বিজ্ঞাপন

কোটার প্রয়োজনীয়তা কেন?

July 10, 2024 | 3:55 pm

শিশির ওয়াহিদ

সামাজিক অগ্রগতির ধারা চলমান রাখতে পিছিয়ে পড়া অনগ্রসর জনগোষ্ঠী, বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন ব্যক্তি, সুবিধাবঞ্চিত নারী, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জন্য কোটা একপ্রকার বাধ্যতামূলক। এতে করে সামাজিক ভারসাম্য রক্ষা হয়, পিছিয়ে পড়াদের মূলধারায় যুক্ত করা যায়। সবাই সুবিধাপ্রাপ্ত প্রিভিলেজ্ড পরিবার থেকে বেড়ে উঠে আসবেনা, সুবিধাবঞ্চিতদের এই বিশেষ সুবিধা রাষ্ট্র প্রদান করবে। শুধু বাংলাদেশে নয়, পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে সমতার ভিত্তিতে এগিয়ে নিতে কর্মসংস্থানসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধায় সারা বিশ্বে কোটা সংরক্ষণ ব্যবস্থা প্রচলিত।

বিজ্ঞাপন

বৈষম্যমূলক কোটা বাতিল আন্দোলনের নামে শিক্ষার্থীদের একাংশের যে তৎপরতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে, তা বেশ সন্দেহজনক এবং বিভ্রান্তিকর। কেন সন্দেহজনক তা আমি লেখার পরবর্তী অংশে আলোচনা করবো। আন্দোলনের শিরোনাম ‘বৈষম্যমূলক কোটা বাতিল’ হলেও তাদের উদ্দেশ্যটাই বৈষম্যমূলক মনে হয়েছে। তারা লড়ছে কোটা বাতিলের পক্ষে। প্রশ্ন থেকে যায়, তাহলে ঐ অনগ্রসর জনগোষ্ঠী, হাত-পা না থাকা ব্যক্তিটি কিংবা গোঁড়ামিকে পিছনে ঠেলে ফুটবল-ক্রিকেট খেললো যে নারীটি, তাদের পরিণতি কী হবে? কোটা বাতিল নয়, বরং মূখ্য দাবি এবং শিরোনাম হওয়া উচিত ছিলো কোটার সুষ্ঠু প্রয়োগ। কিছু কোটার সংখ্যা বেশি মনে হলে তা পুনঃনির্ধারণ বা পুনর্বিন্যাসের দাবি রাখা যেতে পারে, গঠনমূলক ও যৌক্তিক উপায়ে আইনি প্রক্রিয়াতেও এগোনো যেতে পারে, যেহেতু প্রক্রিয়াটা আদালতে বিচারাধীন। তবে তা কোনোমতেই বাতিল নয়। কিন্তু তারা সেসব করলেন না। অথর্ব নুরুল হক নুরের পদাঙ্ক অনুসরণ করে তারাও নেমে পড়লেন হাওয়ায় গা-ভাসাতে।

এখন আসি সন্দেহের প্রসঙ্গে। ২০১৮ সালে আন্দোলনের পর কোটাপ্রথা রহিত রাখতে সরকার আপিল করেছিল, একজন মুক্তিযোদ্ধা সন্তানের রিটের পরিপ্রেক্ষিতে সম্প্রতি আদালত মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিল অবৈধ ঘোষণা করেন। সরকারের সিদ্ধান্ত বহাল রাখতে সরকার সুপ্রিম কোর্টে আপিলও করেছে, অর্থাৎ সরকার আন্দোলনকারীদের পক্ষেই আপিল করেছে, আন্দোলনকারীরা চুড়ান্ত রায়ের অপেক্ষা করতে পারতো। এরইমধ্যে তাদেরকে পথে নামালো কারা? কোন অপশক্তি?

দেখুন, মুক্তিযুদ্ধের প্রশ্নে কোনো বাঙালির সমস্যা থাকবার কথা নয়। সমস্যা নিয়াজীর ঔরসজাত সন্তানদের থাকতে পারে। মুক্তিযুদ্ধবিরোধী একটি পক্ষ বরাবরই অতিউৎসাহী। এই যে এদেশে দাঁড়িয়ে যেসব আন্দোলন করছে, যাদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে এই দেশটা স্বাধীন করেছে কারা? মুক্তিযোদ্ধারা। দেশ স্বাধীনের পর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালে বীরমুক্তিযোদ্ধাদের জন্য উপহার হিশেবে কোটা চালু করেছিলেন। এই সুবিধাও বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। কেননা মুক্তিযোদ্ধারা এতটাই হতভাগা যে, বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি তারা উপহার দিলেও একটা সময় পর্যন্ত নিজেদের পরিচয় পর্যন্ত গোপন রেখে চলতে হয়েছে। ১৯৭৫-এ শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার সাথে-সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের ভাগ্যটাও একপ্রকার নির্ধারণ হয়ে যায়। কাউকে ঝুলতে হয়েছে জিয়াউর রহমানের ফাঁসিকাষ্ঠে, কাউকে-বা যাযাবরের মতো এদিক-ওদিক ঘুরে, কোনো কোনো মুক্তিযোদ্ধা ভুগেছেন আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে। ১৯৭৫ থেকে ১৯৯৬ সাল, দীর্ঘ ২১ বছর তাদেরকে কাটাতে হয়েছে দুর্বিষহ জীবন, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে পরিবারটা। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ পুনরায় ক্ষমতায় আসবার পর বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের জন্য নতুনভাবে কোটা ব্যবস্থা চালু করেন। প্রয়োজনীয়তা আছে বলেই তিনি চালু করেছেন। এ-প্রসঙ্গে ঢাবির সাবেক উপাচার্য আ.আ.ম.স আরেফিন সিদ্দিক স্যার একটি লেখায় বলেছেন, “মুক্তিযোদ্ধাদের কোটা অত্যন্ত যুক্তিযুক্ত। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর মুক্তিযোদ্ধারা কোটার সুবিধা পাননি। সে কারণে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর আবার মুক্তিযোদ্ধাদের কোটা চালু করা হলো। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের তখন আর বয়স ছিল না। তাই তাদের সন্তানদের জন্য উন্মুক্ত করা হলো, পরবর্তী সময়ে মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-নাতনিদের কোটা সুবিধার আওতায় আনা হলো।”

বিজ্ঞাপন

রক্ত দিয়ে জীবন বাজি রেখে মুক্তিযোদ্ধারা এদেশটা স্বাধীন করেছে, তাদের জন্ম দেওয়া দেশেও তাদেরকে বঞ্চিত-ব্যথাহত বুকে চলতে হয়েছে। অতএব, সুবিধা শুধু তারা নয়— তাদের চৌদ্দগুষ্ঠি পাবে, অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পাওয়া উচিত। এতে সমস্যা অকৃতজ্ঞ নিয়াজীপুত্র ব্যতীত কারো হওয়ার কথা নয়। কেউ-কেউ বলছে কোটা মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য অপমান! তারা কোন যুক্তিতে এগুলো বলে আমার বোধগম্য নয়। সব মুক্তিযোদ্ধা সচ্ছল নয়। সবার পরিবার আরাম-আয়েশে দিনাতিপাত করছেনা। কোটা ব্যবস্থার মাধ্যমে রাষ্ট্র তাদেরকে সম্মানিত করছে, সামান্য কিছু সুবিধা দিচ্ছে। উপকারির প্রতি কৃতজ্ঞতাস্বরূপ প্রতিদান দেওয়া প্রয়োজন আছে। উপকারী কখনো চেয়ে নিবেনা, বরং আমারই উচিত তাকে উপকার প্রদান করা। মুক্তিযোদ্ধারা দেশটা স্বাধীন করেছে, রাষ্ট্রের উচিত তাদের পরিবারের সুবিধা নিশ্চিত করা। রাষ্ট্র তার দায়িত্ব পালন করছে। এখন কোনো মুক্তিযোদ্ধা চাইলে সেই সুবিধা নেবে, কেউ না-চাইলে নেবেনা। এতে সমস্যা দেখিনা, আমি বেশকিছু মুক্তিযোদ্ধাকে দেখেছি এ-সুবিধা না নিতে। মুক্তিযোদ্ধাদের একটা নির্দিষ্ট প্রজন্ম পর্যন্ত এই সুবিধা পাওয়া উচিত।

আন্দোলনকারীদের আরো ভালোভাবে বিবেচনার প্রয়োজন আছে। যেভাবে এগোচ্ছে, তাতে করে এই আন্দোলন ছিনতাই হতে বেশি দেরি করবেনা। ইতোপূর্বে আমরা দেখেছি এসব আন্দোলনকে পুঁজি করে দেশ ও মুক্তিযুদ্ধবিরোধী একটি অপশক্তি নিজেদের স্বার্থ হাসিল করতে তৎপর ভূমিকা পালন করেছে। এখন উচিত আন্দোলনকারী ও সরকার বিষয়টি উভয়পক্ষে আলোচনা করে সমতার ভিত্তিতে শান্তিপূর্ণ সমাধানের দিকে যাওয়া। পিছিয়ে পড়া, অনগ্রসর, অস্বচ্ছল আর ত্যাগী মুক্তিযোদ্ধা পরিবারগুলো বঞ্চিত না-হোক, একইসাথে পরিশ্রমী মেধাবীরা সন্তুষ্টির সাথে চাকরিক্ষেত্রে প্রবেশ করুক।

আবার, আমাকে সরকারি চাকরিই করতে হবে— এই মানসিকতাটাও ভয়ংকর। চাকরিই জীবনের একমাত্র লক্ষ্য হওয়া উচিত নয়। আত্মকেন্দ্রিক চাকরিমুখী এই প্রজন্মটায় রাজপথে নেমেছে, কেননা তারা নিজেদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে উদাসীন এবং এ-ব্যতীত তাদের গন্তব্যস্থল নেই। রাষ্ট্রকে এই প্রজন্মটার ব্যাপারে ভাবতে হবে। একইসাথে ইতোপূর্বে ঘটে যাওয়া কোটা বিরোধী আন্দোলনের পর কতজন আন্দোলনকারী মেধার ভিত্তিতে চাকরিতে প্রবেশ করেছে, সেটাও আন্দোলনকারীদের ভাবা উচিত। কেননা আমরা দেখেছি ২০১৮ সালের পর কোটা বিরোধী আন্দোলনের কোনো-কোনো নেতাকে বিকাশ-রকেটে খয়রাতি করতে, কাউকে দেখেছি সড়কে আম-জাম ও মলম বিক্রি করতে।

বিজ্ঞাপন

একইসাথে কোটার প্রার্থী মানেই সে মেধাবী নয়, এই ধারণা থেকেও আন্দোলনকারীদের সরে আসা প্রয়োজন। আমরা কাকে মেধাবী বলছি, কোন ভিত্তিতে বলছি সেটা বিবেচনার বিষয়। তোতা পাখির মতো গোটা কতক বই-পুস্তক মুখস্থ করে উগলে দিয়ে চাকরিতে উত্তীর্ণ হওয়াকে যদি মেধা বলা যায়, তবে নিঃসন্দেহে তা সংকীর্ণ আর নিম্নরুচির পরিচায়ক। এই চিন্তার খরা কাটাতে হবে, ভাবনার প্রাচীর ভাঙতে হবে।

আরো একটি মজার বিষয় হচ্ছে, ২০১৩ তে স্বাধীনতাবিরোধী ও যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে শাহবাগে হওয়া আন্দোলনকে বহু পাকিস্তানপন্থী তরুণ ভালো দৃষ্টিতে দেখেন না। তারা গালাগালির মতো করে একটি শব্দ বানিয়েছেন— ‘শাহবাগী’। শব্দটাকে নেতিবাচকরূপে উপস্থাপন করে একধরনের সুখ নেয়। এখন তাদেরই বিশাল একটা অংশকে দেখলাম মুক্তিযোদ্ধা কোটা বিরোধী আন্দোলনে সেই শাহবাগেই বসে যেতে। শাহবাগ’ই তাদের এখন কেন্দ্রস্থল। অর্থাৎ আপনি যে পন্থীই হন-না কেন, ঘুরেফিরে আপনাকে শাহবাগী হতে হবেই, এই শাহবাগ আপনাকে ছাড়বেনা। বিষয়টি মাথায় রাখা প্রয়োজন।

এখনও অবধি আমার কাছে যেটা মনে হয়েছে, সরকার আন্দোলনকারীদের প্রতি সহনশীল। কিন্তু আন্দোলনকারীরা অসহিষ্ণুতা ও হটকারিতার পরিচয় দিচ্ছে। কোটা এসেছে ভারসাম্য রক্ষার জন্য, বৈষম্যের জন্য নয়। সময় পরিবর্তনের সাথে কোটার যৌক্তিক সংস্কার হতে পারে, কোন কোটা কত শতাংশ রাখা যেতে পারে তা বৈজ্ঞানিক উপায়ে প্রয়োগ করা যেতে পারে, তবে কোনোমতেই বাতিল নয়। আন্দোলনকারীদের এই শব্দটি (বাতিল) উচ্চারণে সতর্ক থাকা উচিত। বয়সটা জোশের, আন্দোলন ভুল উদ্দেশ্য নিয়ে করে শক্তি ক্ষয় করবেন না।

লেখক: শিক্ষার্থী, এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ

বিজ্ঞাপন
প্রিয় পাঠক, লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই ঠিকানায় -
sarabangla.muktomot@gmail.com

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত মতামত ও লেখার দায় লেখকের একান্তই নিজস্ব, এর সাথে সারাবাংলার সম্পাদকীয় নীতিমালা সম্পর্কিত নয়। সারাবাংলা ডটনেট সকল মতাদর্শের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তবে মুক্তমতে প্রকাশিত লেখার দায় সারাবাংলার নয়।

সারাবাংলা/এসবিডিই

Tags: , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন