বিজ্ঞাপন

বিষন্ন বোধন

June 24, 2024 | 3:48 pm

কাজী মাসুদুর রহমান

দেবদারু ও ইউক্যালিপটাসের ঘন শ্যামল কেশের ফাঁকে প্রভাতি রবি’র উঁকি-ঝুঁকি। শিশির স্নাত ঘাসের বুকে আলো-ছায়ার শ্বাশত আলপনা। পাশে মৃদু লয়ে বয়ে কাজলদীঘি। রুপালি স্রোতের ভাজে তার ধ্রুপদী কারুকার্য। নির্জন পাড়ে প্রণয়াবনত অপ্সরা কৃষ্ণচুড়া। রিক্তনিলীমার বুকে ফেরারি মেঘের বিষন্ন মৌন মিছিল। এই শ্যামলিমাতেই চঞ্চল শৈশব আর উচ্ছল কৈশোর পেরিয়েছি বেশ আগেই। পাখ-পাখালির কুহরণে মুখরিত মায়াবি সবুজে ঘেরা যশোর শহরস্থ এই স্থানটি এখন আবাসিক উদ্যানে পরিণত হয়েছে। স্মৃতিতীর্থ এই পাদপীঠে প্রায় প্রতিনিয়তই প্রাতঃভ্রমণ ও শারিরীক কসরত সারি। দু’দিন আগে বরাবরের মতো এগুলো সেরে ফিরতেই হঠাৎ ওয়াকওয়েতে বর্ষার চিরায়ত সৌন্দর্য- কদমফুলের গুচ্ছ হাতে এক শিশুর মুখোমুখি। ১০/১১ বছর বয়সী শিশুটির পরনে পাজামা- পাঞ্জাবি ও মাথায় টুপি। কদম ফুলের সুমিষ্ট সুবাস, অনিন্দ্য শোভনীয়তা এবং শিশুটির নিষ্পাপ চেহারা, সরলতা নিমিষেই পবিত্র আবহ সৃষ্টি করেছিল এবং ফলে, তাকে তখন স্বর্গের দেবদূতের মতো মনে হয়েছিল। জিজ্ঞাসায় জানলাম, তার বাবা কৃষি মজুর ও মা অন্যের গৃহকর্মী। সে পার্শ্ববর্তী একটি হাফেজি মাদ্রাসার ছাত্র। বুঝলাম, টানাপোড়েনের সংসার।

বিজ্ঞাপন

ফুলের প্রতি ছেলেবেলা থেকেই আমার প্রবল দুর্বলতা। যদিও এটার প্রতি দুর্বলতা সকলেরই থাকে। তবে আমার দুর্বলতাটা অনেকটা হাই-ইমোশনাল। তাই তার কাছে অনুনয়ের সুরে একটি ফুল চাইলাম। সাথেসাথে সে পুরো গুচ্ছটাই আমাকে হাতবাড়িয়ে দিতে চাইল। অবলীলায় এভাবে দিতে চাওয়াটা আমাকে বেশ অবাক করেছিল। তার চোখে মুখে তখন পবিত্র সারল্যের অভূতপূর্ব দীপ্তিময় বিচ্ছুরণ। সৃষ্টির পরতে-পরতে যে প্রেমের অনন্ত ফল্গুধারা অবিরাম বইছে, যে প্রেমের মহিমা প্রকাশে ও সকাশে এই ধরাধামে কালে কালান্তরে অগণন ধর্মাবতার, সাধক, মনিষী, বিদ্বান, বিদুষী ইত্যাদি বিচিত্র পথপ্রদর্শকের দ্যুতিময় আবির্ভাব ঘটেছে সেই শাশ্বত প্রেমের স্বর্গীয় সারথি রুপে শিশুটির আগমন ঘটেছিল। শ্রদ্ধার আরতি হয়ে সে আমার অবসন্ন মন কে প্রসন্ন করে তুলেছিল। শিশুটির সরলতার সুযোগ না নিয়ে একটি ফুলই নিলাম। পরক্ষণেই এক অপ্রিয় ভাবনায় প্রসন্ন মন বিষন্ন হয়ে উঠলো। শিশুটির অনাগত জীবন আমাকে ব্যথিত করে তুললো; পৃথিবীর সকল শিশুর মতোই সেও স্বর্গদূত তুল্য। সে ধর্মের বিভেদ বোঝেনা। বোঝেনা মানুষে-মানুষে প্রভেদ, প্রবঞ্চনা। কিন্তু তার পবিত্র সারল্যে ক্রমশঃ ধর্মবিরুদ্ধ ধর্মান্ধতার বিষাক্ত বীজ বপন করা হবে। তাকে বোঝানো হবে যে, পৃথিবীতে অন্যসকল ধর্ম মিথ্যা এবং অমুসলিমদের কোনো ধর্ম নাই বা তারা বিধর্মী; অমুসলিমদের সাথে বন্ধুত্ব তো দূরের কথা, তাদের গ্লাসে পানি খাওয়াও হারাম;নারীরা সৃষ্টির আবর্জনা এবং এদেরকে দাসীর দৃষ্টিতে দেখবে; এরা শুধু সম্ভোগ ও সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র মাত্র;স্বদেশ প্রেম কুফরি বা নাস্তিক্যবাদ; তাই স্বদেশ প্রেমে বিশ্বাসী হওয়া যাবেনা; বাঙালি সংস্কৃতি হিন্দুয়ানি বলে পহেলা বৈশাখ, ভাষাদিবস প্রভৃতি জাতীয় দিবস পালন করা হারাম; গান-বাজনা এমনকি জাতীয় সঙ্গীতও হারাম; যে কোনো শিল্পকর্ম হারাম;সুন্দর কোনো সৃষ্টির বাসনা, ভজনা করাও কুফরি তাই হারাম; মা,বাবা,শিক্ষক ও গুরুজনদের প্রণাম করা যাবেনা কেননা এটাও কুফরি – ইত্যাদি বিচিত্র। এমনকি, মুসলিম ঘরে জন্ম নিয়েছে বলেই ছেলেটির সমগ্র জীবনে সংঘটিতব্য কুকর্মের সকল পাপ একদিন পুণ্যে পরিণত হবেই- মর্মে তাকে জীবনভোর পরোক্ষভাবে পাপাচারে উৎসাহিত করানো হবে। এভাবে তার কোমল মনস্তত্ত্বে এসকল কুশিক্ষা ও কুদীক্ষা প্রবিষ্ট করানো হবে যার কোনোটাই সুমহান ইসলাম সমর্থন করেনা; কেননা, সর্বজনীন সাম্যের অধিকার ও মর্যাদার স্বাধীকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যেই জগতে ইসলামের আগমন এবং এটাই ইসলামের চিরায়ত বিশেষত্ব।

এতে ধীরেধীরে সাধারণ মানুষ ও সমাজের প্রতি তার চরম নেতিবাচক ধারণা জন্মাবে। ফলে সে নিজেকে পারিপার্শ্বিকতা থেকে আইসোলেট করে ফেলবে। একসময় প্রকৃতিপ্রদত্ত সহজাত সামাজিক প্রবৃত্তি তার মধ্যে লোপ পাবে। জীবনবোধ হারিয়ে ফেলবে। এভাবে সৃষ্ট অবিশ্বাসের প্রভাবে আত্মবিশ্বাস লোপ পাবে। ফলে তার মধ্যে অনিয়ন্ত্রিত নিষ্ঠুরতা জন্ম নিবে। এভাবে নিজের অজান্তেই সে জঙ্গি মনোভাবাপন্ন হয়ে উঠতে পারে। ধর্মান্ধ ও সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী তার এই অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে তাদের কুরাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থে তাকে অপব্যবহার করবে। হয়তো একসময় সে তাদের ভয়ংকর অস্ত্রে পরিণত হবে। এভাবে তার রুপালী শৈশব ও সোনালী কৈশোর জীর্ণ জীবনের বিদগ্ধ যৌবনের গহীন আঁধারে হারিয়ে যাবে! সেদিন যে বৈষম্যহীন মানব প্রেমের মহানুভব স্ফুরণ তার মধ্যে দেখেছি, অন্তরের বিনয়াবনতা ও মানবিকতার যে হিরন্ময় আভা তার পবিত্র মুখাবয়বে প্রস্ফুটিত হতে দেখেছি, তা হয়তো একদিন ধর্মান্ধতার গহীন আঁধারে হারিয়ে গিয়ে অপমৃত্যু ঘটবে। বিপন্ন হবে লালিত জীবনের নকশিশোভা স্বপ্ন-সাধ। ধর্মবিকৃত ধর্মান্ধতা ও সাম্প্রদায়িকতার কোপানলে এভাবে বহু শিশুর স্বর্গীয় জীবন বিপন্ন হয়েছে এবং হচ্ছে যার অসংখ্য উদাহরণ এ সমাজে আছে। সেদিন যে শিশুটিকে আমি প্রভাতি রবির স্নিগ্ধ আলোয় শুচিশুভ্র হতে দেখেছি, দেখেছি- আষাঢ়ের পবিত্র প্রাতে: পাখির কলতানে হরিণী চঞ্চল হতে, দেখেছি কদম ফুলের মিষ্টি সৌরভে বিমোহিত হয়ে আনমনে-চনমনে তৃষিত জীবনের সোনালী স্বপ্ন বুনতে, দেখেছি স্বর্গের স্বপ্নীল সওগাত রুপে, কালের পরাক্রম বিবর্তে কোনো একদিন তাকে হয়তো আবার দেখবো রুদ্র, ক্ষুব্ধ, বিক্ষুব্ধ, রুঢ়, প্রেমহীন মূর্ত পাষাণ রুপে! এমনই এক বিভীষিকাময় সম্ভাবনায় আমার হৃদয় মন দুখের বরষে বিষন্নে গেল। বিবর্ণ কষ্টে ভারাক্রান্ত হলো ঝলমলে সুবর্ণ সকালের আকাশ বাতাস। হঠাৎ পূবালি দিগন্তে ঘনকালো মেঘের ঘনঘটা! অশ্রুসিক্ত মেঘের বিষন্ন বেদনে ঢেকে গেল সূর্য। থেমে গেল সব কলরব। অঝোরে মূর্ছা গেল রিক্ত নীলিমা। বুকের অবরুদ্ধ কষ্টগুলো দীর্ঘশ্বাসের কুন্ডলি হয়ে ফেরারি মেঘের মিছিলে মিশে গেল। বিমর্ষ পৃথিবীকে প্রশ্ন করলাম- এ দুখের শেষ কোথায়?

লেখক: কলামিস্ট

বিজ্ঞাপন

সারাবাংলা/এসবিডিই

Tags: ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন