বিজ্ঞাপন

পুনর্বাসনে প্রাণ পাবে দেশের বৃহত্তম সেচ প্রকল্প

June 28, 2024 | 9:55 pm

জোসনা জামান, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট 

ঢাকা: গঙ্গা-কপোতাক্ষ সেচ প্রকল্প। দেশের বৃহত্তম সেচ প্রকল্প। খুলনা বিভাগের চার জেলার ১৩ উপজেলায় এক লাখ ৯৭ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে বিস্তৃত এর কার্যক্রম। অথচ চলতি মৌসুমেই গোটা এলাকা ছিল সেচের বাইরে। কারণ পদ্মা নদী থেকে প্রকল্পের অধীন খালগুলোতে পানি সরবরাহের জন্য যে তিনটি পাম্প ব্যবহার করা হয়, তার সবগুলোই ছিল অকেজো।

বিজ্ঞাপন

এতে বিস্তীর্ণ এলাকার কৃষি পড়ে হুমকির মুখে। ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহার করে সেচ দিতে গিয়ে কৃষকদের খরচ বেড়ে যায় প্রায় ৩৩ গুণ। হুমকিতে পড়ে জীববৈচিত্র্যও। কেবল পাম্পের সমস্যা নয়, গত প্রায় এক দশকে মূল পদ্মা থেকে গঙ্গা-কপোতাক্ষ সেচ প্রকল্পে পানি আনতে ব্যবহৃত সংযোগ খালের কারণেও ভুগতে হয়েছে কৃষকদের।

ওই অঞ্চলের কৃষকসহ সংশ্লিষ্টরা নানা সমস্যায় আক্রান্ত জিকে সেচ নামে পরিচিত এই প্রকল্পটির সংস্কার বা পুনর্বাসনের দাবি জানিয়ে আসছেন দীর্ঘ দিন ধরেই। শেষ পর্যন্ত প্রকল্পটি পুনর্বাসনের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। ‘গঙ্গা-কপোতাক্ষ সেচ প্রকল্পের পুনর্বাসন’ শিরোনামে প্রকল্প প্রস্তাব করা হয়েছে পরিকল্পনা কমিশনে। দুই হাজার ৪৫৫ কোটি ৯৯ লাখ টাকার প্রকল্পটি অনুমোদন পেলে বাস্তবায়ন করবে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড (বাপউবো)।

খুলনা বিভাগের চার জেলা কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, মাগুরা ও ঝিনাইদহের ১৩টি উপজেলাকে সেচের আওতায় আনতে ১৯৫৪ সালে হাতে নেওয়া হয় জিকে সেচ প্রকল্প। এর অধীন উপজেলাগুলো হলো— কুষ্টিয়ার কুষ্টিয়া সদর, কুমারখালী, খোকসা, মিরপুর, ভেড়ামারা ও দৌলতপুর; চুয়াডাঙ্গার চুয়াডাঙ্গা সদর ও আলমডাঙ্গা; ঝিনাইদহের ঝিনাইদহ সদর, হরিণাকুন্ড ও শৈলকূপা; এবং মাগুরার মাগুরা সদর ও শ্রীপুর।

বিজ্ঞাপন

কৃষি উৎপাদন বাড়িয়ে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের লক্ষ্যে ১৯৫৫-৫৬ সালে শুরু হয়ে জিকে প্রকল্পের প্রথম পর্যায় শেষ হয় ১৯৬৯-৭০ সালে। প্রকল্পের আওতায় আসে প্রধান তিনটি খাল, ৪৯টি শাখা খাল ও ৪৪৪টি উপশাখা খাল। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে জিকে সেচ প্রকল্পেও নানা ধরনের সীমাবদ্ধতা তৈরি হয়েছে, যা অতিক্রম করে একে পূর্ণ সক্ষম করে তুলতেই পুনর্বাসন প্রকল্পটি প্রণয়ন করা হয়েছে।

ভেড়ামারায় প্রকল্পের প্রধান পাম্প হাউজ। এর তিনটি পাম্পের মধ্যে একটি কোনোমতে চলছে, বাকি দুটি অচল। ছবি: সংগৃহীত

জিকে সেচ প্রকল্পের বর্তমান অবস্থা

পরিকল্পনা কমিশন সূত্র বলছে, প্রকল্পের আওতায় ১৯৩ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের তিনটি প্রধান খাল, ৪৬৭ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের ৪৯টি সেকেন্ডারি খাল বা শাখা খাল ও ৯৯৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের ৪৪৪টি টারশিয়ারি খাল তথা উপশাখা খাল রয়েছে। শুষ্ক মৌসুমে যখন গঙ্গার পানি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৪ মিটার নিচে চলে গেলে প্রকল্পের প্রধান পাম্প কাজ করে না। তখন সাবসিডিয়ারি পাম্প ব্যবহার করা হয়।

বাপাউবোর তথ্য বলছে, ৪৯টি শাখা খালের মধ্যে ২০টির ডাইক সম্পূর্ণ নষ্ট হওয়ায় সেগুলো দিয়ে সেচ দেওয়া যাচ্ছে না। বাকি ২৯টির ডাইক আংশিক নষ্ট। ফলে সেগুলোর সেচ সরবরাহ সক্ষমতা কমে গেছে। অন্যদিকে ৪৪৪টি উপশাখা খালের মধ্যে ২০৮টিই পলি দিয়ে ভরাট হয়ে গেছে। বাকিগুলোর ডাইক নষ্ট হয়েছে। ফলে উপশাখা খালগুলো দিয়েও কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় সেচ দেওয়া যাচ্ছে না।

বিজ্ঞাপন

এদিকে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রকল্পের প্রধান তিনটি পাম্পের মধ্যে দুটিই অচল হয়ে গেছে। অন্য একটি পাম্পও কোনোমতে সচল রাখা হয়েছে মেরামত করে করে। অন্যদিকে ২০০৪-০৫ সালে নষ্ট হয়ে গেছে সাবসিডিয়ারি পাম্পগুলো। সেগুলো আর মেরামতযোগ্যও নেই। সব মিলিয়ে জিকে সেচ প্রকল্পের বর্তমান সেচযোগ্য এলাকা কমে দাঁড়িয়েছে ৯৫ হাজার ৬১৬ হেক্টরে। আবার প্রকল্পটির সক্ষমতা কমে যাওয়ায় ২০২০-২১ অর্থবছরে ৫১ হাজার ৫৫৫ হেক্টর, ২০২১-২২ অর্থবছরে ৪০ হাজার ৭৭০ হেক্টর ও ২০২২-২৩ অর্থবছরে মাত্র ৩৯ হাজার ৮২৯ হেক্টর জমিতে সেচ দেওয়া সম্ভব হয়েছে।

পুনর্বাসন প্রস্তাব ও সমীক্ষা

পানি উন্নয়ন বোর্ড বলছে, দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের বিস্তীর্ণ এলাকায় সেচের পানির অভাবে শস্য সংকট একটি চিরন্তন সমস্যা। শুষ্ক মৌসুমে তো বটেই, আমন মৌসুমে এবং বর্ষা ও বর্ষা-পরবর্তী খরা এই অঞ্চলের নিয়মিত ঘটনা। আর এর কারণ, পদ্মা ছাড়া অন্যান্য ছোট ছোট নদী ও খালগুলোতে পানির প্রবাহ অত্যন্ত কম। গোটা এলাকাতেই সেচের পানির প্রাপ্যতা খুবই সীমিত।

এ পরিস্থিতিতেই পদ্মা নদীতে পাম্প হাউজ নির্মাণ করে তার মাধ্যমে বিস্তীর্ণ এলাকায় সেচ দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয় ব্রিটিশ আমল থেকেই। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার জন্য খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বেশি খাদ্যশস্য উৎপাদনের জন্যই গঙ্গা-কপোতাক্ষ (জিকে) সেচ প্রকল্পটি হাতে নেওয়া হয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নানা সীমাবদ্ধতায় এর কার্যক্ষমতা কমে গেলে প্রকল্পটি পুনর্বাসনের পরিকল্পনা শুরু করে পাউবো।

জিকে সেচ প্রকল্পের মোট এলাকা। ছবি: বাংলাপিডিয়া

এর অংশ হিসেবে ইরিগেশন ম্যানেজমেন্ট ইমপ্রুভমেন্ট প্রজেক্টের (আইএমআইপি) আওতায় প্রজেক্ট ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ডিজাইন কনসালট্যান্ট (পিএমডিসি) জিকে সেচ প্রকল্পের পুনর্বাসনে উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) প্রণয়নের দায়িত্ব পায়। এর জন্য ২০১৮ সালে সম্ভাব্যতা সমীক্ষা করা হয়। সেই সমীক্ষার আলোতে ডিপিপি প্রণয়ন করা হয়েছে।

বিজ্ঞাপন

যা থাকছে পুনর্বাসন প্রস্তাবে

এরই মধ্যে পরিকল্পনা কমিশনে জিকে সেচ পুনর্বাসন প্রকল্প প্রস্তাবনা জমা পড়েছে। পরিকল্পনা কমিশন ও বাপাউবো সূত্রে জানা গেছে, বর্তমান অচলাবস্থা কাটাতে কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা উপজেলার জিকে সাবসিডিয়ারি পাম্প হাউজ নির্মাণের পাশাপাশি পাম্প হাউজের উৎস মুখ থেকে প্রধান সংযোগ খাল পুনর্খননের প্রস্তাব রয়েছে। রয়েছে ভেড়ামারা উপজেলার প্রধান সড়ক থেকে সাবসিডিয়ারি পাম্প হাউজ পর্যন্ত সংযোগ সড়ক নির্মাণের কাজও।

জিকে সেচ প্রকল্পে বর্তমানে যে তিনটি প্রধান সেচ খাল রয়েছে, সেগুলো পুনরাকৃতিকরণের (জিএমসি, কেএমসি ও এএমসি) প্রস্তাব রয়েছে। রয়েছে প্রকল্পের সেকেন্ডারি ও টারশিয়ারি সেচ খাল পুনরাকৃতিকরণের কাজ। প্রকল্পের পানি নিস্কাশন খালও পুনর্খনন করা হবে। বাপাউবো বলছে, সবগুলো খাল পুনর্খনন করা হলে সেচযোগ্য এলাকা আগের পরিমাণে ফিরিয়ে নেওয়া সম্ভব হবে।

এর বাইরে জিকে পাম্প স্টেশনের জন্য সিসিটিভি সিস্টেম, শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা, অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থা, হাউজ অয়্যারিং সিস্টেম, আলোকায়ন ও প্রধান পণ্যাগারের স্বয়ক্রিয় মজুত ব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রস্তাব রয়েছে পুনর্বাসন প্রকল্পে। রয়েছে জিকে পাম্প স্টেশনের ৫ দশমিক ৫ কেভি ওভারহেড ট্রান্সমিশন লাইন ও আনুষাঙ্গিক যন্ত্রাংশ সরবরাহসহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য কাজ। বাপাউবো বলছে, জিকে সেচ প্রকল্পকে আধুনিক সেচ প্রকল্প হিসেবেই এসব অঙ্গ রাখা হয়েছে পুনর্বাসন প্রস্তাবনায়।

প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির সভা

জিকে সেচ প্রকল্প পুনর্বাসনের প্রস্তাবটি নিয়ে গত ২ জুন অনুষ্ঠিত হয় প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভা। এতে সভাপতিত্ব করেন পরিকল্পনা কমিশনের কৃষি, পানি সম্পদ ও পল্লী প্রতিষ্ঠান বিভাগের সদস্য (সচিব) আবদুল বাকী। সভায় প্রকল্প প্রস্তাবনার বিভিন্ন দিক নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়।

ঝিনাইদহ শৈলকূপার গাড়াগঞ্জ এলাকার জিকে সেচ প্রকল্পের প্রধান সেচ খাল, যা দিয়ে এখন শুষ্ক মৌসুমে পানি পাওয়া দুষ্কর। ছবি: সংগৃহীত

সভায় বলা হয়, গত একদশকে কী পরিমাণ পানির স্তর নিচে নেমে গেছে এবং পরবর্তী সময়ে ভূ-উপরিস্থ পানির যথাযথ ব্যবহারের মাধ্যমে সেচ কাজ শেষের জন্য সম্ভাব্যতা যাচাই ও গবেষণা প্রয়োজন। প্রকল্পটি মাঠপর্যায়ে ও তৃর্ণমূলে বাস্তবায়ন হবে জন্য প্রকল্পটি প্রতিবছর পর্যবেক্ষণে প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটি গঠনের পক্ষে অভিমত দেওয়া হয়।

সভায় সংশ্লিষ্টরা বলেন, গঙ্গা-কপোতাক্ষ সেচ প্রকল্পের পুনর্বাসনের সব কার্যক্রম পর্যায়ভিত্তিক একাধিক প্রকল্পের মাধ্যমে সরকারি ও বৈদেশিক অর্থায়নে বাস্তবায়ন করা উচিত হবে। এর কার্যক্রম বাস্তবায়নে বৈদেশিক অর্থায়ন পাওয়ার দিকে জোর দেন সংশ্লিষ্টরা। তবে বিদেশি অর্থায়ন না মিললে প্রকল্পভুক্ত সব কার্যক্রম সরকারি অর্থায়নে পর্যায়ভিত্তিক একধিক প্রকল্পের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা যেতে পারে বলে আলোচনায় উঠে আসে।

পরিকল্পনা কমিশনের মতামত

পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীন বাপাউবো গঙ্গা-কপোতাক্ষ সেচ প্রকল্পের পুনর্বাসন প্রস্তাব করার পর প্রকল্প এলাকা ও প্রস্তাবিত কার্যক্রমগুলো সম্পর্কে সম্যক ধারণা নিতে প্রকল্প এলাকা সরেজমিনে পরিদর্শন করা হয়। পরিকল্পনা কমিশনের কৃষি, পানি সম্পদ ও পল্লী প্রতিষ্ঠান বিভাগের উপপ্রধান মোহাম্মদ রাশেদ ওয়াসিফ ও উপপ্রধান এস এম শফিকুল ইসলাম গত ১৯ ও ২০ এপ্রিল প্রকল্প এলাকা ঘুরে দেখেন। পরে তারা প্রকল্পটি নিয়ে নিজেদের মত জানান। পরিকল্পনা কমিশন প্রকল্পটি নিয়ে ইতিবাচক মনোভাবই পোষণ করছে।

পরিকল্পনা কমিশনের কৃষি, পানি সম্পদ ও পল্লী প্রতিষ্ঠান বিভাগের সদস্য (সচিব) আব্দুল বাকী সারাবাংলাকে বলেন, জিকে সেচ প্রকল্পটি ওই অঞ্চলের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু খাল ভরাট হওয়া, পাম্প নষ্ট হওয়ার মতো বিভিন্ন কারণে প্রকল্পটি আগের মতো কার্যকর নেই। নতুন করে খাল খননসহ অন্যান্য কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা গেলে আবার জিকে সেচ প্রকল্পটি সবার কাজে লাগবে। সে কারণে পিইসি সভার পর বেশকিছু সুপারিশ দেওয়া হয়েছে। এগুলো প্রতিপালন করে সংশোধিত প্রকল্প প্রস্তাব পরিকল্পনা কমিশনে এলে অনুমোদনের পরবর্তী ধাপের প্রক্রিয়া শুরু হবে।

সারাবাংলা/জেজে/এনইউ/টিআর

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন