বিজ্ঞাপন

খাবার দেখলে ‘ভয়’ পান সৌদি ফেরত জোবেদা

May 30, 2018 | 8:44 pm

।। জাকিয়া আহমেদ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট ।।

বিজ্ঞাপন

ঢাকা: ‘মেয়েটা আমার সুস্থ ছিল, সৌদি গেল ভালো অবস্থায়। কিন্তু ফিরে এলো ‘পাগল হয়ে। কেন এমন হইল, আমার মাইয়াটারে পাগল বানাইল কারা, মাইয়াটার এখন কী হইব’-জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের একটি বেডে বসে বিড়বিড় করে কথাগুলো বলছিলেন সৌদি ফেরত নারী গৃহকর্মী জোবেদার (ছদ্মনাম) মা সুফিয়া বেগম।

‘মাইয়াডা কী বলে কিছুই বুঝি না, কেবল এটুকু বুঝতি পারি, ‘খাবার দেখলেই বলে, ওতে বিষ আছে, আমি খাব না’ বলেন সুফিয়া বেগম।

গত নয় মাস আগে সৌদি আরব যান সাতক্ষীরার জোবেদা। ছয়মাস পর্যন্ত সব ঠিকভাবেই চলছিল, বাড়িতে টাকা পাঠাতেন, সময় সুযোগ পেলে ফোনে কথা বলতেন। কিন্তু তারপর হঠাৎ জোবেদার সবকিছু বদলে যেতে থাকে। বাড়িতে টাকা পাঠানো বন্ধ হয়ে যায়, বন্ধ হয়ে যায় ফোনে কথা বলা।

বিজ্ঞাপন

এরপর গত শুক্রবার (২৫ মে) অপরিচিত একজনের ফোন পেয়ে জোবেদার বিমানবন্দরে ফেরত আসার বিষয়টি জানতে পারেন সুফিয়া বেগম। এরপরদিন তাকে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

সেখানে গিয়ে দেখা যায়, ইচ্ছে হলে কথা বলেন জোবেদা, আবার কোনও প্রশ্ন করে তার কাছ থেকে উত্তর পাওয়া যায় না। কথা যতটুকু বলছেন তাও আরবি ভাষায়। মা এবং ভাই আরবি ভাষা না জানায় তিরস্কারও করছেন তিনি, একা একা হাসছেন-ছাদের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করছেন নিজে নিজে।

জোবেদার মা এবং ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, জোবেদার ছয়বছর বয়সী এক ছেলে আছে। ছেলের জন্মের পর স্বামী নিরুদ্দেশ হন। জোবেদা ফিরে আসেন বাবার সংসারে, সেখানেই থাকতেন তিনি। কিন্তু বৃদ্ধ ও রোগে আক্রান্ত বাবার সংসারে বড় মেয়ে হিসেবে বোঝা হয়ে থাকতে চাননি জোবেদা। তাই সংসারের হাল ধরতে সৌদি আরব যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। এর আগে পাশের গ্রামের একজনের কাছ থেকে জানতে পারেন যে সৌদি আরব গেলে চার জনের সংসারে গৃহকর্মীর কাজ করতে হবে এবং বেতন হবে ১৯ হাজার ৫০০ টাকা।

বিজ্ঞাপন

তিনি আরও জানান, যে দালালের মাধ্যমে জোবেদা সৌদি গিয়েছিলেন, তিনি তাদের পূর্ব পরিচিত ছিলেন। সেখানে গেলে যে তাদের ভাগ্যের পরিবর্তন হবে এই বিষয়টি তাদের আশ্বস্ত করেছিলেন ওই দালাল।

দেশে ফেরার পর সৌদির কোন ঘটনা বিষয়ে কথা বলেছেন কি না জানতে চাইলে জোবেদার ভাই আফজাল বলেন, ‘কিছু কিছু কথা বলে, কিন্তু সেগুলো কিছুই বুঝি না। আরবি ভাষায় নিজের মতো করে বলে। একা একা হাসে, হাত নাড়ে। কিন্তু খেতে চায় না।’

জোবেদার ভাই আরও বলেন, ‘ওখানে কী হইছে-না হইছে কিছুই বলে না। সৌদি আরব নিয়ে কোনো কথাই বলে না। ওর মতো করে কথা বলতি থাকে, সারাক্ষণ ভুল বকে। ডাক্তাররা বলছেন, আরও কয়েকদিন থাকার পর বাড়ি নিয়ে যেতে পারব।’

বিজ্ঞাপন

শনিবার জোবেদা যখন হাসপাাতালে প্রথম আসেন, সেদিন তাকে ফ্রি বেড দেওয়া সম্ভব হয়নি, তবে পরদিনই ফ্রি বেডে তাকে স্থানান্তরিত করা হয় বলে সারাবাংলাকে জানান জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ। তার অধীনেই হাসপাতালে ভর্তি আছেন জোবেদা।

ডা. হেলাল উদ্দিন বলেন, প্রবাস জীবনে সে মানসিক নির্যাতনসহ খাদ্য ও আবাসনের সমস্যায় ছিল। একসময় সে শারীরিক নির্যাতনেরও শিকার হয়। তার যেসব সমস্যা আমরা দেখছি তাকে আমরা ব্রিফ সাইকোসিস (সংক্ষিপ্ত মানসিক ভারসাম্যহীনতা) বলছি, তার কথা ও আচরণে অসংলগ্নতা রয়েছে। খুব অল্প সময়ের জন্য সে তার নিজস্বতা থেকে দূরে রয়েছেন।

তবে এ অবস্থা দীর্ঘমেয়াদি হবে কী না-সে বিষয়ে এখনও কিছু বলা যাচ্ছে না বলে উল্লেখ করেন তিনি।

এই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক আরও বলেন, সে জন্য জোবেদাকে আরও বেশি পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে এবং যথাসময়ে তাকে মানসিকভাবে স্বাধীনতা দিতে হবে, যেন সে তার কথাগুলো আমাদের বলতে পারেন। একটি বিষয় লক্ষ্য করেছি, জোহরা কথা বলা শুরু করে বেশ উচ্ছ্বাস নিয়ে, বোঝাই যায় তিনি কিছু জানাতে চান কিন্তু পরে তিনি থেমে যান, কথা শেষ করতে পারেন না।

ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘মনোবিজ্ঞানী হিসেবে বলতে পারি, হয় তার ভেতরে একটা বাধা কাজ করে নয়ত ভয় কাজ করে অথবা কোনো কথা সে গোপন করতে চাচ্ছে। এ জন্য ওষুধ দেওয়া হয়েছে। যেহেতু সে এরকম একটি অবস্থার ভেতরে ছিল, দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে এসেছে, পানি কম খাওয়াতে মূত্রথলিতে সংক্রমণের সমস্যাও তৈরি হয়েছে, তাকে এ অসুস্থতার জন্যও চিকিৎসা দিচ্ছি আমরা।’

তবে জোবেদার ভেতরে কোনো আত্মবিধ্বংসী প্রবণতা নেই, নেই নিজেকে আঘাত করার প্রবণতা এবং আগ্রাসী আচরণ-যার কারণে চিকিৎসকরা তাকে স্টেবল বলেও মনে করছেন। তবে তার চিকিৎসায় সময় লাগবে, পরিবারের সহযোগিতায় তাকে সময় নিয়ে চিকিৎসা করতে হবে।

মেয়েকে নিয়ে হাসপাতালে থাকলেও থাকা ও খাবারের সমস্যাতে রয়েছেন জোবেদার মা ও ভাই। একেবারেই দিন এনে দিন খাওয়া এ পরিবারটি চিকিৎসার খরচ নিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন। যদিও বিভিন্ন টেস্ট করছেন হাসপাতালের নির্ধারিত ফিতে। ‘হাতে কেবল সাড়ে থেকে পাঁচশ টাকার মতো রয়েছে বলেন’ ভাই আফজাল।

মা থাকছে বোনের সঙ্গে, কিন্তু আমার তো থাকার জায়গা নাই। হাসপাতালের সামনের রাস্তায়, ভেতরের কোনও গলিতে থাকছি। আর খাওয়ার কথাতো চিন্তাও করতে পারি না। এভাবে কতদিন এখানে থাকবো-সেই চিন্তায় এখন ঘুম হারাম হয়ে গেছে-বলেন তিনি।

ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচির তথ্য কর্মকর্তা আল আমিন নয়ন সারাবাংলাকে বলেন, গত শুক্রবার জোবেদা দেশে ফেরেন। তখন বিমানবন্দরের কল্যাণ ডেস্ক থেকে ফোন করে মানসিক ভারসাম্যহীন জোবেদার কথা জানানো হয়। আমি তার সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করলেও কোনো কথা হয়নি। পরে তার পাসপোর্ট থেকে তার ভাইয়ের নম্বরে ফোন করে কথা হয়।

এদিকে, জোবেদা এখন অনেক শান্ত মন্তব্য করে বিমানবন্দর থেকে তাকে নিয়ে আসা অভিবাসী কর্মী উন্নয়ন প্রোগ্রামের সিনিয়র ট্রেইনার সুপ্রিয়া শাহনেওয়াজ সারাবাংলাকে বলেন, বিমানবন্দরে নেমেই সে সবার সঙ্গে আগ্রাসী আচরণ করেছিল। আমরা খবর পেয়ে বিমানবন্দরে গিয়েই তাকে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাই। পরে তাকে আমাদের শেল্টার হোমে নিয়ে আসা হয় এবং সেখানে প্রায় দেড় দিন থাকার পর তাকে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য হাসপাতালের ভর্তি করা হয়। এখন তো তিনি অনেক শান্ত এবং স্বাভাবিক আছেন।

সারাবাংলা/জেএ/এমআইএস

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন