশ্চিমবঙ্গে মুসলিমদের প্রথম ওবিসির অধীনে নিয়ে আসে ব্রামফ্রন্ট। পরে ২০১১ সালে ক্ষমতায় আসে তৃণমূল সরকার। আদালত রায়ে বলছেন, নির্বাচনি ফায়দা লোটার জন্যই রাজ্য সরকার ওবিসি সনদগুলো বিতরণ করেছিল। অর্থাৎ যাদের ওবিসি সনদ দেওয়া হয়েছিল, মূলত তাদের ভোটব্যাংক হিসেবে ব্যবহারের প্রয়াস ছিল, যা একদিনে সংবিধানের লঙ্ঘন অন্যদিকে মুসলিমদের জন্য অবমাননার সামিল।

বিজ্ঞাপন

বিচারপতি তপোব্রত চক্রবর্তী ও বিচারপতি রাজাশেখর মান্থার হাইকোর্ট বেঞ্চ রায়ে ২০১২ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অনগ্রসর জাতি সংক্রান্ত বিধিকে বাতিল করেছে। ওই বিধির ১৬ নম্বর ধারা রাজ্য সরকারকে অনগ্রসর শ্রেণি সংক্রান্ত তফসিল সংযোজন, সংশোধন বা পরিবর্তন করার অনুমতি দেয়। ওই বিধি মেনে যে ৩৭টি শ্রেণিকে অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণির তালিকায় যোগ করেছিল রাজ্য সরকার, তাও বাতিল করেছে আদালত। কারণ তা নিয়ম বহির্ভূতভাবে করা হয়েছিল বলে মনে করছে হাইকোর্ট।

আদালতের রায়ে বলা হয়েছে, অনগ্রসর জাতির তালিকায় নতুন ভাবে কয়েকটি সম্প্রদায়কে অন্তুর্ভুক্ত করা এবং ওবিসি সনদ জারি করার ক্ষেত্রে অনগ্রসর জাতি সংরক্ষণ আইন মানা হয়নি। নিয়মমাফিক জাতিগত সমীক্ষা হয়নি, খসড়া তালিকা সামনে আসেনি, কোন রিপোর্টের ভিত্তিতে এই সংরক্ষণ তাও জানানো হয়নি। কেন কয়েকটি শ্রেণিকে ওই তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হলো, সে বিষয়ে সঠিক তথ্য পেশ করতে পারেনি রাজ্য সরকার।

আদালতের রায়ে ২০১০ সালের বাম সরকারের শাসনামলের কথা বলা হয়েছে, ওই বছর মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য ১০% সংরক্ষণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এর জন্য তখন ক্ষমতায় থাকা বামপন্থিরা ‘ওবিসি-এ’ ক্যাটাগরি তৈরি করেছিল। সে সময় অনগ্রসর জাতি কমিশনের পক্ষে অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণির তালিকায় ৪২টি শ্রেণিকে অন্তর্ভুক্ত করার সুপারিশ জানানো হয়, এর মধ্যে ৪১টিই ছিল মুসলিম সম্প্রদায়ের অন্তর্গত।

বিজ্ঞাপন

মমতা ব্যানার্জীর সরকার ক্ষমতায় আসার পর ওবিসি-এ এবং ওবিসি-বি ক্যাটাগরি মিলিয়ে আরও ৩৭টি শ্রেণিকে ওই তালিকায় যোগ করে ২০১২ সালে। আদালত ওবিসি তালিকা তৈরির এই প্রক্রিয়ার তীব্র সমালোচনা করেছেন। বলেছেন, ওবিসি হিসেবে অন্তর্ভুকি নির্বাচনে সুবিধা পাওয়ার জন্য করেছে রাজ্য সরকার। এটি সংবিধানবিরোধী এবং বৈষম্যমূলক।

হাইকোর্টের বিচারপতিরা বলেন, আদালত এ বিষয়ে সন্দেহমুক্ত নয় যে উল্লিখিত সম্প্রদায়কে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে পণ্য হিসাবে বিবেচনা করা হয়েছে। ঘটনা পরম্পরা থেকে এটা বোঝা যায় যে ৭৭টি শ্রেণির অন্তর্ভুক্তিকরণ এবং তাদের ওবিসি হিসেবে সনদ দেওয়ার জন্য গণ্য করা তাদের ভোট ব্যাংক হিসাবে বিবেচনা করার জন্যই।

কলকাতা হাইকোর্টের নির্দেশের প্রসঙ্গে জাতীয় অনগ্রসর কমিশনের প্রধান হংসরাজ গঙ্গারাম আহির বার্তা সংস্থা এএনআইকে বলেছেন, ‘২০২৩ সালে রিভিউ করার সময় আমরা লক্ষ্য করি ২০১০ সালের পর ৬৫টি মুসলিম ও ছয়টি হিন্দু বর্ণকে ওবিসি তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। রাজ্য সরকারের কাছে আমরা সংশ্লিষ্ট তথ্য জানতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তারা তা দেননি। আদালতের রায় একদম সঠিক এবং আমরা একে স্বাগত জানাই।’

এ প্রসঙ্গে কর্ণাটকের কথাও টেনেছেন হংসরাজ গঙ্গারাম আহির। তিনি বলেন, ‘কর্ণাটকেও মুসলিমদের ওবিসি তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। সেখানেও এই একই জিনিস (কলকাতা হাইকোর্টের রায়কে ইঙ্গিত করে) হবে। আমরা অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণির বিরুদ্ধে নই। আমরা চাই যারা আসলেই ওই শ্রেণির মধ্যে পড়েন তারা যেন তাদের অধিকার ফিরে পান।’

বিজ্ঞাপন

আদালতের রায় প্রকাশের পর পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী তৃণমূল প্রধান মমতা ব্যানার্জি তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছেন। বলেছেন, এই রায় তিনি মানবেন না। এর বিরুদ্ধে আইনি লড়াই চালিয়ে যাবেন।

মমতা বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী (নরেন্দ্র মোদি) কয়েকদিন ধরে বলে বেড়াচ্ছেন, সংরক্ষণ কেড়ে নেবেন। সেটা কখনো হয়? তাহলে তো সংবিধান ভেঙে দিতে হয়। এটা হতে পারে না। এই রায় আমি মানি না। যতদূর যেতে হয় যাব।’

সরাসরি বিজেপির বিরুদ্ধে ধর্মীয় মেরুকরণের অভিযোগ তুলে মমতা বলেন, ‘দেশে কখনো ভাগাভাগি হয় না। এটা বাংলার কলঙ্কিত অধ্যায়। হিন্দুকে বাদ দিলাম, মুসলিমকে রাখলাম— এটা কখনো হতে পারে? এদের স্পর্ধা তো কম নয়!’

সব নিয়ম মেনেই তার শাসনামলে ওবিসি তালিকা তৈরি হয়েছে এবং সংশ্লিষ্ট সমীক্ষাও করা হয়েছিল জানিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বলেন, ‘আমরা সমীক্ষা করেছিলাম। উপেন বিশ্বাস চেয়ারম্যান ছিলেন। কোর্টে তখনো কেস হয়েছিল। বিজেপি হেরে গিয়েছিল। এবারেও তাই হবে।’

এদিকে এ রায়কে স্বাগত জানিয়েছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। বিরোধী দলগুলোর জোট ‘ইন্ডিয়া’কে কটাক্ষ করে তিনি বলেন, ‘হাইকোর্টের রায় ইন্ডিয়া মঞ্চের কাছে একটা সপাটে চড়। আদালত ২০১০-এর পর জারি হওয়া সব সনদ বাতিল করে দিয়েছে। এটা কেন হলো? কারণ, ভোট ব্যাংকের কথা মাথায় রেখে পশ্চিমবঙ্গ সরকার মুসলিমদের যেনতেনভাবে ওবিসি বানানোর জন্য সনদ দিয়ে দিয়েছিল।’

মমতা ব্যানার্জির সমালোচনা করে বিজেপি নেতা কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বলেন, ‘মমতা ব্যানার্জি যে পিছিয়ে পড়া সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে, সেটা ফাঁস করে দিয়েছেন কলকাতা হাইকোর্ট। তিনি অনগ্রসর শ্রেণির মানুষের অধিকার ছিনিয়ে নিয়ে মুসলসমানদের দিয়ে দিয়েছেন। উনি সবকিছুই মানব না বলেন। আবার আদালতের রায় না মানার কথা বলার অর্থ কিন্তু আদালতকে অবমাননা করা।’

জানতে চাইলে পশ্চিমবঙ্গের বামপন্থি দল সিপিআইএমের সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি বলেন, ‘আদালতের রায় বিস্তারিত পড়ে দেখতে হবে। এ বিষয়ে তারপর মন্তব্য করতে পারব।’ তবে মোদির সমালোচনা করে তিনি বলেন, ‘বিজেপি চার শর বেশি আসনের কথা বলে থাকে। কারণ তারা সংবিধান বদল করতে চায়। সংবিধান রক্ষা করতে হলে ক্ষমতায় আসা থেকে ওদের রুখতে হবে।’

মুসলিমদের উন্নয়নের কথা ভেবেই তাদের ওবিসি সনদ দেওয়া হয়েছিল বলে জানিয়েছেন সিপিএম রাজ্য সম্পাদক মোহাম্মদ সেলিম। তিনি বলেন, ‘রঙ্গনাথ মিশ্র কমিশনের সুপারিশ মেনে আমরা ওবিসি সংরক্ষণ ১৭ শতাংশ করেছিলাম। ওই সুপারিশ অনুযায়ী সংখ্যালঘু, মূলত মুসলিমদের সম্প্রদায়ের শিক্ষা, চাকরি এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে উন্নয়নের জন্য এই অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছিল। হাইকোর্ট ২০১০ সালের আগের সেই তালিকা বজায় রেখেছে।’

তৃণমূল সরকার ক্ষমতায় আসার পর ওবিসি সনদ দিয়ে অনিয়ম হয়েছে দাবি করে সেলিম বলেন, ‘জনপ্রিয় হয়ে ওঠার জন্য খোলামকুচির মতো ওবিসি সনদ বিলি করা হয়েছে কমিশন এবং সংবিধান না মেনে। রাজনৈতিক স্বার্থেই তা করা হয়েছে।’

সারাবাংলা/টিআর

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন