বিজ্ঞাপন

বাংলাদেশের আমে আগ্রহ চীনের

July 9, 2024 | 10:25 pm

এমদাদুল হক তুহিন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা: মধুমাসের মধুফল আম। গোপালভোগ, ল্যাংড়া, আম্রপালি, হাঁড়িভাঙ্গা, ফজলি— নানা জাতের রসালো আর সুস্বাদু আম দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিভিন্ন দেশে রফতানি হয়ে আসছে আগে থেকেই। এবার বাংলাদেশের সুস্বাদু এই ফলটি নিয়ে আগ্রহী হয়ে উঠেছে চীন। এরই মধ্যে দেশটির একটি প্রতিনিধি দল আমের রাজধানীখ্যাত চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নওগাঁ জেলার কয়েকটি আম বাগান পরিদর্শন করেছে। পরিদর্শনে প্রাথমিকভাবে সন্তুষ্টিও প্রকাশ করেছে তারা। সবকিছু ঠিক থাকলে বাংলাদেশ থেকে আম রফতানিতে দুই দেশের মধ্যে শিগগিরই সই হবে সমঝোতা স্মারক (এমওইউ)। আর সেটি হলে চীনে আম রফতানির ব্যাপক সম্ভাবনা দেখছেন দেশের কৃষি ও বাণিজ্য সংশ্লিষ্টরা।

বিজ্ঞাপন

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশ থেকে আম রফতানি নতুন নয়। গত কয়েক বছর ধরেই আম রফতানির পরিমাণ ক্রমবর্ধমান। বাড়ছে রফতানি গন্তব্য দেশের সংখ্যাও। ২০২১-২২ অর্থবছরে ২৮টি দেশে আম রফতানি হয়েছিল এক হাজার ৭৫৭ টন। এর পরের অর্থবছরেই (২০২২-২৩) আম রফতানি হয় ৩৬টি দেশে, পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় তিন হাজার ১০০ টনে। আম রফতানির নতুন গন্তব্য হিসেবেই এবার যুক্ত হতে যাচ্ছে চীন।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্য বলছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে যে ৩৬টি দেশে আম রফতানি হয়েছে, এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আম নিয়েছে যুক্তরাজ্য— এক হাজার ৩৮৫ টন। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৩৪৪ টন আম রফতানি হয় ইতালিতে। সৌদি আরবে রফতানি হয় তৃতীয় সর্বোচ্চ ৩১০ টন।

আমের ভরা মৌসুম চলছে। রাজশাহীর বানেশ্বরে দেশের বৃহত্তম আমের হাটও তাই জমজমাট। ছবি: হাবিবুর রহমান/ সারাবাংলা

এ ছাড়া অস্ট্রিয়া, বাহরাইন, বেলজিয়াম, কানাডা, নেদারল্যান্ডস, ফ্রান্স, জার্মানি, গ্রিস, হংকং, আয়ারল্যান্ড, ভুটান, লেবানন, মালদ্বীপ, ওমান, পুর্তগাল, কাতার, রাশিয়া, সিঙ্গাপুর, সোয়াজিল্যান্ড, সুইডেন, সুইজারল্যান্ড, স্পেন, মালয়েশিয়া, কুয়েত, মাল্টা, সংযুক্ত আরব আমিরাত, তুরস্ক, দক্ষিণ আফ্রিকা, ব্রুনেই, নেপাল, পাকিস্তান, ভারত ও ডেনমার্কেও আম রফতানি হয়েছে।

বিজ্ঞাপন

এবার আম রফতানির প্রক্রিয়ায় যুক্ত হয়েছে চীনও। সংশ্লিষ্ট দফতরগুলোর তথ্য বলছে, গত ২২ থেকে ২৮ জুন চীনের দুই সদস্যের একটি বিশেষজ্ঞ দল বাংলাদেশ সফরে আসে। প্রতিনিধি দলে ছিলেন চীনের রিসার্চ সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল ইন্সপেকশন অ্যান্ড কোয়ারেন্টাইন স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেকনিক্যাল রেগুলেশন অব জিএসিসির সিনিয়র অ্যাগ্রোনমিস্ট ম্যা ফেই এবং কিনজো গ্যাং কাস্টমস ডিস্ট্রিক্ট পিআর চায়নার ভাইস স্টেশন চিফ কিইউ শীন।

আরও পড়ুন- যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দেশে যাবে ৪ হাজার টন আম

সূত্রগুলো বলছে, এই দুই বিশেষজ্ঞ চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নওগাঁ জেলার কয়েকটি আম বাগান পরিদর্শন করেন। আম রফতানির পুরো প্রক্রিয়া পরিদর্শনের মধ্যে তারা ২৬ জুন কৃষি সচিব ওয়াহিদা আক্তারের সঙ্গেও সাক্ষাৎ করেন। আম বাগান পরিদর্শনসহ সংশ্লিষ্ট দফতরগুলোর সঙ্গে আলাপ-আলোচনায় চীনের দুই বিশেষজ্ঞ সন্তুষ্টিই জানিয়েছেন বলে জানা গেছে।

বিজ্ঞাপন

জানতে চাইলে কৃষি মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব ড. মো. মাহমুদুর রহমান সারাবাংলাকে বলেন, ‘বাংলাদেশি আমের প্রতি চীন বেশ আগ্রহ দেখাচ্ছে। সম্প্রতি তাদের একটি বিশেষজ্ঞ দল দেশের দুই জেলার আম বাগান পরিদর্শন করে গেছেন। চীনে আম রফতানির আগ্রহ আমাদেরও রয়েছে। চীনের রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে কৃষিমন্ত্রীর এ নিয়ে বৈঠক হয়েছে। সেই বৈঠকের পরিপ্রেক্ষিতেই চীনের বিশেষজ্ঞ দলটি বাংলাদেশে এসেছিল। তারা তাদের সরকারকে এ বিষয়ে প্রতিবেদন দেবে।’

চীনে আম রফতানির আশাবাদ জানিয়ে ড. মাহমুদুর বলেন, ‘কথা বলে বুঝতে পেরেছি, প্রতিনিধি দল খুবই সন্তুষ্ট। দেশের আমের মান নিয়ে তারা সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছে। তারা খুব খুশি, আমরাও চীনে আম রফতানির বিষয়ে খুবই আশাবাদী।’

নানা জাতের আমের উপস্থিতি হাটে। সারা দেশে ছড়িয়ে পড়বে এসব আম। ছবি: হাবিবুর রহমান/ সারাবাংলা

এক প্রশ্নের উত্তরে যুগ্ম সচিব বলেন, ‘আম রফতানি নিয়ে চীনের সঙ্গে একটি সমঝোতা চুক্তি (এমওইউ) সই হতে পারে। কীভাবে আম রফতানি হবে, কতটুকু হবে, কোন কোন শর্তের আলোকে হবে— চুক্তিতে এসব বিষয় উল্লেখ থাকবে।’

এদিকে চাইলেই যেকোনো আম চাষি বা ব্যবসায়ীর পক্ষে আম রফতানি করা সম্ভব না। রফতানিযোগ্য আম উৎপাদনের জন্য অনুসরণ করতে হয় বিশেষ প্রক্রিয়া। সেই প্রক্রিয়াকেও সারা দেশে ছড়িয়ে দিতে কাজ করছে সরকার। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের অধীনে ‘রফতা‌নি‌যোগ্য আম উৎপাদন’ শিরোনামে একটি প্রকল্পও চলমান।

বিজ্ঞাপন

রফতানিযোগ্য আম উৎপাদন প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক মোহাম্মদ আরিফুর রহমান সারাবাংলাকে বলেন, ‘গত বছর ৩৬টি দেশে আম রফতানি হয়েছে। এর বাইরে চীন, অস্ট্রেলিয়া, জাপানসহ আরও কিছু দেশ আম নেওয়ার জন্য আগ্রহ দেখিয়েছে। তারা তাদের চাহিদাগুলো (রিকোয়ারমেন্টস) বলেছে। আমরা সেগুলো পূরণ করার চেষ্টা করছি। গ্যাপ (গুড অ্যাগ্রিকালচারাল প্র্যাকটিসেস) সার্টিফিকেট নিশ্চিত করে এখন আম উৎপাদন হচ্ছে। এতে আম রফতানি বাড়বে।’

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর বলছে, এ বছর আবহাওয়ার কারণে আমের উৎপাদন কিছুটা কম হতে পারে। ছবি: হাবিবুর রহমান/ সারাবাংলা

আরিফুর রহমানও চীনে আম রফতানির বিষয়টি অবগত। তিনি বলেন, ‘চীনের একটি প্রতিনিধি দল চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নওগাঁর আম বাগান পরিদর্শন করেছে। তারা আম নেওয়ার জন্য আগ্রহ দেখিয়েছে। চীনের সঙ্গে এ বিষয়ে একটি এমওইউ হওয়ার কথা রয়েছে।’

মন্তব্য জানতে চাইলে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের মহাপরিচালক বাদল চন্দ্র বিশ্বাস সারাবাংলাকে বলেন, ‘বাংলাদেশের আমের ব্যাপারে বিভিন্ন দেশ আগ্রহ দেখাচ্ছে। আমরা বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতদের আম বাগান পরিদর্শন করিয়েছি। তাদের বাংলাদেশের আমের মান দেখিয়েছি। আমরা যে নিরাপদভাবে গুণগত মানসম্পন্ন আম উৎপাদন করছি, আম বাগান পরিদর্শনের মাধ্যমে তারা তা দেখেছেন। এর বাইরে চীনের একটি প্রতিনিধি দলও বাংলাদেশ পরিদর্শন করে গেছে। চীনসহ আর বেশ কয়েকটি দেশ বাংলাদেশের আম নিতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে।’

বাদল চন্দ্র বিশ্বাস আরও বলেন, ‘দেশে আমের উৎপাদন অনেক বেড়েছে। এখন কেবল আম রফতানি নয়, আমাদের লক্ষ্য গুণগত মানসম্পন্ন ও নিরাপদ আম উৎপাদন করা। কারণ দেশেও আমের বাজার অনেক বড়। গত কয়েক বছরে দেশ থেকে আম রফতানির পরিমাণ অনেক বেড়েছে। এ বছর মৌসুমের শুরুর দিকে বৃষ্টি না থাকায় আমের উৎপাদন একটু কম হবে। তারপরও আমরা এ বছর আম রফতানির লক্ষ্যমাত্রা গত বছরের মতোই রেখেছি।’

হাটের এসব আম অবশ্য রফতানির জন্য নয়, দেশের বাজারের জন্য। যারা আম রফতানি করে থাকেন, তারা বিশেষ পদ্ধতিতেই আবাদ করেন আম। ছবি: হাবিবুর রহমান/ সারাবাংলা

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে দেশ থেকে ৩০৯ টন আম রফতানি হয়। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে রফতানি হয় ২৩২ টন। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৩১০ টন, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ২৮৩ টন, ২০২০-২১ অর্থবছরে ৭৯১ টন ও ২০২১-২২ অর্থবছরে এক হাজার ৭৫৭ টন আম রফতানি হয়েছে।

সর্বশেষ ২০২২-২৩ অর্থবছরে আম রফতানি হয়েছে তিন হাজার ১০০ টন। ২০২৩-২৪ অর্থবছরেও সমপরিমাণ আম রফতানির লক্ষ্য রয়েছে। এখন পর্যন্ত এ মৌসুমে আম রফতানি হয়েছে ৫৯৭ টন। তবে অতিরিক্ত বিমান ভাড়ার কারণে এ বছর আম রফতানির লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করা কঠিন হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।

এদিকে গত কয়েক বছর ধরে দেশে আমের উৎপাদন ২১ থেকে ২৭ লাখ টনে ওঠানামা করছে। সর্বশেষ ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশে রেকর্ড ২৭ টন আম উৎপাদন হয়। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে দেশে আমের উৎপাদন হয়েছিল ২১ লাখ ৪৩ হাজার ৫০০ টন, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ২৩ লাখ ৭২ হাজার ২০০ টন, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ২২ লাখ ২৯ হাজার টন, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ২৪ লাখ ৬৮ হাজার টন।

এ ছাড়া ২০২০-২১ অর্থবছরে ২৫ লাখ টন ও ২০২১-২২ অর্থবছরে ২৩ লাখ ৫০ হাজার টন আম উৎপাদন হয়। তবে পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য বলছে, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে আমের উৎপাদন ছিল ১২ লাখ ৮৮ হাজার ৩১৫ টন, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ১১ লাখ ৬৫ হাজার ৮০৪ টন, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ১২ লাখ ১৯ হাজার ৪৫০ টন ও ২০১৯-২০ অর্থবছরে ১২ লাখ ২২ হাজার ৩৬৮ টন।

সারাবাংলা/ইএইচটি/টিআর

Tags: , , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন