বিজ্ঞাপন

কোটা বিরোধী আন্দোলন: জামায়েত ইসলামীর এজেন্ডা বনাম মুক্তিযুদ্ধ

July 5, 2024 | 7:29 pm

শিতাংশু ভৌমিক অংকুর

মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলের আন্দোলন যত বড় হবে জামায়েত ইসলামীর এজেন্ডা তত বেশি শক্তিশালী হবে। গত কয়েক দিন ধরে কোটা আন্দোলন ইস্যুতে উত্তাল সময় পার করছে রাজধানীর বিভিন্ন কলেজ- বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা। কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থী ও তরুণেরা কয়েকদিন পরপরই নেমে আসছে রাজপথে। কোটা আন্দোলনকে সাধারণ শিক্ষার্থীদের আন্দোলন আখ্যা দিয়েছে অনেক প্রগতিশীল ছাত্রনেতা ও প্রগতিশীল চিন্তার বুদ্ধিজীবী এবং সুশীল হিসাবে পরিচিত অনেকে। একই সাথে এই আন্দোলনে সমর্থন দিচ্ছেন তারা । আবার অনেকে বলছে এই আন্দোলনটি স্বাধীনতার বিরোধী শক্তির দীর্ঘ দিনের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কৌশল?

বিজ্ঞাপন

আসলে কোটা আন্দোলন কি আসলেই সাধারণ শিক্ষার্থীদের আন্দোলন? নাকি এর পেছনে কলকাঠি নাড়ছে অন্য কোনো অপশক্তি। এমন প্রশ্ন বহুদিন ধরেই কড়া নাড়ছিল মনের মধ্যে। বিভিন্ন সময়ের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে জানা যায়, কোটা বাতিলের দাবির শুরুটা বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিরোধী রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামী হাত ধরে। তারা যখন ২০০১ সালে যখন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয় তখন নিজেদের নির্বাচনী ইশতেহারে তারাই সর্বপ্রথম সরকারি চাকরির কোটা ব্যবস্থা সংস্কার করার দাবি এবং মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিল করার দাবি উত্থাপন করে।নির্বাচনে বিএনপি-জামাত জোট সরকার জয়ী হওয়ার পর প্রথম জাতীয় সংসদ অধিবেশন বসে ২০০২ সালের ৮ জানুয়ারি। সেখানে রাষ্ট্রপতির ভাষণের ওপর ধন্যবাদ প্রস্তাব ও আলোচনার সময় জামাতের সংসদীয় দলের নেতা এবং যুদ্ধাপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত তৎকালীন শিল্পমন্ত্রী মতিউর রহমান নিজামীর মুখ থেকে। তিনিই প্রথম বলেন যে, মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিল করে দেওয়া দরকার। কারণ এই কোটার অপব্যবহার হচ্ছে, অপচয় হচ্ছে। সংসদে নিজামী আরও বলেন, আলাদা মুক্তিযোদ্ধা কোটা রাখার কোনো প্রয়োজন নেই, পুরো কোটা ব্যবস্থারই সংস্কার করা দরকার।এরপর জামাতের আরেক নেতা, যুদ্ধাপরাধের দায়ে আমৃত্যু কারাদণ্ড ভোগকারী দেলোয়ার হোসেন সাঈদী ২০০৩ সালে ৩৩ তম বাজেট অধিবেশনে বাজেটের ওপর আলোচনার সময় মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলের জন্য দাবি উত্থাপন করেন এবং কোটা সংস্কারের দাবি করেন।

একই অধিবেশনে যুদ্ধাপরাধী মাওলানা আবদুস সোবহানও মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলের দাবি তোলেন। এই দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সংসদে কোটা সংস্কারের বিষয়টি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হবে এমন আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া সংসদে ভাষণে বলেছিলেন, কোটা সংস্কার হওয়া উচিত। তবে বিভিন্ন কারণে এ বিষয়ে তখন আর অগ্রসর হতে পারেনি বিএনপি-জামাত জোট সরকার।

সে সময়টাতে মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিল ইস্যুতে বেশি আগাতে না পারলেও নিজেদের এজেন্ডা থেকে বিষয়টিকে কখনো বাদ দেয়নি জামায়াতে ইসলামী। মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলের উদ্দেশ্যে ভেতরে ভেতরে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে গেছে সংগঠনটি। তার ধারাবাহিকতায় এবার সাধারণ শিক্ষার্থীদের আবেগ পুঁজি করে শিবিরের ক্যাডারদের নেতৃত্বে তাদের আন্দোলন করতে মাঠে নামিয়েছে মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী এই শক্তিটি। যেখানে সাধারণ শিক্ষার্থীদের আন্দোলন করার কথা ছিল আধুনিক -কর্মমূখী শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে সেখানে তারা আজ আন্দোলন করছে সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটা সহ অন্যান্য কোটা বাতিলের দাবিতে।

বিজ্ঞাপন

বাংলাদেশের মতো জনসংখ্যাবহুল উন্নয়নশীল দেশে শিক্ষার্থী যেখানে হাতে কলমে ও কাজে পারদর্শী হয়ে উদ্যোক্তা হয়ে উঠার কথা সেখানে তারা সরকারি আমলা হওয়ার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। এই উঠেপড়ে লাগার পিছনে কারণ কি? এমন প্রশ্নের উত্তর অনেকে হাসি ঠাট্টায় বলে থাকেন নিরাপদ জীবন ও দীর্ঘ মেয়াদি জীবিকার জন্য। আমার কাছেও তাই মনে হয়েছে।সরকারি আমলা হলে জীবন একেবারে নিশ্চিত সুখময়। তবে এটা সত্য সরকারি চাকরি বাংলাদেশের অন্যসকল বেসরকারি চাকরির চেয়ে বেশি নিরাপদ ও স্বাচ্ছন্দ্যের হয়ে থাকে।তাই হয় তো বাংলাদেশ সিভিল সাভির্স পরীক্ষায় একটি আসনের বিপরীতে ২০০ এর অধিক চাকরি প্রত্যাশী অংশ গ্রহণ করে।এই দেশে মানুষ এত নিরাপত্তাহীনতায় ভুগে তাই বোধ হয় তারা একটি সরকারি চাকুরির জন্য এত হাহাকার। তাহলে কি আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা সেভাবে সৃষ্টিশীল মানুষ বা উদ্যোক্তার জন্ম দিতে পারছে না নাকি তা সমাধানে সরকারি উদ্যোগ আসলে কাজে আসছে না?

আমাদের তরুণ শিক্ষার্থী বন্ধুরা এসব না ভেবেই মুক্তিযোদ্ধা সহ পিছিয়ে পড়া মানুষের কোটা বাতিল ও সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন করছে। যদিও শুরুর দিকে আন্দোলনকারীদের দেখা গিয়েছিল বঙ্গবন্ধুর ছবি হাতে রাস্তায় নামতে কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তি বা সাধারণ শিক্ষার্থীদের ক্যামোফ্লাজের আড়ালে এই আন্দোলনের মূল টার্গেটই ছিল মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিল করা।যত দিন গেছে আন্দোলনের পেছনের এই মূল উদ্দেশ্য স্পষ্ট হয়ে গেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে পুলিশের গুলিতে ছাত্র মারা গেছে, ছাত্রলীগনেত্রী এক ছাত্রীর পায়ের রগ কেটে দিয়েছে এ ধরনের গুজব ছড়িয়ে আন্দোলনকারীরা ক্রমাগত দেশের পরিস্থিতি উত্তপ্ত করে গেছেন অনেকে। ক্ষমতাশীল দলের ছাত্র সংগঠন খুব একটা সাধু না হলেও তারা কিন্তু এসব করে নি সম্প্রতি কালে। অনেক সময় দেখা গেছে, কোটা আন্দোলনের নেতৃত্বরা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ভাবে সরকারি দলের ছাত্র সংগঠনে নেতা-কর্মী লোক হিসাবে পরিচিত বা তারা আসলে অনেকে সাধারণ শিক্ষার্থীদের খোলসে ছাত্র শিবিরের ক্যাডার। কোটা সংস্কার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক পরিচয়ের জন্ম নূরুল হক নূরের। কোটা সংস্কার আন্দোলনে মাধ্যমে মিডিয়া কাভারেজ পেয়ে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিপি থেকে এখন রাজনৈতিক নেতা। তার বক্তব্য শুনলে বোঝা যায় সে আসলে কেমন বাংলাদেশ চায় তার এজেন্ডা অনেক টা জামায়াতে ইসলামীর এজেন্ডার মতো। তিনি নাকি আবার ছাত্রলীগ করেছেন।

কোটা বাতিল বা সংস্কারের আন্দোলন হওয়ার কথা ছিল প্রগতিশীল চিন্তার মানুষের হাত ধরে তিনপ্রজন্ম পর মুক্তিযোদ্ধা কোটা বা অন্যান্য কোটা কারা পাবে।কিন্তু সেগুলো নিয়ে সরকার ও প্রগতিশীল মানুষদের কোন মাথা নেই। কোটা আন্দোলনের মূল নেতৃত্বদের কথা থেকেও স্পষ্ট হয়েছে, কোটা আন্দোলনের মূল লক্ষ্য মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিল করা। বারবার তাদের কথায় উঠে এসেছে তাদের আপত্তির জায়গাটি ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটা। কোটা আন্দোলন যে সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের আন্দোলন নয়, এর পেছনে যে কলকাঠি নাড়ছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিরোধী অপশক্তি তা সময়ের সঙ্গে দিনের আলোর মতো পরিষ্কার হয়ে উঠেছে।

বিজ্ঞাপন

জামাত মুক্তিযোদ্ধা কোটার বিরোধিতা করবে এ নিয়ে বিস্ময়ের কিছু নেই। জামাত একাত্তরের পরাজিত শক্তি। বাংলাদেশের স্বাধীনতার, বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠারই বিরোধী তারা। এই বিরোধিতা একাত্তরে নিকৃষ্টতম রূপ ধারণ করেছিল। নির্বিচার হত্যা, ধর্ষণ, রাহাজানি চালিয়েছিল তখন জামায়াতে ইসলামী।

স্বাধীনতার পর ৫৩ বছর কেটে গেছেন , রাজাকার-আলবদরদের গাড়িতে জাতীয় পতাকা ওঠার মতো লজ্জাজনক ঘটনা ঘটেছে, কিন্তু জামায়াতে ইসলামীর রাজনৈতিক অবস্থানে কোনো হেরফের হয়নি। তাই জামাত যখন থেকে প্রকাশ্য রাজনীতি করার সুযোগ পেয়েছে তখন থেকেই মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছে।

লেখক: সংবাদকর্মী

বিজ্ঞাপন
প্রিয় পাঠক, লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই ঠিকানায় -
sarabangla.muktomot@gmail.com

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত মতামত ও লেখার দায় লেখকের একান্তই নিজস্ব, এর সাথে সারাবাংলার সম্পাদকীয় নীতিমালা সম্পর্কিত নয়। সারাবাংলা ডটনেট সকল মতাদর্শের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তবে মুক্তমতে প্রকাশিত লেখার দায় সারাবাংলার নয়।

সারাবাংলা/এজেডএস

Tags: ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন