বিজ্ঞাপন

নরেন্দ্র মোদি: বিভক্ত ভারত ইতিহাসের দ্বারপ্রান্তে

June 4, 2024 | 4:38 pm

সারাবাংলা ডেস্ক

ঢাকা: ২০১৪ সালে প্রথমবার ভারতের ক্ষমতায় আসেন ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) নেতা নরেন্দ্র মোদি। দেশটির ২০১৯ সালের সাধারণ নির্বাচন তথা লোকসভা নির্বাচনেও তার ও বিজেপির অগ্রযাত্রা ছিল অব্যাহত। দ্বিতীয়বারের মতো ভারতের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন মোদি। দুই মেয়াদে টানা ১০ বছর ক্ষমতায় থাকা মোদি ও বিজেপি এবারের নির্বাচনেও জয় প্রত্যাশা করছে।

বিজ্ঞাপন

মঙ্গলবার (৪ জুন) ভারতের লোকসভা নির্বাচনের ভোট গণনা শুরু হয়েছে। ভারতীয় গণমাধ্যমগুলোর খবর বলছে, বিকেল পর্যন্ত সবশেষ খবরে বিজেপির নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স (এনডিএ) ৫৪টি আসনে জয় পেয়েছে, এগিয়ে রয়েছে ২৩২টি আসনে। তাদের প্রধান প্রতিপক্ষ কংগ্রেসসহ অন্যদের জোট ‘ইন্ডিয়া’ আসন পেয়েছে ২৫টি, এগিয়ে রয়েছে আরও ১৭৬টি আসনে। অন্য দলগুলোর ৫৬টি আসনে জয় পাওয়া বা এগিয়ে থাকার তথ্য মিলেছে।

ভারতীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষকরা বলছেন, নরেন্দ্র মোদির ‘৪০০ পার’ তথা ৪০০ আসনে জয়ের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ না হলেও তার দল ও তাদের নেতৃত্বাধীন জোটই নির্বাচনে জয় পাবে। সে ক্ষেত্রে ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরুর পর মোদিই প্রথম ব্যক্তি হিসেবে টানা তৃতীয় মেয়াদে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হতে যাচ্ছেন— এটি বলাই যায়।

ভারতীয় লোকসভা নির্বাচনের ফল গণনার প্রাক্কালে অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস মোদিকে নিয়ে একটি বিশ্লেষণমূলক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। তাতে বলা হয়েছে, ২০১৪ সালে প্রথম ক্ষমতায় আসার পর থেকে গত ১০ বছরে ভারতের রাজনৈতিক পটভূমি পালটে দিয়েছেন নরেন্দ্র মোদি। ব্যক্তি জনপ্রিয়তায় তিনি ছাপিয়ে গেছেন দলকে। তার ব্যক্তি কারিশমায় ভারতের সংসদীয় নির্বাচনের চেহারা বদলে ক্রমশ প্রেসিডেন্সিয়াল ধাঁচের নির্বাচনে পরিণত হয়েছে। ফলে ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য বিজেপিকে নির্ভর করতে হয়েছে ‘মোদি ব্র্যান্ডে’র ওপর। এমনকি রাজ্য নির্বাচন তথা বিধানসভা নির্বাচনেও স্থানীয় নেতারা পেছনের সারিতে চলে যাচ্ছেন। সবখানেই মুখ কেবল মোদি।

বিজ্ঞাপন

নয়া দিল্লিভিত্তিক জননীতিবিষয়ক থিংক ট্যাংক সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চের প্রেসডেন্ট ইয়ামিনি আইয়ারও মনে করছেন, কেবল মোদির ওপর ভর করেই এবারের নির্বাচনে প্রচার চালিয়েছি বিজেপি। ইয়ামিনি বলেন, ‘মোদি শুধু প্রধান প্রচারকারী ছিলেন না, এই নির্বাচনে তিনি ছিলেন একমাত্র প্রচারকারী।’

এপি বলছে, সমর্থকরা মোদিকে দেখেন একজন স্বনির্ভর ও শক্তিশালী নেতা হিসেবে, যিনি বিশ্বে ভারতের অবস্থান উন্নত করেছেন। তারা মোদির ব্যবসায়বান্ধব নীতিকেও স্বাগত জানান। ভারত যে বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনীতির দেশে পরিণত হয়েছে, তার পেছনেও তারা মোদির এই নীতিকেই কারণ হিসেবে দেখেন।

তবে মোদির অধীনে ভারতের অর্থনীতিতে বৈষম্যও বেড়েছে। একদিকে ভারতের পুঁজিবাজারে নতুন নতুন রেকর্ড হয়েছে, লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে কোটিপতির সংখ্যা; অন্যদিকে তরুণদের মধ্যে ব্যাপক হারে বেড়েছে বেকারত্ব। অর্থনীতি বিশ্লেষকদের অভিমত, মোদির এই ব্যবসায়বান্ধব নীতির কারণে যে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, তার সুবিধাভোগী ভারতের খুব অল্পসংখ্যক মানুষ।

বিজ্ঞাপন

এদিকে মোদির এক দশকের শাসন ভারতকে ধর্ম ও রাজনীতিতে গভীরভাবে বিভক্ত করেছে বলেই মনে করেন বিশ্লেষকরা। সমালোচকরা বলছেন, মোদির হিন্দু ধর্মভিত্তিক রাজনীতি দেশে অসহিষ্ণুতা ও ঘৃণা ছড়িয়েছে। পাশাপাশি সংখ্যালঘু, বিশেষ করে মুসলিম জনগোষ্ঠীর ওপর নির্লজ্জ আক্রমণ আগের তুলনায় বেড়েছে। অথচ ভারতের মোট জনসংখ্যার ১৪ শতাংশ মুসলিম।

মোদির সমালোচকরা বলছেন, তার সরকারের অধীনে দেশের গণতন্ত্র নড়বড়ে হয়ে পড়েছে। রাজনৈতিক বিরোধীদের দমিয়ে রাখার জন্য সরকার ক্রমশ শক্তি ব্যবহার করছে, স্বাধীন গণমাধ্যমের জায়গা সীমিত করে দিচ্ছে এবং ভিন্নমত দমন করছে। সরকার অবশ্য সমালোচকদের অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছে, দেশ গণতন্ত্র বিকশিত হচ্ছে।

গত এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে যখন ভারতের লোকসভা নির্বাচনের ভোট গ্রহণ শুরু হয়, তখন বিজেপি তাদের প্রচারণায় ‘মোদির গ্যারান্টি’র ওপর জোর দিয়েছিল। অর্থনীতি, দারিদ্র্য বিমোচন ও সমাজসেবায় বিজেপির সাফল্যকেই প্রচারের মূল হাতিয়ার করেছিল।

মোদি নিজেও তার নির্বাচনি জনসভাগুলোতে ভারতের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিকেই বার বার প্রচারের আলোয় নিয়ে আসার চেষ্টা করেছেন। মোদি বলেন, তার হাতে শাসনভার থাকলে ২০৪৭ সালের মধ্যে ভারত একটি উন্নত দেশে পরিণত হবে।

বিজ্ঞাপন

ভোট বাগাতে লক্ষ্য মুসলিমরা

লোকসভা নির্বাচন সামনে রেখে ভোটের মাঠে মুসলিমদের লক্ষ্য বানিয়ে ফেলেন নরেন্দ্র মোদি। তার বক্তব্য ক্রমেই ধর্মীয় মেরুকরণকে স্পষ্ট করে তুলতে থাকে। বিভিন্ন জনসভায় মোদির বক্তব্য ক্রমেই মুসলিমদের আরও বেশি বেশি লক্ষ্য বানিয়ে ফেলতে থাকে। ধর্মভিত্তিক রাজনীতির এই কৌশল মোদি ও বিজেপির পক্ষেই যায়, বিশেষ করে হিন্দু ভোটারদের কাছে এমন রাজনৈতিক অবস্থান অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে। বলা হয়, মুসলিমবিদ্বেষী এসব বক্তব্য বিজেপি সমর্থক কট্টর হিন্দু ভোটারদের মধ্যে নতুন প্রাণ সঞ্চার করে।

বিরোধী দল কংগ্রেস ও তাদের নেতৃত্বাধীন জোট ‘ইন্ডিয়া’ শুরু থেকেই মোদির এই হিন্দু জাতীয়বাদকে উসকে দেওয়া রাজনীতির সমালোচনা করে আসছে। উদারপন্থি রাজনীতি বিশ্লেষকরাও বলে আসছেন, মোদির এই ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক মেরুকরণ ভারতে গভীর ক্ষত জন্ম দিয়েছে।

কংগ্রেস ও তাদের জোট ‘ইন্ডিয়া’ লোকসভা নির্বাচনে নিজেদের প্রচারে ভারতের অর্থনৈতিক অবস্থা নিয়ে জনমনে অসন্তোষকেই পুঁজি করার চেষ্টা করেছে। বেকারত্বের উচ্চ হার, উচ্চ মূল্যস্ফীতি আর বৈষম্য পরিস্থিতি তাদের পক্ষে ভোট এনে দেবে বলে মনে করছে। তবে এই জোটের দলগুলোর মধ্যে আদর্শগত পার্থক্য রয়েছে। বেশকিছু নেতা দলত্যাগও করেছেন। ফলে এই জোটও মোদির বিজেপির বিরুদ্ধে কতটা কার্যকর হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।

বিরোধীদের জোট আরও দাবি করছে, তাদের অন্যায়ভাবে লক্ষ্যবস্তু বানানো হয়েছে। জোট নেতারা বলছেন, তাদের নেতাদের বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলো তল্লাশি, গ্রেফতার ও দুর্নীতির তদন্ত চালিয়েছে, যেগুলোর কোনো ভিত্তি নেই। এসব অভিযোগের সবই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। মোদি সরকার অবশ্য এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছে।

মোদির কট্টর সমালোচকদের একজন হার্শ মান্দার। একটি বেসরকারি সংস্থা চালান তিনি, যেখানে একাধিকবার অভিযান চালিয়েছে রাষ্ট্রীয় বাহিনী। মান্দার বলেন, গত এক দশকে ভারতের ভারতের গণতন্ত্র উল্লেখযোগ্য পরিমাণে ধ্বংসের দিকে এগিয়েছে। আমাদের বিচার বিভাগ সাংবিধানিক মূল্যবোধ ধরে রাখতে খুব ধারাবাহিক ভূমিকা রাখতে পারেনি। গণমাধ্যমও সরকার দলের ‘চিয়ারলিডার’ হিসেবে কাজ করেছে, মুসলিম সংখ্যালঘুদের বিপক্ষে বিদ্বেষ ছড়াতে সহায়তা করেছে।

সারাবাংলা/একে/টিআর

Tags: , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন