বিজ্ঞাপন

‘নির্বাহী বিভাগের প্রতিশ্রুতি পেলে তবেই রাজপথ ছাড়ব’

July 10, 2024 | 7:51 pm

ঢাবি করেসপন্ডেন্ট

সরকারি চাকরিতে কোটাব্যবস্থার যৌক্তিক সংস্কার বিষয়ে নির্বাহী বিভাগের আদেশ বা প্রতিশ্রুতি না পাওয়া পর্যন্ত রাজপথ ছাড়বেন না কোটাবিরোধী আন্দোলনকারীরা। বরং গত কয়েক দিনের ধারাবাহিকতায় আগামীকালও তাদের ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে।

বিজ্ঞাপন

বুধবার (১০ জুলাই) সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে শাহবাগ চত্বরে কোটাবিরোধী আন্দোলনের মূল মঞ্চ থেকে আন্দোলনের সমন্বয়করা এ ঘোষণা দিয়েছেন।

আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) শিক্ষার্থী সারজিস আলম বলেন, ‘নির্বাহী বিভাগ থেকে (কোটা বাতিল বা কোটাব্যবস্থার যৌক্তিক সংস্কারের) আদেশ দিলে আমরা আন্দোলন বন্ধ করে দেবো। কিংবা নির্বাহী বিভাগ থেকে এ বিষয়ে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলে তবেই আমরা রাজপথ ছাড়ব।’

এ সময় কেবল প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণি নয়, সব ধরনের সরকারি চাকরিতে তিন ধরনের গোষ্ঠীর জন্য সর্বোচ্চ ৫ শতাংশ কোটা রাখা যেতে পারে বলে আন্দোলনকারীদের পক্ষ থেকে জানান সারজিস। বলেন, বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তান, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ও প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর জন্য সব মিলিয়ে ৫ শতাংশ কোটা রাখা যেতে পারে। তবে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-নাতনির জন্য কোটা রাখা চলবে না।

বিজ্ঞাপন

আরও পড়ুন-

বলেন, আগামীকাল (বৃহস্পতিবার, ১১ জুলাই) বিকেল সাড়ে ৩টা থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে থেকে বাংলা ব্লকেড কর্মসূচি শুরু হবে। সারা দেশের সব গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে এই কর্মসূচি চলবে।

বিজ্ঞাপন

এর আগে বুধবার সকাল থেকেই বাংলা ব্লকেড কর্মসূচির অধীনে ঢাকার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সড়ক দখলে নিতে থাকেন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা। শাহবাগ চত্বর, সায়েন্স ল্যাবরেটরি মোড়, নিউমার্কেট, চানখাঁরপুল, জিপিও-জিরো পয়েন্ট, আগারগাঁও, তেজগাঁও, মহাখালী, ফার্মগেটসহ গুরুত্বপূর্ণ সব সড়ক অবরোধ করেন তারা। এতে ঢাকার বেশির ভাগ সড়কই স্থবির হয়ে পড়ে। ব্যাপক ভোগান্তিতে পড়তে হয় রাজধানীবাসীকে।

এ দিন প্রথমবারের মতো অবরোধ করা হয় রেলপথও। ফলে রাজধানী ঢাকার সঙ্গে সারা দেশের রেল যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। কেবল ঢাকা নয়, সারা দেশেই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়সংলগ্ন এলাকায় সড়ক-মহাসড়ক ও রেলপথ অবরুদ্ধ হয়ে থাকে দিনভর।

যে কারণে আন্দোলন

২০১৮ সাল পর্যন্ত সরকারি চাকরিতে মোট ৫৬ শতাংশ কোটা প্রচলিত ছিল। এর মধ্যে ৩০ শতাংশ ছিল বীর মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের সন্তান-নাতি-নাতনি কোটা, ১০ শতাংশ নারী কোটা, ১০ শতাংশ জেলা কোটা, ৫ শতাংশ ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী কোটা ও ১ শতাংশ প্রতিবন্ধী কোটা। এই কোটা পদ্ধতি সংস্কার করে সব ধরনের কোটা ১০ শতাংশের মধ্যে নামিয়ে আনার দাবিতে ওই বছর আন্দোলন শুরু করেন শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশীরা।

‘ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদে’র ব্যানারে ওই আন্দোলন সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। আন্দোলনের মুখে ওই বছরের ৪ অক্টোবর পরিপত্র জারি করে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরিতে (নবম থেকে ১৩তম গ্রেড) সব ধরনের কোটা বাতিল করে সরকার। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের বিধি-১ শাখা থেকে জারি করা প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, ৯ম গ্রেড (আগের প্রথম শ্রেণি) ও ১০ম থেকে ১৩তম গ্রেড (আগের দ্বিতীয় শ্রেণি) পদে সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে মেধা তালিকার ভিত্তিতে নিয়োগ দিতে হবে। ওই পদগুলোতে সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে বিদ্যমান কোটা পদ্ধতি বাতিল করা হলো।

বিজ্ঞাপন

শিক্ষার্থীদের অবরোধে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায় রাজধানীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সড়কে। ছবি: সারাবাংলা

 

ওই পরিপত্র চ্যালেঞ্জ করে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও প্রজন্ম কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের পক্ষ থেকে ২০২১ সালের জুন মাসে হাইকোর্টে রিট করা হয়। রিটের শুনানি নিয়ে ২০২১ সালের ৬ ডিসেম্বর বিচারপতি মো. মজিবুর রহমান মিয়া ও বিচারপতি মো. কামরুল হোসেন মোল্লার সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ রুল জারি করেন। ৯ম থেকে ১৩ম গ্রেড পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধা কোটা সংরক্ষণের সিদ্ধান্ত বাতিল করে জারি করা পরিপত্র কেন আইনি কর্তৃত্ব বহির্ভূত ও অবৈধ ঘোষণা করা হবে না, তা রুলে জানতে চান আদালত। গত ৫ জুন ওই রিটেরই রায়ে পরিপত্রের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের কোটা বাতিলের অংশটি হাইকোর্ট অবৈধ ঘোষণা করেন।

এরপরই শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশীরা আবার ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে’র ব্যানারে নতুন করে কোটাবিরোধী আন্দোলন শুরু করেন। এর অংশ হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের প্রায় সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েই শিক্ষার্থীরা জুলাইয়ের প্রথম দিন থেকে সড়কে রয়েছেন।

সর্বশেষ কী ঘটল আদালতে

হাইকোর্ট থেকে সরকারের ২০১৮ সালের পরিপত্রের একাংশ বাতিল করে যে রায় তার বিরুদ্ধে আপিল করেছিল রাষ্ট্রপক্ষ। গত রোববার (৪ জুলাই) সেই আপিলের শুনানি হওয়ার কথা ছিল আপিল বিভাগে। তবে সেদিন আদালত আদালত শুনানি নেননি। পরে শুনানি নেওয়ার কথা জানান। তবে আপিল বিভাগ শুনানি না নেওয়ায় হাইকোর্টের রায়ই বহাল থাকে। ফলে শিক্ষার্থীরাও আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন।

এর মধ্যে আন্দোলনকারীদের পক্ষ থেকেও কোটা বাতিলের বিষয়ে আবেদন করা হয় আদালতে। আজ বুধবার (১০ জুলাই) আপিল বিভাগ রাষ্ট্রপক্ষের আপিল ও শিক্ষার্থীদের আপিলের শুনানি একসঙ্গে নিয়ে হাইকোর্টের রায়ে স্থিতাবস্থা জারি করেন চার সপ্তাহের জন্য। প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বাধীন সুপ্রিম কোর্টের পাঁচ সদস্যের আপিল বেঞ্চ এ বিষয়ে আগামী ৭ আগস্ট শুনানির জন্য দিন নির্ধারণ করে দেন।

সড়কের পাশাপাশি বুধবার সারা দেশে রেলপথও অবরোধ করা হয়। ছবি: সারাবাংলা

আপিল বিভাগের দেওয়া এই স্থিতাবস্থার ফলে আগামী চার সপ্তাহ পর্যন্ত হাইকোর্টের রায়ের কার্যকারিতা স্থগিত থাকবে বলে জানিয়েছেন রিটকারীর পক্ষের আইনজীবী মনসুরুল হক চৌধুরী ও শিক্ষার্থীদের পক্ষের আইনজীবী শাহ মঞ্জুরুল হক। তারা বলছেন, এর ফলে আপাতত সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে কোটা অনুসরণ করতে হবে না।

এ আদেশের পর আপিল বিভাগ শিক্ষার্থীদের প্রতি নিজ নিজ শ্রেণিকক্ষে ফিরে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধানদের প্রতিও আহ্বান জানিয়েছেন, তারা যেন শিক্ষার্থীদের শ্রেণিক্ষে ফিরিয়ে নিতে উদ্যোগ নেন। তবে শিক্ষার্থীরা বলছেন, কোটাব্যবস্থার স্থায়ী সংস্কার না হওয়া পর্যন্ত তারা রাজপথ ছাড়বেন না। তারা এ বিষয়ে নির্বাহী বিভাগের আদেশ এবং এই মুহূর্তে আদেশ না হলেও অন্তত প্রতিশ্রুতি দাবি করে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন।

জুলাইয়ে যা ঘটল আন্দোলনে

কোটাবিরোধী আন্দোলনে ১ জুলাই থেকে বিকেলে দুই-আড়াই ঘণ্টার জন্য শাহবাগ অবরোধ শুরু করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। ঢাকায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও ঢাকা কলেজ, ইডেন মহিলা কলেজ, তিতুমীর কলেজসহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরাও বিক্ষোভ, সমাবেশ, মিছিলের মাধ্যমে আন্দোলন করছিলেন। দেশের অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েও ছড়িয়ে পড়ে আন্দোলন।

চতুর্থ দিনে গিয়ে আন্দোলন তীব্রতা পায়। এ দিন সকাল ১১টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত শাহবাগ চত্বর অবরোধ করে রাখেন আন্দোলনকারীরা। পরের দুই দিন শুক্র-শনিবার জনসংযোগের পর রোববার (৭ জুলাই) ক্লাস-পরীক্ষা বর্জনসহ ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচি ঘোষণা দেন তারা। সে দিন দুপুরের পর থেকে শাহবাগ, সায়েন্স ল্যাবরেটরি, নিউমার্কেটসহ রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ সব সড়ক অবরোধ করেন বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। তাদের কর্মসূচিতে সন্ধ্যা পর্যন্ত কার্যত অচল হয়ে পড়ে ঢাকা শহর।

সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায় মেট্রোরেলের ওপর ব্যাপক চাপ পড়েছে বুধবার দিনভর। ছবি: সারাবাংলা

বাংলা ব্লকেড কর্মসূচির আওতায় ঢাকার বাইরেও সব সড়ক-মহাসড়কে অবস্থান নিয়েছিলেন শিক্ষার্থীরা। পরদিন সোমবারও (৮ জুলাই) একই কর্মসূচি অব্যাহত ছিল। সেদিনও দুপুরের পর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ঢাকা স্থবির হয়ে পড়ে। ঢাকার বাইরেও বিশ্ববিদ্যালয়সংলগ্ন সড়ক-মহাসড়কগুলোতে যান চলাচল বন্ধ থাকে কয়েক ঘণ্টা। পরে মঙ্গলবার বিরতি দিয়ে আজ বুধবার সকাল থেকেই বাংলা ব্লকেড কর্মসূচির ঘোষণা দিয়েছিলেন আন্দোলনকারীরা। আজ সকাল ১১টার পর থেকেই তারা নিজ নিজ বিশ্ববিদ্যালয়সংলগ্ন সড়ক-মহাসড়ক অবরোধ করেন।

আরও পড়ুন-

সারাবাংলা/আরআইআর/টিআর

Tags: , , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন