বিজ্ঞাপন

ডিক্রি বাতিল, দেশপ্রিয়র বাড়ি-সম্পত্তি থাকবে সরকারের নিয়ন্ত্রণে

June 11, 2024 | 6:53 pm

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট

চট্টগ্রাম ব্যুরো: চট্টগ্রামে শতবর্ষ প্রাচীন দেশপ্রিয় যতীন্দ্র মোহন সেনগুপ্তের বাড়িসহ সম্পত্তি ‘বায়নামূলে দখলস্বত্ত্ব’ নেয়ার আদেশ বাতিল করে দিয়েছেন আদালত। এর ফলে অর্পিত সম্পত্তি হিসেবে দেশপ্রিয়র বাড়ি-জমি এখন সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকবে বলে মত দিয়েছেন সরকারি কৌঁসুলি।

বিজ্ঞাপন

সোমবার (১০ জুন) চট্টগ্রামের প্রথম যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ মো. খায়রুল আমিন এ আদেশ দিয়েছেন বলে অতিরিক্ত সরকারি কৌঁসুলি মো. ফখরুদ্দিন জাবেদ জানিয়েছেন।

চট্টগ্রাম নগরীর রহমতগঞ্জে আঠারো শতকের খ্যাতিমান বাঙালি আইনজীবী যাত্রা মোহন সেনের গড়ে তোলা বাড়িসহ সম্পত্তি নিয়ে ২০২১ সালে তুলকালাম কাণ্ড ঘটে। বৃটিশবিরোধী আন্দোলনের স্মৃতি বিজড়িত বাড়িটি প্রায় অর্ধশত বছর ধরে বেদখল হয়ে ছিল। এর জমির পরিমাণ ১৯ গণ্ডা এক কড়া। অর্পিত সম্পত্তি হিসেবে ঘোষিত বাড়িসহ জমিটি জেলা প্রশাসনের কাছ থেকে ইজারা নিয়ে শামসুদ্দিন মো. ইছহাক নামে এক ব্যক্তি ‘বাংলা কলেজ’ নামে একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। সর্বশেষ সেখানে ‘শিশুবাগ’ নামে একটি স্কুলের কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছিল।

বিজ্ঞাপন

যাত্রা মোহন সেনের সন্তান দেশপ্রিয় যতীন্দ্র মোহন সেনগুপ্ত ছিলেন সর্বভারতীয় কংগ্রেসের নেতা। ১৯১৯ সালের ২ নভেম্বর তিনি কোলকাতায় মারা যান। তার স্ত্রী নেলী সেনগুপ্ত ১৯৭০ সাল পর্যন্ত বাড়িটিতে ছিলেন। সেসময় তিনি ভারতের কংগ্রেস সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর আমন্ত্রণে চিকিৎসার জন্য সেখানে যান। দেশে ফিরে তিনি দেখেন বাড়িটি বেদখল হয়ে গেছে। এরপর তিনি ভারতে চলে গেলে পাকিস্তান সরকার সেটিকে শত্রু সম্পত্তি ঘোষণা করে।

দখলী পক্ষ ইজারা নিয়ে ১৯৭৫ সালে সেই বাড়িতে ‘শিশুবাগ স্কুল’ নামে একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করে। তবে বৃটিশ আন্দোলনের স্মৃতি বিজড়িত ভবনটি অক্ষত রাখা হয়। ইজারাগ্রহীতা শামসুদ্দিন মো. ইছহাকের সন্তানরা ২০২১ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত সেটি পরিচালনা করছিলেন।

২০২১ সালের ৪ জানুয়ারি দুপুরে পুলিশের উপস্থিতিতে স্কুলের শিক্ষকদের জোরপূর্বক সেখান থেকে বের করে দিয়ে ভবনটির একাংশ বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেয় এম ফরিদ উদ্দিন নামে এক ব্যক্তির লোকজন। ভবনসহ জমিটি দখলে আদালতের নির্দেশনা আছে বলে জানিয়েছিলেন ঘটনাস্থলে থাকা ফরিদের দুই ছেলে।

বিজ্ঞাপন

তবে উচ্ছেদ সংক্রান্তে জেলা প্রশাসনকে অন্ধকারে রেখে শুধুমাত্র পুলিশের সহায়তায় ঐতিহ্যবাহী ভবনটির একাংশ গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ করেন ভবনটি ভাঙার বিপক্ষে অবস্থান নেওয়া বিশিষ্টজনেরা। এসময় মানবতা বিরোধী অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর রানা দাশগুপ্ত ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে ভবন ভাঙার চেষ্টা ব্যর্থ করে দেন। চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনও এগিয়ে এসে ভবনটি ভাঙা থেকে বিরত থাকার আদেশ দেয় এবং সেখানে পুলিশ মোতায়েন করা হয়। এরপর জেলা প্রশাসনের আদেশে বাড়ি ভাঙায় নিষেধাজ্ঞা দেয় আদালত।

এদিকে ঐতিহাসিক বাড়ি ভাঙা ও যাত্রা মোহন সেনের সম্পদ দখলের চেষ্টার বিরুদ্ধে বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন আন্দোলনে নামে। হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত, কবি ও সাংবাদিক আবুল মোমেনসহ বিশিষ্টজনেরাও রাজপথে নামেন।

সর্বস্তরের নাগরিকদের আন্দোলনের মুখে ২০২১ সালের ২৩ জানুয়ারি দেশপ্রিয়র বাড়ির পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নেয় জেলা প্রশাসন। বাড়িটিতে ‘স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর নির্মাণের জন্য নির্ধারিত স্থান’ লেখা একটি সাইনবোর্ড স্থাপন করা হয়।

রাষ্ট্রপক্ষে দেওয়ানি মামলা পরিচালনাকারী অ্যাডিশনার গভর্নমেন্ট প্লিডার (জিপি) মো. ফখরুদ্দিন জাবেদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘অর্পিত সম্পত্তি হিসেবে নথিভুক্ত থাকা সম্পত্তি একটি পক্ষের কাছ থেকে বায়নানামা মূলে খরিদের দাবি করে আদালতে দখলস্বত্ত্ব দেয়ার আবেদন করেছিলেন এম ফরিদ চৌধুরী। আদালত তার পক্ষে ডিক্রি দিয়েছিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে ভবন ভাঙার চেষ্টায় বিষয়টি যখন জানাজানি হয়, তখন জেলা প্রশাসন এবং রাষ্ট্রপক্ষে আমরা ডিক্রি বাতিলের আবেদন করি।’

বিজ্ঞাপন

‘যে পক্ষের কাছ থেকে বায়নানামা নেয়ার কথা বলা হয়েছে, সেটি ভূয়া মর্মে আমরা আদালতে মিসকেস করি। আমাদের আবেদনের সপক্ষে শুনানিতে তথ্যপ্রমাণ উপস্থাপন করি। আদালত আমাদের আবেদন গ্রহণ করে ডিক্রির আদেশ বাতিল করেছেন। এর ফলে ওই বাড়িসহ সম্পত্তি এখন রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে অর্পিত সম্পত্তি হিসেবে থাকবে। একইসঙ্গে অর্পিত সম্পত্তি আইনের মামলাটিও আবার পূর্বাবস্থায় ফেরত গেল। এখন দখল দাবিদার পক্ষ যদি উচ্চ আদালতে এ আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করে, আমরাও রাষ্ট্রপক্ষে মুভ করবো।,’ – বলেন ফখরুদ্দিন জাবেদ।

জেলা প্রশাসনের আইনজীবী রুবেল পাল সারাবাংলাকে বলেন, ‘যতীন্দ্র মোহন সেনগুপ্তের ভাগ্নে দাবিদার মিলন সেনগুপ্তের কাছ থেকে জমি কেনার বায়নামূলে মামলা করে ফরিদ গং দখলের আদেশ পেয়েছিলেন। কিন্তু দখল চেয়ে করা মামলায় জেলা প্রশাসনকে বিবাদী করা হলেও এ সংক্রান্ত কয়েকটি শুনানিতে সরকার পক্ষের হাজিরাও ছিল না।’

‘সরকার পক্ষের অজ্ঞাতে মামলার শুনানি শেষ করে ডিক্রি পেয়েছিলেন তারা। এ সংক্রান্ত আদেশের নথিতে দেওয়ানি শাখার দায়িত্বপ্রাপ্ত নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের কোনো স্বাক্ষর না নিয়ে তারা বাড়িটি ভেঙে সম্পত্তি দখল করতে গিয়েছিল। এমনকি ভবন ভাঙতে যাবার আগপর্যন্ত জেলা প্রশাসন বিষয়টি অবগতই ছিলেন না। আমরা বিষয়গুলো আদালতে উপস্থাপন করি। আদালত সন্তুষ্ট হয়ে আগের আদেশ বাতিল করেন,’ – বলেন রুবেল পাল।

সারাবাংলা/আরডি/এনইউ

Tags:

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন