বিজ্ঞাপন

জলবায়ু বাজেট পর্যাপ্ত নয়

June 9, 2024 | 11:00 am

রাজনীন ফারজানা, স্টাফ করেসপন্ডেন্টড

ঢাকা: জলবায়ু পরিবর্তনের শিকার দেশগুলোর অন্যতম বাংলাদেশ। একদিকে বৃষ্টিপাত কমে যাওয়া, অন্যদিকে তীব্র বৃষ্টি ও বন্যা, উপকূল ডুবে যাওয়া, লবণাক্ততা, কৃষিকাজে প্রভাব, সুপেয় পানির অভাব, মরুকরণ, শিলাবৃষ্টি, জলোচ্ছ্বাস-ঘূর্ণিঝড়, টর্নেডো— দিন দিন এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রভাব বাড়ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের এই অভিঘাতে উপকূলে দেখা দিচ্ছে মানবিক বিপর্যয়।

বিজ্ঞাপন

এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রভাব মোকাবিলার জন্য প্রয়োজন বিপুল পরিমাণ অর্থ। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটে জলবায়ু পরিবর্তনের এই অভিঘাত মোকাবিলার জন্য ৪২ হাজার ২০৬ কোটি ৮৯ লাখ টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তন কৌশল ও কর্মপরিকল্পনার ছয়টি বিষয়ভিত্তিক ক্ষেত্রে মন্ত্রণালয় ও বিভাগ এ অর্থ ব্যয় করে, যা মোট ২৫টি মন্ত্রণালয়/বিভাগের মধ্যে বণ্টন হবে।

২০২০-২১ অর্থবছর থেকে ২০২৪-২৫ অর্থবছর সময়ের মধ্যে জলবায়ু বাজেটের সবচেয়ে বেশি বরাদ্দ পেয়েছে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়। এর পরে রয়েছে কৃষি মন্ত্রণালয়। তৃতীয় অবস্থানে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়। চতুর্থ ও পঞ্চম অবস্থানে রয়েছে যথাক্রমে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ এবং দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়।

এর আগে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে প্রস্তাবিত বাজেট ছিল ৩৭ হাজার ৫১ কোটি ৯৪ লাখ টাকা। অর্থাৎ আগের অর্থবছরের তুলনায় নতুন অর্থবছরে এই খাতে বাড়তি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫ হাজার ১৫৪ কোটি ৯৫ লাখ টাকা। সে হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে বরাদ্দ বেড়েছে ১৩ দশমিক ৯১ শতাংশ। তবে পরিবেশবিদ ও পরিবেশ অধিকার কর্মীরা বলছেন, এই বাজেট চাহিদা বা প্রয়োজনের তুলনায় মোটেও পর্যাপ্ত নয়।

বিজ্ঞাপন

জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত গত কয়েক বছর ধরেই অন্যতম আলোচিত ইস্যু। জলবায়ু পরিবর্তনের চলমান প্রবণতার জন্য বাংলাদেশ খুব একটা দায়ী না হলেও এর নেতিবাচক প্রভাব সবচেয়ে বেশি যে দেশগুলোর ওপর পড়ে, তার মধ্যে বাংলাদেশ একটি। জাতীয় বাজেটেও এই বিষয়টিকে অন্যতম চ্যালেঞ্জ হিসেবে উল্লেখ করেছেন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী।

বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী বলেন, পরিবেশ দূষণে বাংলাদেশ নিম্ন সারিতে থাকলেও নিম্ন ব-দ্বীপ অঞ্চলে অবস্থিত হওয়ায় জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবের দিক থেকে সর্বোচ্চ ঝুঁকির মুখে রয়েছে। জার্মানওয়াচ প্রকাশিত গ্লোবাল ক্লাইমেট রিস্ক ইনডেস্ক ২০২১ অনুযায়ী, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সবচেয়ে ঝুঁকির মুখে যেসব দেশ রয়েছে তার মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে জলবায়ু-উদ্বাস্তু মানুষের সংখ্যা, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ও চরমভাবাপন্ন আবহাওয়ার তীব্রতা বেড়ে যাওয়ার ফলে কৃষি জমি ও কৃষি উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার চরম আশঙ্কাও রয়েছে।

এসব ঝুঁকি ও শঙ্কা বিবেচনায় নিয়েই সরকার গত কয়েক বছর ধরেই বিভিন্ন কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে। অর্থমন্ত্রী বলেন, এরই মধ্যে আমরা ন্যাশনাল অ্যাডাপটেশন প্ল্যান (ন্যাপ), মুজিব ক্লাইমেট প্রোসপারিটি প্ল্যান (এমসিপিপি), ন্যাশনালি ডিটারমাইন্ড কন্ট্রিবিউশন (এনডিসি) এবং বাংলাদেশ ব-দ্বীপ পরিকল্পনা-২১০০ প্রণয়ন করা হয়েছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটেও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় ১০০ কোটি টাকা বিশেষ বরাদ্দের প্রস্তাব করেন মন্ত্রী।

বিজ্ঞাপন

ওয়াটার কিপার্স বাংলাদেশের প্রধান সমন্বয়ক শরীফ জামিল সারাবাংলাকে বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের নতুন নতুন অভিঘাত ঘনবসতিপূর্ণ এই ক্ষুদ্র বদ্বীপের ওপর ইতোমধ্যে চরমভাবে আঘাত আনতে শুরু করেছে। এর জন্যে আমরা মোটেও প্রস্তুত নই। উলটো আমরা যথেষ্ট পরিবেশ ও প্রতিবেশগত সমীক্ষা ছাড়াই অনেক বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছি এবং করছি। এসব প্রকল্প বাস্তুতন্ত্র ও জীবিকার ওপর ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। তাই বাজেট বাড়ানো কেবল নয়, পরিবেশ মন্ত্রণালয়কে কর্মপরিচালনাতেও ক্ষমতায়ন করাটা জরুরি।’

স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের ডিন ও বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) যুগ্ম সম্পাদক পরিবেশবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. আহমেদ কামরুজ্জামান মজুমদার সারাবাংলাকে বলেন, ‘বর্তমানে বাংলাদেশ অনেক ধরনের পরিবেশগত বিপর্যয়ের সম্মুখীন। দূষণ সর্বোচ্চ পর্যায়ে রয়েছে। এ সমস্যা সমাধানের জন্য বাজেট বরাদ্দের সময় আমাদের পরিবেশ মন্ত্রণালয়কে অগ্রাধিকার দেওয়া প্রয়োজন। তবে আমরা দেখতে পাচ্ছি, প্রস্তাবিত বাজেটে এই মন্ত্রণালয়কে মাত্র দুই হাজার ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হচ্ছে, যেখানে এই মন্ত্রণালয়ের জন্য বরাদ্দ কমপক্ষে ১০ হাজার কোটি টাকা হওয়া প্রয়োজন।’

আগামী অর্থবছরের জন্য পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের জন্য বাজেটে দুই হাজার ১৩১ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এই বরাদ্দ ছিল দুই হাজার ৭১ কোটি টাকা। সে হিসাবে পরিবেশ মন্ত্রণালয়ে জন্য বরাদ্দ বেড়েছে ৬০ কোটি টাকা।

এ ছাড়া চলতি অর্থবছরের তুলনায় আগামী অর্থবছরে জলবায়ুবিষয়ক খাতে বাজেট বরাদ্দ ১৩ দশমিক ৯১ শতাংশ বাড়লেও গত কয়েক বছরে এই খাতে বরাদ্দ ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে। ২০২০-২১ অর্থবছরের তুলনায় ২০২৪-২৫ অর্থবছরে জলবায়ু সংশ্লিষ্ট মোট বরাদ্দ বেড়েছে ৭৫ দশমিক ৩১ শতাংশ। ২০২০-২১ অর্থবছরে ২৫টি মন্ত্রণালয়/বিভাগের প্রকৃত ব্যয় ছিল সংশোধিত বরাদ্দের ৯০ দশমিক ৩৯ শতাংশ, যা ২০২১-২২ অর্থবছরে বেড়ে ৯২ দশমিক ৬৪ শতাংশে দাঁড়ায়।

বিজ্ঞাপন

এ বিষয়গুলোকে আশাব্যঞ্জক উল্লেখ করে এই পরিবেশবিজ্ঞানী বলেন, ‘পরিবেশ খাত সবসময় উপেক্ষিত ছিল। এখন তাও কিছুটা বরাদ্দ পাওয়া যাচ্ছে। তবে টেকসই অর্থনৈতিক ব্যবস্থা জোরদার করতে এবং আগামী প্রজন্মের জন্য নিরাপদ বাংলাদেশ গড়তে পরিবেশ খাতে পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ এখন সময়ের দাবি।’

সারাবাংলা/আরএফ/টিআর

Tags: , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন