বিজ্ঞাপন

অদক্ষতার খেসারত সেতু নির্মাণ প্রকল্পে

June 26, 2024 | 10:32 am

জোসনা জামান, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা: দক্ষতার অভাবে প্রকল্প বাস্তবায়নে দেখা দেয় জটিলতা। কেননা প্রকল্পের শুরুতেই প্রতিটি সেতু বা কালভার্টের সমীক্ষা সঠিকভাবে হয়নি। এ ছাড়া প্রকল্প তৈরি হয়নি চাহিদা অনুযায়ী। ফলে শুরুতেই বাধাগ্রস্ত হয়েছে প্রকল্পের বাস্তবায়ন। সেই সঙ্গে দক্ষতাসম্পন্ন জনবলের অভাব ও প্রাক্কলন পদ্ধতির জটিলতার কারণে প্রকল্পের মাঠপর্যায়ের কাজ দেরি হয়েছে। বাস্তবায়ন পর্যায়ে তদারকির ক্ষেত্রেও ছিল ঘাটতি। এমন অদক্ষতার খেসারতে প্রকল্পে বিরাজ করছে ধীরগতি।

বিজ্ঞাপন

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সেতু নির্মাণের ক্ষেত্রে উচ্চতা, প্রশস্ততা ও স্থান নির্বাচন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সড়কের মতো সেতুর আকার, উচ্চতা ও স্থান বারবার পরিবর্তন কর সম্ভব নয়। তাই সঠিকভাবে সমীক্ষা করে উপযুক্ত স্থান নির্ধারণের পর সেই স্থানে সেতু ব্রিজ নির্মাণের জন্য সঠিক নকশা প্রণয়নে সচেষ্ট হওয়া দরকার।

‘প্রোগ্রাম ফর সাপোর্টিং রুরাল ব্রিজেস, সেতু নির্মাণ, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল, পরিকল্পনা কমিশন, ডিপিপি, প্রকল্প প্রস্তাব’ শীর্ষক প্রকল্পে ঘটছে এমন ঘটনা। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) নিবিড় পরিবীক্ষণ প্রতিবেদনের প্রাথমিক খসড়ায় এসব তথ্য উঠে এসেছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতর। দেশের ৬১ জেলার ৪৬৬ উপজেলায় প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।

আইএমইডির সচিব আবুল কাশেম মো. মহিউদ্দিন সারাবাংলাকে বলেন, এসব খসড়া প্রতিবেদন চূড়ান্ত করার কাজ চলছে। শিগিরই চূড়ান্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করা হবে। খসড়ায় অনেক কিছুই থাকে প্রাথমিক তথ্য। তাই এসব নিয়ে কথা বলা যায় না।

বিজ্ঞাপন

আইএমইডির খসড়া প্রতিবেদন থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা গেছে, প্রকল্পটি ২০১৮ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর একনেকে অনুমোদিত হয়। মূল প্রকল্পটি চার হাজার ৯৭১ কোটি টাকা প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছিল। ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০২৩ সালের আগস্ট পর্যন্ত প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় নির্ধারণ করা হয়।

পরে বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিটি সেতু বা কালভার্টের জন্য সমীক্ষা করে সেতুর সুনির্দিষ্ট চাহিদা অনুযায়ী প্রকল্পের প্রাক্কলন তৈরি করতে হয়েছে। পাশাপাশি পরিবেশগত সমীক্ষাও করতে হয়েছে। এসব কিছু করতে গিয়ে প্রচুর সময় লেগে যায়। ফলে শুরুর দিকে কাজের অগ্রগতি ছিল অনেক কম। বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ওই প্রকল্পের কাজকে আরও ধীরগতির করে দেয়।

এ অবস্থায় গত বছরের ১০ অক্টোবর যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন নিয়ে পাঁচ দশমিক ৯৯ শতাংশ ব্যয় কমিয়ে চার হাজার ৬৭৩ কোটি ১৪ লাখ টাকা ও প্রকল্পের মেয়াদ ২০২৫ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত নির্ধারণ করা হয়। এতে প্রকল্পের মূল পর্যায়ের তুলনায় সময় বাড়ে ২৩ দশমিক ৩৩ শতাংশ, ব্যয় কমে ৫ দশমিক ৯৯ শতাংশ।

বিজ্ঞাপন

প্রকল্পের কর্মপরিকল্পনা নিয়ে পর্যবেক্ষণ

প্রকল্পটির শুরুতেই ২০১৮-১৯ অর্থবছরে কর্মপরিকল্পনা অনুযায়ী কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জন হয়নি। এর অন্যতম কারণ — এলজিইডি প্রকল্পের সাধারণত স্কিমের তালিকা সন্নিবেশিত থাকে। কিন্তু সাপোর্টিং ব্রিজ একটি কর্মসূচি। তাই ডিপিপির সংস্থান অনুযায়ী জরিপের মাধ্যমে ব্রিজ বা কালভার্টের হালনাগাদ তথ্য সংগ্রহ করে কম্পিউটার ডাটাবেজ সফটওয়্যার ইনপুট দিতে দেরি হয়েছে।

এ ছাড়া প্রকল্পটির শুরুর দিকে প্রতিটি ব্রিজ বা কালভার্টের সার্ভে করে স্ট্রাকচারাল কন্ডিশন চিহ্নিত করে নিড-বেজড ট্রিটমেন্ট অনুযায়ী প্রাক্কলন প্রস্তুত করা বেশ কঠিন ছিল। তাই শুরুর দিকে কাজের অগ্রগতি অনেকাংশেই কম হয়েছে। করোনাভাইরাসের প্রভাবে দেরি হওয়ার কথা আগেই বলা হয়েছে।

প্রকল্পের সার্বিক অগ্রগতি নিয়ে পর্যবেক্ষণ

প্রকল্পটির গত বছরের জুন পর্যন্ত আর্থিক অগ্রগতি এক হাজার ৩৬০ কোটি ৪৩ লাখ টাকা। ভৌত অগ্রগতি ৩০ দশমিক ১১ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের প্রকল্পের বরাদ্দ এক হাজার কোটি টাকা। অর্থছাড় হয়েছে ৭১০ কোটি ১২ লাখ টাকা, চলতি অর্থ বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৬০২ কোটি ৪৫ লাখ ৪৬ হাজার টাকা।

প্রকল্পটির ক্রমপুঞ্জিত অগ্রগতি চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এক হাজার ৯২৮ কোটি ৬১ লাখ ১১ হাজার টাকা এবং ভৌত অগ্রগতি ৫০ শতাংশ। প্রকল্পের সময় অতিবাহিত হওয়ার তুলনায় অগ্রগতি অনেকাংশেই পিছিয়ে আছে।

বিজ্ঞাপন

প্রকল্পের ক্রয় কার্যক্রম নিয়ে পর্যবেক্ষণ

ডিপিপি (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব) বা আরডিপিপি (সংশোধিত উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব) অনুযায়ী ৪৪টি পণ্য প্যাকেজ রয়েছে। বাস্তবে ২৮টি পণ্য প্যাকেজেরই দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। চুক্তি সই হয়েছে ২৮টি এবং ক্রয় প্রক্রিয়া শেষ হয়েছে ২৪টির, এবং চলমান রয়েছে চারটি প্যাকেজের কাজ। এ ছাড়া সিভিল ওয়ার্কের ৩৬৬টি প্যাকেজ রয়েছে, বাস্তবে এক হাজার ৫১৫টি প্যাকেজেরই দরপত্র আহবান করা হয়েছে, চুক্তি সই হয়েছে এক হাজার ৪০৯টি, কাজ শেষ হয়েছে ৬৭২টি এবং চলমান রয়েছে ৮৪৩টি প্যাকেজের কাজ।

সেবা প্যাকেজের আওতায় ৬৬টি প্যাকেজ রয়েছে। বাস্তবে ৬৬টি প্যাকেজেরই দরপত্র আহবান করা হয়েছে। চুক্তি সই হয়েছে ৬৬টি এবং শেষ হয়েছে ২২টি এবং চলমান রয়েছে ৪৪ প্যাকেজের কাজ।

প্রকল্পের অধীনে এ পর্যন্ত মোট দুই হাজার ৩৭৪টি ব্রিজ বা ৭১ হাজার ৬১১ মিটার ব্রিজের কাজ শেষ হয়েছে এবং এক হাজার ৪২৪টি ব্রিজ বা ৪৯ হাজার ৩৫৯ মিটার ব্রিজের কাজ চলমান।

প্রকল্পের অডিট নিয়ে পর্যবেক্ষণ

প্রকল্পের শুরু থেকেই এ পর্যন্ত ২০১৮-১৯ থেকে ২০২১-২২ পর্যন্ত চারটি অর্থবছরে অডিট শেষ হয়েছে। প্রকল্পের চার অর্থবছরে মোট ৫২টি আপত্তি উত্থাপিত হয়েছে। তারমধ্যে ২৪ আপত্তি শেষ হয়েছে এবং ২৮টি আপত্তি শেষের জন্য ত্রিপাক্ষিক সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী জবাব পাঠানো হয়েছে।

সুপারিশ

প্রতিবেদনের খসড়ায় দেওয়া আইএমইডির সুপারিশগুলো হচ্ছে, অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় সেতুর সামনে সংযোগ সড়কটি ৯০ ডিগ্রি কোণে বেঁকে গেছে, যার ফলে যানবাহন চলাচল বিঘ্নসহ দুর্ঘটনার প্রবণতা বাড়তে পারে। ভবিষ্যতে সেতু নির্মাণে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বা বিভাগ থেকে বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখার জন্য অনুরোধ করা হয়েছে।

সেতু নির্মাণের ক্ষেত্রে উচ্চতা, প্রশস্ততা ও স্থান বিবেচনায় নিয়ে নকশা প্রণয়ন করতে হবে। এ ধরনের প্রযুক্তিনির্ভর কর্মসূচি নেওয়ার আগে এলজিইডিকে পর্যাপ্ত প্রস্তুতি, সম্ভাব্যতা যাচাই গুরুত্বের সঙ্গে করা প্রয়োজন। বিশেষ করে সেতু বা কালভার্টের সার্ভে করে স্ট্রাকচারাল কন্ডিশন চিহ্নিত করে নিড-বেজড ট্রিটমেন্ট অনুযায়ী এবং সেই সঙ্গে এনভায়রনমেন্টাল অ্যাসেসমেন্ট করে এনভায়রনমেন্টাল মিটিগেশন প্ল্যানসহ সংশ্লিষ্ট প্রকল্পের প্রাক্কলন প্রস্তুত করতে হবে।

প্রকল্পের মেয়াদ যেন আর বাড়াতে না হয়, সে জন্য প্রকল্পের অবশিষ্ট কাজ সময়মতো শেষ করার জন্য স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতর থেকে যথাযথভাবে টাইম বাউন্ড কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করে সার্বক্ষণিক মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার করে প্রকল্পের অবশিষ্ট কাজ শেষ করতে হবে।

সুপারিশে আরও বলা হয়েছে, প্রকল্পের এ পর্যন্ত চারটি অর্থবছরে অডিট শেষ হয়েছে, যার মধ্যে ৫২টি আপত্তি উত্থাপিত হয়েছে এবং এখনও ২৮টি আপত্তি অমিমাংসিত রয়েছে। তাই অতি দ্রুত আপত্তিগুলো শেষের ব্যাপারে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। পরের বছরগুলোতে যথা সময়ে অডিট শেষের জন্য অডিট বিভাগকে পত্রের মাধ্যমে অনুরোধ করা যেতে পারে।

সারাবাংলা/জেজে/টিআর

Tags: , , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন