বিজ্ঞাপন

ইবিতে বিবস্ত্র করে র‌্যাগিং: ৩ শিক্ষার্থীকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত

June 9, 2024 | 7:19 pm

আজাহারুল ইসলাম, ইবি করেসপন্ডেন্ট

কুষ্টিয়া: ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে (ইবি) লালন শাহ হলের গণরুমে (১৩৬ নম্বর কক্ষ) র‌্যাগিং তদন্তে গঠিত কমিটি প্রশাসনের কাছে প্রতিবেদন দাখিল করেছে। সেই প্রতিবেদনে র‌্যাগিং ছাড়াও শারিরীক, পাশবিক ও মানসিক নির্যাতনের সত্যতা মিলেছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ইতোমধ্যে তিন শিক্ষার্থীকে এক বছরের জন্য বহিষ্কার ও দু’জনকে সতর্ক করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শৃঙ্খলা কমিটি।

বিজ্ঞাপন

এ ছাড়া, বহিষ্কৃতদের কারণ দর্শানোর সুযোগ দেওয়া হয়েছে। চিঠি পাওয়ার ৭ কার্যদিবসের মধ্যে তাদের জবাব দিতে বলা হয়েছে। কিন্তু ক্যাম্পাস বন্ধ থাকায় আগামী ৩০ জুনের মধ্যে তাদের জবাব দিতে হবে। গত ২ জুন রেজিস্ট্রারের সই করা চিঠি সূত্রে তথ্য জানা গেছে।

এদিকে, হল প্রশাসন গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন সারাবাংলা’র এই প্রতিবেদকের হাতে এসেছে। তদন্ত প্রতিবেদন সূত্রে জানা গেছে, কমিটি কয়েক দফায় অভিযুক্ত, ভূক্তভোগী, সাক্ষী, অন্যান্য শিক্ষার্থী, সাংবাদিকসহ বিভিন্ন মাধ্যমে তথ্য ও উপাত্ত সংগ্রহ করেছে। এসব তথ্য যাচাই-বাছাই শেষে তারা ঘটনার সতত্যা পেয়েছেনর। এ বিষয়ে তাদের কাছে যথেষ্ট সাক্ষ্য-প্রমাণ রয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভুক্তভোগীকে চড়-থাপ্পড়সহ বেঞ্চের ওপর দাঁড় করিয়ে রাখা অপমানজনক। তাছাড়া উলঙ্গ করা, নাকে খত দেওয়া, স্কেল ও রড দিয়ে আঘাত করা- এ ধরনের কার্যক্রম হত্যা চেষ্টার শামিল। গভীর রাতে রুম থেকে বিছানা-পত্র ছুঁড়ে ফেলে হল থেকে বের করে দেওয়ার প্রচেষ্টা অমানবিক ও নিষ্ঠুরতার পরিচায়ক। বারবার আকুতি-মিনতি করার পরও অভিযুক্তরা ভুক্তভুগীর কথা কর্ণপাত করেনি। যা ২০০৯ সালে আবাসিক হল সমূহের প্রভোস্ট কাউন্সিলের প্রণীত অভিন্ন নীতিমালার লঙ্ঘন। নীতিমালা ৭-এর (ক) ও ৭-এর (৩) বিধির আলোকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ। তদন্ত কমিটির সর্বসম্মতিক্রমে অভিযুক্ত অপরাধী ছাত্রদের অপরাধের মাত্রা অনুযায়ী শাস্তির সুপারিশ করেছে।

বিজ্ঞাপন

প্রতিবেদনে তারা দেশরত্ন শেখ হাসিনা হলের র‌্যাগিংয়ের ঘটনা ‘নজির’ হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, ‘দেশরত্ন শেখ হাসিনা হলে সংঘটিত র‌্যাগিং বিষয়ে শাস্তির বিষয়টি সর্বমহল অবহিত হওয়ার পরও অপরাধীরা এ ধরনের জঘন্যতম ঘটনায় জড়িত হয়েছে। তবুও তাদের অপরাধের মাত্রা তুলনামূলক ভাবে কমেনি।

প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, র‌্যাগিংয়ের শুরু ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষের সাগর প্রামাণিকের জন্য। প্রথমত, সাগর প্রামানিক অপুকে রুমে ডেকে নিয়ে আসে। শুরুটা করে সাগর নিজেই, ‘তুই কেন দেরি করে আসলি’সহ বিভিন্ন প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে পরবর্তী সময় র‌্যাগিং চলাকালে অপুকে বেঞ্চের ওপর দাঁড় করিয়ে হাত উঁচু করে বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গি করতে বাধ্য করে। এর পর গেঞ্জি-ট্রাউজার খুলতে বাধ্য করে। পরবর্তী সময়ে র‌্যাগিং চলাকালে একই বর্ষের শারীরিক শিক্ষা ও ক্রীড়া বিজ্ঞান বিভাগের মুদ্দাসির কাফি ভুক্তভোগীকে চড়-থাপ্পড়সহ স্কেল ও রড দিয়ে শরীরের বিভিন্ন স্থানে মারধর করে এবং বিভিন্ন অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি করতে বাধ্য করে। ইসলামের ইতিহাস বিভাগের একই বর্ষের আরের ছাত্র উজ্জল হোসেন শুরু থেকেই র‌্যাগিংয়ে সহায়তা করে। উজ্জলই ভুক্তভোগীকে নাকে খত দিতে বাধ্য করে। এ ছাড়াও সবাই মিলে ভূক্তভোগী বিভিন্নভাবে শারিরীক, পাশবিক ও মানসিক নির্যাতন করে।

এদিকে ল’ অ্যান্ড ল্যান্ড ম্যানেজমেন্ট বিভাগের একই বর্ষের ইউসুফ সানী র‌্যাগিংয়ে সংশ্লিষ্ট ছিল না। ঘটনার সময় সানী সেখানে উপস্থিত ছিল এবং র‌্যাগিংয়ের এক পর্যায়ে অপুকে ছেড়ে দিতে বলে এবং হুমকি স্বরূপ বলে, ‘তুমি ভালো হয়ে যাও’। এদিকে, অভিযুক্ত সাগরের কথামতো অপুর বিছানাপত্র সাগরের রুমে নিয়ে যায়।

বিজ্ঞাপন

তদন্ত কমিটির সুপারিশ

র‌্যাগিংয়ের ঘটনায় অপরাধের মাত্রার ভিত্তিতে মুদ্দাসির কাফিকে দুই বছর, সাগর প্রামাণিক ও উজ্জলকে এক বছরের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কারের সুপারিশ করে তদন্ত কমিটি। এ ছাড়াও, তাদের আবাসিক সুবিধা বাতিলের সুপারিশ করেছে কমিটি। এদিকে, ইউসুফ সানি ও মিশনোর অপরাধ গুরুতর হিসেবে বিবেচনায় নেয়নি কমিটি। তাই তাদের থেকে লিখিত মুচলেকা দেওয়ার জন্য তদন্ত কমিটির পক্ষ থেকে সুপারিশ করা হয়।

এদিকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কর্তৃক গঠিত তদন্ত কমিটিও ঘটনার সতত্যা পায়। ১৪ পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদনে বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত সংযুক্ত ছাড়াও অপরাধের মাত্রার ভিত্তিতে বিভিন্ন সুপারিশ করেছে।

যা বলছে মানবাধিকার কমিশন

বিজ্ঞাপন

লালন শাহ হলের র‌্যাগিংয়ের ঘটনা গণমাধ্যমের দ্বারা জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের দৃষ্টিগোচর হয়। তারা সুয়োমুটো (স্বেচ্ছায়) ভাবে এই অভিযোগ গ্রহণ করেছে। তদন্ত কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কর্তৃক গৃহীত ব্যবস্থা আগামী ২৯ জুলাইয়ের মধ্যে কমিশনকে অবহিত করতে রেজিস্ট্রারকে বলা হয়েছে।

এক আদেশনামায় কমিশন বলেন, ইবিতে এক ছাত্রকে রাতভর র‌্যাগিংয়ের অভিযোগ উঠেছে। এ সময় ঐ শিক্ষার্থীকে নগ্ন করে দাঁড় করিয়ে রাখা, নাকে খত দেওয়ানো, রড দিয়ে আঘাত, অশ্রাব্য ভাষায় গালাগালি, হল থেকে বের করে দেওয়ার হুমকি দেওয়া হয়েছে। গত ০৭ ফেব্রুয়ারি রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের লালন শাহ হলের গণরুমে (১৩৬ নম্বর কক্ষ) রাত ১২টা থেকে ভোর রাত পর্যন্ত এ ঘটনা ঘটেছে বলে জানিয়েছে একাধিক সূত্র। পরে শাখা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা বিষয়টি সমাধান করে দিয়েছেন বলে জানা যায়। ঘটনায় জড়িতরা সবাই শাখা ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত।

কমিশনের এক আদেশনামায় বলা হয়, সাম্প্রতিক কালে বিভিন্ন স্বনামধন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থী নির্যাতন উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। উল্লিখিত ঘটনায় ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন শিক্ষার্থীকে নগ্ন করে দাঁড় করিয়ে রাখা, নাকে খত দেওয়ানো, রড দিয়ে আঘাত, অশ্রাব্য ভাষায় গালাগালি, হল থেকে বের করে দেওয়ার হুমকি দেওয়ার ঘটনাটি নৈতিক স্খলনের উদাহরণ। এটি মানবিক মর্যাদার পক্ষে হানিকর, অত্যন্ত অমানবিক ও মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন। ওই ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তপূর্বক দোষী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে বিধি অনুযায়ী শাস্তির ব্যবস্থা নেওয়া সমীচীন।

প্রশাসনের সিদ্ধান্ত

লালন শাহ হলে র‌্যাগিংয়ের ঘটনায় মুদ্দাসির খান কাফি, সাগর প্রামাণিক ও উজ্জল হোসেনকে এক বছরের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। একইসঙ্গে তাদের বিরুদ্ধে কেন চূড়ান্ত শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে না- এ মর্মে আগামী সাত কার্যদিবসের মধ্যে রেজিস্ট্রার বরাবর আত্মপক্ষ সমর্থনপূর্বক লিখিত জবাব দিতে বলা হয়েছে।

এদিকে ‘র‌্যাগিংয়ের সমঝোতাকারী ‘বড়ভাই’ শাখা ছাত্রলীগের শিক্ষা ও পাঠচক্র সম্পাদক ও অর্থনীতি বিভাগের ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের নাসিম আহমেদ মাসুম এবং আইসিটি বিভাগের মিসনো আল আসনাওয়ীকে সতর্ক করা হয়েছে। ভবিষ্যতে এ ধরনের কর্মকাণ্ডে যুক্ত হলে তাদের স্থায়ী বহিষ্কার করা হবে হবে বলে জানানো হয়েছে। অভিযুক্তরা সবাই শাখা ছাত্রলীগের কর্মী ও সাধারণ সম্পাদক নাসিম আহমেদ জয়ের অনুসারী বলে জানা গেছে।

সারাবাংলা/পিটিএম

Tags: , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন