বিজ্ঞাপন

থানা হাজতে আসামির মৃত্যু, পুলিশ বলছে ‘আত্মহনন’

July 3, 2024 | 5:01 pm

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট

চট্টগ্রাম ব্যুরো: চট্টগ্রাম নগরীর চান্দগাঁও থানা হেফাজতে মৃত আসামি নিজের শার্ট খুলে গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করেছেন বলে সিসি ক্যামেরার ফুটেজে প্রমাণ পাবার কথা জানিয়েছে পুলিশ। মৃতের স্বজনদের ভাষ্য অনুযায়ী, ওই যুবক ব্যাটারিচালিত রিকশা চালাতেন। কয়েকদিন আগে তার কাছ থেকে রিকশাটি ছিনতাই করে দুর্বৃত্তরা। এরপর থেকে রিকশা মালিকের ক্রমাগত মানসিক চাপ সহ্য করতে না পেরে যুবক বাসায়ও দুই দফা আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিলেন।

বিজ্ঞাপন

বুধবার (৩ জুলাই) সকালে থানা হাজতের ভেন্টিলেটরের সঙ্গে ঝুলন্ত অবস্থায় যুবকের লাশ দেখতে পেয়ে সেটি উদ্ধার করে পুলিশ। থানা হাজতে আসামির মৃত্যু নিয়ে তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। মৃতের স্বজনরা হেফাজতে থাকা আসামির জীবন রক্ষা করতে না পারার জন্য পুলিশকে দায়ী করে আহাজারি করছিলেন।

মৃত মো. জুয়েলের (২২) নগরীর চান্দগাঁও থানার খেজুরতলা এলাকায়। তবে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে জুয়েল নগরীর কোতোয়ালী থানার পাথরঘাটা এলাকায় থাকতেন। স্বজনদের তথ্য অনুযায়ী, তারা তিন ভাই ও তিন বোন। জুয়েলের স্ত্রী ও ছয় মাস বয়সী এক ছেলে আছে।

বিজ্ঞাপন

কোতোয়ালী থানায় গত ফেব্রুয়ারি মাসে দায়ের হওয়া একটি অস্ত্র মামলায় আদালতের পরোয়ানামূলে চান্দগাঁও থানা পুলিশ মঙ্গলবার (২ জুলাই) রাতে জুয়েলকে বাসা থেকে গ্রেফতার করে। নিয়ম অনুযায়ী, রাতে তাকে থানা হাজতে রাখা হয়। বুধবার দুপুরে তাকে আদালতে হাজির করার কথা ছিল।

চান্দগাঁও থানার প্রবেশমুখে হাতের বামে লোহার গ্রিলের গেট পেরিয়ে যেতে হয় পুরুষ হাজতে। প্রথম লোহার গেটের সামনে কর্তব্যরত থাকেন হাজতরক্ষী (কনস্টেবল পদমর্যাদার)।

থানায় গিয়ে দেখা গেছে, হাজতখানার ভেতরে দেয়ালের সঙ্গে লাগোয়া একপাশে আধাদেয়াল ঘেরা একটি শৌচাগার আছে। এর ওপরে আছে ভেন্টিলেটর। সিসি ক্যামেরার ফুটেজে দেখা গেছে, পরণের শার্ট খুলে শৌচাগারের আধাদেয়ালের ওপর দাঁড়িয়ে প্রথমে জুয়েল শার্টের এক হাত ভেন্টিলেটরের সঙ্গে বাঁধেন। নিচে ঝুলে থাকা হাতটি গলায় পেঁচিয়ে তিনি ‍ঝুলে পড়েন। মিনিটখানেকের মধ্যেই নিস্তেজ হয়ে যান।

বিজ্ঞাপন

চান্দগাঁও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জাহিদুল কবীর সারাবাংলাকে জানান, রাতভর হাজতে জুয়েল একাই ছিলেন। রাত আড়াইটার দিকে ডিউটি অফিসার গিয়ে হাজতে তার সঙ্গে কথা বলেন। ভোর ৫টা ২৫ মিনিট থেকে ৬টা পর্যন্ত ডিউটি অফিসার ও হাজতরক্ষীর সঙ্গে জুয়েলের হাজতের সামনে দফায় দফায় কথা হয়। ভোর ৬টা ২৪ মিনিট থেকে ৬টা ২৭ মিনিটের মধ্যে তাকে ভেন্টিলেটরের সঙ্গে শার্ট বেঁধে ঝুলে পড়তে দেখা যায় সিসি ক্যামেরায়।

‘ভোরে ডিউটি অফিসার ও সেন্ট্রি যখন জুয়েলের কাছে যায়, তখন সে জানায়, সকালে নাস্তা খাওয়ার পর সে একটি ওষুধ খায়, কিন্তু ওষুধের নাম সে জানে না। এজন্য তাকে তার ভগ্নিপতি সাগরের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলে দেয়ার জন্য বলেন। ডিউটি অফিসার তাকে মোবাইলে কথা বলে দেন। ছয়টার পর হাজতখানার সামনে থেকে ডিউটি অফিসার ও সেন্ট্রি চলে যান। নিয়ম অনুযায়ী, প্রতি দুই ঘণ্টা পরপর সেন্ট্রি পরিবর্তন করা হয়। সকাল সাতটায় নতুন সেন্ট্রি দায়িত্ব গ্রহণ করে পাঁচ মিনিট পর গিয়ে দেখেন, ‍জুয়েল ঝুলে আছে। তখনও রাতের ডিউটি অফিসারই দায়িত্বরত ছিলেন,’ – বলেন ওসি।

জুয়েলের বোন সালমা বেগম সারাবাংলাকে বলেন, ‘সকালে পুলিশের ফোন থেকে কল করে জুয়েল প্রথমে আমার বড় বোনের সঙ্গে কথা বলে। এরপর আমার মায়ের সঙ্গে কথা বলে তার জন্য ওষুধ নেয়ার কথা জানায়। আমি ও আমার স্বামী সকাল সাতটার একটু পরে ওষুধ নিয়ে থানায় আসি। আমাদের নয়টা পর্যন্ত এখানে (ডিউটি অফিসারের কক্ষ) বসিয়ে রাখে পুলিশ। দুই ঘণ্টা পর পুলিশ আমাদের একটি ভিডিও দেখায়। সেখানে দেখি, আমার ভাই তার শার্ট খুলে ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করেছে।’

বিজ্ঞাপন

এদিকে সকাল সাড়ে ১১টার দিকে জেলা প্রশাসনের ম্যাজিস্ট্রেট থানায় গিয়ে লাশের সুরতহাল সম্পন্ন করে। পুলিশের পক্ষ থেকেও আলাদাভাবে সুরতহাল করা হয়। সুরতহাল প্রতিবেদনে শুধুমাত্র গলায় ফাঁসজনিত জখমের চিহ্ন ছাড়া অস্বাভাবিক আর কিছু পাওয়া যায়নি বলে জানিয়েছেন নগর পুলিশের অতিরিক্ত উপ কমিশনার (উত্তর) মো. জাহাঙ্গীর।

পরিবারের সদস্যদের ভাষ্য অনুযায়ী, তিনবছর আগে জুয়েল মাদক সেবন, ছিনতাইসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কাজে জড়িত ছিলেন। সাত-আটমাস আগ থেকে অপরাধ কর্মকাণ্ড ছেলে প্রথমে টানা রিকশা চালাতে শুরু করে। এরপর সম্প্রতি তার ভগ্নিপতি রুবেলসহ মিলে ব্যাটারি চালিত রিকশা (ইজিবাইক) চালাতে শুরু করেন। নগরীর কোরবানিগঞ্জ এলাকায় একটি গ্যারেজ থেকে ইজিবাইক ভাড়া নিয়ে চালাতেন।

গত ২৫ জুন রাত সাড়ে এগারোটার দিতে যাত্রী নিয়ে যান নগরীর ফিরিঙ্গিবাজার লইট্যাঘাট এলাকায়। সেখানে জুয়েলকে বেধড়ক পিটিয়ে রিকশা ছিনিয়ে নেয় একদল দুর্বৃ্ত্ত। এ ঘটনা গ্যারেজ মালিককে জানানোর পর তিনি কোনোভাবে ছিনতাইয়ের ঘটনা বিশ্বাস করেননি। তিনি এক লাখ পঁয়তাল্লিশ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ দাবি করেন।

সালমা বেগম সারাবাংলাকে বলেন, ‘এক লাখ পঁয়তাল্লিশ হাজার টাকা মালিককে দিতে হবে শুনে জুয়েল পাগলের মতো হয়ে যায়। এত টাকা কোত্থেকে দেবে, বারবার শুধু একথা বলে টেনশন করতো। আমি, আমার বোন ও জুয়েলের স্ত্রী মিলে ত্রিশ হাজার টাকা জোগাড় করি। সেটা নিতে প্রথমে রাজি হয়নি গ্যারেজ মালিক। জুয়েলকে ডেকে নিয়ে গ্যারেজে আটকে মারধর করে। পরে সেই টাকা রেখে প্রতিদিন দুইশ টাকা করে কিস্তি দাবি করে।’

‘বাসায় ফিরে জুয়েল প্রথমে একবার নিজের রুমে গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করে। আমার মা দেখে তাকে কোনোমতে রক্ষা করে। এরপর বাসার বাইরে টয়লেটে ঢুকে আত্মহত্যার চেষ্টা করে। তখন আমার বোন এবং অন্যান্য ভাড়াটিয়ারা দেখে তাকে বের করে আনে,’ – বলেন সালমা বেগম।

পরিবারের সদস্যদের বক্তব্য অনুযায়ী, প্রথমে ছিনতাইকারীদের এবং পরবর্তীতে গ্যারেজ মালিকের মারধরের কারণে জুয়েল অসুস্থ হয়ে পড়েন। ব্যাথায় কাতর জুয়েল কয়েকদিন ধরে বিভিন্ন ওষুধ সেবন করে আসছিলেন।

এদিকে বেলা বারোটার দিকে থানার সামনে যান জুয়েলের মা, স্ত্রীসহ আরও কয়েকজন স্বজন। তারা থানার সামনে আহাজারি করছিলেন। পুলিশকে উদ্দেশ্য করে তার মা মিনারা বেগম বলেন, ‘আমার ছেলেকে সুস্থ অবস্থায় এনেছেন আপনারা। সে হাসিমুখে আপনাদের সাথে এসেছে। সে কেন মারা যাবে ? তাকে আমার কাছে ফেরত দেন। আমি আমার ছেলেকে জীবিত ফেরত চাই।’

তাদের সামনে দিয়ে লাশ চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে নেয়ার জন্য অ্যাম্বুলেন্সে তোলা হয়। অ্যাম্বুলেন্স যাত্রার সময় আহাজারিরত স্বজনরা সামনে শুয়ে সেটা কিছুক্ষণ আটকে রাখেন। পরে পুলিশ তাদের সরিয়ে লাশ মর্গে নিয়ে যায়।

এ ঘটনায় একটি অপমৃত্যু মামলা দায়ের করা হয়েছে বলে চান্দগাঁও থানার ওসি জাহিদুল কবীর জানিয়েছেন।

সারাবাংলা/আরডি/এনইউ

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন