বিজ্ঞাপন

নিখোঁজ শিশুর লাশ মিলল ‘জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের’ খালে

June 9, 2024 | 6:35 pm

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট

চট্টগ্রাম ব্যুরো : চট্টগ্রাম নগরীতে জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের আওতায় সংস্কারকাজ চলমান থাকা একটি খাল থেকে আট বছর বয়সী এক স্কুলছাত্রের লাশ উদ্ধার হয়েছে। এলাকাবাসী ও পরিবারের সদস্যদের দাবি, খালের সঙ্গে নতুনভাবে নির্মাণ করা বক্স ড্রেনের ওপর শিশুটি খেলছিল। অসতর্কতাবশত ড্রেনের ওপর থেকে স্ল্যাববিহীন খোলা অংশের ভেতরে পড়ে শিশুটি খালে তলিয়ে যায়। নিখোঁজের প্রায় ১৬ ঘণ্টা পর তার লাশ উদ্ধার হয়েছে।

বিজ্ঞাপন

রোববার (৯ জুন) সকাল ১০টার দিকে নগরীর বন্দর থানার গোসাইলডাঙ্গা ওয়ার্ডের আবিদার পাড়া এলাকায় নাসিরখাল থেকে শিশুটির লাশ উদ্ধার করা হয়।

মৃত সাইদুল ইসলাম শহীদুল (৮) খালপাড়ের বিল্লাপাড়া এলাকার বাসিন্দা রিকশাচালক আলী আকবরের ছেলে। সাইদুল আগ্রাবাদ শিশু নিকেতন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রথম শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিল। তার মা ভিক্ষাবৃত্তির সঙ্গে যুক্ত নাছিমা আক্তার বাকপ্রতিবন্ধী। আঁখি আক্তার মীম (৯) নামে তার বড় বোন একই বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণির ছাত্রী।

বোন আঁখি আক্তার মীম সারাবাংলাকে জানান, শনিবার (৭ ‍জুন) সন্ধ্যা ৬টার দিকে সাইদুল বাসা থেকে খেলতে বের হয়। বক্স ড্রেনের ওপর প্রতিদিন তারা খেলত। আনুমানিক ৭টার দিকে মীম তাকে নাস্তা খাওয়ার জন্য ডাকতে যায়। কিন্তু বক্স ড্রেনসহ আশপাশে খুঁজে না পেয়ে মীম বাসায় গিয়ে তার মাকে ঘটনা জানায়।

বিজ্ঞাপন

এরপর রাতভর এলাকার লোকজন ও পরিবারের সদস্যরা মিলে তাকে খোঁজাখুঁজি করেন। না পেয়ে সকাল ৬টার দিকে স্থানীয় সাগরিকা গরুর বাজারে খুঁজতে যায় তার বাবা-মা ও এলাকার দুজন ব্যক্তি। তখন খবর পাওয়া যায়, খালে সাইদুলের লাশ ভেসে উঠেছে।

স্থানীয়রা জানান, নাসিরখালে পানি ও আবর্জনার মধ্যে প্রথমে হাত দুটি দেখা যায়। এলাকার লোকজন সেগুলো দেখেই ধারণা করেন, সেটি সাইদুলের লাশ। কয়েকজন খালে নেমে লাশটি উদ্ধার করে।

বিজ্ঞাপন

বাবা আলী আকবর কান্নাজড়িত কণ্ঠে সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমার ছেলে ড্রেনের (বক্স ড্রেন) ওপর খেলছিল। দৌড়াদৌড়ি করতে গিয়ে অন্ধকারে বুঝতে পারেনি। সেজন্য ড্রেনের ভেতরে পড়ে গেছে। ড্রেনের ওপর থেকে স্ল্যাবগুলো যদি না তুলতো, আমার ছেলে মরতো না।’

বাক প্রতিবন্ধী মা নাছিমা আক্তার ছেলেকে হারিয়ে আহাজারি করছিলেন। নিজের মর্মান্তিক অনুভূতিটুকু ভাষায় প্রকাশ করতে পারছিলেন না। যন্ত্রণাকাতর হয়ে নাছিমা বারবার বক্স ড্রেনের ওপর স্ল্যাববিহীন গর্তগুলো দেখাচ্ছিলেন আর কপাল চাপড়ে আর্তনাদ করছিলেন।

স্থানীয় বাসিন্দা রিকশাচালক সেকান্দর বাদশা সারাবাংলাকে বলেন, ‘আগে এটা একটা নালা ছিল। রোজার সময় বক্স ড্রেন করা হয়েছে। ড্রেন করার পর আমাদের জন্য সুবিধা হয়েছে। এটা একটা রাস্তা হয়ে গেছে। লোকজন হাঁটে। রিকশা, মোটরসাইকেলসহ বিভিন্ন গাড়ি নিয়েও আসা যায়। কিন্তু হঠাৎ করে গত রাতে ড্রেনের ওপর থেকে কয়েকটা স্ল্যাব তুলে ফেলা হয়েছে। তখন এখানে খণ্ড খণ্ড বড় বড় গর্ত হয়ে গেছে। সেই গর্তে পড়ে ছেলেটা মারা গেছে।’

স্থানীয় একটি কলোনির ভাড়াটিয়া পোশাককর্মী মঞ্জু আক্তার সারাবাংলাকে বলেন, ‘এখানে বৃষ্টি হলে খাল ভরাট হয়ে যায়। জোয়ারের পানি এলেও খাল থেকে পানি বাসাবাড়িতে ঢুকে যায়। তখন রাস্তা আর ফুটপাত পানির নিচে থাকে। বছরখানেক আগেও এখানে একটা সিএনজি টেক্সি জোয়ারের পানিতে পড়ে গিয়েছিল।’

বিজ্ঞাপন

চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের সংশ্লিষ্টরা জানান, আবিদারপাড়া থেকে আসা একটি নালা ঠাণ্ডা মিয়া সড়কের মোড়ে এসে নাসিরখালের সঙ্গে যুক্ত হয়। আগে নালাটি উন্মুক্ত ছিল। জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের আওতায় নালাটি সংস্কার করে ১৭০ মিটার বক্স ড্রেন নির্মাণ করা হয়। ড্রেনের ওপর মোট ২৬টি স্ল্যাব আছে। প্রতিটি স্ল্যাবের হিসেবে বক্স ড্রেনের ওপর প্রতিটি গর্তের আয়তন ১ দশমিক ২ বর্গমিটার।

খালে পড়ে শিশুর মৃত্যুর খবর পেয়ে সেখানে যান সিডিএর জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের পরিচালক সেনাবাহিনীর ৩৪ ইঞ্জিনিয়ার কনস্ট্রাকশন ব্রিগেডের লেফট্যানেন্ট কর্নেল ফেরদৌস আহমেদ। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘সকাল সাড়ে ১০টার দিকে আমরা খবর পেয়েছি যে, এখানে একটি শিশু খালে পড়ে মারা গেছে। খবর পেয়ে আমি এখানে আসি। এখানে আমাদের জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের আওতায় খাল সংস্কার ও বক্স ড্রেন নির্মাণের কাজ চলছে। আমরা জানতে পেরেছিলাম, বক্স ড্রেনের ওপর লোডেড ট্রাক যাওয়ার কারণে কয়েকটা স্ল্যাবের ক্ষতি হয়েছে। নির্মাণ ত্রুটিরও অভিযোগ কিছুটা পেয়েছিলাম। এগুলো খতিয়ে দেখার জন্য আমি ৫-৬টা স্ল্যাব তুলে নেওয়ার নির্দেশ দিই।’

‘গতকাল (শনিবার) রাত ৮টার দিকে ৫-৬টা স্ল্যাব তুলে নেওয়া হয়। শিশুটি কিন্তু নিখোঁজ হয়েছে বিকেল ৫টার দিকে। আর আমাদের স্ল্যাব তোলা হয়েছে রাত ৮টার দিকে। তাহলে শিশুটির স্ল্যাবের অংশে ড্রেনে পড়ে নিখোঁজের সম্ভাবনা মোটামুটি নেই বললেও চলে। তারপরও যেহেতু বক্স ড্রেনের মাত্র ২০০ গজ দূরে খালে লাশটা পাওয়া গেছে, আমরা কিন্তু সেটা বলছি না। আরও একটা বিষয় খেয়াল করবেন, গত এক সপ্তাহ ধরে কিন্তু বৃষ্টি নেই। খালের পানি, ড্রেনের পানি একেবারে স্ট্রেইট আছে। এখানে পড়ে গিয়ে স্রোতে তলিয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। আশা করি, পুলিশের ইনভেস্টিগেশনে সবকিছু পরিস্কার হবে,’ – বলেন লেফট্যানেন্ট কর্নেল ফেরদৌস আহমেদ।

ঘটনাস্থলে দেখা গেছে, বক্স ড্রেনের ওপর থেকে স্ল্যাব তুলে নেওয়ার কারণে বড় বড় গর্তের সৃষ্টি হলেও চলাচলে সতর্কতাসূচক কোনো চিহ্ন কিংবা প্রতিবন্ধকতা ছিল না। ফলে পুরোপুরি অরক্ষিত ছিল বক্স ড্রেনটি। দুপুর ১টার দিকে বক্স ড্রেনের দুই প্রবেশমুখে বাঁশ দিয়ে প্রতিবন্ধক দিতে দেখা গেছে।

এছাড়া বক্স ড্রেনসংলগ্ন নাসিরখালের পাড়ে কলোনি-বস্তি গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ভাঙ্গাচোরা ঘরগুলো আবার ভাড়া দেওয়া হয়েছে। সেখানে নিম্ন আয়ের লোকজনের অর্ধশতাধিক বসতি দেখা গেছে। সেখানে একটি বাসায় মৃত সাইদুলের বাবা রিকশাচালক আলী আকবরের প্রথম স্ত্রী ও দুই ছেলেমেয়ে থাকেন। সেখানে অনিরাপদভাবে বসতি স্থাপন ও ভাড়া দেওয়া এবং খাল-ড্রেন অরক্ষিত জানার পরও স্থানীয় জনপ্রতিনিধি কোনো ব্যবস্থা নেননি।

জানতে চাইলে ৩৬ নম্বর গোসাইলডাঙ্গা ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মো. মোর্শেদ আলী সারাবাংলাকে বলেন, ‘জলাবদ্ধতা নিরসনের কাজ করছে সিডিএ ও সেনাবাহিনী। বিভিন্ন স্থাপনা তারাই উচ্ছেদ করেছে। কাজ এখনও শেষ হয়নি। আমাদেরও বুঝিয়ে দেওয়া হয়নি। আমাদের কাছে হস্তান্তর করলে তখন দেখা যাবে।’

বন্দর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মোহাম্মদ মনজুর কাদের সারাবাংলাকে বলেন, ‘শিশুটি প্রায় ১৬ ঘণ্টা নিখোঁজ ছিল। সেটা কিন্তু পরিবারের পক্ষ থেকে পুলিশকে জানানো হয়নি। এরপর আজ (রোববার) সকালে নাসিরখালে লাশ পাওয়া গেছে। পরিবারের লোকজন বলছে, খেলতে গিয়ে ড্রেনে পড়ে মৃত্যু হয়েছে। আমরা সেটা এখনও নিশ্চিত হতে পারিনি। আমরা লাশ ময়নাতদন্তের জন্য চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে পাঠিয়েছি। ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন পেলে বোঝা যাবে।’

প্রসঙ্গত, চট্টগ্রামে খাল ও নালায় পড়ে গত এক যুগে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রীসহ অন্তত ১৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে একজনের খোঁজ এখনো মেলেনি। আহত হয়েছেন অনেকে।

সিটি করপোরেশনের হিসাব অনুযায়ী, নগরীর ৪১ ওয়ার্ডে খাল-নালা আছে এক হাজার ১৩৭ কিলোমিটার। এর মধ্যে নিরাপত্তা বেষ্টনি ছাড়া খালের পাড় আছে ১৯ কিলোমিটার। উন্মুক্ত নালা রয়েছে ৫ হাজার ৫২৭টি স্থানে। এসব জায়গা চরম ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে চসিক।

সারাবাংলা/আরডি/পিটিএম

Tags: , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন