বিজ্ঞাপন

আইএমএফ-বিশ্বব্যাংক নয়, ভর্তুকি-প্রণোদনার সিদ্ধান্ত নিজেদের

May 28, 2024 | 11:00 pm

জোসনা জামান, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা: জাতীয় সংসদে নতুন অর্থবছরের জাতীয় বাজেট পেশের সময় ঘনিয়ে এসেছে। নতুন বাজেটে কী থাকছে আর কী থাকছে না— এসব নিয়ে এখন চলছে জল্পনা-কল্পনা। বিশেষ করে জনসম্পৃক্ত কয়েকটি খাতে ভর্তুকি ও প্রণোদনার বিষয়টি রয়েছে আলোচনায়। চলতি অর্থবছরের বাজেটেও বেশকিছু খাতে ভর্তুকি ও প্রণোদনা কমাতে হয়েছিল, যার পেছনে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণ পাওয়ার জন্য শর্তপূরণ বড় ভূমিকা রেখেছিল। তবে পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী মো. শহীদুজ্জামান সরকার জানাচ্ছেন, আইএমএফ বা বিশ্বব্যাংকের পরামর্শ আমলে নিলেও এসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত একান্তই সরকারের।

বিজ্ঞাপন

সারাবাংলার সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী বলেন, আমরা আমাদের মতো করেই সিদ্ধান্ত নেব। কারণ তারা অন্যান্য দেশের সঙ্গে তুলনা করেই পরামর্শ দিয়ে থাকে। আর আমাদের অর্থনীতিকে এগিয়ে নিতে কোথায় কোথায় ভর্তুকি ও প্রণোদনা দরকার, সেটা আমরাই ভালো বুঝব।

মঙ্গলবার (২৮ মে) নিজ কার্যালয়ে সারাবাংলার সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় প্রতিমন্ত্রী এমন কথা বলেছেন। আগামী অর্থবছরের সার্বিক বাজেট ও উন্নয়ন বাজেট এবং অর্থনীতির বিভিন্ন খুঁটিনাটি বিষয় উঠে এসেছে এই সাক্ষাৎকারে।

বাজেটে জনসম্পৃক্ত বিভিন্ন খাতে ভর্তুকি ও প্রণোদনা কমানোর বিষয়টি আলোচনায় আসে আইএমএফের ঋণ ঘিরে। বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ কমতে থাকায় এই ঋণপ্রাপ্তি বাংলাদেশের জন্য ছিল গুরুত্বপূর্ণ, গত বছরের ৩০ জানুয়ারি যা মঞ্জুর করে আইএমএফ। কিন্তু এই ঋণের শর্তেই ছিল বিভিন্ন খাতে ভর্তুকি-প্রণোদনা কমানোর কথা। এর মধ্যে বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে ভর্তুকি কমানো এবং এ বছরেরই জানুয়ারিতে রফতানিতে প্রণোদনা কমানোর বিষয়টি ব্যাপক আলোচনায় ছিল। এর মধ্যেই গত এপ্রিলেও আইএমএফের একটি প্রতিনিধি দল অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে বৈঠক করে ভর্তুকি কমিয়ে বাজেট ঘাটতি কম রাখার পরামর্শ দিয়েছে।

বিজ্ঞাপন

বাজেটে ভর্তুকি ও প্রণোদনা নিয়ে এসব পরামর্শকে সরকার কতটা বাস্তবায়ন করছে— সারাবাংলার এমন প্রশ্নের জবাবে প্রতিমন্ত্রী শহীদুজ্জামান সরকার বলেন, ‘ভর্তুকি ও প্রণোদনা অর্থনীতিকে চাঙ্গা রাখতেই প্রয়োজন। অর্থনীতিকে শক্তিশালী করতে গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলোতে এটি অব্যাহত রাখতে হবে। আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংক বিভিন্ন দেশকে যেভাবে দেখে, আমাদেরও একইভাবে দেখে থাকে। আমরা তাদের পরামর্শ গ্রহণ করব, তবে আমরা সিদ্ধান্ত নেব আমাদের মতো করেই। কারণ আমরা জানি কোন খাতে গুরুত্ব দিয়ে ভর্তুকি ও প্রণোদনা বজায় রাখা প্রয়োজন।’

নিজ দফতরে পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শহীদুজ্জামান সরকার। ছবি: সারাবাংলা

অর্থ বিভাগ সূত্রে অবশ্য জানা গেছে, আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটের তুলনায় ভর্তুকি বেশিই থাকছে। চলতি অর্থবছরের বাজেটে ভর্তুকি খাতে মূল বরাদ্দ ছিল এক লাখ ১০ হাজার ৬৭২ কোটি টাকা। সংশোধিত বাজেটে তা ছিল ৯৮ হাজার কোটি টাকা। সেখানে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে ভর্তুকি প্রস্তাব থাকছে এক লাখ ১২ হাজার কোটি টাকা।

ভর্তুকির মতো সামাজিক নিরাপত্তা খাতেও বরাদ্দ বাড়ছে। চলতি ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরের বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তার আওতায় ৪৭টি কর্মসূচি বাস্তবায়নে বরাদ্দ রাখা হয়েছিল এক লাখ ২৬ হাজার ২৭২ কোটি টাকা। অর্থ মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানিয়েছে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে এই বরাদ্দ থাকতে পারে এক লাখ ৩৫ হাজার কোটি টাকার বেশি।

বিজ্ঞাপন

সামাজিক নিরাপত্তার এই অর্থ কতটা ও কীভাবে কাজে লাগে— এমন প্রশ্নের জবাবে শহীদুজ্জামান সরকার বলেন, ‘সরকার যে ভাতা দিচ্ছে সেটি ওই ব্যক্তির টিকে থাকার জন্য, তার পরিবার-পরিজনের খরচ চালানোর জন্য নয়। তিনি যেন অন্তত ক্ষুধা নিবারণ করতে পারেন, সে কারণে সহায়তা দেয় সরকার, তার সব খরচ চালানোর জন্য নয়। সরকার যে তীব্র অভাবগ্রস্ত মানুষটির পাশে আছে, সেটি বোঝানোর জন্য সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বৈষম্য কমানো ও দারিদ্র্য নিরসনেও এর ভূমিকা আছে। সে কারণেই আগামী বাজেটেও সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ ও উপকারভোগীর সংখ্যা বাড়বে।’

পরিকল্পনামন্ত্রী আরও বলেন, ‘পুরো বাজেট নিয়ে কথা বলবেন অর্থমন্ত্রী। সেটি বলার দায়িত্ব আমার নয়। তারপরও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী হিসেবে কিছু বিষয়ে কাজ করতেই হয়। সেই জায়গা থেকেই বলছি, আগামী অর্থবছরের বাজেটের মূল লক্ষ্য হচ্ছে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, কর্মসংস্থান তৈরি এবং সার্বিকভাবে সরকারের নির্বাচনি ইশতেহার বাস্তবায়ন করা।’

বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) প্রণয়নে কোন কোন বিষয়কে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে— জানতে চাইলে প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘এডিপি তৈরিতে সবার আগে গুরুত্ব পেয়েছে কর্মসংস্থান তৈরি, বৃহত্তর অর্থে বলতে গেলে দারিদ্র্য বিমোচন। কেননা আমরা যা কিছুই করি তার মূলেই রয়েছে দেশের মানুষের উন্নয়ন করা, তাদের অবস্থার পরিবর্তন করা। এ জন্য সবার আগে তাদের দারিদ্র্য অবস্থা থেকে বের করে আনতে হবে। তাদের জন্য কাজের ব্যবস্থা করতে হবে। সেভাবেই এডিপি তৈরি করা হয়েছে।’

পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে জানা গেছে, আগামী অর্থবছরের এডিপিতে বৈদেশিক সহায়তাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। দুই লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকার নতুন এডিপিতে এক লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা ধরা হয়েছে সরকারি তহবিল থেকে। বাকি এক লাখ কোটি টাকার সংস্থান বিদেশি সহায়তা থেকে ধরা হয়েছে। এর আগে কখনো এডিপিতে এত বেশি বিদেশি সহায়তা প্রাক্কলন করা হয়নি। এর পেছনে সুনির্দিষ্ট কোনো কারণ রয়েছে কি না— এমন প্রশ্নও রাখা হয় প্রতিমন্ত্রীর কাছে।

বিজ্ঞাপন

জবাবে পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা আমদানিনির্ভর দেশ। এখন অর্থনীতির চাপ সামলাতে সক্ষমতার ওপর চাপ পড়ছে। সে কারণেই প্রকল্প বাস্তবায়নে বৈদেশিক ঋণের ব্যবহার বাড়ানোর দিকে নজর দেওয়া হয়েছে। উন্নয়নের ধারাবাহিকতা রক্ষায় ঋণ নেওয়া হচ্ছে। তবে সেটি ঋণ ধারণক্ষমতার বাইরে যায়নি। আমরা বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের সক্ষম।’

মেগা প্রকল্প থেকে শুরু করে নানা ধরনের উন্নয়ন প্রকল্প সরকার প্রতিনিয়তই অনুমোদন করছে। কোনোটির বাস্তবায়ন হচ্ছে ধীরগতিতে, কোনোটির স্বাভাবিক গতিতে। কিন্তু এসব উন্নয়ন প্রকল্পে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে প্রমাণও রয়েছে।

এসব দুর্নীতি-অনিয়মে উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর লক্ষ্যপূরণ হচ্ছে কি— জানতে চাইলে শহীদুজ্জামান সরকার বলেন, ‘এটা ঠিক যে আমরা দুর্নীতি রোধে এখনো কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারিনি। তবে জি কে শামীমদের মতো একক ঠিকাদারের আধিপত্য আর থাকবে না। আমরা সরকারি ক্রয় আইন ও বিধিমালা সংশোধনের কাজ করছি। টেন্ডারবাজি যেন না হয় তার জন্য কিন্তু ইজিপি চালু করা হয়েছে। এখন আর কেউ টেন্ডার বাক্সের ওপর পা তুলে বসে থাকতে পারে না। এখন কেউ কাউকে টেন্ডারে অংশগ্রহণ থেকে ঠেকাতে পারে না। এসবের সুফল কিন্তু ধীরে ধীরে আসছে।’

সরকার সুশাসন নিশ্চিত করতে বদ্ধ পরিকর জানিয়ে পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘এখন অনিয়ম-দুর্নীতি ঠেকাতে অনেক জায়গাতেই সব সিস্টেম ডিজিটাল করে ফেলা হচ্ছে। ইজিপিতে যেমন দরপত্র আহ্বান থেকে শুরু করে এ সংক্রান্ত সব কাজ করা হচ্ছে। আবার আগে বেসরকারি শিক্ষক নিয়োগে লাখ লাখ টাকা লেনদেন হতো। সেটি বন্ধ করতে প্রধানমন্ত্রী শিক্ষক নিয়োগের দায়িত্ব দিলেন বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষকে (এনটিআরসিএ)। প্রধানমন্ত্রী প্রতিনিয়তই চেষ্টা করে যাচ্ছেন সুশাসন নিশ্চিত করার জন্য। ইজিপির মতো সবকিছুই তিনি অনলাইন ও ডিজিটাল করার জন্যই কাজ করছেন। স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার যে ভিশন, তার পেছনেও সেই অনিয়ম-দুর্নীতিমুক্ত স্বচ্ছ একটি ব্যবস্থা সবখানে গড়ে তোলার লক্ষ্যই রয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার।’

সারাবাংলা/জেজে/টিআর

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন