বিজ্ঞাপন

‘গেদুচাচা’: বিশ্বসাংবাদিকতায় অক্ষয় চরিত্র এক

June 28, 2024 | 5:16 pm

রফিকুল ইসলাম

‘আপনি অত্যন্ত পণ্ডিত ব্যক্তি। আপনার জ্ঞান-গরিমা এবং মূল্যবান পরামর্শের প্রতি আমার যথাযথ সম্মানবোধ রয়েছে। আমার উদ্দেশ্যে লেখা আপনার খোলাচিঠি আমি যথেষ্ট গুরুত্বসহকারে পাঠ করেছি। বোঝার চেষ্টা করেছি এবং উপদেশাবলি গ্রহণেরও চেষ্টা করেছি।’

বিজ্ঞাপন

এই উদ্ধৃতিটি আশির দশকের দাপুটে সামরিক স্বৈরশাসক রাষ্ট্রপতি জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের লেখা একটি রাজপত্রের অংশবিশেষ।

এটি লেখা হয়েছিল ‘গেদুচাচার খোলাচিঠি’র কালজয়ী কলাম লেখক আজকের সূর্যোদয় পত্রিকার প্রধান সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা খোন্দকার মোজাম্মেল হকের বরাবরে; যিনি বিশ্বজোড়া ‘গেদুচাচা’ নামে প্রসিদ্ধ ছিলেন।

আজ ২৯ জুন, ‘গেদুচাচা’ খ্যাত খোন্দকার মোজাম্মেল হকের চতুর্থ মৃত্যুবার্ষিকী। ২০২০ সালের এদিন ৭০ বছর বয়সে বৈশ্বিক মহামারি করোনায় মারা যান তিনি।

বিজ্ঞাপন

খোন্দকার মোজাম্মেল হক সাংবাদিক ও সম্পাদক হিসেবে কখনও কর্তাভজা ছিলেন না। কোনো শাসক বা সরকারের পোঁ ধরেননি কিংবা মোসাহেবি করেননি; না করতেন কারও তাঁবেদারি। ছিলেন রাষ্ট্র, সরকার সর্বোপরি গণমানুষের পথপ্রদর্শক।

প্রচারবিমুখ নিভৃতচারী মিলিট্যান্ট এই প্রখ্যাত সম্পাদক খোন্দকার মোজাম্মেল হক ফেনী জেলার ছাগলনাইয়া উপজেলার গতিয়া পূর্ব সোনাপুর গ্রামে সম্ভ্রান্ত এক মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা এটিএম খোন্দকার ওবায়দুল হক এবং মাতা সৈয়দা আজিজুন নেছা খানম। তাঁর শিক্ষাবিদ পিতার পূর্বপুরুষ ছিলেন বাগদাদের অধিবাসী।

খোন্দকার মোজাম্মেল হক ছিলেন জ্ঞানগরিমায় বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী। তিনি একাধারে কীর্তিমান সাংবাদিক, কলামিস্ট, লেখক ও কবি এবং উনসত্তরের কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের তুখোড় ছাত্রনেতা ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক ছিলেন।

বিজ্ঞাপন

তাছাড়া অটুট স্বদেশপ্রেমে উজ্জীবিত মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম এই সংগঠক অসীম সাহসে নিজ জেলা ফেনীতে প্রথম উড়িয়ে ছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা। এজন্য নিজেকে অধিক গৌরবান্বিত ও সুখ বোধ করতেন তিনি।

তথাপি এ সকল পরিচয় ছাপিয়ে একসময় খোন্দকার মোজাম্মেল হক হয়ে উঠেছিলেন আমজনতার ‘গেদুচাচা’।

জনগণের পক্ষে কথা বলতে গিয়ে দুঃসাহসিকভাবে সামরিক স্বৈরশাসক জেনারেল এরশাদের অনৈতিক তথা জনস্বার্থবিরোধী পদক্ষেপ এবং ভুলত্রুটি সূক্ষ্মভাবে তীক্ষ্ণ লেখনীতে তুলে ধরতেন তাঁর পত্রিকার পাতায়। সেসাথে গঠনমূলক নির্মম ও দৃঢ় সমালোচনা করায় অল্পসময়ের মধ্যেই অধিক জনপ্রিয় হয়ে উঠেন ‘গেদুচাচা’।

এ ব্যাপারে গেদুচাচা তাঁর বিখ্যাত কলাম ‘গেদুচাচার খোলাচিঠি’তে সূচনালগ্নে কতই না মজা করে পরিচয়ে লেখেন –

বিজ্ঞাপন

“মাননীয় প্রেসিডেন্ট এরশাদ চাচা,

আমার সালাম গ্রহণ করিবেন। আমাকে আপনার না চিনারই কথা। আমি বাংলাদেশের ৬৮ হাজার গ্রামের ১০ কোটি মানুষের একজন। থাকি অজপাড়া গাঁয়ে। সকলে আমারে গেদুচাচা বলিয়া ডাকে। পুতেও ডাকে চাচা, বাপেও ডাকে চাচা। মানে আমি সকলের চাচা। সেই মতে ভোটের লিস্টির মধ্যেও আমার নাম হইয়া গিয়াছে ‘গেদুচাচা’।”

ধীমান পাঠক ছাড়া অন্যরা জানতেনই না গেদুচাচা লোকটা আসলে কে! গ্রন্থনায় থাকতেন খ ম হ। মহৎপ্রাণ এই যুগন্ধরই খোন্দকার মোজাম্মেল হক।

আপসহীন সংগ্রামী এই প্রবাদপ্রতিম গভীর মেধার অধিকারী ও অগাধ পাণ্ডিত্যসম্পন্ন ব্যক্তিটি ছিলেন বাংলাদেশের সাংবাদিকতার জগতে এক উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক। দুর্জয় সাহস, অমিত তেজ, সরল যুক্তি, নিপুণ প্রকাশভঙ্গি, লেখনীর সরস ধরন এবং স্বদেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ গণতান্ত্রিক সহিষ্ণুতা সবই আয়ত্ত করেছিলেন তিনি।

খোন্দকার মোজাম্মেল হক আশির দশকে দুর্দান্ত প্রতাপশালী সামরিক শাসক রাষ্ট্রপতি জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের স্বৈরশাসনামলে সাপ্তাহিক সুগন্ধা সম্পাদনাকালীন ‘গেদুচাচা খোলাচিঠি’ নামে ব্যতিক্রমধর্মী এই কলামটি প্রবর্তন করেছিলেন। যেটির যাত্রা শুরু হয়েছিল ১৯৮৮ সালের ১ জুন।

যাত্রালগ্নেই ‘গেদুচাচা’ ছদ্মনামের আড়ালে খোন্দকার মোজাম্মেল হক কঠিন অথচ প্রীতিপ্রদ প্রয়োগকৌশলে সামরিক স্বৈরশাসক আর শোষকশ্রেণির মনে হৃদকম্পন জাগাতেন যেমন, তেমনি ৫৬ হাজার বর্গমাইল ভূখণ্ডের অধিবাসীদের জাতীয়তাবোধের স্ফুরণ ঘটিয়ে বৈষম্যহীন ও দুর্নীতিমুক্ত সোনার বাংলা গড়ার প্রত্যয়ী করে তুলতেন পাঠকদের।

তা তো ছিলই! তদুপরি সামরিক জান্তা স্বৈরাচারী শাসক জেনারেল এরশাদের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে বিক্রমী সাংবাদিকতায় দৃষ্টান্ত গড়ে যে লাইম লাইটে ওঠে আসেন তিনি, তা এ যুগে সত্যিই বিরল।

বন্ধুর বা প্রতিকূল পরিবেশেও অক্লান্ত সারথির মতো লিখে প্রথিতযশা কলমযোদ্ধা খোন্দকার মোজাম্মেল হক হয়ে উঠেছিলেন এ এযাবৎকালের সবচেয়ে পাঠকপ্রিয় কলাম লেখক। তিনি মুক্তিযুদ্ধ ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার নির্লোভ আর নির্ভীক সাংবাদিকতার কিংবদন্তি পথিকৃৎ।

এছাড়া সাংবাদিকতার ইতিহাসে নবধারা সূচনা করে সত্যনিষ্ঠতা, সততা, স্বচ্ছতা ও পাঠকের কাছে জবাবদিহিতাসহ জনসম্পৃক্তার স্পৃহায় বিধিবিধান বা নিয়মকানুনের মধ্য দিয়ে নিজেকে কালক্রমে পরিণত করেছিলেন একটি আদর্শ প্রতিষ্ঠানরূপে।

খোন্দকার মোজাম্মেল হক শুধু সেলিব্রিট সাংবাদিকই ছিলেন না, সেলিব্রিটদের সেলিব্রিটি ছিলেন। অনেক খ্যাতিমান সাংবাদিক, সম্পাদক ও সাংবাদিক নেতাদের গুরু তিনি।

তথ্যনির্ভর ক্ষুরধারে রসাত্মক উপস্থাপনায় ‘গেদুচাচার খোলাচিঠি’ কলামে থাকত হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার সুরের সম্মোহনী শক্তি। যাতে পাঠক পড়তে পড়তে একাত্ম হয়ে যেতেন তাঁর কলামের সঙ্গে।

গেদুচাচার ছিল দৃষ্টির বৈভব আর ভাষার জাদু। কলামের বৈশিষ্ট্য ও আকর্ষণ ছিল প্রজাহিতসাধন তথা বঞ্চিত মানুষের অধিকার প্রশ্নে উচ্চকণ্ঠ। এক্ষেত্রে তথ্যের ব্যাপৃতি ছিল নিম্নবর্গ হতে উচ্চবর্গ, মেঠোপথ হতে রাজপথ, অজপাড়া হতে মন্ত্রীপাড়া, কুঁড়েঘর হতে গণভবন ও বঙ্গভবন পর্যন্ত।

সেক্ষেত্রে সংখ্যাগুরু আঞ্চলিক ভাষাকে শৈল্পিক রুপ দিয়ে নবতর ঢঙ্গে চিত্তাকর্ষক করে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করার মতো ভাষাশৈলীর মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলতেন তথ্যের বিশ্লেষণ। লেখায় বৈপরীত্য বিষয়বস্তুতে অন্তর্দৃষ্টি ফেলে অগণিত পাঠকের হৃদয়শীর্ষে ঠাঁই করে নিয়েছিলেন ‘গেদুচাচা’।

গেদুচাচার কলামে থাকত গণমানুষের অভাব-অভিযোগ, দাবি-দাওয়া, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারিদের দুষ্কর্মসহ সমাজ ও রাষ্ট্রের যতসব অনিয়ম-অসঙ্গির বিরুদ্ধে অনিরুদ্ধ এক গতি। দিব্য চোখে স্বচ্ছ সেই দৃষ্টি দিয়ে দেখেছেন রাজনীতি, অর্থনীতি, সামাজিক বৈষম্যসহ খুঁটিনাটি সামগ্রিক বিষয়। নিরলস লিখে গেছেন সত্যের পথে জনমত সংগঠনের লক্ষ্যে।

এজন্য গেদুচাচা লেখনিতে কখনই পাঠকের হাতের তালুতে বসতে চাননি, বসতে সক্ষম হয়েছিলেন আস্থার জায়গাটিতে। ফলে ক্রমেই হয়ে উঠেছিলেন ৬৮ হাজার গ্রামের অভিভাবক ও মুখপাত্র হিসেবে।

জাতির এক ক্রান্তিলগ্নে কঠিন খারাপ সময়ে গেদুচাচার আবির্ভাব ঘটেছিল গাঁয়ের মেঠোপথ ও শহুরে উত্তপ্ত রাজপথ থেকে, ঠিক ধূমকেতুর ন্যায়। যখন দেশ চলছিল রাষ্ট্রপতি জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের পাকিস্তানের ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খাঁনের মৌলিক গণতন্ত্রের মুখোশে নির্ভেজাল ডিক্টেটরি স্টাইলে। তখন জাতির বিবেক হিসেবে সাংবাদিকতাও ছিল গণতন্ত্রের জন্য অপরিহার্য অথচ সংগ্রামেরই অংশ।

সেই সময় বিশেষ করে বিবিসির সাংবাদিক আতাউস সামাদ, ভয়েস অব আমেরিকার সাংবাদিক গিয়াস কামাল চৌধুরী, সাপ্তাহিক যায়যায়দিন সম্পাদক শফিক রেহমান, সাপ্তাহিক বিচিন্তার সম্পাদক মিনার মাহমুদ ও প্রথিতযশা সাংবাদিক মতিউর রহমান চৌধুরীরা যখন নানানভাবে ভীষণ হয়রানির শিকার শুধু নয়, অনেকের পত্রিকা বন্ধ করে দিয়ে পাঠানো হয়েছিল নির্বাসনেও।

এমনি এক বেয়াড়া পরিস্থিতিতে জনগণের তথ্য জানার অধিকার থেকে ‘গেদুচাচার খোলাচিঠি’ কলামটির আত্মপ্রকাশ ঘটে। দুরূহ আর কণ্টকাকীর্ণ পথ জেনেও তথ্য জানানোর এই ওয়াকিয়ানবিস বা বার্তাবাহকের দায়িত্বটি কাঁধে নিয়েছিলেন গেদুচাচা। এ ব্যাপারে গেদুচাচা লেখেন –

‘চাচারে, আপনারা তো শহরের মানুষ। থাকেন চাইর দেওয়ালের ভেতরে। চলেন ৪ কাঁচের ভেতর। কিন্তু আমরা যারা গেরামে থাকি, তাদের মরণের খবরও অন্যগেরামের লোকেরা জানে না।’

এই চ্যালেঞ্জিং পেশায়, তাও আবার স্বৈরশাসনামল। এতে টিকে থাকতে ঝুঁকি তো ছিলই, কিন্তু দেশপ্রেমিক সাংবাদিক হিসেবে মানুষকে তথ্য জানানোটাও অবশ্যম্ভাবী মনে করেছেন তিনি। এজন্য অধিক নিউরন খাঁটিয়ে উত্তম তরিকা বের করতে হয়েছিল গেদুচাচার।

গেদুচাচার মতে, ভাষার মতো কৌশলও একটি শিল্প। তাই লিখতেন জাদুময়ী ব্যঞ্জনায়; টক-ঝাল-মিষ্টি মিশিয়ে। ‘গেদুচাচার খোলা চিঠি’ কলামটির আত্মপ্রকাশই ছিল ভিমরুলে ঢিল ছোঁড়া। ঠিক এমনিভাবে, যেমনটি লিখে গেছেন গেদুচাচা –

‘গতকাইল আমাদের গেরামের চৌধুরী বাড়ির আবু চৌধুরী বাড়ি আসিয়াছে। তিনি বলিলেন, এই বছরই আবার নাকি একখান ভোট হইবে। সেই কথাখানা শুনিবার পর হইতে সারারাইত আমার ঘুম হয় নাই।

… চাচা, আপনার আল্লার কসম লাগে আপনি আর ভোট দিয়েন না। এই বছরের পয়লা যেই দুইখানা ভোট দিয়াছেন, তাহাতেই সারাজনমের হাউস মিটিয়া গিয়াছে। সেই নির্বাচন দেখিয়া আমার ‘৪৭ সালের রায়টের কথা মনে পড়িয়া গিয়াছিল।

… শুনিতেছি আপনি নাকি ভোটের নিয়ম বদলাইয়া দিবার কথা ভাবিতেছেন। তাহাতে আমার একখান পরামর্শ আছে। সেইটা হইলো, দশ বছরে একবার ভোট দিবেন। ভোটকেন্দ্রে আমরা যাইতে চাই না। অবশ্য না গেলেও ঠিকমতো ভোট হইয়া যায়। এমনকি যাহারা বাঁচিয়া নাই, তাহারাও ভোট দিয়া যায়। খামোখা ভোটের দরকার কি?’

এমনই তীর্যকভাবে ‘আর্ট অব ব্লিঙ্কিং’ পদ্ধতিতে ভিন্ন আঙ্গিকে ও নিজস্ব ভাষাভঙ্গিতে বিষয়াবলি উপস্থাপন করেছেন। আর এভাবেই খোন্দকার মোজাম্মেল হক ‘গেদুচাচা’ হিসেবে প্রভূত খ্যাতি অর্জন করেন। মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে দরদি ভাষায় বলিষ্ঠভাবে উপস্থাপনার পাশাপাশি কলামে ওঠে আসত রাষ্ট্রপতি জেনারেল এরশাদের স্বৈর রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহের গঠনমূলক কুটিল সমালোচনার উপস্থাপন ও এর সমাধান।

খোন্দকার মোজাম্মেল হক নব্বই দশকের গোড়াতে সুগন্ধা ছেড়ে সূর্যোদয় এবং পরে আজকের সূর্যোদয় পত্রিকা প্রকাশ করে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত লাভ করেছিলেন জনমতকে প্রভাবিত করার দুর্লভ ক্ষমতা। জাতীয় স্বার্থের প্রতি নিরবিচ্ছিন্নভাবে অবিচল ও দায়িত্বশীল থেকে যুক্তির ভাষায় তিনি প্রতিটি ইস্যুর গণতান্ত্রিক ফয়সালার দিকনির্দেশনা দিতেন। কারোর প্রতি ব্যক্তিগত বিরাগ বা বিদ্বেষ নয়, জনসাধারণের প্রতি অগাধ প্রেমপ্রীতি আর ভালোবাসার উম্মুখে তুমুল সমালোচনামূলক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে সম্যক দৃশ্যপট উম্মোচনে প্রয়াস পেতেন তিনি।

‘গেদুচাচার খোলাচিঠি’তে থাকত আদরণীয় যতসব সম্বোধন। যেমন- মাননীয় প্রেসিডেন্ট এরশাদ চাচা। এরপর প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমেদ যখন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হলেন, তখন তাঁকে লিখে দিলেন মাননীয় অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি কডু চাচা।

আসলে ৬৮ হাজার গ্রামেই ছিল গেদুচাচার সোর্স। বিশ্বস্ত সোর্সে জেনে নিয়েছিলেন কডু মিয়া ছিল সাহাবুদ্দীন আহমেদের পারিবারিক ডাক নাম। ব্যাস্, আর কি!

এমনিভাবেই লিখতেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী খালেদা বিবি, মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা লতিফুর চাচা, মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা ফখরুদ্দীন চাচা, মাননীয় বিরোধী নেত্রী বা প্রধানমন্ত্রী হাছিনা বিবি।

খোন্দকার মোজাম্মেল হক বেগম খালেদা জিয়া এবং শেখ হাসিনা শাসনামলেও প্রতি সপ্তাহে সমাজে, রাষ্ট্রে ও সরকারে ঘটে যাওয়া চুম্বকাংশ তৃতীয় নয়নে গেদুচাচার মুখেই যেন নিজের মতামত ও পরামর্শ বলে যেতেন। যা লিখতেন, তা যুক্তিগ্রাহ্য করে খোলাখুলিভাবেই লিখতেন। পরিমিত কিন্তু চৌকশ ভাষায় ক্ষহিষ্ণু সমাজ ও রাষ্ট্রের অনিয়ম-অসঙ্গতি তুলে ধরার মেধাবী বিশ্লেষণ ও সমাধানই ছিল তাঁর শক্তির উৎস।

তিনি অকুতোভয় সম্পাদক হিসেবে সংবাদপত্রের জগতে ভিন্ন ধাঁচের প্রিন্টার্স লাইনের জন্ম দিয়েছিলেন। ‘লেখালেখির জন্য প্রধান সম্পাদক ব্যতীত অন্য কাউকে দায়ী করা যাবে না’- সম্পাদকীয় পৃষ্ঠায় উৎকীর্ণ এ লেখা সম্পাদকীয় নীতি ও তাঁর দুর্দান্ত তেজস্বী সাংবাদিকতারই সাক্ষী। যা আমাদের মধ্যেও সঞ্চারিত হয়েছিল।

খোন্দকার মোজাম্মেল হক অ্যাসাইনমেন্ট দেওয়ার সময় ‘ফ্যাক্টস আর সিক্রেটস কমান্ডস আর ফ্রি, নিউজ ইজ ব্যাইজড অন ফ্যাক্ট, ফিকশন ইজ নট নিউজ’ – এই বলে একটা বিশ্বাসে ছেড়ে দিতেন আমাদের।

এছাড়া ‘খবর ভালো হোক মন্দ হোক আমরা সত্য কথা লিখবো’- পত্রিকার এই স্লোগানের মধ্যে পাঠক সমাজ তাদের অসমসাহসী প্রিয় গেদুচাচাকে আবিষ্কার করতেন।

দুঃসাহসিক এই সম্পাদকীয় নীতির দরুন চলার পথও কিন্তু মসৃণ ছিল না। এজন্য রাষ্ট্রনায়ক, সরকার ও সংক্ষুব্ধ পক্ষের অনেক বিরুদ্ধতা সহ্য করে টিকিয়ে রাখতে হয়েছে অস্তিত্ব ও প্রকাশনা। সত্যের পথে হাঁটতে মাসুলও গুণতে হয়েছে ৬৬ টি মামলা ও হুলিয়া খেয়ে।

এক্ষেত্রে মামলাও লড়েছেন নিজে আইনজীবী হয়ে। অপরদিকে স্ত্রী ব্যবস্থাপনা সম্পাদক ফারজানা মোজাম্মেল হক পত্রিকার ‘ননস্টপ’ প্রকাশনা ধরে রেখেছেন সিদ্ধহস্তে।

‘আজকের সূর্যোদয়’ সমকালিক সময়ের দর্পণের ভূমিকা পালন করায় প্রচারসংখ্যার বিচারে কাগজের বরাদ্দ মিলত না, না মিলত বিজ্ঞাপন। আবার বেসরকারি বিজ্ঞাপনের ক্ষেত্রে হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর ‘তৈল’ পড়া থাকলেও তা মর্দনে হাত ছিল না বলে পাঠকই ছিল একমাত্র লক্ষী।

খোন্দকার মোজাম্মেল হক রাজনীতিমনস্ক ক্ষমতাধর ও প্রভাবশালী একজন সম্পাদক হয়েও ছিল না কোনো উচ্চাভিলাস, না ছিল অর্থের মোহ। সেই সুবাদে পাহাড়সম সম্পদ গড়ার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও দৈন্যতাকে বেছে সততাই ছিল তাঁর নীতি।

এ কারণেই তিনি সত্য কথা অকপটে বলার সাহস দেখাতে পারতেন। তিনি আমাদেরকে বলতেন, ‘সত্যের জন্য সবকিছু ত্যাগ করা যায় কিন্তু সবকিছুর জন্য সত্যকে ত্যাগ করা যায় না।’

খোন্দকার মোজাম্মেল হকের পরিচয় একজন কলাম লেখক ও সাংবাদিক-সম্পাদক হলেও তাঁর ভূমিকা ছিল একজন ‘স্টেটসম্যান’-এর মতোই অসামান্য। একজন স্টেটসম্যান যেমন জাতীয় দুর্দিনে জাতিকে দিশা ও সঠিক পরামর্শ দেন এবং জাতি তা নিঃসঙ্কোচে পালন করে, তেমনি গেদুচাচার আহ্বান বা পরামর্শ জাতি ঠিক সেভাবেই গ্রহণ করেছে।

সম্পাদক হিসেবে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে গেদুচাচার গ্রহণযোগ্যতা ছিল অসামান্য। তাঁর লিখনিতে কর্তৃপক্ষীয় সমাধান যে আসত না তা কিন্তু নয়। কোনটার সমাধান হতো আর কোনটা সমাধানের পথ বেয়ে এগোত। রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধান তাঁদের দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে গেদুচাচার খোলা চিঠিকে কীভাবে মূল্যায়নে নিতেন তা তো ছিলই, তার চেয়েও বড় কথা গেদুচাচাতে আসক্ত থাকতেন পাঠককুল। এখানেই গেদুচাচা একটি প্রজন্মের নেতা।

খোন্দকার মোজাম্মেল হক-সৃষ্ট গেদুচাচা চরিত্রটি বিশ্বসাংবাদিকতায় সত্যিই বিরল এবং ন্যায়ের সাহসী সাংবাদিকতার মূর্ত প্রতীক। ‘গেদুচাচার খোলা চিঠি’ কলামটি তাঁকে ছাপিয়ে সৃষ্ট গেদুচাচাই যেন হয়ে উঠেন ‘টেন আউট অব টেন’। অর্থাৎ দশে দশ।

বিপুল পাঠকনন্দিত ‘গেদুচাচার খোলাচিঠি’ কলামের পাশাপাশি একই পত্রিকায় তিনি নামে-বেনামে অনেক কলাম লিখে গেছেন বিচক্ষণতার সাথে। এরমধ্যে ‘সুসংবাদ-দুঃসংবাদ’, ‘সিদ্ধিবাবার উপলব্ধি’, ‘ক্রসকানেকশন’, ‘স্বর্গ-নরক’সহ একটি ধর্মীয় কলাম অন্যতম।

অধিকন্তু সম্পাদকীয়ের নাম দিয়েছিলেন ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’; যা পড়ে যে কেউ আঁতকে উঠার মতো। সেসব কলাম ও সম্পাদকীয়তে নির্ভয়ে সত্য উচ্চারণ, অনন্য আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক দিকনির্দেশনায় নিজেকে দেশের অন্যতম সেরা সম্পাদক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। অর্জন করেছিলেন স্বাধীন প্রিয় জনপদের প্রত্যেক দেশপ্রেমিক মানুষের অনুপম শ্রদ্ধা আর অতল ভালোবাসা, যা পায়নি কখনও কেউ।

খোন্দকার মোজাম্মেল হক তাঁর ‘গেদুচাচার খোলাচিঠি’র বিখ্যাত কলামের ইতিতে সম্বোধনকারীকে লিখতেন, ‘আপনারই ৬৮ হাজার গেরামের নালায়েক নাখান্দা অধম গেদুচাচা।’

গেদুচাচা, তুমি মোটেও তা নও। অকুতোভয় আত্মত্যাগের লড়াইয়ে প্রেরণার বলিষ্ঠ স্বচ্ছ চিন্তার মহানায়ক তুমি। জাতির মনন তৈরিতে তোমার ভূমিকা অবিস্মরণীয়।

এছাড়া একচোখা নীতি তোমার ছিল না। যেখানে অন্যায়, সেখানেই ছিলে তুমি। যেখানে অত্যাচার-অবিচার সেখানেই ছিল তোমার কথা। ছিলে না মিথ্যার সন্ধিতে আপসকামীতায়। কোনো সম্প্রদায়ভুক্ত ছিলে না, ছিলে সকলের।

খোন্দকার মোজাম্মেল হক জী-নিউজ ওয়ার্ল্ড এবং রুপসীবাংলা টিভির পরিচালকও ছিলেন। এছাড়া ওয়ার্ল্ডওয়াইড অনলাইন জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের সিইও, তথ্য মন্ত্রণালয়ের ন্যস্ত সম্পাদক (Accredited Editor), জাতীয় প্রেসক্লাবের নির্বাহী সিনিয়র সদস্য, হিউম্যান রাইটস গ্রুপ- বাংলাদেশের মহাসচিব, চট্টগ্রাম বিভাগ সাংবাদিক ফোরাম- ঢাকার সভাপতি, বঙ্গবন্ধু পরিষদ কেন্দ্রীয় কমিটির সম্পাদক, বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা পরিবার কল্যাণ পরিষদের চেয়ারম্যানসহ বিভিন্ন সংস্থা ও সংগঠের গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করে গেছেন।

খোন্দকার মোজাম্মেল হক ছিলেন বিনয়ী, সদাচার, সদালাপী, মানবসত্তা ও সচ্চরিত্রের অধিকারী এবং ধর্ম দর্শনেও পণ্ডিত ব্যক্তি। আলোকিত দেশ গড়তে হাইস্কুল প্রতিষ্ঠা করেছেন। করেছেন শিক্ষকতাও। তাছাড়া জনসেবা ও উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডেও অনুকরণীয় হবেন তিনি।

খোন্দকার মোজাম্মেল হকের মৃত্যুর আগে ফেসবুক স্ট্যাটাস ছিল- ‘দুই কন্যা তাসনুভা হক ইভা এবং তানহা তাবাসসুম মম। তিন পুত্র তানভীর মোজাম্মেল রিদয়, রাহাত এম হক এবং রিফাত এম হক। আর আমার নাতি-নাতনিদের নিয়ে বেঁধেছি খেলাঘর এই নশ্বর ভূবনে।’

আজ চার বছরে হলো এই ভূবনে তিনিই নেই। রাষ্ট্রীয় পদক-পদবির পথ মাড়াননি কখনও। গেদুচাচাই ছিল তাঁর অভিধা। সরকার ও জনগণের মধ্যে ভাবনার সেতুবন্ধন রচনা করেছিলেন গেদুচাচা, তাঁরই বিখ্যাত ‘গেদুচাচার খোলা চিঠি’র মধ্য দিয়ে।

সাংবাদিকতার বিশ্ব পরিমণ্ডলে গেদুচাচা এক অক্ষয় চরিত্র। ‘গেদুচাচা’ খ্যাত খোন্দকার মোজাম্মেল হক সাংবাদিকতার জগতে এক দীপ্তিমান আলোকসঙ্কেত।

দেশপ্রেমিক এই মহীয়ান গেদুচাচা সৃষ্টিশীল কর্মে স্মরণে বরণীয় হয়ে রবেন চিরদিন।

লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও কলামিস্ট

প্রিয় পাঠক, লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই ঠিকানায় -
sarabangla.muktomot@gmail.com

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত মতামত ও লেখার দায় লেখকের একান্তই নিজস্ব, এর সাথে সারাবাংলার সম্পাদকীয় নীতিমালা সম্পর্কিত নয়। সারাবাংলা ডটনেট সকল মতাদর্শের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তবে মুক্তমতে প্রকাশিত লেখার দায় সারাবাংলার নয়।

সারাবাংলা/এজেডএস

Tags: ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন