বিজ্ঞাপন

৪ লাখ টাকায় যমজ সন্তান বিক্রি, দ্বন্দ্বে জড়িয়ে ‘চুরির অভিযোগ’

June 9, 2024 | 11:16 pm

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট

চট্টগ্রাম ব্যুরো: পাঁচ মাস আগে যমজ ছেলে-মেয়ে জন্ম নেxয়ার পর বাবা-মা মিলে পরস্পরের সম্মতিতে চার লাখ টাকায় তাদের দুই নারীর কাছে ‘বিক্রি’ করে দেন। পরে সেই টাকার ভাগাভাগি নিয়ে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে দ্বন্দ্ব হয়। এর জেরে স্ত্রী আদালতে তার সন্তান চুরির অভিযোগে নিজের স্বামী ও দুই চিকিৎসকের বিরুদ্ধে মানবপাচার আইনে মামলা ঠুকে দেন।

বিজ্ঞাপন

সেই মামলা তদন্ত করতে গিয়ে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) বের করে নেপথ্যের রহস্য। পিবিআই জানিয়েছে, শনিবার (৭ জুন) দিনভর অভিযান চালিয়ে ছেলে শিশুটিকে চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া উপজেলার রাজানগর ইউনিয়নের রাণীরহাট এলাকায় এক নারীর হেফাজত থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। যাকে তিনি তিন লাখ টাকার বিনিময়ে দত্তক নিয়েছিলেন। অন্যদিকে, মেয়ে শিশুটিকে নগরীর বায়েজিদ বোস্তামি থানার অক্সিজেন এলাকায় এক নারীর হেফাজত থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। যাকে তিনি এক লাখ টাকার বিনিময়ে দত্তক নিয়েছিলেন।

রোববার (৯ জুন) দুপুরে সংবাদ সম্মেলনে পিবিআই, চট্টগ্রাম মহানগর ইউনিটের পুলিশ সুপার নাঈমা সুলতানা জানান, মানবপাচার মামলার বাদী মুন্নী আক্তার গত ৩ জানুয়ারি নগরীর পাঁচলাইশে পলি ক্লিনিক নামে একটি বেসরকারি হাসপাতালে যমজ সন্তান প্রসব করেন। বাবুর্চির সহকারী পেশায় নিয়োজিত মুন্নীর সঙ্গে রাশেদা বেগম নামে এক নারীর পরিচয় ছিল। তার বাড়ি সীতাকুণ্ডের জঙ্গল সলিমপুরের ছিন্নমূল এলাকায়। রাশেদা মুন্নীকে গর্ভাবস্থায় তার সন্তানগুলো বিক্রির বিষয়ে রাজি করেন।

এসপি নাঈমা সুলতানা সারাবাংলাকে বলেন, ‘রাশেদা বেগম একদিকে মুন্নীকে রাজি করান, অন্যদিকে বাচ্চা দত্তক নেওয়ার জন্য দুই নারীকেও সংগ্রহ করেন। তাদের সঙ্গে রাশেদার আগে থেকে পরিচয় ছিল। মুন্নী তার স্বামী হাবিবুর রহমানের সঙ্গে আলাপ করে স্বেচ্ছায় চার লাখ টাকায় দুই সন্তান বিক্রি করেন। মধ্যস্থতাকারী হিসেবে রাশেদা পান এক লাখ টাকা।’

বিজ্ঞাপন

‘ঘটনার কিছুদিন পর টাকার ভাগ নিয়ে মুন্নীর সঙ্গে তার স্বামী হাবিবুর রহমানের দ্বন্দ্ব হয়। হাবিবুর তার কাছ থেকে দেড় লাখ টাকা কেড়ে নেয়। এতে তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে আদালতে তার সন্তান চুরির অভিযোগ করেন। অভিযোগে পলি ক্লিনিকের দুই চিকিৎসক, স্বামী হাবিবুর রহমান এবং অজ্ঞাতনামা আরও তিন নারীকে আসামি করা হয়। আদালত সেটি মানবপাচার আইনে মামলা হিসেবে গ্রহণ করে পিবিআইকে তদন্তের নির্দেশ দেন। বিভিন্ন সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে তদন্তে আমরা শিশু চুরির অভিযোগের কোনো সত্যতা পাইনি,’ – বলেন এসপি নাঈমা ‍সুলতানা।

এদিকে, উদ্ধার হওয়া দুই শিশুকে রোববার বিকেলে আদালতে উপস্থাপন করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআই-মেট্রো ইউনিটের উপ-পরিদর্শক (এসআই) মো. শাহেদুল্লাহ। এ সময় তাদের হেফাজতকারী দুই নারী এবং মামলার বাদীও আদালতে হাজির ছিলেন।

এসআই শাহেদুল্লাহ সারাবাংলাকে বলেন, ‘আদালত দুই শিশুকে পুলিশের ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। দুই শিশুর সঙ্গে তাদের জন্মদাত্রী মা অর্থাৎ মামলার বাদী এবং পরবর্তী সময়ে দত্তক নেওয়া দুই নারীকেও থাকার নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। আমরা তাদের ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে পঠিয়ে দিয়েছি। এ ছাড়া, মামলার তদন্তে যা যা পেয়েছি, সব আদালতে লিখিতভাবে জমা দেওয়া হয়েছে। আদালত সেগুলো সোমবার শুনানির জন্য উপস্থাপনের আদেশ দিয়েছেন। মামলার বাদী ও তার স্বামী অর্থাৎ যমজ সন্তানের বাবা-মা ও তাদের দত্তক নেওয়া দুই নারী এবং মধ্যস্থতাকারী নারীর বিষয়ে আশা করি আদালত সিদ্ধান্ত দেবেন।’

বিজ্ঞাপন

এদিকে, নগদ টাকায় দুই শিশুকে দত্তক নিয়ে বিপাকে পড়েছেন দুই নারী। সামাজিক সম্মান হারানো এবং পরিবারের সদস্য ও স্বজনদের মানসিক নির্যাতনের মুখোমুখি হওয়ার আশঙ্কা করছেন তারা। দুই শিশুকে উদ্ধার করে তাদেরও রোববার সকালে পিবিআই কার্যালয়ে নেওয়া হয়।

ছেলে শিশুটিকে দত্তক নেওয়া নারী সারাবাংলাকে জানান, ২০০২ সালে তার বিয়ে হয়। তার স্বামী সৌদিআরব প্রবাসী। তাদের সংসারে তিন মেয়ে আছে। বড় মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু কোনো ছেলে সন্তান না হওয়ায় প্রবাসী স্বামীর সম্মতিতে শিশুটিকে দত্তক নিয়েছিলেন। এ জন্য রাশেদার মাধ্যমে মুন্নী ও তার স্বামী হাবিবুরকে তিন লাখ টাকা দিয়েছিলেন। রাশেদাকে আরও বিশ হাজার টাকা দিয়েছিলেন।

‘আমার তিনটাই মেয়ে। স্বামীও থাকে বিদেশে। একটা ছেলে নেই, এজন্য শ্বশুরবাড়ির লোকজনের অনেক কথা শুনেছি। তাই আমার হাজবেন্ডকে বলে ছেলেটাকে দত্তক নিয়েছিলাম। হাজবেন্ড টাকা পাঠিয়েছিল। হাজবেন্ড শুধু জানতো দত্তক নিয়েছি, বাকি সবাই জানত আমি জন্ম দিয়েছি। এখন যদি এ ঘটনা সবাই জেনে যায়, তাহলে শ্বশুরবাড়ির লোকজনকে মুখ কীভাবে দেখাব জানি না। এতবড় ঘটনা হয়ে যাবে, সেটা আমি কখনও কল্পনাও করতে পারিনি,’ – বলেন ওই নারী।

মেয়ে শিশুটিকে দত্তক নেওয়া নারী জানান, ২০০৭ সালে তার বিয়ে হয়। ১৬ বছর বয়সী এক ছেলে আছে, জন্ম থেকে পঙ্গু। এরপর একাধিকবার তার গর্ভের সন্তান নষ্ট হয়েছে। তার স্বামী দুবাই থাকে। সর্বশেষ গর্ভধারণের পর এক লাখ টাকায় মেয়েটিকে দত্তক নিয়ে স্বামী এবং শ্বশুরবাড়ির লোকজনকে জানিয়েছেন, এ সন্তান তিনি প্রসব করেছেন।

বিজ্ঞাপন

‘আমার হাজবেন্ড জানে না, আমি মেয়েটিকে কিনে নিয়েছি। এতবছর পর আমার বাচ্চা হয়েছে শুনে আমার স্বামী খুব খুশি হয়েছেন। শ্বশুরবাড়ির লোকজন, আমার বাপের বাড়ির লোকজনও খুব খুশি হয়েছেন। এখন ঘটনা জানাজানি হলে স্বামী আমাকে তালাক দেবে। আমি কী করব, নিজেও জানি না,’ – বলেন ওই নারী।

সারাবাংলা/আরডি/পিটিএম

Tags: , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন