বিজ্ঞাপন

বাংলাদেশ-চীন সম্পর্কেও ‘ইস্যু’ ভারত, কূটনৈতিক ভারসাম্যের তাগিদ

July 3, 2024 | 9:16 pm

ঝর্ণা রায়, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা: দুই সপ্তাহের ব্যবধানে দুইবার ভারত সফরের পর এবার চীন সফরে যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। চার দিনের এই সফরে বাণিজ্য বাড়ানোর পাশাপাশি আলোচনার অন্যতম ইস্যু হবে দেশের যোগাযোগ খাতে বিনিয়োগ। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ইস্যুও আলোচনার প্রধান বিষয় হিসেবে উঠে আসতে পারে। আলোচনা হতে পারে বহুল আলোচিত তিস্তা প্রকল্প নিয়েও।

বিজ্ঞাপন

আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এশিয়ার প্রধান দুই অর্থনৈতিক পরাশক্তি চীন ও ভারতের সঙ্গে বড় পরিসরে সম্পৃক্ত হওয়ার লক্ষ্যেই এই সফর। তবে ভারত-চীন সম্পর্কে উত্তেজনা সাম্প্রতিক সময়ে বেড়েছে। বাংলাদেশ-চীন সম্পর্কের বিভিন্ন ইস্যুতেও জড়িয়ে পড়েছে চীন। সেই প্রতিদ্বন্দ্বিতার বাইরে থেকে বাংলাদেশকে দুই দেশের সঙ্গেই দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক বজায় রাখতে হবে, বজায় রাখতে হবে কূটনৈতিক ভারসাম্য।

আগামী সোমবার (৮ জুলাই) চীনের পথে রওয়ানা হবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ১১ জুলাই পর্যন্ত দেশটি সফর করবেন তিনি। মঙ্গলবার (২ জুলাই) সচিব মাসুদ বিন মোমেন এক সংবাদ সম্মেলনে জানান, প্রধানমন্ত্রীর এবারের চীন সফরে বিনিয়োগ, আঞ্চলিক বাণিজ্য, সহযোগিতা, রোহিঙ্গাসহ নানা ইস্যুতে আলোচনা হবে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে আবারও আলোচনায় উঠে আসা তিস্তা ইস্যু নিয়ে কোনো আলোচনা হবে কি না, এ নিয়ে কোনো তথ্য দিতে পারেননি সচিব।

প্রাধান্য পাবে বাণিজ্য ও উন্নয়ন

সূত্র বলছে, প্রধানমন্ত্রীর এবারের চীন সফরের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকবে ব্যবসায়িক খাত। চীনের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক বাড়ানোর পাশাপাশি আঞ্চলিক সম্পর্ক বাড়াতেও গুরুত্ব দিচ্ছে বাংলাদেশ। বিশেষ করে দেশের উন্নয়ন খাত এই সফরে প্রাধান্য পেতে পারে।

বিজ্ঞাপন

পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ বুধবার সাংবাদিকদের বলেন, চীন আমাদের বড় উন্নয়ন সহযোগী দেশ। আমাদের অবকাঠামো উন্নয়ন, বঙ্গবন্ধু টানেল, পদ্মা ব্রিজসহ নানা ক্ষেত্রে অনেক আইকনিক স্থাপনা নির্মাণে চীনের অর্থ ও লোকবল কাজে লেগেছে। তাই (প্রধানমন্ত্রীর) আগামী সফর নিশ্চিতভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এতদিন চীন আমাদের উন্নয়ন অভিযাত্রায় যে ভূমিকা রেখে আসছে, সেটি বেগবান করতে এই সফর গুরুত্বপূর্ণ।

স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণ হলে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে অনেক শুল্ক সুবিধা হারাবে। বিভিন্ন দেশের সঙ্গে তাই দ্বিপাক্ষিক চুক্তির মাধ্যমে শুল্ক সুবিধা বহাল রাখার চেষ্টা করছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের বড় অংশীদার হিসেবে চীনের সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) বাস্তবায়নের মাধ্যমে শুল্কমুক্ত সুবিধা ধরে রাখতে চায়।

গত মাসেই বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল হক টিটু এক অনুষ্ঠানে বলেন, ‘আমরা ২০১৬ সালে এফটিএর সম্ভাব্যতা যাচাই নিয়ে সমঝোতা স্মারক সই করেছি। যৌথ সভা হয়েছে ২০১৮ সালে। আমরা সম্ভাব্যতা যাচাই প্রতিবেদন বিনিময় করেছি। আশা করি, প্রধানমন্ত্রী চীন সফরের আগে আগে আমরা সমীক্ষা শেষ হয়েছে বলে ঘোষণা দিতে পারব।’ বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানিয়েছে, প্রধানমন্ত্রীর এই সফরে আলোচনার জন্য এফটিএ ইস্যুটি এজেন্ডা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে।

বিজ্ঞাপন

আলোচনায় যোগাযোগ খাতে প্রকল্প সহায়তা

সরকারের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, দেশের যোগাযোগ খাতে সড়ক ও রেলের বেশ কিছু নতুন প্রকল্পে চীনের সহযোগিতা পেতে চায় বাংলাদেশ। এরই মধ্যে উত্তরা-মতিঝিল মেট্রোরেল চালুর সুফল পেতে শুরু করেছে রাজধানীবাসী। কিন্তু এমআরটি-২ তথা গাবতলী থেকে নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত তথা মেট্রোরেল লাইনের জন্য কোনো ঋণ এখনো পাওয়া যায়নি। এ প্রকল্পের জন্য চীনের ঋণ পেতে আগ্রহী সড়ক মন্ত্রণালয়।

সড়ক পরিবহণ ও সেতু মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে সারাবাংলাকে বলেন, ‘গাবতলী থেকে নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত মেট্রোরেলের লাইন নির্মাণ, পিরোজপুরের কচা নদীতে সেতু নির্মাণ ও মুন্সীগঞ্জের মুক্তারপুর সেতু মেরামতের বিষয়ে চীনের সঙ্গে আলোচনা হতে পারে। আমরা এসব প্রকল্পের তালিকা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছি।’

চীনের কাছ থেকে প্রকল্পে অর্থায়ন পেতে তালিকা পাঠিয়েছে রেলপথ মন্ত্রণালয়ও। চীনের সহায়তায় পদ্মা সেতুর দুই প্রান্তে ১৭২ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণের কাজ প্রায় শেষ। চীনের এক্সিম ব্যাংক এই প্রকল্পের জন্য ঋণ দিয়েছে। মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়া এই ঋণের মেয়াদ নভেম্বর পর্যন্ত বাড়াতে প্রকল্পটি রাখা হয়েছে তালিকায়। আবার ভাঙ্গা থেকে কুয়াকাটা পর্যন্ত রেললাইন নতুন রেলপথের জন্য ৪১ হাজার কোটি টাকা প্রয়োজন হবে। এটিও প্রধানমন্ত্রীর চীন সফরের জন্য আলোচনায় রাখা হয়েছে।

এ ছাড়া গাজীপুরের জয়দেবপুর থেকে জামালপুর পর্যন্ত মিশ্র গেজ রেলপথ নির্মাণ, পাবনার ঢালারচর থেকে ফরিদপুরের পাচুরিয়া পর্যন্ত ব্রডগেজ রেলপথ নির্মাণ, রাজবাড়ীতে একটি রেলওয়ে ওয়ার্কশপ নির্মাণ ও ভৈরববাজার থেকে ময়মনসিংহ পর্যন্ত মিটারগেজ লাইন মিশ্র গেজে রূপান্তরের চারটি প্রকল্পও রয়েছে চীন সফরের তালিকায়।

বিজ্ঞাপন

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র সারাবাংলাকে নিশ্চিত করেছে, সড়ক ও রেল মিলিয়ে মোট ৯টি প্রকল্পের তালিকা তাদের কাছে এসেছে। এই প্রকল্পগুলোর জন্য চীন অর্থায়ন করবে কি না, তা নিয়ে আলোচনা হতে পারে প্রধানমন্ত্রীর চীন সফরে।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও সরকারের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) একাধিক সূত্র বলছে, প্রধানমন্ত্রীর এই সফর থেকে বাংলাদেশ বিভিন্ন প্রকল্পের জন্য প্রায় ৭০০ কোটি ডলার ঋণ পেতে পারে চীনের কাছ থেকে। চীন সফরে নতুন কোনো চুক্তি হবে কি না— জানতে চাইলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘সেটি এখনো চূড়ান্ত হয়নি। এখনো বলার সময় আসেনি। সবকিছু চূড়ান্ত হলে আমরা জানাব।’

রোহিঙ্গা ইস্যুও আলোচনায়

মিয়ানমারের রাখাইন থেকে দেশটির সরকার ও সেনাবাহিনীর নির্যাতনের শিকার হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর একজনকেও গত সাত বছরে নিজেদের ভূমিতে ফেরত পাঠানো সম্ভব হয়নি। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের এই প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশ বরবারই চীনের সহযোগিতা চেয়ে আসছে। চীনের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে মৌখিক সমর্থন থাকলেও শেষ পর্যন্ত নানা প্রক্রিয়া অতিক্রম করেও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু করা যায়নি। প্রধানমন্ত্রীর চীন সফরে রোহিঙ্গা ইস্যু আলোচনায় উঠে আসতে পারে বলে জানা গেছে সংশ্লিষ্ট সূত্রে।

রোহিঙ্গা ইস্যুতে চীনের পক্ষ থেকে কোনো সমর্থন পাওয়া যাবে কি না— এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবীর সারাবাংলাকে বলেন, ‘চীনের কাছ থেকে আমরা কতটা প্রত্যাশা করেছি, সেটা দেখতে হবে আগে। চীন এ বিষয়ে কতটা সহযোগিতা করতে পারবে, সেটাও দেখতে হবে। মিয়ানমারে সরাসরি স্বার্থ রয়েছে চীনের। সেই স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার মতো কোনো কাজ তারা করবে না। যতটা সরলভাবে সবাই দেখি, এসব বিষয় ততটা সরল নয়। চীনের মন্ত্রী এসে বলে গেছেন, তাদের কথা মিয়ানমার শোনে না। ফলে চীনের কাছ থেকে রোহিঙ্গা ইস্যুতে কতটা সহযোগিতা পেতে পারি, সেটা বাস্তবতার নিরিখেই বিবেচনায় রাখতে হবে।’

তিস্তা নিয়ে ভারত-চীন ২ দেশেরই আগ্রহ

প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরে তিস্তা ইস্যু নিয়ে আলোচনা নিয়ে কৌতূহল ছিল সব মহলে। বাংলাদেশ অনেক দিন ধরেই ‘তিস্তা মহাপরিকল্পনা’ বাস্তবায়নের চেষ্টা করছে। বাংলাদেশের পানি উন্নয়ন বোর্ড ও পাওয়ার চায়না যৌথভাবে প্রায় তিন বছর সমীক্ষা করে এই নদী ব্যবস্থাপনার একটি প্রস্তাব তৈরি করেছে। প্রকল্পের আওতায় তিস্তায় নদী খনন থেকে শুরু করে ভূমি উদ্ধার করে সেচ, নৌ চলাচল, পর্যটন, আবাসন ও শিল্পায়নের সম্ভাবনা তুলে ধরা হয়।

চীন এ প্রকল্পে আর্থিক ও কারিগরি সহায়তা দিতে আগ্রহ দেখিয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর সবশেষ ভারত সফরে ভারতও এ প্রকল্প নিয়ে আগ্রহের কথা জানিয়েছে। ফলে কৌতূহল রয়েছে, প্রধানমন্ত্রীর চীন সফরে এটি আলোচনার টেবিলে কতটা গুরুত্ব পাবে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফর-পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনেও এ প্রসঙ্গে প্রশ্ন করেন গণমাধ্যম কর্মীরা। জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘ভারতের কাছে আমাদের তিস্তার পানির দাবিটা অনেক দিনের। ভারত যদি আমাদের তিস্তা প্রজেক্টটা করে দেয়, তাহলে তো সমস্যার সমাধান হয়ে গেল।’ দুই দেশেরই প্রস্তাব রয়েছে জানিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের চীন প্রস্তাব দিয়েছে, ভারতও প্রস্তাব দিয়েছে। অবশ্যই আমি এটা বিবেচনা করব কোন প্রস্তাবটা (গ্রহণ) করলে আমার দেশের মানুষের কল্যাণে আসবে। আমি সেটাই গ্রহণ করব।’

তিস্তা প্রসঙ্গে সাবেক কূটনীতিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ এম হুমায়ুন কবীর বলেন, ‘প্রকল্পটা আমরা তৈরি করেছি এবং সেখানে চীন অর্থায়নের আগ্রহ দেখিয়েছে। এখন ভারতও আগ্রহ দেখাচ্ছে। হয়তো প্রধানমন্ত্রীর চীন সফরে বিষয়টি জানতে চাইবে। এখন বাংলাদেশ যদি বলে যে জাতীয় স্বার্থে আমরা চীন ও ভারত দুই দেশের প্রস্তাবই আমরা দেখছি বা বিবেচনা করছি, আমার ধারণা, তাহলে এ আলোচনা এখানেই শেষ হয়ে যাবে।’

চীন-ভারত উত্তেজনার জের বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কে

চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক আলোচনায় ভারত-বাংলাদেশ প্রসঙ্গও উঠে আসে। দীর্ঘ দিন ধরেই দুই দেশের সঙ্গেই বাংলাদেশ বন্ধুত্বপূর্ণ সর্ম্প রেখে চলেছে। উন্নয়ন ও সহযোগিতা থেকে শুরু করে কৌশলগত অংশীদারির সম্পর্ক বাংলাদেশ বজায় রেখে চলেছে দুই দেশের সঙ্গেই। এর মধ্যেই সীমান্তসহ নানা ইস্যুতে চীন-ভারত সম্পর্কে উত্তেজনা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা বাংলাদেশের সঙ্গে দেশ দুইটির সম্পর্কে কোনো প্রভাব ফেলবে কি না, তা নিয়ে রয়েছে উদ্বেগ। সদ্য শেষ হওয়া জুনেই প্রধানমন্ত্রীর দুই দফা ভারত সফর ঘিরেও উঠে এসেছে এমন প্রসঙ্গ।

ভারতের সাবেক পররাষ্ট্র সচিব হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা সম্প্রতি এক নিবন্ধ লিখেছেন ইকোনমিক টাইমসে। সেখানে তিনি বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্কের নানা দিক তুলে ধরেছেন। একই সঙ্গে বলেছেন, বাংলাদেশের রাজনীতি ও অর্থনীতিকে চীনের প্রভাব বাড়তে থাকলে তা বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্কে বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে।

তবে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে বৈঠকেই তাকে চীন সফরের কথা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জানিয়েছিলেন বলে সাংবাদিকদের বলেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ। বুধবার এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক রেখেই বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে হবে।

বাংলাদেশ অবশ্য বরাবরই সব দেশের সঙ্গেই বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখতে সচেষ্ট। ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়’— এই নীতিকেই বাংলাদেশ কূটনীতির মূলমন্ত্র হিসেবে অনুসরণ করে আসছে। ভারত সফর-পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী সংবাদ সম্মেলনেও একই কথাই জানিয়েছেন। ওই সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীর কাছে প্রশ্ন রাখা হয়, ভারত কবা চীনের মধ্যে কোনো দেশের প্রতি বাংলাদেশ বেশি ঝুঁকে পড়ছে কি না। প্রধানমন্ত্রী সে প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘আমার বাংলাদেশ সভরেইন (সার্বভৌম) দেশ। সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব নিয়ে চলব। কার কী সমস্যা, সেটা তাদের বিষয়, আমার না।’

কূটনৈতিক সম্পর্কে ভারসাম্য বজায় রাখার আহ্বান

কূটনীতিক ও বিশেষজ্ঞরাও বাংলাদেশের ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্কেই মনোযোগী থাকার কথা বলছেন। প্রধানমন্ত্রীর চীন সফর প্রসঙ্গে কথা হয় সাবেক রাষ্ট্রদূত ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ এম হুমায়ুন কবীরের সঙ্গে। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘বর্তমানে ভারত-চীনের মধ্যে এক ধরনের প্রতিদ্বন্দ্বিতা তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশের সবার আগে উচিত হবে এ ধরনের প্রতিদ্বন্দ্বিতার বাইরে থেকে দ্বিপাক্ষিক অবস্থান বজায় রাখা। এখন চীনের কাছ থেকে বাংলাদেশ অনেক ধরনের সহযোগিতা পায়। ভবিষ্যতেও উন্নয়ন খাতে সহযোগিতা প্রয়োজন হবে। সেগুলো বিবেচনায় নিয়েই সম্পর্ক এগিয়ে নিতে হবে।’

সাবেক এই কূটনীতিক বলেন, ‘ভূ-রাজনৈতিক ইস্যুগুলোও মাথায় রাখতে হবে। কিন্তু বাংলাদেশের উচিত যতটাসম্ভব ভারতের ট্র্যাক ভারতের জায়গায় এবং চীনের ট্র্যাক চীনের জায়গায় রাখতে চেষ্টা করা। তাদের (ভারত-চীন) প্রতিদ্বন্দ্বিতার মধ্যে বাংলাদেশের ঢোকা ঠিক হবে না। আমার বিশ্বাস, সরকার সেখানে ঢুকতে চায়ও না।’

উন্নয়ন বা ব্যবসায়িক স্বার্থে চীন-ভারত দুই দেশের কাছ থেকেই বাংলাদেশকে প্রয়োজনীয় সহায়তা নিতে হবে বলে মনে করেন এম হুমায়ুন কবীর। বলেন, ‘পায়রা বন্দর ও ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ এমআরটি বাস্তবায়ন নিয়ে কথা হচ্ছে। আসলে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের অনেক ইস্যু রয়েছে, যেখানে ভারতের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। ভারতের নিশ্চয় নিজস্ব চিন্তা রয়েছে। কিন্তু স্বাধীন দেশ হিসেবে দেশের জন্য যা দরকার, সেদিকেই এগাবে বাংলাদেশ। ভারত সফর নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে, চীন সফর নিয়েও হবে। কিন্তু বাংলাদেশকে নিজ স্বার্থের জায়গায় অটল থাকতে হবে।’

প্রধানমন্ত্রীর চীন সফর সূচি

প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ঢাকা থেকে আগামী সোমবার (৮ জুলাই) চীনের পথে রওয়ানা দেবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ওই দিনই তিনি চীনের রাজধানী বেইজিং পৌঁছাবেন।

মঙ্গলবার (৯ জুলাই) চীনের প্রধানমন্ত্রী লি কিয়াংয়ের সঙ্গে বৈঠক করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ১০ জুলাই চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিন পিংয়ের সঙ্গে বৈঠক করবেন তিনি। ওই দিনই চীনের সংসদ ন্যাশনাল পিপলস কংগ্রেস অব চায়নার প্রেসিডেন্ট ঝাও লেজির সঙ্গে তার বৈঠক রয়েছে।

দুই দেশের রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের এ বৈঠকে যোগাযোগ, রোহিঙ্গা ছাড়াও ২০২৫ সালে বাংলাদেশ-চীনের সম্পর্কের ৫০ বছর উপলক্ষে বিশেষ ঘোষণা আসতে পারে। সই হতে পারে বেশ কিছু সমঝোতা স্মারক।

এর আগে ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে সরকার গঠনের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চীন সফর করেছিলেন জুন মাসে। ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জিতে সরকার গঠনের পরও ২০১৯ সালের জুলাইয়ে তিনি চীন সফর করেছিলেন। এর মধ্যে ২০১৬ সালে বাংলাদেশ সফর করেছিলেন চীনের প্রধান নেতা শি জিনপিং।

এবার টানা চতুর্থবারের মতো সরকার গঠনের পর এই প্রথম চীন সফরে যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর আগে তিনি গত মাসেই দুই দফা ভারত সফর করে এসেছেন।

সারাবাংলা/জেআর

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন