বিজ্ঞাপন

জোটের যুগ ফিরেছে ভারতে, সঙ্গে ফিরবে জোট ধর্মও

June 5, 2024 | 8:53 am

আন্তর্জাতিক ডেস্ক

‘জোট ধর্ম’— ভারতের রাজনীতিতে এই কথাটি বিজেপির প্রয়াত নেতা, সাবেক প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ীর। কিন্তু নরেন্দ্র মোদিকে কখনও জোটসঙ্গীদের উপর ভরসা করতে হয়নি। ফলে কাউকে সন্তুষ্ট করারও দরকার পড়েনি। এবার অটল বিহারী বাজপেয়ীর রাজনৈতিক উত্তরাধিকারী নরেন্দ্র মোদিকে প্রথমবারের মতো সরকার চালাতে জোট ধর্ম পালন করতে হবে।

বিজ্ঞাপন

১০ বছরে টানা দুইবার নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার গঠন করেছিল বিজেপি। এবার বিরোধী জোট ইন্ডিয়া ব্লকের প্রবল চ্যালেঞ্জে নরেন্দ্র মোদির দল ম্যাজিক ফিগার ২৭২ অর্জন করতে ব্যর্থ হয়েছে। তাই এক দশক পর ভারতের কেন্দ্রের রাজনীতিতে জোট যুগ ফিরে এসেছে। বেড়েছে কিংমেকারদের কদর।

নরেন্দ্র মোদি কেন্দ্রের রাজনীতিতে আসার আগে ভারতের ভোটাররা তিন দশক তাদের ম্যান্ডেট ভাগ করেছেন। ফলে জোটের রাজনীতিই ছিল আদর্শ। ৮০, ৯০ দশক এবং চলতি শতাব্দীর প্রথম দশকের বেশিরভাগ সময় কোনো দলই লোকসভায় একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। তারপর গুজরাট থেকে দিল্লি এলেন নরেন্দ্র মোদি। তার নেতৃত্বে স্পষ্ট সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে অগোছালো জোট সরকারের অবসান ঘটিয়ে বিজেপির কর্তৃত্বের সরকার আসে ভারতে।

এবারও বিজেপি বৃহত্তম দল হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। কিন্তু নিজের শক্তিতে ২৭২ এর ম্যাজিক ফিগার অতিক্রম করতে পারেনি তারা। কেন্দ্রে সরকার গড়তে ও চালাতে জোট হিসেবে এনডিএ-র সাংগঠনিক সমর্থনের প্রয়োজন হবে বিজেপির। নরেন্দ্র মোদির জন্য এটিই হবে কেন্দ্রে জোট সরকার চালানোর প্রথম অভিজ্ঞতা। এবার সরকার গড়লে নরেন্দ্র মোদিকে সামলাতে হবে চন্দ্রবাবু নাইডু, নীতিশ কুমারের মতো ঝানু জোটসঙ্গীদের।

বিজ্ঞাপন

আরও পড়ুন- একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারিয়েও ইতিহাস মোদি-বিজেপির

জোট সরকার চালানোর চাবিকাঠি ভারসাম্য

জোট সরকার চালাতে ভারসাম্য প্রধান চাবিকাঠি। অটল বিহারী বাজপেয়ীর রাজনৈতিক উত্তরাধিকারসূত্রে রাজনৈতিক অঙ্গনে এসেছিলেন মোদি। বাজপেয়ী ছিলেন জোট সরকার পরিচালনার আদর্শ নেতা।

বাজপেয়ী কিভাবে ক্ষুব্ধ মমতা ব্যানার্জিকে সামলিয়েছিলেন তা জোট ব্যবস্থাপনার রাজনীতিতে পাঠ্য-পুস্তক উদাহরণ। বাজপেয়ীর অনন্য রাজনৈতিক শৈলী এবং মমতার উপাখ্যানে যাওয়ার আগে ভারতে কয়েক দশকের জোট রাজনীতির দিকে নজর দেওয়া যাক।

বিজ্ঞাপন

ভারতের নির্বাচনী ইতিহাসের ৭৩ বছরের মধ্যে প্রথম নির্বাচন ১৯৫১ থেকে শুরু করে  ৩২ বছর জোট সরকার ক্ষমতায় ছিল। বিপরীতে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির অধীনে ১০ বছরসহ ৩১ বছর শাসন করেছে একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের সরকার। ভারতের রাজনীতি বিশ্বজুড়েই জোট রাজনীতির আদর্শ। স্বাধীন ভারত প্রথমবার কেন্দ্রে জোট সরকার দেখেছিল জরুরি অবস্থার ঠিক পরে ১৯৭৭ সালে।

বিজেপির পূর্বসূরি ভারতীয় জনসংঘসহ ১১টি দল একজোট হয়ে জনতা সরকার গঠন করে। রংধনু ওই জোট ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত স্থায়ী ছিল। এর পরের সরকারের প্রধানমন্ত্রী হন কৃষক নেতা চরণ সিং। তাকে সমর্থন দিয়েছিল ইন্দিরা গান্ধীর কংগ্রেস। ইন্দিরা গান্ধী মাত্র ২৩ দিন পর চরণ সিংয়ের উপর থেকে তার সমর্থন প্রত্যাহার করে নেন। ভারতে জোট সরকার চালানোর ক্ষেত্রে এমন ঝুঁকি রয়েছে। এর পরেও এরকম রাজনৈতিক টানাপড়েন দেখা গেছে।

ইন্দিরা গান্ধী ১৯৮০ সালে ক্ষমতায় ফিরেন। ১৯৮৩ সালে আততায়ীর হাতে নিহত হওয়া পর্যন্ত তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। ইন্দিরা হত্যার পর সহানুভূতি ভোটে কংগ্রেস ১৯৮৪ সালে ক্ষমতায় ফিরে। সেবার কংগ্রেস এমন সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছিল যা আগে কখনও দেখা যায়নি ভারতে। দলটি ৫৪১টি লোকসভা আসনের মধ্যে ৪১৪টি আসনে জয় পায়।

১৯৮৪ সালের ঐতিহাসিক ম্যান্ডেটের পর ২৫ বছরের জোট

রাজীব গান্ধীর অধীনে কংগ্রেস যে ঐতিহাসিক ম্যান্ডেট পেয়েছিল, তা ছিল দলটির ভোটের রাজনীতির ইতিহাসের সবচেয়ে সফল সময়। সেখান থেকে কংগ্রেসের আসন আস্তে আস্তে কমতে থাকে। রাজীব গান্ধীর ওই সরকারই ছিল নরেন্দ্র মোদির আগে ভারতে দেখা শেষ একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের সরকার।

বিজ্ঞাপন

এর পর কংগ্রেস ক্ষমতায় আসলেও তাদের জোট সঙ্গীদের উপর ভর করতে হয়েছে। ইউপিএ ১ ও ইউপি২ জোটসঙ্গীদের নিয়ে ২০০৪ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ভারতের সরকার চালিয়েছে কংগ্রেস।

২০১৪ সালের নির্বাচনে এনডিএ অংশীদারদের প্রাক-নির্বাচন জোটের নেতৃত্বে থাকা বিজেপি ২৮২টি আসন জিতেছিল। নরেন্দ্র মোদির জনপ্রিয়তায় নিজেরাই ২৭২টি ম্যাজিক ফিগার অতিক্রম করেছিল তারা। পাঁচ বছর পর ফের বিজেপির বাজিমাত। ২০১৯ সালে আসন সংখ্যা আরও বেড়ে বিজেপি এককভাবে জিতেছিল ৩০৩টি আসন।

২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে ভারতের ভোটাররা অবশ্য একক কোনো দলকে সংখ্যাগরিষ্ঠতা দেয়নি। আবার তারা জোট যুগে ফেরত পাঠিয়েছেন ভারতের রাজনীতিবিদদের। বিজেপিকে এবার চন্দ্রবাবু নাইডুর টিডিপি ও  নীতিশ কুমারের জেডি(ইউ)-এর উপর নির্ভর করেই সরকার গড়তে হবে।

জোট রাজনীতির ওস্তাদ বাজপেয়ী

অটল বিহারী বাজপেয়ী ১৯৯৬ সালে প্রথম ১৬ দিনের জন্য প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। বিজেপির আসন সেবার ছিল মাত্র ১৬১টি। ফলে সরকার গড়তে জোটের শরিকদের সমর্থন প্রয়োজন ছিল।

১৯৯৮ সালের মার্চে শিরোমণি অকালি দল (এসএডি), সমতা পার্টি, এআইএডিএমকে এবং বিজেডিসহ বিভিন্ন দলের সমর্থনে বাজপেয়ী আবার প্রধানমন্ত্রী হন। সেই বাজপেয়ী সরকার এক বছর সাত মাস টিকে ছিল।

১৯৯৯ সালে বিজেপি ১৮২টি আসন পায়, অটল বিহারী বাজপেয়ী কেন্দ্রের ক্ষমতায় ফেরেন।  জোট সরকার গড়ে প্রধানমন্ত্রী হয়ে এক প্রকার কাটার মুকুট পরে সরকার চালাতে হয়েছিল তাকে।

বাজপেয়ী তার দক্ষতা এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক ব্যক্তিত্বের কারণে টালমাটাল জোট নিয়েও পাঁচ বছর মেয়াদ পূর্ণ করেন। এর মাধ্যমে তিনি ভারতে প্রথমবারের মতো অ-কংগ্রেসীয় প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পাঁচ বছর পূর্ণ করার রেকর্ড গড়েন। বাজপেয়ীকে সরকার টিকিয়ে রাখতে বেশ কয়েকজন আদর্শবিরোধী বা আদর্শহীন রাজনীতিবিদদের সঙ্গেও ভারসাম্য বজায় রাখতে হয়েছিল।

বাজপেয়ী যখন মমতাকে শান্ত করতে কলকাতায় গিয়েছিলেন

অটল বিহারী বাজপেয়ী ২০০০ সালে কিভাবে কলকাতায় গিয়ে ক্ষুব্ধ মমতা ব্যানার্জিকে শান্ত করেছিলেন তা রাজনীতিতে কিংবদন্তির বিষয়। মমতা ব্যানার্জি বাজপেয়ী সরকারের রেলমন্ত্রী ছিলেন। পশ্চিমবঙ্গে কিছু অকার্যকর পাবলিক-সেক্টর ইউনিট (পিএসইউ) বন্ধ করে দিয়েছিল কেন্দ্রীয় সরকার। এতে মমতা ক্ষুব্ধ ছিলেন। এনডিএ জোটের অন্যতম সদস্য মমতাকে জোট রাখা সরকার টিকিয়ে রাখার জন্য জরুরি। তখন বাজপেয়ী খেলেন তার মাস্টারস্ট্রোক।

ক্ষুব্ধ বাজপেয়ী মমতাকে দিল্লিতে ডাকেননি। বরং তিনি কলকাতায় ছুটে যান মমতার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে। আবার, রাজভবনে মমতার সঙ্গে দেখা করার পরিবর্তে বাজপেয়ী গিয়েছিলেন মমতার মা গায়ত্রী দেবীর সঙ্গে দেখা করতে তার বাড়িতে।

প্রাক্তন কূটনীতিক পবন কে ভার্মা ২০১৮ সালে বাজপেয়ীর মৃত্যুর পর টাইমস অব ইন্ডিয়াতে লিখেছিলেন, সেখানে বাজপেয়ী বেশিরভাগ সময়ই মমতার মায়ের সঙ্গে কথা বলেছেন। তার স্বাস্থ্য সম্পর্কে খোঁজখবর নিয়েছেন। এক পর্যায়ে মমতা সম্পর্কে তার মা গায়ত্রী দেবীকে বলেন, আপনার প্রতিভাবান মেয়েটি খুব জেদিও বটে। মেয়ে সম্পর্কে এই মূল্যায়নের সঙ্গে পুরোপুরি একমত হন গায়ত্রী দেবী।

কলকাতায় আধা-পাকা বাড়িতে বাজপেয়ীর সফর মমতাকে অনুপ্রাণিত করেছিল। বাজপেয়ী মমতাকে যে বার্তা দিয়েছিলেন তা হলো, তিনি এনডিএর অমূল্য একজন সদস্য। মমতা আরও বুঝতে পেরেছিলেন, বাজপেয়ী শুধু মন্ত্রিপরিষদের প্রধান হিসেবেই কাজ করছেন না, তার কাজ একজন পিতার মতোও।

বাজপেয়ী ‘জোট ধর্ম’ কথাটি তৈরি করেছিলেন, যার অর্থ জোট অংশীদারদের যথাযথ সম্মান দেওয়া।

বিরোধী ইন্ডিয়া ব্লক এবার বেশ শক্তিশালী। এর মধ্যে বিজেপির নেই একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা। ফলে সরকার টিকিয়ে রেখে ইন্ডিয়া ব্লককে মোকাবিলা করতে বেগ পেতে হবে বিজেপিকে।

ইন্ডিয়া ব্লকের চেয়ে অবশ্য দলের সংখ্যায় এনডিএ জোট বড়। এই দুই ডজনের বেশি দলকে সন্তুষ্ট রেখেই ১৮ দলের জোট ইন্ডিয়া ব্লককে সামলাতে হবে বিজেপিকে।

এনডিএ জোটের বড় খেলোয়াড় চন্দ্রবাবু নাইডু এবং নীতীশ কুমার উভয়ই যথাক্রমে ১৬ ও ১২টি আসন পেয়েছেন। তারা এখন কেন্দ্রে সরকার গঠন এবং চালিয়ে যাওয়ার জন্য বিজেপির জন্য অত্যাবশ্যক মিত্র হয়ে উঠেছেন। তারপরে রয়েছেন চিরাগ পাসোয়ানের মতো অন্যান্য সহযোগীরা- যারা চার-পাঁচটি আসন নিয়ে এনডিএ জোটের সংখ্যা আসন সংখ্যা ২৯৫তে পৌঁছে দিয়েছেন। এই জোটের অংশীদারদের খোশমেজাজে রাখতে হবে বিজেপিকে, আর এতে বাজপেয়ীর মতো স্পর্শ প্রয়োজন হবে বিজেপির।

জোটের রাজনীতি ভারতীয় রাজনীতিতে ফিরেছে, সঙ্গে ফিরতে যাচ্ছে জোট ধর্মও।

সারাবাংলা/আইই

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন