বিজ্ঞাপন

হারুনকাণ্ডের ৯ মাস পার, প্রতিবেদন দেয়নি পুলিশ-প্রশাসন কেউই

June 26, 2024 | 10:23 pm

উজ্জল জিসান, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা: চাকরি বিধিমালা অনুযায়ী অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটলে তদন্ত কমিটি গঠিত হয় এবং তদন্ত শেষে প্রতিবেদন জমা হয়। সেই প্রতিবেদন অনুযায়ী পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হয়ে থাকে। কিন্তু পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি) হারুন অর রশিদ ও সানজিদা আফরিনের সঙ্গে রাষ্ট্রপতির এপিএস আজিজুল ইসলাম মামুনের অপ্রীতিকর ঘটনার তদন্ত প্রতিবেদন এক বছরেও জমা হয়নি।

বিজ্ঞাপন

২০২৩ সালের ৯ সেপ্টেম্বর রাতে বারডেম হাসপাতাল থেকে তুলে নিয়ে শাহবাগ থানায় আটকে ছাত্রলীগের দুই কেন্দ্রীয় নেতা এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক নেতাকে ব্যাপক মারধর করা হয়। মারধরের শিকার ছাত্রলীগ নেতাদের অভিযোগ, পুলিশের রমনা বিভাগের তৎকালীন এডিসি হারুন অর রশিদ এই মারধরে নেতৃত্ব দেন। পরে তাকে সাময়িক বরখাস্ত করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

এ ঘটনায় শাহবাগ থানার পরিদর্শক (অপারেশন) গোলাম মোস্তফাকেও দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। গঠিত হয় একাধিক তদন্ত কমিটি। ডিএমপির পক্ষ থেকে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়। কমিটিতে ডিসি হেডকোয়ার্টার্স ক্রাইম, একজন এডিসি ও নিউ মার্কেট জোনের সহকারী কমিশনারকে (এসি) রাখা হয়। এমনকি তিন বার সময় চেয়েও প্রতিবেদন দিতে পারেনি কমিটি।

পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, ডিএমপির পক্ষ থেকে যে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল, সেই কমিটি বার বার সময় চেয়েছে এজন্য যে, প্রশাসন ক্যাডারের পক্ষ থেকে আরও একটি তদন্ত কমিটি করা হয়েছিল। সেই কমিটির প্রতিবেদন দেওয়ার অপেক্ষা করছিল। যেহেতু প্রশাসন ক্যাডারের পক্ষের কমিটি তদন্ত প্রতিবেদন জমা হয়নি, তাই ডিএমপি গঠিত তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়নি। ফলে বিষয়টি ওই অবস্থায় রয়ে গেছে। এতদিনেও কোনো প্রতিবেদন জমা হয়নি, এমনকি কোনো ব্যবস্থাও নেওয়া হয়নি।

বিজ্ঞাপন

এতে যার যে অবস্থান ছিল তা বহাল থাকলেও মাঝখান থেকে ছাত্রলীগ নেতারা মারধরের শিকারের পরও কোনো বিচার পাচ্ছেন না। এমনকি পুলিশের ক্ষমতা দেখিয়ে পিটিয়ে দাঁত ভেঙে ফেলারও কোনো বিচার হলো না বলে জানায় সূত্র। পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, ‘বর্তমান কমিশনারের সময়ে যেহেতু বিষয়টি ঘটেনি। তাই তিনি এ নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছেন না। পূর্ববর্তী কমিশনাররাও প্রতিবেদন আদায় করতে পারেননি। সেটি তাদের বিষয় বা ব্যর্থতা।’

তদন্ত কমিটি যখন প্রথম ও দ্বিতীয় বার সময়ের আবেদন করে তখন কমিটির একজন অন্যতম সদস্য বলেছিলেন, ‘ক্ষমতার অপব্যবহার করে ছাত্রলীগের তিন নেতাকে মারধরের ঘটনায় ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) রমনা বিভাগের বরখাস্ত হওয়া অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) হারুন অর রশিদের জড়িত থাকার প্রাথমিক সত্যতা মিলেছে। অথচ এখনো আলোর মুখ দেখেনি তদন্ত প্রতিবেদন।’

পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, এডিসি হারুন কাণ্ডের পর সাময়িক বরখাস্ত করে হারুন অর রশিদকে রংপুর রেঞ্জে সংযুক্ত করা হয়। একই দিন আরেক আদেশে এডিসি সানজিদা খানমকেও রংপুর রেঞ্জে বদলি করা হলেও অদৃশ্য ক্ষমতাবলে সানজিদা ডিএমপি হেড কোয়ার্টার্সে আগের পোস্টেই বহাল রয়েছেন। কিন্তু হারুন ঠিকই রংপুর রেঞ্জে সংযুক্ত হয়েছেন।

বিজ্ঞাপন

আরও পড়ুন:

সম্প্রতি পরীমণি-সাকলায়েন কাণ্ড, সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ, সাবেক ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া, এডিশনাল ডিআইজি জামিল হাসানসহ পুলিশ কর্মকর্তাদের দুর্নীতির খবর গণমাধ্যমে প্রকাশ এবং পুলিশ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের বিবৃতির পর পুলিশের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। সেখানে এডিসি হারুন ও সানজিদার তদন্তের বিষয়টিও উঠে আসছে। পুলিশ কর্মকর্তারা প্রশ্ন তুলে বলছেন, এডিসি হারুনের বিষয়ে কেন তদন্ত প্রতিবেদন জমা হচ্ছে না।

তদন্ত কমিটিসংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, কমিটির কাছে এডিসি হারুন, সানজিদা আফরিন, তার স্বামী রাষ্ট্রপতির সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস) আজিজুল হক লিখিত বক্তব্য দিয়েছেন। জড়িত ছাত্রলীগের নেতাদের বক্তব্যও নিয়েছে তদন্ত কমিটি। তাদের বক্তব্যে সেদিন কী ঘটেছিল, তা জানা গেছে। এ ঘটনায় সব পক্ষের দায় পেয়েছে বলে জানান তদন্তসংশ্লিষ্টরা।

বিজ্ঞাপন

ঘটনা সূত্রে জানা যায়, গত বছরের ৯ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় এডিসি সানজিদা আফরিন রাজধানীর বারডেম হাসপাতালে ডাক্তার দেখাতে যান। সেখানে ডাক্তার এক ঘণ্টা দেরিতে আসবেন বলে একটি কক্ষে হাসপাতালের পোশাক পরে অপেক্ষা করছিলেন। সানজিদা ডাক্তার দেখাতে গেলেও স্বামী আজিজুল হক মামুন জানতেন না। এটি জানার পর সেখানে উপস্থিত হন মামুন। গিয়ে দেখেন ওই কক্ষে সানজিদার সঙ্গে আছেন এডিসি হারুন। এটি দেখার পর তিনি ক্ষেপে যান। এ সময় তার সঙ্গে ছাত্রলীগের তিন নেতাও ছিলেন। এক পর্যায়ে তাদের মধ্যে ধস্তাধস্তি হয়। এরপর সেখানে শাহবাগ থানার পুলিশ আসে। তখন এডিসি হারুন তিন ছাত্রলীগ নেতাসহ মামুনকে শাহবাগ থানায় নিয়ে যান। থানায় রাতভর তিন ছাত্রলীগ নেতাকে মারধর করলে এক নেতার দুটি দাঁত ভেঙে যায়।

এ ঘটনায় ডিএমপি কমিশনার একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেন। দু’দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেন তৎকালীন কমিশনার গোলাম ফারুক। কিন্তু নির্ধারিত সময়ের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে ব্যর্থ হয়ে পাঁচ দিনের সময় চেয়ে আবেদন করে তদন্ত কমিটি। পরে কমিশনার তাদের আবেদন মঞ্জুর করেন। এর পর তৃতীয়বারও সময় চেয়ে আবেদন করেন। কিন্তু এরপর আর আবেদনও করা হয়নি প্রতিবেদনও জমা হয়নি।

এ বিষয়ে বর্তমান ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমানের কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি বিব্রত বোধ করেন। একই বিষয়ে প্রশাসন ক্যাডারের পক্ষ থেকে কমিটির প্রধানকে ফোন করে কোনো উত্তর মেলেনি।

নিয়ম অনুযায়ী ডিএমপির তদন্ত প্রতিবেদন কমিশনার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়ার কথা ছিল। আবার প্রশাসন ক্যাডারের কমিটির প্রতিবেদনও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়ার কথা ছিল। অন্যদিকে, পুলিশ সদর দফতরের পক্ষ থেকে যে কমিটি হয়েছিল সেই প্রতিবেদনও আইজিপির মাধ্যমে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে জমা হওয়ার কথা ছিল।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এ সংক্রান্ত কোনো প্রতিবেদনই জমা হয়নি। কোনো পক্ষই প্রতিবেদন জমা দেয়নি। ফলে একটি আলোচিত ঘটনার পেছনে আসলে কী ঘটেছিল তা অন্ধকারেই রয়েছে জানান মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা শরীফ মাহমুদ অপু সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমার জানা মতে কোনো কমিটি এখনো প্রতিবেদন জমা দেয়নি। এমনকি মন্ত্রণালয়ের কমিটিও প্রতিবেদন জমা দেয়নি। তবে খুব শিগগিরই প্রতিবেদন দেবেন বলে শুনেছি।’

অন্যদিকে, ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে যে কমিটি গঠন করা হয়েছিল, সেটিও আলোর মুখ দেখেনি। ওই কমিটিও কোনো প্রতিবেদন জমা দিতে পারেনি। এ বিষয়ে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি সাদ্দাম হোসাইনকে ফোন করলে তিনি রিসিভ করেননি।

এসব বিষয়ে জানতে সাবেক এডিসি হারুনকে ফোন করে পাওয়া যায়নি। এমনকি সানজিদা আফরিনও কল রিসিভ করেননি। জানতে চেয়ে আজিজুল হক মামুনকে কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি।

সারাবাংলা/ইউজে/পিটিএম

Tags: , , , , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন