বিজ্ঞাপন

স্থিতিশীলতা পুনরুদ্ধারে সংকোচনশীল বাজেট, সামনে ৪ চ্যালেঞ্জ

June 5, 2024 | 9:41 pm

গোলাম সামদানী, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা: দেশের অর্থনীতির সুস্থতার মানদণ্ড নির্ধারক প্রায় সব সূচকই নিম্নমুখী। প্রত্যাশিত রাজস্ব আদায় না হওয়ায় সরকারের হাতে অর্থপ্রবাহ কমছে। ঘাটতি মেটাতে নির্ভর করতে হচ্ছে দেশি-বিদেশি ঋণের ওপর। সেখানে আবার বড় মাথাব্যথা ডলার— একদিকে এর সরবরাহ ঘাটতি, অন্যদিকে বাজারও লাগামছাড়া। এ অবস্থায় আমদানি ব্যয় কমিয়ে আনা গেলেও রফতানির সঙ্গে সঙ্গে রেমিট্যান্সের গতিও কাঙ্ক্ষিত নয়। অন্যদিকে অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক ঋণের সুদ ও আসল পরিশোধে ব্যয় আগের তুলনায় দ্বিগুণ হয়েছে।

বিজ্ঞাপন

দেশের অর্থনীতিতে এত সব নেতিবাচক নিয়ামকের প্রভাবে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ তলানিতে নেমেছে। পাশাপাশি লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে মূল্যস্ফীতি। বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান ও মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধিও এখন নিম্নমুখী। একই সঙ্গে নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ায় সরাসরি ভুগতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। সার্বিক পরিস্থিতিতে দেশের অর্থনীতি এখন সংকটকাল অতিক্রম করছে বলছেন অর্থনীতিবিদরা।

এ রকম অর্থনৈতিক সংকটের মুখেই আগামীকাল বৃহস্পতিবার (৬ জুন) ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা করতে যাচ্ছেন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। দেশের ৫৪তম এবং আওয়ামী লীগ সরকারের ২৫তম বাজেট এটি। তবে অর্থমন্ত্রী হিসেবে আবুল হাসান মাহমুদ আলীর এটি প্রথম বাজেট।

২০২৪-২৫ অর্থবছরের এই বাজেটের সামনে বেশকিছু বড় চ্যালেঞ্জ দেখছেন অর্থনীতিবিদরা। তবে এর মধ্যে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ মনে করা হচ্ছে চারটি বিষয়কে— উচ্চ মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরা, বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ানো, ডলারের দাম ও সরবরাহে অস্থিতিশীলতা দূর করা এবং নিত্যপণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখা। এই চ্যালেঞ্জগুলোতে সরকারের পক্ষে শতভাগ সফল হওয়া সম্ভব বলে মনে করছেন না অর্থনীতিবিদরা। তবে তারা বলছেন, এ বিষয়গুলোতে সরকার মোটাদাগে ব্যর্থ না হলেও পরিস্থিতি উন্নতির দিকে যাবে।

বিজ্ঞাপন

প্রধান চার চ্যালেঞ্জের পাশাপাশি রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে না পারা দীর্ঘ দিনের সমস্যা। এই ঘাটতি পূরণে এবারও সরকারকে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হবে। দেশি-বিদেশি ঋণের সুদ পরিশোধে বাড়তি খরচের জোগানও সরকারের বড় মাথাব্যথা। বিদ্যুৎ, গ্যাস ও সারে বকেয়া ভর্তুকি ব্যয়ের পাশাপাশি স্বল্প আয়ের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা ধরে রাখতে সামাজিক নিরাপত্তা বলয়ের আওতা বাড়িয়ে তাদের নিরাপত্তা বলয়ের ‍নিয়ে আসাকেও সরকারের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ মনে করা হচ্ছে।

অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, এ বছর বাজেটের প্রস্তাবিত সম্ভাব্য আকার চূড়ান্ত করা হয়েছে সাত লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকা। এটি চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের চেয়ে ১১ দশমিক ৫৬ শতাংশ বেশি। তবে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের মূল বাজেটের চেয়ে আগামী বাজেটের আকার মাত্র ৪ দশমিক ৬২ শতাংশ বড়। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকট বিবেচনায় রাখার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) পরামর্শও মাথায় রাখতে হয়েছে সরকারকে। সব মিলিয়ে এ বছর বাজেটের আকার খুব বেশি বাড়েনি।

এবারের বাজেটের প্রতিপাদ্য ‘সুখী সমৃদ্ধ, উন্নত ও স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের অঙ্গীকার’। এতে জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ, মূল্যস্ফীতির গড় হার ৬ দশমিক ৫০ শতাংশের মধ্যে সীমিত রাখার লক্ষ্য রাখা হচ্ছে। সার্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতির কারণেই বাজেট রাখা হয়েছে সংকোচনশীল।

বিজ্ঞাপন

চলতি ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরের মূল বাজেটের আকার ধরা হয়েছিল সাত লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা। আর আগামী অর্থবছরে বাজেটের চূড়ান্ত করা হয়েছে সাত লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকা। সে হিসাবে বাজেটের আকার বাড়ছে ৪ দশমিক ৬২ শতাংশ। টাকার অঙ্কে বাজেটের আকার বাড়ছে মাত্র ৩৫ হাজার ২১৫ কোটি টাকা। অথচ চলতি অর্থবছরে মূল বাজেটের আকার তার আগের অর্থবছরের তুলনায় ১২ দশমিক ৩০ শতাংশ বাড়ানো হয়েছিল।

এদিকে আগামী অর্থবছরে বাজেটে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ, যা চলতি অর্থবছরে ধরা হয়েছিল ৭ দশমিক ৫ শতাংশ। পরে তা কমিয়ে সাড়ে ছয় শতাংশ করা হয়। তবে বিশ্বব্যাংক পূর্বাভাস দিয়েছে, চলতি অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি হতে পারে সর্বোচ্চ ৫ দশমিক ৬ শতাংশ। প্রায় কাছাকাছি প্রবৃদ্ধি প্রক্ষেপণ করেছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলও (আইএমএফ)।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের সূত্র মতে, প্রতিবছর বাজেটের প্রবৃদ্ধি ১০ থেকে ১২ শতাংশ ধরেই প্রাক্কলন করা হয়। এবার সেটি ৫ শতাংশের নিচে রাখা হচ্ছে। কাঙ্ক্ষিত পরিমাণ রাজস্ব আদায় না হওয়া, প্রবাসী আয় কমে যাওয়া এবং আমদানি ও রফতানি পরিস্থিতি আশানুরূপ ভালো না হওয়ায় বাজেটের আকার তেমন বাড়ছে না। আসন্ন বাজেটের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আর্থিক নীতির সঙ্গে রাজস্ব নীতির সমন্বয়।

বাজেটের আকার ও আয় ব্যয়ের পরিমাণ

২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটের মোট আকার ধরা হয়েছে সাত লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকা। নতুন বাজেটে বৈদেশিক অনুদান ছাড়া সম্ভাব্য মোট আয় ধরা হয়েছে পাঁচ লাখ ৪১ হাজার কোটি টাকা। সে হিসাবে ঘাটতি দাঁড়াচ্ছে দুই লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা, যা জিডিপির ৪ দশমিক ৬ শতাংশ।

বিজ্ঞাপন

বাজেটের আয় যেভাবে আসবে

বাজেটে আয় ধরা হয়েছে পাঁচ লাখ ৪১ হাজার কোটি টাকা। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) নিয়ন্ত্রিত কর ও এনবিআর বহির্ভূত করের মাধ্যমে আয় হবে চার লাখ ৯৫ হাজার কোটি টাকা। এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে চলতি অর্থবছরের সংশোধিত রাজস্ব থেকে ৬৬ হাজার কোটি টাকা বেশি আহরণ করতে হবে। মোট আয়ের মধ্যে এনবিআরের মাধ্যমে আয় হবে চার লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। আর এনবিআরবহির্ভূত কর থেকে আয় আসবে ১৫ হাজার কোটি টাকা। এ ছাড়াও কর ছাড়া প্রাপ্তি আসবে ৪৬ হাজার কোটি টাকা।

বাজেটের ঘাটতি মোকাবিলা যেভাবে

২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে মোট ঘাটতি ধরা হয়েছে দুই লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা। এই ঘাটতি অর্থায়নের উৎস হিসেবে আসবে অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক ঋণ। এর মধ্যে বৈদেশিক উৎস থেকে ঋণ নেওয়া হবে এক লাখ ২৭ হাজার ২০০ কোটি টাকা। নিট ঋণের পরিমাণ ৯০ হাজার ৭০০ কোটি টাকা।

এ ছাড়াও বৈদেশিক অনুদান ধরা হয়েছে চার হাজার ৪০০ কোটি টাকা। অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ঋণ নেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে এক লাখ ৬০ হাজার ৯০০ কোটি টাকা। অভ্যান্তরীণ ঋণের মধ্যে ব্যাংকিং খাত থেকে নেওয়া হবে এক লাখ ৩৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। ব্যাংকবহির্ভূত খাত থেকে ঋণের জোগান আসবে ২৩ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ নেওয়া হবে ১৫ হাজার ৪০০ কোটি এবং অন্যান্য খাত থেকে নেওয়া হবে আট হাজার কোটি টাকা।

ঋণের সুদ পরিশোধে ব্যয়

আগামী বাজেটে সরকারকে শুধু সুদ পরিশোধেই ব্যয় করতে হবে এক লাখ ১৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদ পরিশোধে ব্যয় হবে ৯৩ হাজার কোটি টাকা, বৈদেশিক ঋণের সুদ পরিশোধে যাবে ২০ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। ফলে মোট বাজেটের ২০ শতাংশই চলে যাবে সুদ পরিশোধে।

এডিপির আকার

আগামী বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) বরাদ্দ রাখা হয়েছে দুই লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা। চলতি সংশোধিত এডিপির লক্ষ্যমাত্রা হচ্ছে দুই লাখ ৪৫ হাজার কোটি টাকা। সে হিসাবে বর্তমান অর্থবছরের সংশোধিত এডিপির তুলনায় নতুন অর্থবছরের এডিপি ২০ হাজার কোটি টাকা বেশি হবে।

সারাবাংলা/জিএস/টিআর

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন