বিজ্ঞাপন

ঢাকা শহরের যানজট সমস্যার অবসান কবে হবে?

July 2, 2024 | 3:06 pm

অমিত বণিক

যানজটে নগরবাসীর জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। যানজটের কবলে পড়ে মানুষের কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে। দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের গতি কমছে। আর এতে জাতীয় অর্থনীতির ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। বৈদেশিক বিনিয়োগ পিছিয়ে পড়ার অন্যতম কারণ যানজট। এ ছাড়া যানজটে প্রতিনিয়ত মানসিক চাপ নিয়েই চলাচল করতে হচ্ছে। যানজটের কারণে ট্রাফিকব্যবস্থা অনেকটাই ভেঙে পড়েছে। সড়কে সিগন্যাল বাতি অকার্যকর রয়েছে অনেক আগে থেকেই। উল্টো পথে যানবাহন চলাচল, ফুটপাতে মোটরসাইকেলসহ বিভিন্ন যানবাহনের চলাচল থেমে নেই। আইনের তোয়াক্কা করছেন না কেউ। পথচারীরাও বেপরোয়া। ফুটওভার ব্রিজ থাকলেও তা ব্যবহার করছেন না অনেকেই। রাজধানীর এমন চিত্র প্রতিদিনের।

বিজ্ঞাপন

যানজট এড়াতে ফুটওভার ব্রিজ, ফ্লাইওভার, মেট্রোরেলসহ সড়ক যোগাযোগে ব্যাপক উন্নয়ন করা হয়েছে, কিন্তু যানজট নিরসন হয়নি। সকালে কর্মস্থলে যেতে মানুষের ব্যস্ততা বেশি থাকে। একই সময়ে শিক্ষার্থীরাও স্কুল-কলেজে যাতায়াত করে। এ সময়ে যানবাহন চলাচলের ধীরগতির কারণে চরম ভোগান্তিতে পড়তে হয় নগরবাসীকে। কত ঘণ্টা সময় চলে যায় রাস্তায় যানজটের জন্য, কোনো কাজ না করেই। প্রতিদিন যানজটে আটকে থেকে লাখো মানুষের কোটি কোটি কর্মঘণ্টা হারিয়ে যায়। যদি অর্থনীতির ভাষায় এ ক্ষতি হিসাব করা হয়, তাহলে বোঝা যেত যানজটে আমাদের কতটা ক্ষতি হচ্ছে। আর এর সঙ্গে জটে আটকা পড়া গাড়িগুলো তেল পুড়িয়ে ও হর্ন বাজিয়ে পরিবেশের কতটা ক্ষতি করছে সেটা কি অবহেলা করা যায়।এমনিতে ঢাকা পৃথিবীর অন্যতম বাস-অযোগ্য শহর, আর সঙ্গে যানজটে আটকা পড়া গাড়িগুলোর কারণে শব্দ ও পরিবেশদূষণ আরও বাড়ে। আর বৃষ্টি হলে তো কথাই নেই, ঢাকা হয়ে যায় ভাসমান একটি নগর দ্বীপ। অথচ এ শহরের যানজট নিরসনে বছরের পর বছর হাজার কোটি টাকার প্রকল্প আর আলোচনা হয়, ফলাফল সবার জানা। সময় সময় অনেক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, হয়েছে অনেক ফ্লাইওভার। বিভিন্ন রাস্তাকে বিভিন্নভাবে চিহ্নিত করে নির্দিষ্ট ধরনের যানবাহনের জন্য ব্যবহারের ব্যবস্থা হয়েছে। কোটি কোটি টাকা খরচ করে স্থাপন করা হয়েছে আধুনিক ট্রাফিক ব্যবস্থা, উলটোপথে আসা গাড়ির জন্য প্রতিরোধক ব্যবস্থাসহ অনেক কিছুই হয়েছে। কিন্তু যানজট আর ঢাকা শহর যেন সমার্থক হয়ে গেছে। আর রমজান, ঈদসহ বিশেষ সময়ে এর তীব্রতা আরও ভয়াবহ হয়। একসময় বলা হতো রিকশার কারণে যানজট হয়, তাই অনেক রাস্তায় রিকশা বন্ধ করা হয়েছে। করা হয়েছে ভিআইপি রোড, কিন্তু যানজটের তীব্রতা যেন সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েই চলেছে। ফ্লাইওভার দিয়ে যানজটমুক্ত ঢাকা শহরের স্বপ্ন শেষ, এখন বাকি আছে মেট্রোরেল। যানজট নেই এমন শহর পৃথিবীতে খুব কমই আছে, কিন্তু ঢাকাসহ দেশের প্রধান শহরগুলোর যানজট শহরবাসীর জন্য অভিশাপ হয়ে যাচ্ছে। আমাদের এখন নতুন করে ভাবতে হবে এবং সে ভাবনা হতে হবে বাস্তবতানির্ভর। আমাদের উন্নয়ন প্রকল্পের একটি বড় দুর্বলতা হচ্ছে সুদূরপ্রসারী চিন্তাভাবনা না থাকা। অনেক ক্ষেত্রেই আমরা সমস্যার কারণ চিহ্নিত না করে বা সঠিকভাবে অনুধাবন না করেই সমাধানের জন্য কোটি কোটি টাকা ব্যয় করি।

যদি প্রকৃত অর্থে যানজটের সমাধান বা তীব্রতা কমাতে চাই, তাহলে আমাদের এর কারণগুলো নিয়ে সবার আগে ভাবতে হবে। অতিরিক্ত জনসংখ্যা, মানুষের মধ্যে নিয়ম না-মানার প্রবণতা, অপরিকল্পিতভাবে ভবন নির্মাণ, ফুটপাত দখল করে ব্যবসা করা, ইত্যাদিকে যানজটের জন্য দায়ী করা হয়। আপাতদৃষ্টিতে এগুলো কারণ বটে, কিন্তু কারণের পেছনেও যে কারণ থাকে তা আমরা ভাবি কি? রাজধানীর অতিরিক্ত জনসংখ্যার প্রধানতম কারণ হচ্ছে দেশের সব সুযোগ-সুবিধাকে রাজধানীতে কেন্দ্রীভূত করে রাখা। সব ধরনের প্রতিষ্ঠানের প্রধান অফিস ঢাকায়, এমনকি কোস্টগার্ডের প্রধান অফিসও। আসলে আমাদের মজ্জার ভেতর ঢাকা শহর এমনভাবে মিশেছে, আমরা ঢাকা ছাড়া অন্যকিছু চিন্তা করি না। এভাবে চললে রাজধানী থেকে জনসংখ্যা কি কমানো যাবে? শিক্ষা, চিকিৎসা, বিনোদনসহ সবকিছুর কেন্দ্র ঢাকা। পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোয় বিভিন্ন শহর বিভিন্নভাবে সুযোগ-সুবিধায় বিন্যস্ত বলে যার যেখানে প্রয়োজন সেখানে যায়। কিন্তু আমাদের যেতে হয় একই শহরে। এভাবে ঢাকা শহরকে আমরা যানজট ও মানুষজটের শহর বানিয়েছি। আমরা অনেক কিছু করছি, কিন্তু সমস্যার কারণগুলো দূর করতে চেষ্টা করছি না। লক্ষ করলে দেখবেন, রাজধানীসহ সব শহরে হাসপাতাল, রোগ নির্ণয় কেন্দ্র, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানসহ সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর উপস্থিতি মূল সড়কের পাশেই। আবার বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট এলাকায় এসব প্রতিষ্ঠান গায়ে গায়ে গড়ে উঠেছে। ফলে মানুষ একই সময়ে একসঙ্গে এসব এলাকায় জামায়েত হয়, যা যানজটের অন্যতম কারণ। আবার খুব কম প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব পার্কিং ব্যবস্থা আছে এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সেটা অপ্রতুল। ফলে গাড়িগুলো সড়কে থাকে, তৈরি করে যানজট।

নিয়ম অনুযায়ী বহুতল ভবনের নিজস্ব পার্কিং থাকা এবং মূল রাস্তা থেকে নির্দিষ্ট দূরত্বে ভবন নির্মাণের বিধান থাকলেও তা মানার প্রবণতা নেই। আবার এসব তদারকি করার কথা থাকলেও সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিদের চরম অবহেলা লক্ষণীয়। এমন পরিস্থিতিতে আমরা কী করে যানজট নিরসন করতে পারব? আবার ভবনের সামনে থাকা সরকারি স্থানগুলো অস্থায়ী ছোট দোকানের দখলে থাকে। যদি সত্যিকার অর্থে রাজধানীসহ প্রধানশহরগুলোর যানজট পরিস্থিতির উন্নতি করতে চাই, তাহলে নগর পরিকল্পনাবিদ ও সংশ্লিষ্ট নীতিনির্ধারকদের সমন্বিত ভাবে বিষয় কাজ করতে হবে- কেবল নতুন নতুন মেগা প্রকল্প দিয়ে যে যানজট নিরসন সম্ভব নয়, তা আমাদের উপলব্ধি করতে হবে। বরং শহরের ব্যবস্থাপনার দিকে নজর দিলে ভালো ফল পাওয়া যেতে পারে। সবার আগে দরকার শহরের আয়তন, জনসংখ্যা, চাহিদা প্রভৃতি বিবেচনায় একটি সুনির্দিষ্ট নীতি, পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের জন্য উপযুক্ত পদক্ষেপ। প্রয়োজনে একটি শহরকে কয়েক ভাগে বিভক্ত করে এলাকাভিত্তিক চাহিদার ভিত্তিতে সেবা ব্যবস্থার বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে। যেমন কোনো এলাকার আয়তন ও জনসংখ্যার অনুপাতে এবং তাদের চাহিদার ভিত্তিতে ওই এলাকায় নতুন কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন থাকলেই কেবল অনুমোদন দিতে হবে। বিপরীতে যে এলাকায় অতিরিক্ত সেবাদান প্রতিষ্ঠান রয়েছে, সেসব বিষয়ে ভাবতে হবে। আমাদের বিদ্যমান ইমারত আইনের সঠিক প্রয়োগকে প্রাধান্য দিতে হবে। মানুষ যাতে নিয়ম মেনে বহুতল ইমারত তৈরি করে সে বিষয়টি নিশ্চিতে কাজ করতে হবে। এখানে কারও বিশেষ কোনো পরিচয় নয়, বরং আইনের সঠিক প্রয়োগ নিশ্চিতের ওপর জোর দিতে হবে। শহরের প্রায় বেশির ভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কোনো পার্কিং ব্যবস্থা নেই অথচ প্রতিদিন ওইসব প্রতিষ্ঠানে অসংখ্য ব্যক্তিগত গাড়ি একসঙ্গে হাজির হয়। প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীর সংখ্যা বিবেচনায় তাদের জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিবহণের ব্যবস্থা করার নিয়ম চালু করা যেতে পারে। কেবল উন্নত দেশ নয়, অনেক উন্নয়নশীল দেশেও এমন ব্যবস্থা আছে। একই নিয়ম হতে পারে শহরে বিদ্যমান বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য। আমাদের দেশে রমজান ছাড়া সারা বছর একই সময়ে অফিস চলে। এ কারণে রাস্তায় চাপও হয়, আবার সময়ের বা দিনের আলোও সঠিকভাবে ব্যবহার করা হয় না। ঋতুভিত্তিক সময় চালু করা এবং অফিস ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সময় আলাদা করা যায় কি না, তা ভেবে দেখা যেতে পারে।

বিজ্ঞাপন

কিছু স্বাস্থ্যসচেতন ও শৌখিন মানুষ ছাড়া শহরে সাইকেল ব্যবহারকারীর সংখ্যা খুবই কম। আমাদের এ বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়া দরকার। প্রয়োজনে সাইকেলের জন্য সড়কের পাশে বিশেষ লেন তৈরি করা যেতে পারে, যাতে মানুষ নিরাপদে ব্যবহার করতে পারে। সাইকেল সময়, পরিবেশ ও স্বাস্থ্যের জন্য খুবই উপকারী। এমনকি ব্যবহারকারীর জন্য প্রয়োজনে প্রণোদনার ব্যবস্থাও করা যেতে পারে। ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহারের ক্ষেত্রেও বিধিনিষেধ থাকার দরকার আছে। কোনো পরিবারে একাধিক ব্যক্তিগত গাড়ি থাকলে তাদের জন্য অতিরিক্ত করারোপ করা, নতুন গাড়ির অনুমোদন দেওয়ার আগে মালিকের প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়া দরকার। টাকা থাকলেই গাড়ি কিনতে হবে-এ মজ্জাগত দুর্বলতা দূর করতে হবে।

আমাদের জন্য এটা দুর্ভাগ্য যে, যানজটে নাকাল হতে হয় সাধারণ মানুষের। বিত্তবানদের আছে আরামদায়ক ব্যক্তিগত গাড়ি, ভিআইপি রোড। আর যাদের এসব দেখার দায়িত্ব তারাও চড়েন সরকারি টাকায় বিলাসবহুল গাড়িতে, রাস্তায় পান বিশেষ ছাড়। মাঝেমধ্যে বিশেষ ঘটনা ঘটলেই আমরা জেগে ওঠি, কত কথা হয়, কত পরিকল্পনা। আবার আমরা ঘুমিয়ে যাই, অপেক্ষায় থাকি নতুন কোনো ঘটনা ঘটার। ঢাকার যানজট সমস্যার স্থায়ী অবসান কবে হবে?

বিজ্ঞাপন

সারাবাংলা/এসবিডিই

Tags: , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন