বিজ্ঞাপন

ফ্রান্সে যে ৪ কারণে লা পেনের ডানপন্থি দলের জয়জয়কার

July 3, 2024 | 8:54 am

আন্তর্জাতিক ডেস্ক

ফ্রান্সের সংসদীয় নির্বাচনের প্রথম দফায় চূড়ান্ত ফল না আসায় নির্বাচন গড়িয়েছে দ্বিতীয় দফায় রান-অফ ভেঅটে। তবে সবাইকে চমকে দিয়ে প্রথম দফায় ৩৩ শতাংশ ভোট পেয়ে এগিয়ে রয়েছে ডানপন্থি দল ন্যাশনাল র‌্যালি (এনআর)। নির্বাচনে বামপন্থি জোট নিউ পপুলার ফ্রন্ট (এনপিএফ) ২৮ শতাংশ ভোট নিয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে। আর বর্তমান প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁর নেতৃত্বাধীন মধ্যপন্থি জোট এনসেম্বলে অ্যালায়েন্স তৃতীয় স্থানে রয়েছে প্রায় ২১ শতাংশ ভোট নিয়ে।

বিজ্ঞাপন

গত রোববার (৩০ জুন) ফ্রান্সে এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এবার আগামী ৭ জুলাই রয়েছে রান-অফ ভোট। এই নির্বাচনে যেন ফ্রান্সের সংসদ ডানপন্থিদের হাতে না চলে যায়, তা নিশ্চত করতে মধ্যপন্থি ও বামপন্থি দলগুলোকে এক হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন বর্তমান প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোঁ।

মারি লা পেন ও জর্ডান বারডেলার নেতৃত্বাধীন দল এনআরকে এই নির্বাচনের প্রথম দফায় এত ভোট দেওয়ার কারণ নিয়ে অনেক আলোচনাই হচ্ছে। ফ্রান্সের প্রবীণ রাজনৈতিক বিশ্লেষক অ্যালাইন ডুহামেল একে ঐতিহাসিক ঘটনা হিসেবে উল্লেখ করেছেন। বিবিসির এক প্রতিবেদনে ফরাসি সংসদ নির্বাচনে ডানপন্থি এই উত্থানের পেছনে চারটি বড় কারণ তুলে ধরা হয়েছে।

অভ্যন্তরীণ কারণ ও অর্থনৈতিক অবস্থা

জীবনযাত্রার ব্যয়, ক্রয়ক্ষমতা, বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি, স্বাস্থ্যসুবিধা নিয়ে অনিশ্চয়তা ইত্যাদি বিষয়গুলো ফ্রান্সের এই নির্বাচনে অভ্যন্তরীণ ইস্যুগুলোর মধ্যে গুরুত্ব পেয়েছে ভোটারদের কাছে। ফরাসিরা জানিয়েছেন, ক্রমবর্ধমান অপরাধ নিয়েও শঙ্কিত ছিলেন তারা, যেটিকে উল্লেখ করেছেন ‘নিরাপত্তাহীনতা’ বলে। সামগ্রিকভাবে ফ্রান্সের অর্থনীতি ভালো হলেও প্রান্তিক জনগোষ্ঠী জানিয়েছে, দেশটির সরকারের সব মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু শহর। প্রান্তিক পর্যায়ে থেকে তারা উপেক্ষিত হয়েছেন।

বিজ্ঞাপন

ফ্রান্সের কোথাও কোথাও বেকারত্বের হার অনেক বেশি, যা ২৫ শতাংশ পর্যন্তও হয়ে থাকতে পারে। দেশটির আবাসন ব্যবস্থা বেশ ব্যয়বহুল হয়ে পড়েছে। বরাদ্দ সংকুচিত করার কারণে কোনো কোনো এলাকার স্কুল ও স্থানীয় স্বাস্থ্য সেবাকেন্দ্রগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। এতে অনেকেই ক্ষুব্ধ হয়েছেন।

অধ্যাপক থমাস পিকেটি বিবিসিকে বলেন, উপেক্ষিতরাই ডানপন্থিদের দিকে ঝুঁকছে। ছোট শহরগুলোর শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মানুষজেনকে সেবার জন্য ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে। ট্রেন লাইন বন্ধ হয়ে গেছে, হাসপাতাল বন্ধ হয়ে গেছে। বড় শহর থেকে দূরে থাকলে আপনার শিশুদের শিক্ষিত করা পর্যন্ত কঠিন হয়ে গেছে।

পরিচ্ছন্নতা কর্মী অরেলি (৩৭) দুই সন্তানের মা, যিনি উত্তর ফ্রান্সের অ্যামিয়েন্স শহরে থাকেন। তিনি বলেন, লা পেনের দল এনআরের নীতির সঙ্গে আমি একমত। এর পেছনে মূল কারণ ‘নিরাপত্তা’। আমি প্রতিদিন ভোর সাড়ে ৪টায় ঘুম থেকে উঠে কাজের জন্য বের হই। একসময় আমি অ্যামিয়েন্সের রাস্তায় সাইকেল চালাতে বা হাঁটতে পারতাম। কিন্তু এখন আর পারি না। এখন আমাকে গাড়ি ব্যবহার করতে হয়। কারণ এসব রাস্তাজুড়ে সবসময় তরুণরা ঘোরাফেরা করে এবং আমি বিষয়টি নিয়ে ভয় পাই।

বিজ্ঞাপন

প্যারিসের পূর্ব দিকের শহর পন্টাল্ট-কম্বল্ট শহরের প্যাট্রিক এনআরকে ভোট দিয়েছেন। তিনি বলেন: মানুষ এখন পরিবর্তন চায়। সে জন্য তারা ভোট দিতে আগ্রহী। তারা যখন রাস্তাঘাটে অনিরাপদ বোধ করে, তখন তারা খুশি হয় না।

এ ছাড়া পেনশন নিয়েও ভোটাররা চিন্তিত। কারণ গত বছর ম্যাক্রোঁ আইন পাস করে পেনশনের বয়সসীমা ৬২ থেকে ৬৪ বছরে উন্নীত করেন। ম্যাক্রোঁ সরকারের অজনপ্রিয় সংস্কারগুলোর মাঝে এটি ছিল অন্যতম।

বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি ও ঘর গরম করার জন্য প্রয়োজনীয় গ্যাসও ভোটারদের কাছে উদ্বেগের বিষয়। এসব বিষয় নিয়েই বিশেষ প্রতিশ্রুতি দিয়েছে এনআর। দলটির নেতা জর্ডান বারডেলা বলেন, তারা জ্বালানি ও ১০০টি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ওপর থেকে ভ্যাট কর্তনের বিষয়ে মনোনিবেশ করবেন। শুধু তাই নয়, তারা কয়েক মাসের মাঝে পেনশন ব্যবস্থাও সংস্কার করবেন।

বিদ্যমান ব্যবস্থা নিয়ে অসন্তোষ

ভোটাররা প্রায়ই বলছেন যে বিদ্যমান রাজনৈতিক ব্যবস্থা কাজ কারছে না। তারা মনে করছেন, এনআর সরকারে গিয়ে কাজ করার সুযোগ পায়নি। বিশ্রাম নেওয়ার মতো সরকার ব্যবস্থায় পরিবর্তন আসাটাও ভালো মনে করছেন তারা।

বিজ্ঞাপন

এনআর সমর্থক জেন-ক্লড গ্যালেট (৬৪) রয়টার্সকে বলেন, আমি সন্তুষ্ট। কারণ আমাদের পরিবর্তন প্রয়োজন।

আরেক এনআর সমর্থক মার্গারিট (৮০) বলেন, তারা (ন্যাশনাল র‍্যালি) উঠে আসতে পেরেছে, কারণ জনগণ বিরক্ত। তাই জনগণ এখন বলছে যে ‘উই ডোন্ট কেয়ার। আসুন ভোট দেই। দেখি কী হয়। তবে আমি যা নিয়ে ভয়ে আছি তা হলো— অন্যান্য রাজনৈতিক দল এখানে বাধা তৈরি করবে। আমরা ভোট দিয়েছি। এই হলো তার ফলাফল। আমাদের এটা মেনে নিতে হবে এবং দেখতে হবে যে কী ঘটে।’

ওয়েনিজ শহরের ইয়ামিনা আদ্দোউ অবশ্য এনআরের সাফল্যে হতবাক। তিনি বলেন, ‘ডানপন্থিদের সমর্থন করার জন্য ভোটারদের প্রভাবিত করা হয়েছে এবং তাদের এ সিদ্ধান্ত ফরাসি সমাজকে গুরুতর ও বিপজ্জনক বিভাজনের দিকে নিয়ে যেতে পারে। অবশ্যই এটি আমায় ধাক্কা দিয়েছে। এটি খুব দুঃখজনক বলে আমি মনে করি। কী ঘটছে, মানুষ তা বুঝতে পারছে বলে আমার মনে হচ্ছে না। তারা কেবল ক্রয়ক্ষমতা আর স্বল্পমেয়াদি ও দৃশ্যমান অন্যান্য বিষয়গুলোকে বিবেচনা করে।

‘কিন্তু এর পিছনে অনেক ভাবনা ও কৌশল আছে যা আমাদের একটি ভিন্ন ধরনের যুদ্ধের দিকে পরিচালনা করবে। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সঙ্গে তুলনা করলে এই যুদ্ধ হবে আরও অনেক বেশি সূক্ষ্ম। মানুষ বুঝতে পারছে না যে আমরা একটি গৃহযুদ্ধ বাঁধিয়ে ফেলব; আমি এমনটাই ভাবি। এতে আমাদের মতো মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে,’— বলেন ইয়ামিনা।

অনেকেই ফ্রান্সের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও চলমান সংকটের জন্য প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোঁকে দায়ী করেন। ইকোনমিস্ট পত্রিকার প্যারিস ব্যুরো চিফ সোফি পেডার বিবিসিকে বলেন, ‘তিনি (ম্যাক্রোঁ) বিভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শে বিশ্বাসী মানুষদের একত্রিত করার জন্য একটি আন্দোলন তৈরি করেছিলেন। সংসদ ও দুপক্ষের মাঝে চলমান বিরামহীন কলহ থামাতে এটি কাজও করেছিল। কিন্তু ফলাফল হলো, কেবল বামপন্থি ও মধ্যপন্থিরা ম্যাক্রনের দলে যোগ দিয়েছে। শুধু যোগ দেয়নি কট্টরপন্থিরা।

অভিবাসী ও ভয়

বহু বছর ধরে ন্যাশনাল র‍্যালির নেতা মারি লা পেন তার দলকে মূলধারায় আনতে ও ভোটারদের কাছে দলকে আরও গ্রহণযোগ্য করে তোলার জন্য কাজ করছেন। শুরুর দিকে এই দলের নাম ছিল ন্যাশনাল ফ্রন্ট, যার প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন মারির বাবা জ্যোঁ- মারি লা পেন। তার বাবা ও দলের বাকি প্রতিষ্ঠাতা সদস্যদের ইহুদিবিরোধী ও চরমপন্থি অবস্থানকে মুছে দিতে কাজ করেছেন বলে জানান মারি। এ কারণেই দলের নামও বদলে দেন তিনি।

কিছু পরিবর্তন এলেও অভিবাসন প্রসঙ্গে ন্যাশনাল র‌্যালির অবস্থান বদলায়নি। তারা এখনো অভিবাসনের বিরুদ্ধে। দলের নেতা জর্ডান বারডেলা বলেছেন, তিনি ফরাসি দ্বৈত নাগরিকদেরকে কৌশলগত সংবেদনশীল পদ থেকে নিষিদ্ধ করতে চান। অভিবাসীদের ‘হাফ-ন্যাশনালস’ অভিহিত করে তাদের সামাজিক সুযোগ-সুবিধাও সীমিত করতে চান। ফ্রান্সে জন্মগ্রহণ করা বিদেশি নাগরিকদের সন্তানদের স্বয়ংক্রিয়ভাবে ফরাসি নাগরিকত্ব পাওয়ার অধিকার বন্ধ করতে চান তিনি।

লা পেনের দলের অভিবাসন ইস্যুতে এমন অবস্থান ফ্রান্সের নাগরিকদের বড় একটি অংশকেই প্রতিনিধিত্ব করে। একজন বিশ্লেষক বলেন, গত এক দশকে ফরাসি জনমত অভিবাসনের বিরুদ্ধে কঠোর হয়েছে।

ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের প্যারিসের ব্যুরো চিফ লেইলা আবৌদ বলেন, ‘গত এক দশকে অভিবাসনের বিরুদ্ধে ফরাসি জনমত বেশ কঠোর হয়েছে। ২০১৫ সালের সিরিয়া যুদ্ধের সময় থেকে শরণার্থী সংকটের কথা বিবেচনা করা যায়। চারপাশের এই পরিবর্তনের প্রতিক্রিয়ায় রাজনীতিবিদরাও পরিবর্তিত হয়েছে।’

ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রসঙ্গে এনআর প্রতিশ্রুতি দিয়েছে যে তারা ইউরোপীয় আইনের প্রাধান্যের অবসান ঘটাবে, যা ইইউ প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর। কিন্তু এনআর তাদের ন্যাটোবিরোধী ও ইইউবিরোধী নীতিগুলো শিথিল করেছে। এবং রাশিয়ার সঙ্গে এনআরের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কও বাদ দেওয়া হয়েছে। ২০২২ সাল থেকে তাদের এজেন্ডায় ইইউ ছাড়ার বিষয়টি আর নেই।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ব্যবহার

এনআর নেতা জর্ডান বারডেলা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বেশ সক্রিয়, বিশেষ করে টিকটকে। এনআর খুব সাধারণ স্লোগান ও ধারণার ওপর ভিত্তি করে সফলভাবে তাদের প্রচার চালিয়েছে। জনগণের মধ্যে ফরাসি পরিচয় হারানোর ভয় ও জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির যে চলমান সংকট, এই দুই বিষয়কে কাজে লাগিয়েছে এনআর। তারা ভোটারদের কাছে নিজেদের বিশ্বাসযোগ্য হিসেবে গড়ে তোলার জন্য খুব কার্যকরভাবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করেছে।

ইউনিভার্সিটি ডি ফ্রাঞ্চ-কমটির ভিনসেন্ট লেব্রু বিবিসির এক অনুষ্ঠানে বলেন, ‘ফ্রান্সে আমরা জর্ডান বারডেলাকে টিকটিক রাজনীতিক বলি। কারণ তিনি এমন একজন রাজনীতিবিদ, যিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে ব্যবহার করতে খুব স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। এটি এমন কিছু, যা তার প্রোফাইলে বেশ অবদান রেখেছে। তিনি ঠিক কী প্রস্তাব করছেন, সেটি না জানলেও তার অনেক কিছুই আপনি দেখতে পাচ্ছেন।

এনআরের বিরুদ্ধে থাকা একজন বামপন্থি দল এনপিএফ প্রার্থী চার্লস কুলিওলি। তিনি বলেন, অনেক মানুষই বর্ণবাদী নয়। তারা কেবল সিস্টেমে বিরক্ত না, তারা ম্যাক্রোঁর নীতিতে বিরক্ত, তাদের প্রতিশ্রুতিতেও বিরক্ত।

সারাবাংলা/টিআর

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন