বিজ্ঞাপন

বৃষ্টি-ব্যারিকেড সব ডিঙিয়ে শাহবাগ অবরোধ কোটাবিরোধীদের

July 11, 2024 | 5:42 pm

ঢাবি করেসপন্ডেন্ট

রাস্তায় নামলেই ব্যবস্থা— ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার ড. খ মহিদ উদ্দিনের এমন হুঁশিয়ারি উপেক্ষা করে কোটাবিরোধী আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা আগেই দিয়ে রেখেছিলেন শিক্ষার্থীরা। হয়েছেও তাই। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি থামতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মিছিল বের করেন তারা। পুলিশের দেওয়া ব্যারিকেড ভেঙেই আগেই কয়েক দিনের মতো তারা অবরোধ করেছেন শাহবাগ চত্বর।

বিজ্ঞাপন

বৃহস্পতিবার (১১ জুলাই) বিকেল ৫টার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে থেকে মিছিল নিয়ে শাহবাগ অভিমুখে রওনা দেন সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থার যৌক্তিক সংস্কারের দাবিতে মাঠে থাকা কোটাবিরোধী আন্দোলনকারীরা।

বিকেল ৫টার দিকে ঢাবি কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে থেকে কয়েক হাজার শিক্ষার্থীর মিছিলটি ক্যাম্পাসের গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট প্রদক্ষিণ শেষে শাহবাগে গিয়ে পৌঁছায়। সেখানে শাহবাগ থানার সামনে মিছিল আটকে দেয় পুলিশ। তবে পুলিশি বাধা ঠেলেই শাহবাগ মোড় দখলে নেন আন্দোলনকারীরা।

আরও পড়ুন- পরিপত্র-রায় নয়, কমিশনের মাধ্যমে কোটা সংস্কারে স্থায়ী সমাধান দাবি

বিজ্ঞাপন

এ সময় ফের গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি শুরু হলেও আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের বিচলিত হতে দেখা যায়নি। তারা এক দাবির আন্দোলনে অনড় অবস্থান ধরে রেখেছেন।

এর আগে বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা শাহবাগ অবরোধ করতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে জড়ো হন। ওই সময় অল্প দূরত্বেই মধুর ক্যান্টিনে জড়ো হন ছাত্রলীগের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণের নেতাকর্মীরা। উভয় পক্ষের স্লোগানে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে।

যে কারণে আন্দোলন

২০১৮ সাল পর্যন্ত সরকারি চাকরিতে মোট ৫৬ শতাংশ কোটা প্রচলিত ছিল। এর মধ্যে ৩০ শতাংশ ছিল বীর মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের সন্তান-নাতি-নাতনি কোটা, ১০ শতাংশ নারী কোটা, ১০ শতাংশ জেলা কোটা, ৫ শতাংশ ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী কোটা ও ১ শতাংশ প্রতিবন্ধী কোটা। এই কোটা পদ্ধতি সংস্কার করে সব ধরনের কোটা ১০ শতাংশের মধ্যে নামিয়ে আনার দাবিতে ওই বছর আন্দোলন শুরু করেন শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশীরা।

বিজ্ঞাপন

‘ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদে’র ব্যানারে ওই আন্দোলন সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। আন্দোলনের মুখে ওই বছরের ৪ অক্টোবর পরিপত্র জারি করে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরিতে (নবম থেকে ১৩তম গ্রেড) সব ধরনের কোটা বাতিল করে সরকার। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের বিধি-১ শাখা থেকে জারি করা প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, ৯ম গ্রেড (আগের প্রথম শ্রেণি) ও ১০ম থেকে ১৩তম গ্রেড (আগের দ্বিতীয় শ্রেণি) পদে সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে মেধা তালিকার ভিত্তিতে নিয়োগ দিতে হবে। ওই পদগুলোতে সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে বিদ্যমান কোটা পদ্ধতি বাতিল করা হলো।

শাহবাগ থানার সামনে ব্যারিকেড দিয়েও পুলিশ আন্দোলনকারীদের আটকাতে পারেনি। ছবি: সারাবাংলা

ওই পরিপত্র চ্যালেঞ্জ করে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও প্রজন্ম কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের পক্ষ থেকে ২০২১ সালের জুন মাসে হাইকোর্টে রিট করা হয়। রিটের শুনানি নিয়ে ২০২১ সালের ৬ ডিসেম্বর বিচারপতি মো. মজিবুর রহমান মিয়া ও বিচারপতি মো. কামরুল হোসেন মোল্লার সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ রুল জারি করেন। ৯ম থেকে ১৩ম গ্রেড পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধা কোটা সংরক্ষণের সিদ্ধান্ত বাতিল করে জারি করা পরিপত্র কেন আইনি কর্তৃত্ব বহির্ভূত ও অবৈধ ঘোষণা করা হবে না, তা রুলে জানতে চান আদালত। গত ৫ জুন ওই রিটেরই রায়ে পরিপত্রের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের কোটা বাতিলের অংশটি হাইকোর্ট অবৈধ ঘোষণা করেন।

এরপরই শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশীরা আবার ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে’র ব্যানারে নতুন করে কোটাবিরোধী আন্দোলন শুরু করেন। এর অংশ হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের প্রায় সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েই শিক্ষার্থীরা জুলাইয়ের প্রথম দিন থেকে সড়কে রয়েছেন।

সর্বশেষ কী ঘটল আদালতে

হাইকোর্ট থেকে সরকারের ২০১৮ সালের পরিপত্রের একাংশ বাতিল করে যে রায় তার বিরুদ্ধে আপিল করেছিল রাষ্ট্রপক্ষ। গত রোববার (৪ জুলাই) সেই আপিলের শুনানি হওয়ার কথা ছিল আপিল বিভাগে। তবে সেদিন আদালত আদালত শুনানি নেননি। পরে শুনানি নেওয়ার কথা জানান। তবে আপিল বিভাগ শুনানি না নেওয়ায় হাইকোর্টের রায়ই বহাল থাকে। ফলে শিক্ষার্থীরাও আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন।

বিজ্ঞাপন

এর মধ্যে আন্দোলনকারীদের পক্ষ থেকেও কোটা বাতিলের বিষয়ে আবেদন করা হয় আদালতে। আজ বুধবার (১০ জুলাই) আপিল বিভাগ রাষ্ট্রপক্ষের আপিল ও শিক্ষার্থীদের আপিলের শুনানি একসঙ্গে নিয়ে হাইকোর্টের রায়ে স্থিতাবস্থা জারি করেন চার সপ্তাহের জন্য। প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বাধীন সুপ্রিম কোর্টের পাঁচ সদস্যের আপিল বেঞ্চ এ বিষয়ে আগামী ৭ আগস্ট শুনানির জন্য দিন নির্ধারণ করে দেন।

আগের কয়েক দিনের ধারাবাহিকতায় বৃহস্পতিবারও বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী শাহবাগ মোড় অবরোধ করেন। ছবি: সারাবাংলা

আপিল বিভাগের দেওয়া এই স্থিতাবস্থার ফলে আগামী চার সপ্তাহ পর্যন্ত হাইকোর্টের রায়ের কার্যকারিতা স্থগিত থাকবে বলে জানিয়েছেন রিটকারীর পক্ষের আইনজীবী মনসুরুল হক চৌধুরী ও শিক্ষার্থীদের পক্ষের আইনজীবী শাহ মঞ্জুরুল হক। তারা বলছেন, এর ফলে আপাতত সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে কোটা অনুসরণ করতে হবে না।

এ আদেশের পর আপিল বিভাগ শিক্ষার্থীদের প্রতি নিজ নিজ শ্রেণিকক্ষে ফিরে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধানদের প্রতিও আহ্বান জানিয়েছেন, তারা যেন শিক্ষার্থীদের শ্রেণিক্ষে ফিরিয়ে নিতে উদ্যোগ নেন। তবে শিক্ষার্থীরা বলছেন, কোটাব্যবস্থার স্থায়ী সংস্কার না হওয়া পর্যন্ত তারা রাজপথ ছাড়বেন না। তারা এ বিষয়ে নির্বাহী বিভাগের আদেশ এবং এই মুহূর্তে আদেশ না হলেও অন্তত প্রতিশ্রুতি দাবি করে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন।

জুলাইয়ে যা ঘটল আন্দোলনে

কোটাবিরোধী আন্দোলনে ১ জুলাই থেকে বিকেলে দুই-আড়াই ঘণ্টার জন্য শাহবাগ অবরোধ শুরু করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। ঢাকায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও ঢাকা কলেজ, ইডেন মহিলা কলেজ, তিতুমীর কলেজসহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরাও বিক্ষোভ, সমাবেশ, মিছিলের মাধ্যমে আন্দোলন করছিলেন। দেশের অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েও ছড়িয়ে পড়ে আন্দোলন।

চতুর্থ দিনে গিয়ে আন্দোলন তীব্রতা পায়। এ দিন সকাল ১১টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত শাহবাগ চত্বর অবরোধ করে রাখেন আন্দোলনকারীরা। পরের দুই দিন শুক্র-শনিবার জনসংযোগের পর রোববার (৭ জুলাই) ক্লাস-পরীক্ষা বর্জনসহ ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচি ঘোষণা দেন তারা। সে দিন দুপুরের পর থেকে শাহবাগ, সায়েন্স ল্যাবরেটরি, নিউমার্কেটসহ রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ সব সড়ক অবরোধ করেন বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। তাদের কর্মসূচিতে সন্ধ্যা পর্যন্ত কার্যত অচল হয়ে পড়ে ঢাকা শহর।

কোটাবিরোধী স্লোগান লেখানানা ধরনের ব্যানার, প্ল্যাকার্ড নিয়ে শিক্ষার্থীরা হাজির হয়েছেন শাহবাগে। ছবি: সারাবাংলা

বাংলা ব্লকেড কর্মসূচির আওতায় ঢাকার বাইরেও সব সড়ক-মহাসড়কে অবস্থান নিয়েছিলেন শিক্ষার্থীরা। পরদিন সোমবারও (৮ জুলাই) একই কর্মসূচি অব্যাহত ছিল। সেদিনও দুপুরের পর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ঢাকা স্থবির হয়ে পড়ে। ঢাকার বাইরেও বিশ্ববিদ্যালয়সংলগ্ন সড়ক-মহাসড়কগুলোতে যান চলাচল বন্ধ থাকে কয়েক ঘণ্টা। পরে মঙ্গলবার বিরতি দিয়ে বুধবার (১০ জুলাই) সকাল থেকেই বাংলা ব্লকেড কর্মসূচির ঘোষণা দেন আন্দোলনকারীরা। এ দিন সকাল ১১টার পর থেকেই তারা নিজ নিজ বিশ্ববিদ্যালয়সংলগ্ন সড়ক-মহাসড়ক অবরোধ করেন।

এর মধ্যেই আপিল বিভাগের স্থিতাবস্থার আদেশ পেলেও শিক্ষার্থীরা আন্দোলন বন্ধ করেননি। তারা জানান, তাদের দাবি রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগের কাছে। নির্বাহী বিভাগ উদ্যোগ নিয়ে কমিশন গঠন করে কোটাব্যবস্থার যৌক্তিক সংস্কার করার আগ পর্যন্ত তারা আন্দোলন চালিয়ে যাবেন। বৃহস্পতিবার বিকেল থেকে ফের সারা দেশে বাংলা ব্লকেড কর্মসূচির ঘোষণা দেন তারা। এদিকে বৃহস্পতিবার ঢাকা মহানগর পুলিশ আন্দোলনে নামলে শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে ‘আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা’ নেওয়ার কথা জানালেও শিক্ষার্থীরাও ঠিকই আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন।

আরও পড়ুন-

বাংলা ব্লকেড: চট্টগ্রামে আটকে ছিল ৬ ট্রেন

ডিএমপি ‘হুঁশিয়ারি’ দিলেও অনড় আন্দোলনকারীরা

‘শিক্ষার্থীদের কল্যাণে সব কিছু করতে প্রস্তুত সরকার’

শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নামলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা: ডিএমপি

‘সর্বোচ্চ আদালতের আদেশে সরকারের পরিপত্র বহাল আছে’

বৈষম্যমূলক সব কোটা বাতিলের দাবিতে রাবিতে মশাল মিছিল

‘শিক্ষার্থীদের আবেগ পুঁজি করে অরাজকতা করলে আইনি ব্যবস্থা’

‘কোটা আন্দোলনকারীদের জন্য আদালতের দরজা সবসময় খোলা’

‘জনগণ বনাম শিক্ষার্থী’—এমন অবস্থায় দাঁড়িয়েছে আন্দোলন: ছাত্রলীগ

সারাবাংলা/আরআইআর/টিআর

Tags: , , , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন