বিজ্ঞাপন

নারীর প্রতি বৈষম্য বিলোপে গণতন্ত্র-আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার তাগিদ

June 26, 2024 | 11:49 pm

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা: নারীর প্রতি বৈষম্য দূর করতে সমাজে যে গণতন্ত্র ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা প্রয়োজন, তার জন্যই সুফিয়া কামাল আজীবন লড়াই করেছেন বলে মন্তব্য করেছেন বক্তারা।

বিজ্ঞাপন

তারা বলছেন, গৎবাঁধা লিঙ্গীয় নির্মাণের বিপরীতে পথ চলে সুফিয়া কামাল উদাহরণ তৈরি করেছেন। পশ্চিমে যে নারী আন্দোলন নব্বইয়ের দশকে গতি পেয়েছে, তা আরও কয়েক দশক আগেই সুফিয়া কামাল সামনে নিয়ে এসেছেন। কিন্তু কবি হিসেবে তিনি যতটা আলোচিত, নারী আন্দোলনে তার অবদান সেভাবে সামনে আসেনি। এখন সময় এসেছে সামাজিক লিঙ্গীয় নির্মাণ ও ব্যাখার বাইরে গিয়ে ভিন্ন আলোকে সুফিয়া কামালকে দেখা ও তাকে দেশ-বিদেশে পরিচয় করিয়ে দেওয়া।

বুধবার (২৬ জুন) বিকেলে সেগুনবাগিচায় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি জননী সাহসিকা কবি সুফিয়া কামালের ১১৩তম জন্মবার্ষিকীতে আয়োজিত অনুষ্ঠানে এসব কথা উঠে এসেছে। সুফিয়া কামাল স্মারকবক্তৃতা, সুফিয়া কামাল সম্মাননা প্রদান ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানটিতে সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ডা. ফওজিয়া মোসলেম।

মহিলা পরিষদের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সীমা মোসলেমের সঞ্চালনায় স্বাগত বক্তব্য রাখেন সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু। ‘নারীর প্রতি প্রচলিত গৎবাঁধা দৃষ্টিভঙ্গি: সুফিয়া কামালের আন্দোলন’ বিষয়ে স্মারকবক্তৃতা দেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ও বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ড. আইনুন নাহার।

বিজ্ঞাপন

সভাপতির বক্তব্যে ডা. ফওজিয়া মোসলেম বলেন, সুফিয়া কামাল আজীবন নারী-পুরুষের সমতা, সাম্য ও সমাজের শান্তির জন্য লড়াই করেছেন। গৎবাঁধা লিঙ্গীয় নির্মাণ কীভাবে হয়, সমাজজীবন কে পরিচালিত করে, কর্মকাণ্ডকে প্রভাবিত করতে কে নিয়ন্ত্রণ করে, সমাজভেদে এ সব বিষয়ে পার্থক্য থাকলেও মোটাদাগে সমাজে নারীকে অধঃস্তন হিসেবেই ভাবা হয়। এ সব কুপ্রথার মধ্য থেকে তিনি নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় প্রথা ভেঙে এগিয়েছেন, প্রতিবাদ করেছেন এবং পথ নির্মাণ করেছেন।

তিনি বলেন, প্রথা ভেঙে ভেঙে সুফিয়া কামাল পথ তৈরি করে দিয়েছেন। নারী আন্দোলন সামাজিক আন্দোলনের অংশ, এটি কেবল নারীর জন্য নয়; দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে আন্দোলন, গণতান্ত্রিক আন্দোলন এবং আইন প্রতিষ্ঠা ও সুশাসনের আন্দোলন নারী আন্দোলনের সঙ্গে একই সূত্রে গাথা। তার দেখানো পথেই আজও আমরা নারীর অধিকারের জন্য আন্দোলন করছি, যার সুফল পাচ্ছে পুরো সমাজ।

অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখছেন মহিলা পরিষদের সভাপতি ডা. ফওজিয়া মোসলেম। ছবি: সারাবাংলা

মহিলা পরিষদের সভাপতি আরও বলেন, বর্তমানে বৈশ্বিক নারীবাদকে আদর্শ ধরা হলেও সুফিয়া কামাল তারও বহু আগে থেকেই নারীর জন্য সমানাধিকারের জন্য লড়াই করেছেন। স্বয়ং আমেরিকাতেও হিলারি ক্লিন্টন প্রেসিডেন্ট হতে পারেননি নারী হওয়ার কারণে। অন্যদিকে আমাদের দেশে নারী রাষ্ট্রক্ষমতায় থেকেও স্বীকৃতি পাচ্ছে না। আজকের নারী আন্দোলনের লক্ষ্য পুরুষ আধিপত্যবাদের চিন্তাভাবনা দূর করা।

বিজ্ঞাপন

স্বাগত বক্তব্যে সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু বলেন, সুফিয়া কামাল আমাদের জন্য প্রাতঃসম্মরণীয়। তার যে বিশাল কর্মময় জীবন, তার অংশবিশেষ নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার লক্ষ্যে প্রতিবছর তাকে স্মরণ করে স্মারকবক্তৃতা ও সম্মাননা প্রদান অনুষ্ঠানের আয়োজন করে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ। তিনি ছিলেন এক অতুলনীয় মানবিক গুণাবলির অধিকারী, যার ভেতরে থাকা আত্মশক্তিকে কোনো শাসকগোষ্ঠী কখনোই উপেক্ষা করতে পারেননি।

তিনি আরও বলেন, পিতৃতান্ত্রিক এ সমাজে যেখানে নারী লেখক বা কবি হিসেবে উপেক্ষিত, সেখানে এমন এক সমাজে সুফিয়া কামাল কবি হিসেবে, লেখক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন, স্বীকৃতি আদায় করেছেন এবং নারীর মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন।

স্মারকবক্তৃতায় ড. আইনুন নাহার বলেন, গৎবাঁধা লিঙ্গীয় নির্মাণ স্থান ও কাল নির্বিশেষে সব সমাজেই শক্তিশালীভাবে দেখা যায়, যদিও সংস্কৃতিভেদে এর ভিন্নতা রয়েছে। যখন গৎবাঁধা লিঙ্গীয় নির্মাণের ভিত্তিতে নারীর প্রতি বৈষম্য নিয়ে কথা বলা হয় কিংবা নারীর অধিকার নিয়ে কথা হয়, তখন সুস্পষ্টভাবে মনে রাখা প্রয়োজন যে সব নারীর জীবন ও অভিজ্ঞতা একই নয়। এই গৎবাঁধা ভাবনাগুলো বিভিন্ন সময়ে চ্যালেঞ্জড হয়, পরিবর্তিতও হয়।

অনুষ্ঠানে সুফিয়া কামাল স্মারকবক্তৃতা ছাড়াও দুজনকে সম্মাননায় ভূষিত করা হয়। ছবি: সারাবাংলা

তিনি বলেন, সুফিয়া কামাল শৈশব থেকেই জীবনব্যাপী নারীকে যে গৎবাঁধা ছকে ফেলে দেখা হয়, তার সীমানা ভেঙেছেন। তিনি প্রশ্ন করেছেন সামাজিক রীতিনীতিকে, সহনশীল ও অটল মনোভাব থেকেই বাস্তবতার নিরিখে নারীর অধিকার ও সামাজিক ন্যায় বিচারের জন্য লড়াই করেছেন। তিনি খুব অল্প বয়স থেকেই ঘর-সংসার সামলে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ধরনের রাজনৈতিক-সামাজিক আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে জড়িত থেকে পুরুষের আধিপত্যশীল পারিবারিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক পরিসরে গৎবাঁধা লিঙ্গীয় মতাদর্শ ও চর্চাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন।

বিজ্ঞাপন

আইনুন নাহার আরও বলেন, লিঙ্গীয় অসমতার বিরুদ্ধে সুফিয়া কামালের নানামুখী নিরলস কার্যক্রম বাংলাদেশের নারীসমাজকে নিরন্তর লড়াই করতে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। সর্বোপরি সুফিয়া কামালকে নিয়ে অনেক লেখালেখি আছে ঠিকই, কিন্তু সেগুলো মোটাদাগে সীমিত বা খণ্ডিত পরিসরেই রয়ে গেছে। তার বহুমাত্রিক সত্তা ও সম্পৃক্ততা, তার লেখনী, নারী আন্দোলনের পাশাপাশি অন্তর্ভুক্তিমূলক ও ন্যায়সঙ্গত সমাজ প্রতিষ্ঠার লড়াই নিয়ে আরও গভীর অনুসন্ধান ও গবেষণা করা আজ সময়ের দাবি।

অনুষ্ঠানে সুফিয়া কামাল সম্মাননায় ভূষিত করা হয় প্রকৌশলী শেখ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ ও প্রয়াত স্থপতি কবি রবিউল হুসাইনকে। সম্মাননা গ্রহণ করেন প্রকৌশলী শেখ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহের কন্যা সাইকা মাহমুদ এবং প্রয়াত স্থপতি কবি রবিউল হুসাইনের পুত্র জিসান হুসাইন। সম্মাননাপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের পরিচিতি পাঠ করেন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের প্রকাশনা সম্পাদক সারাবান তহুরা এবং প্রশিক্ষণ গবেষণা ও পাঠাগার সম্পাদক রীনা আহমেদ।

এর আগে অনুষ্ঠানের শুরুতে কবি সুফিয়া কামালের প্রতিকৃতিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের নেতারা। এরপর কবি সুফিয়া কামালকে নিয়ে তৈরি করা প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শন করা হয়। সংগীত পরিবেশন করেন ইফ্ফাত আরা দেওয়ান ও খায়রুল আনাম শাকিল। আবৃত্তি করেন বাংলা শুদ্ধ উচ্চারণ গবেষক ও আবৃত্তিকার গোলাম সারোয়ার।

সারাবাংলা/আরএফ/টিআর

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন