বিজ্ঞাপন

যশোরে ‘জিন সাপ’ দংশন আতঙ্ক, হাসপাতালে ১০ জন

July 9, 2024 | 10:37 pm

ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট

যশোর: যশোরের চৌগাছা উপজেলার রাণীয়ালি গ্রামে ‘কথিত সাপের কামড়ে’ অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন রোগীরা। অসুস্থদের দাবি ‘জিন সাপে’ তাদের কামড়েছে। গত এক সপ্তাহে অজানা এই সাপের কামড়ে আক্রান্ত হয়েছেন অন্তত ৩০ জন। এর মধ্যে যশোর জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন ১০ জন। বাকীরা স্থানীয় ওঁঝা ও কবিরাজের কাছে চিকিৎসা নিয়েছেন। তবে চিকিৎসকরা বলছেন, তারা মানসিক আতঙ্কে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।

বিজ্ঞাপন

স্থানীয় পাশাপোল ইউনিয়নের ইউপি সদস্য গোবিন্দ চন্দ্র ঢালী জানান, গত বুধবার রাতে সাপে দংশনের শিকার হন রাণিয়ালি গ্রামের আব্দুর হকের স্ত্রী রাবেয়া বেগম। যশোর জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় পরদিন রাবেয়ার মৃত্যু হয়। তারপর থেকে এলাকায় সাপ আতঙ্ক বিরাজ করছে। সাপে কামড়েছে দাবি করে অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। কিন্তু কেউ সাপ দেখেননি।

তিনি বলেন, শরীরে জ্বালাপোড়া আর জ্ঞান হারানো ঘটনা ঘটলেই ওঁঝা কবিরাজদের কাছে যাচ্ছেন সবাই। ওঁঝারা শরীরে বিষের উপস্থিতি নিশ্চিত করলেই কেউ হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন, কেউ বা স্থানীয় পল্লী চিকিৎসক ও কবিরাজের কাছে চিকিৎসা নিচ্ছেন। এ পর্যন্ত গ্রামটিতে ৩০ জন আক্রান্ত হয়েছেন। ১০ জনের মতো যশোর সদর হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন।

বিজ্ঞাপন

যশোর জেনারেল হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, শুধুমাত্র চৌগাছা উপজেলার পাশাপোল ইউনিয়নের রানিয়ালি গ্রাম থেকে রোববার (৭ জুলাই) ও সোমবার (৮ জুলাই) ১০ জন রোগী কোনো কিছুর দংশনের শিকার হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এর মধ্যে নারী ৮ জন ও দুইজন পুরুষ।

হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, ওই ব্যক্তিদের কারো কারো হাত ও পায়ে লাল দাগ আবার দাগ ছাড়াও কেউ কেউ ভর্তি হয়েছেন। ১০ জনকেই ভর্তি রেখে পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে। সাপে কামড়ানোর তেমন কোনো লক্ষণ দেখা যায়নি। তাই অ্যান্টিভেনাম ইনজেকশন দেওয়া হয়নি তাদের।

যশোর জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি রাণিয়ালি পশ্চিমপাড়ার এলাকার মিথুন মন্ডলের স্ত্রী প্রান্ত মন্ডল (৩৩) বলেন, ‘সোমবার সকালে রান্নাঘরের শুকনা কাঠ সাজাচ্ছিলাম। এ সময় হাতে কিছু একটা কামড় দিলে জ্বলে উঠে। হাতের ডান হাতের কবজিতে লাল দাগ সৃষ্টি হয়। বাড়ির লোকজনের পরামর্শে স্থানীয় ওঁঝার কাছে গেলে তিনি আমার শরীরে বিষের উপস্থিতি আছে বলে জানান। এর পর গতকাল রাতে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছি।’

বিজ্ঞাপন

রাণীয়ালি হাই স্কুলপাড়া এলাকার উৎপল মন্ডলের স্ত্রী তমালিকা (২২) বলেন, রাতে ঘুমিয়ে ছিলাম। সকালে দেখি হাতে জ্বলছে। এক পর্যায়ে হাত অবশ হয়ে যায়। সেখানে কিছু একটা কামড়ের দাগ রয়েছে। ওঁঝার কাছে গেলে বিষের উপস্থিতি আছে বললে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছি। এখন অনেকটা সুস্থ বোধ করছি।

স্থানীয় বাসিন্দা সন্তোষ কুমার মন্ডল বলেন, ‘কয়েকদিন আগে একজন মারা যাওয়ার পর থেকে সাপ আতঙ্কে রয়েছি আমরা। কিন্তু সাপ দেখেনি কেউ। কবিরাজ, ওঁঝার কাছে গেলে তারা বলছে, জিন সাপে কেটেছে। জিন সাপ তার নাতনীর পায়ে কামড়ায়। এরপর ঝিকরগাছার বাঁকড়া ওঁঝার কাছে নিয়ে গেলে ঝাড়ফুঁক করেছেন। চার হাজার টাকার বিনিময়ে ওঁঝার থেকে ঝাড়ফুঁক নেন। কিছুটা সুস্থ হলেও স্থানীয়দের পরামর্শে নাতনীকে হাসপাতালে এনেছি।

তিনি দাবি করেন, তাদের পরিবারের একজনসহ গত এক সপ্তাহে রাণিয়ালি গ্রামে প্রায় অর্ধশতাধিক মানুষকে জিন সাপ কামড়েছে।

যশোর জেনারেল হাসপাতালের মহিলা মেডিসিন বিভাগের সিনিয়র নার্স শিউলি সরকার বলেন, মহিলা মেডিসিন ওয়ার্ডে বর্তমানে আটজন রোগী ভর্তি রয়েছেন। তারা বলছেন, তাদের সাপে কেটেছে। তবে সাপে কাটার তেমন কোনো লক্ষণ দেখা যায়নি। তাদের ২৪ ঘণ্টা পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে। তারা সবাই সুস্থ রয়েছেন।

বিজ্ঞাপন

এদিকে, গ্রামের বেশ কয়েকজন জানান, সাপে কাটার কথা শোনা গেলেও কেউ এখনও সাপ দেখেননি। কবিরাজ-ওঁঝারা বলছেন, এটি জিন সাপ। গ্রামের সাধারণ মানুষ তা বিশ্বাসও করছেন। তাই গ্রামবাসীর রাতের ঘুম হারাম হয়ে গেছে। অনেকেই স্থানীয় ওঝা কবিরাজের কাছে চিকিৎসা নিচ্ছেন। অনেকেই হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হচ্ছেন।

জিন সাপে আতঙ্কের সুযোগ নিয়েছেন স্থানীয় ওঁঝা, সাপুড়ে, কবিরাজরাও। জিন সাপে দংশিত হচ্ছে মানুষ- এমন আতঙ্ক ছড়িয়ে তারা লুটে নিচ্ছে জনসাধারণের অর্থ।

যশোর হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের ডাক্তার আবু হায়দার মোহাম্মাদ মনিরুজ্জামান বলেন, কোনো রোগীকে সাপে কামড় দেয়নি। সবাই আতঙ্কে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। মেডিকেলের ভাষায় এই রোগকে বলা হয় ‘ম্যাসহিস্ট্রিরিয়া ইলনেস’। এটি মূলত মানুষের নিউরো হরমোন ও মানসিক দ্বন্দ্বের কারণে হয়ে থাকে।

যশোর জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. হারুন অর রশিদ বলেন, অনেকেই আতঙ্কে ভর্তি হচ্ছেন। ভর্তি রোগীরা সবাই সুস্থ রয়েছেন।

তিনি বলেন, মানুষকে আতঙ্কিত না হয়ে সচেতন হতে হবে। বাড়িঘরের ঝোপঝাড় পরিষ্কার রাখতে হবে। কোনো সাপ কামড়ালে সরাসরি হাসপাতালে চলে আসা উচিত। এছাড়া সাপে কামড়ালে সেটির ছবি তুলে রাখতে পারলে চিকিৎসা দেওয়া অনেকটাই সহজ হয়। হাসপাতালে সাপে কাটার ওষুধের কোনো সংকট নেই।’

জিন সাপের কামড় সম্পর্কে তিনি জানান, এই ধরণের রোগীকে ডাক্তারী শাস্ত্র অনুযায়ী ‘মাস সাইকোজেনেটিক ইলনেস’ বলা হয়।

সারাবাংলা/এনইউ

Tags: , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন