বিজ্ঞাপন

বিরোধীদের আপত্তি, তবু দণ্ডবিধির বদলে ন্যায় সংহিতার যুগে ভারত

July 1, 2024 | 8:27 am

আন্তর্জাতিক ডেস্ক

নানা ধরনের অপরাধের সাজা দিতে ব্রিটিশ আমলে প্রণীত পেনাল কোড তথা দণ্ডবিধি থেকে বেরিয়ে আসছে ভারত। স্বাধীনতার ৭৫ বছর পর অপরাধের সাজা দিতে দেশটি নিজেদের মতো করে আইন প্রণয়ন করেছে। বিরোধীদের আপত্তি থাকলেও ‘ভারতীয় ন্যায় সংহিতা (বিএনএস)’ শিরোনামের আইনটি এবার কার্যকর হতে যাচ্ছে ভারতে। একই সঙ্গে কার্যকর হচ্ছে ব্রিটিশ আমলে প্রণীত আরও দুটি আইন।

বিজ্ঞাপন

ভারতীয় গণমাধ্যমগুলোর খবর বলছে, ১৮৬০ সালে ব্রিটিশ শাসনামলে প্রণয়ন করা দণ্ডবিধির বদলে ন্যায় সংহিতা গোটা ভারতে চালু হচ্ছে আজ সোমবার (১ জুলাই)। পাশাপাশি ১৮৯৮ সালের ‘ক্রিমিনাল প্রসিডিওর অ্যাক্ট’ তথা ফৌজদারি দণ্ডবিধির বদলে চালু হচ্ছে ‘ভারতীয় নাগরিক সুরক্ষা সংহিতা’ এবং ১৮৭২ সালের ‘ইন্ডিয়ান এভিডেন্স অ্যাক্ট’ তথা ভারতীয় সাক্ষ্য আইনের বদলে কার্যকর হচ্ছে ‘ভারতীয় সাক্ষ্য অধিনিয়ম’।

নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকারের দ্বিতীয় মেয়াদে গত বছরের ১১ আগস্ট কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ নতুন বিল তিনটি সংসদে উত্থাপন করেন। তিনি জানান, নতুন তিন বিলের মাধ্যমে ভারতের ফৌজদারি আইনে ৩১৩টি পরিবর্তন আনা হচ্ছে। এতে দেশের আইন ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আসবে। এত দিন আইনে সাজার কথা বলা ছিল। এবার সাধারণ মানুষ যেন ন্যায় পান, নতুন আইনের নামের মধ্য দিয়েই সেই ভাবনা প্রকাশ পেয়েছে।

দণ্ডবিধি থেকে কী কী পরিবর্তন

ভারতীয় গণমাধ্যমগুলো বলছে, ন্যায় সংহিতায় নতুন ২০টি অপরাধ চিহ্নিত করা হয়েছে। অন্যদিকে দণ্ডবিধিতে থাকা ১৯টি বিধান বাদ পড়েছে। একই সঙ্গে ৩৩টি অপরাধের জন্য কারাদণ্ডের সাজার মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। ৮৩টি অপরাধের জন্য জরিমানার পরিমাণও বেড়েছে আগের তুলনায়। আবার ২৩টি এমন অপরাধ চিহ্নিত করা হয়েছে, যেখানে একটি বাধ্যতামূলক সর্বনিম্ন শাস্তির কথা বলা রয়েছে ন্যায় সংহিতায়।

বিজ্ঞাপন

হত্যা, আত্মহত্যায় প্ররোচনা দেওয়া, আক্রমণ, গুরুতর আঘাতের মতো অপরাধের জন্য দণ্ডবিধিতে যেসব বিধান ছিল, সেগুলো একই রকম থাকছে ন্যায় সংহিতায়। চুরি, ডাকাতি, প্রতারণার মতো অপরাধের জন্যও আগের দণ্ডবিধিতের বিধানগুলো একই রকম থাকছে নতুন আইনে।

তবে এই আইনে সংগঠিত অপরাধ, সন্ত্রাসবাদ, গণহত্যার মতো অপরাধ নতুন করে যুক্ত হয়েছে। যুক্ত হয়েছে সাইবার অপরাধ ও আর্থিক প্রতারণার মতো নতুন নতুন অপরাধ। আবার গণপিটুনির মতো ঘটনার জন্য কোনো সাজা ছিল না। নতুন আইনে একে অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করে মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত সাজার বিধান যুক্ত করা হয়েছে। পাশাপাশি, পরিবেশ দূষণ ও মানব পাচারের মতো অপরাধকে ন্যায় সংহিতার অধীনে আনা হয়েছে। এমনকি নারীদের হার বা মোবাইল ছিনতাইয়ের মতো ঘটনার বিচারের জন্যও রয়েছে আলাদা বিধান।

ভারতীয় ন্যায় সংহিতায় দেশদ্রোহের মতো অপরাধকে সরিয়ে রাখা হয়েছে। তবে তার পরিবর্তে ভারতের সার্বভৌমত্ব, একতা ও অখণ্ডতাকে বিপন্ন করাকে অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করার কথা বলা হয়েছে। নতুন আইনে সেই অপরাধের জন্য নির্দিষ্ট সাজার কথাও বলা রয়েছে।

বিজ্ঞাপন

নতুন আইনে নারী সুরক্ষা ও নারীদের সঙ্গে ঘটা বিভিন্ন অপরাধের ক্ষেত্রে আগের তুলনায় কঠোর বিধান যোগ করা হয়েছে। নতুন আইনে ১৮ বছরের কম বয়সী বা নাবালিকা ধর্ষণের সাজা মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত রাখা হয়েছে। গণধর্ষণের ক্ষেত্রে ন্যূনতম সাজা ২০ বছর থেকে যাবজ্জীবন করা হয়েছে।

যৌন সহিংসতার মামলার ক্ষেত্রে নির্যাতনের শিকার নারীর জবানবন্দি তার বাড়িতেই নেওয়ার কথা বলা হয়েছে একজন নারী ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে। বিয়ে বা অন্য প্রতিশ্রুতি দিয়ে নারীদের সঙ্গে যৌন সম্পর্কের অপরাধের জন্য ১০ বছরের সাজার কথা বলা হয়েছে।

যা আছে নাগরিক সুরক্ষা সংহিতায়

১ জুলাই থেকে ভারতীয় নাগরিক সুরক্ষা সংহিতাও চালু হচ্ছে ভারতে। আগের ফৌজদারি দণ্ডবিধি থেকে বেশকিছু পরিবর্তন এসেছে নতুন এই আইনে। কিছু ধারা বাতিল করা হয়েছে, কিছু সংশোধন করা হয়েছে। নতুন আইনে অভিযুক্তের অধিকারকে আরও শক্তিশালী করার কথা বলা রয়েছে। কোনো অভিযুক্তের এমন অধিকার থাকবে যেন তারা নিজেদের পছন্দের আইনজীবী বেছে নিতে পারেন।

নাগরিক সুরক্ষা সংহিতায় বলা হয়েছে, পুলিশ কাউকে বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতার করলে তাকে অবশ্যই জানাতে হবে কোন অপরাধে গ্রেফতার করা হয়েছে। পাশাপাশি তার শারীরিক পরীক্ষার জন্য কেন্দ্রীয় বা রাজ্য সরকারকে অবশ্যই একজন চিকিৎসকের ব্যবস্থা করতে হবে। ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থার দক্ষতার উন্নতির কথাও নতুন আইনে বলা রয়েছে।

বিজ্ঞাপন

এতে আরও বলা হয়েছে, বৃহত্তর স্বার্থে কোনো ব্যক্তিকে পরোয়ানা ছাড়াই গ্রেফতার করা যাবে। পুলিশকে কোনো অপরাধের তদন্তের স্বার্থে আরও বেশি ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। তবে তদন্ত শেষ করার জন্য নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দেওয়ার কথাও রয়েছে নতুন আইনে। বিচার প্রক্রিয়ায় গতি আনতে মামলা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নিষ্পত্তি করার বিষয়ও উল্লেখ রয়েছে।

সাক্ষ্য অধিনিয়মে যা থাকছে

আগের দুটি আইনের মতোই ভারতীয় সাক্ষ্য আইনের পরিবর্তে চালু হচ্ছে ভারতীয় সাক্ষ্য অধিনিয়ম। অপরাধের প্রমাণ সংগ্রহে ভিডিও রেকর্ডিং বাধ্যতামূলক করা হয়েছে এই আইনে। পাশাপাশি ভিডিও প্রমাণ বাজেয়াপ্ত করার ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে নিম্ন আদালতে জমাও দিতে বলা হয়েছে। নতুন আইনে আরও বলা হয়েছে, কেউ অনলাইনে অভিযোগ করলে তিন দিনের মধ্যে সংশ্লিষ্ট থানায় গিয়ে এফআইআরে সই না করলে অভিযোগ গ্রহণযোগ্য হবে না।

বিরোধিতার কেন্দ্রে ‘দেশদ্রোহিতা’

ব্রিটিশ আমলের তিন আইনকে নতুন করে প্রণয়ন করার পর সবচেয়ে বেশি বিরোধিতা এসেছে দেশদ্রোহিতা সংক্রান্ত অপরাধ ও সাজার বিধান নিয়ে। আগের আইন ভারতীয় দণ্ডবিধির ১২৪(ক) ধারায় ‘দেশদ্রোহিতা’ অপরাধের বিধান ছিল। নতুন আইন ন্যায় সংহিতায় এই অপরাধটি রাখা হয়েছে ১৫২ ধারায়। তবে দেশিদ্রোহিতা শব্দটিই রাখা হয়নি। এর বদলে প্রায় একই ভাষায় দেশের ‘সার্বভৌমত্ব ও ঐক্য’র যেকোনো বিরোধিতার ক্ষেত্রে কঠোর সাজার কথা বলা হয়েছে।

ভারতীয় বিরোধী দলগুলো মনে করছে, দেশের নাগরিকরা এত গভীরে বিষয়টি বুঝতে পারবেন না। গত ১০ বছরে মোদি সরকারের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ উঠেছে, সেভাবেই সমালোচনা বা বিরোধিতা করলে এই বিধান দিয়ে এবার দমনমূলক পদক্ষেপ নিতে পারবে সরকার।

অপরাধ ও সন্ত্রাস দমনে যে নতুন ধারাগুলো যুক্ত হয়েছে, সেগুলোর মাধ্যমেও সরাসরি নাগরিক অধিকার খর্ব করা হয়েছে বলে দাবি বিরোধীদের। নতুন আইন কার্যকর হওয়ার আগের দিন তথা গতকাল রোববারও (৩০ জুন) বিরোধী বিভিন্ন দলের নেতাই এ নিয়ে কথা বলেছেন।

বিরোধীদের আপত্তির মুখেও আইন পাস ও কার্যকর

মোদি সরকারের প্রণয়ন করা তিন আইন নিয়ে শুরু থেকেই বিতর্ক হচ্ছে ভারতে। সংসদে এই বিল পেশ হওয়ার পর থেকেই শুরু হয় বিরোধিতাও। লোকসভা ও রাজ্যসভায় বিল নিয়ে আলোচনায় বিরোধী দলগুলি অংশও নেয়নি। সংসদের বাইরেও তা নিয়ে সমান প্রতিবাদ জানিয়েছে বিরোধীরা।

গত লোকসভা নির্বাচনের প্রচারের সময়ও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী তৃণমূল কংগ্রেসের প্রধান মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই ন্যায় সংহিতার বিরোধিতা করে বক্তব্য রেখেছেন। একই ধরনের বক্তব্য রেখেছেন কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধীও। এমনকি এই আইন বাতিলের দাবিতে আইনি পথও বেছে নিয়েছিলেন বিরোধীরা। সুপ্রিম কোর্টে মামলা করেছিলেন। তবে তাদের অভিযোগ আমলে নেননি আদালত।

এখনই আইন বলবৎ না করে পুনর্বিবেচনার দাবিও তুলেছিলেন মমতা। এমনকি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে চিঠি লিখেছিলেন তিনি। আইনজীবীদের একাংশেরও দাবি, এই তিন আইনে পুলিশের হাতে এমন ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে যা আগে কখনো ছিল না। তার ওপর তিন আইন চালুর ফলে গোটা দেশে আইনি জটিলতা বেড়ে যাবে।

এত বিতর্কের মধ্যেও সংসদের দুই কক্ষেই পাস হয়ে যায় তিন অপরাধমূলক আইনের বিল। ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে সেই বিলে সই করেন রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু। পরে গত ফ্রেব্রুয়ারিতে কেন্দ্রীয় সরকার জানিয়ে দেয়, ১ জুলাই থেকে আইন তিনটি কার্যকর হবে। সেই ঘোষণা অনুযায়ীই আজ ভারতে ব্রিটিশ আমলের সেই দণ্ডবিধি, ফৌজদারি আইন আর সাক্ষ্য আইনের বদলে চালু হচ্ছে ভারতীয় নতুন আইন।

সারাবাংলা/টিআর

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন