বিজ্ঞাপন

মশা মারতে ‘কামান’ নয়, নজর দিতে হবে প্রজননস্থলে

July 12, 2024 | 10:47 pm

সৈকত ভৌমিক, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা: প্রতি বছরই দেশে এডিস মশার কামড়ে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। একইসঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে শিশু থেকে বৃদ্ধ— নানা সব বয়সী মানুষের মৃত্যুর সংখ্যাও। চলতি বছরেই আজ শুক্রবার (১২ জুলাই) পর্যন্ত দেশে দেশে চার হাজার ৪১ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য ভর্তি হয়েছেন। এর মধ্যে ৪৭ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মারাও গেছেন।

বিজ্ঞাপন

মৌসুম এলেই সিটি করপোরেশন ও পৌরসভাসহ সংশ্লিষ্টরা মশা মারতে কামান দাগানোর মতো ফগিং মেশিন দিয়ে কীটনাশক ছিটানোর দিকেই বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকে। পাশাপাশি এডিস মশার লার্ভা নির্মূলে চিরুনি অভিযান, জরিমানাসহ নানা ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব কার্যক্রম একদিকে যথেষ্ট নয়, অন্যদিকে কার্যকরও নয়। প্রকৃতপক্ষে এডিস মশার হাত থেকে রক্ষা পেতে প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদি ও বিজ্ঞানসম্মত পদক্ষেপ ও কার্যক্রম। বিশেষ করে মশার প্রজননস্থলগুলোকে নজরদারির আওতায় আনতে হবে। উৎসেই ধ্বংস করতে হবে মশা।

ডেঙ্গু ভাইরাসের বাহক এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে সিটি করপোরেশনের করণীয় বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রথমেই ধারাবাহিকভাবে জরিপ চালাতে হবে নগরজুড়ে। সেই জরিপের ফলাফল অনুযায়ী এডিস মশার প্রজননস্থলগুলো ধ্বংস করতে হবে। নিয়মিত নজরদারি অব্যাহত রাখতে হবে। এসব কাজ করার জন্য স্বাস্থ্য অধিদফতরের সঙ্গে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগের সমন্বয় করতে হবে। প্রয়োজন অনুযায়ী সক্ষমতা বাড়াতে হবে সিটি করপোরেশনগুলোর। এভাবে প্রতিরোধ করতে পারলেই কেবল ডেঙ্গুর প্রকোপ মোকাবিলা করা সম্ভব।

লার্ভার ঘনত্ব বেড়েছে সাড়ে ৩ গুণ বেশি
প্রতি বছর কেবল রাজধানীর দুই সিটি করপোরেশনে স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখা বর্ষার আগে, বর্ষার সময় ও পরে তিন দফায় লার্ভার জরিপ করে। এ জরিপের ফলাফল তারা দুই সিটি করপোরেশনের কাছে হস্তান্তর করে। চলতি বছরের বর্ষার আগের জরিপ প্রকাশ করা হয় এপ্রিল মাসে। জরিপের ফল প্রকাশ করা হয় গত ২৮ মে।

বিজ্ঞাপন

জরিপ প্রতিবেদন অনুযায়ী, ঢাকায় চলতি বছরের প্রাক-বর্ষা মৌসুমে ১৪ দশমিক ৬৮ শতাংশ বাসাবাড়িতে এডিস মশার শূককীট বা লার্ভা পাওয়া গেছে। ২০২৩ সালে একই সময় এই হার ছিল ৪ দশমিক শূন্য তিন শতাংশ। অর্থাৎ গত বছরের তুলনায় চলতি বছর রাজধানীর বাসাবাড়িতে এডিস মশার ঘনত্ব বেড়েছে সাড়ে তিন গুণের বেশি।

এডিস মশার ঘনত্বের সূচককে বলা হয় ব্রুটো ইনডেক্স। এর হার ২০-এর বেশি হলে তাকে ঝুঁকিপূর্ণ ধরা হয়। জরিপের ফলাফলে দেখা যায়, দক্ষিণের ২৯টি ওয়ার্ড ও উত্তরের ১২টি ওয়ার্ড ঝুঁকিপূর্ণ।


এদিকে স্বাস্থ্য অধিদফতরের ডেঙ্গু বিষয়ক প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, চলতি বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা তুলনামূলকভাবে ২০২৩ সালের তুলনায় কম থাকলেও মৃত্যুহার বেড়েছে। ২০২৩ সালের ৭ জুলাই পর্যন্ত আক্রান্তের তুলনায় মৃত্যু হার ছিল শূন্য দশমিক পাঁচ সাত শতাংশ। বিপরীতে চলতি মৌসুমে এই হার পাওয়া গেছে ১ দশমিক ১৫ শতাংশ।

বিজ্ঞাপন

বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন
কীটতত্ত্ববিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার সারাবাংলাকে বলেন, এডিস মশার ঘনত্ব পরিমাপ বা এর মাত্রা বাড়ছে নাকি কমছে, তা জানার জন্য জরিপ করানো প্রয়োজন। এমনকি ভবিষ্যতে ডেঙ্গুর সংক্রমণ কোন দিকে যাচ্ছে, তা বোঝার জন্যে হলেও জরিপ প্রয়োজন। এই জরিপের প্রতিবেদন অনুযায়ীই মূলত পদক্ষেপ নিতে হয়। এক কথায় বলা যায়, ডেঙ্গু নির্মূলে বিজ্ঞানসম্মত কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হলেই জরিপটা জরুরি। এ ক্ষেত্রে সিটি করপোরশনের নিজেরই জরিপ চালানো উচিত, তার জন্য প্রয়োজনীয় সক্ষমতাও তাদের বাড়াতে হবে।

মশা নির্মূলে কার্যকর পদক্ষেপগুলো ধাপে ধাপে তুলে ধরে এই কীটতত্ত্ববিদ বলেন, একটি সিটি করপোরেশন তার এলাকায় কীভাবে মশা নিয়ন্ত্রণ করবে, তা নিয়ে আলাদা দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে চারটি বিষয়ে নজর দিতে হয়— প্রথম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো সার্ভিল্যান্স। দেখতে হবে কোন মশার ঘনত্ব কখন ও কোথায় বেশি, কোন ধরনের ব্রিডিং প্লেসে কোন মশার ঘনত্ব বেশি। দ্বিতীয়ত, এই সার্ভিল্যান্স রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করে তৈরি করতে হবে অ্যাকশান প্ল্যান বা কর্মপরিকল্পনা, যেখানে কেমিক্যাল কন্ট্রোল, লার্ভিসাইট কন্ট্রোল, অ্যাডাল্টিসাইট কন্ট্রোল, বায়োলজিক্যাল কন্ট্রোল, সোর্স রিডাকশান ও কমিউনিটিকে সংযুক্ত করার মতো বিষয়গুলো উঠে আসবে।

তৃতীয়ত, এই কার্যক্রম বাস্তবায়নের সময় পুরো বিষয়টি যথাযথভাবে নজরদারির মাঝে রাখতে হবে। চতুর্থত, কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নের অগ্রগতি নিয়মিত মূল্যায়ন করতে হবে। কর্মপরিকল্পনা কার্যকর হলে অর্থাৎ এতে ভালো ফল এলে কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে হবে, সঠিক ফলাফল না পেলে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে পরামর্শ করে সংশোধিত অ্যাকশন প্ল্যান তৈরি করতে হবে। আর সবকিছুর মূলেই থাকবে মশার উৎপত্তিস্থল বা প্রজননস্থল নিয়ন্ত্রণে রাখা।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সভাপতি পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান সারাবাংলাকে বলেন, আগের মৌসুমগুলোর ধারাবাহিকতায় ডেঙ্গু অগ্রাধিকার পাওয়ার মতো একটি ইস্যু, যেটি সরাসরি মানুষের জীবনের সঙ্গে জড়িত। এ ক্ষেত্রে ডেঙ্গু মোকাবিলায় পরিকল্পনা বিজ্ঞানসম্মত হওয়া জরুরি। কর্মপরিকল্পনা বিজ্ঞানসম্মত না হলে সেটি কোনো কাজেই আসবে না।

বিজ্ঞাপন

দেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ নিয়ন্ত্রণে যেসব কার্যক্রম গ্রহণ করা হয় সেগুলো বিজ্ঞানসম্মত নয় উল্লেখ করে ড. আদিল বলেন, ডেঙ্গু নিধনে যা কিছু করা হয়, সেখানে কখনো সমন্বিত পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে? প্রতি বছর মশা নিধনের বাজেট রাখা হয়, বাড়ানো হয়। কিন্তু বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ না নিয়ে কেবল কীটনাশক স্প্রে করে মশা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব? আজ মনে হলো কীটনাশক দিলাম, কাল মনে হলো গাপ্পি মাছ ছাড়লাম— এভাবে তো সমাধান আসবে না। এর কোনাটিই মশা নির্মূলের বিজ্ঞানস্মত উপায় নয়।

এই নগর পরিকল্পনাবিদও মশার প্রজননস্থলের দিকেই মনোযোগ দেওয়ার কথা উল্লেখ করছেন। তিনি বলেন, আমাদের দেশে মশা মারতে ফগিংয়ে প্রচুর গুরুত্ব দেওয়া হয় কিন্তু লার্ভা ধ্বংস করার বিষয়টি সে অর্থে গুরুত্ব পায় না। আবার লার্ভা ধ্বংস করতে হলে আগে জানা জরুরি লার্ভা কোথায় বেশি। সেটা জানার উদ্যোগও সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে তেমন একটা দেখা যায় না। মশার প্রজননস্থলগুলো সঠিকভাবে শনাক্ত করে ধ্বংস করতে না পারলে কিন্তু মশা নিয়ন্ত্রণে আসবে না।

নিজস্বভাবে জরিপ প্রসঙ্গে সিটি করপোরেশনগুলো সবসময় সক্ষমতার অভাবের কথা বলে। এ প্রসঙ্গে ড. আদিল বলেন, সত্যি সত্যি ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করতে হলে তাদের সক্ষমতা বাড়াতে হবে। এ ক্ষেত্রে অবশ্যই কাউন্সিলরদের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। ওয়ার্ড কাউন্সিলর কিন্তু জানেন, কোন বাড়ির মালিক কে আর কোন কোন জায়গায় সমস্যা আছে। তারা সে বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে পারবেন। নিজ এলাকার বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষদের নিয়ে সচেতনতা কার্যক্রমও চালাতে পারবেন। এভাবেই স্থানীয় সরকারকে কার্যকর করতে হবে, যেটি পৃথিবীর সব দেশেই করা হয়ে থাকে।

জানতে চাইলে সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ এবং স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. বেনজির আহমেদ সারাবাংলাকে বলেন, রোগ হলে চিকিৎসা দেওয়ার চেয়ে প্রতিরোধের জন্য কাজ করা জরুরি। ডেঙ্গু মোকাবিলার ক্ষেত্রে সেটি সঠিকভাবে করা হচ্ছে না। সিটি করপোরেশনগুলো মশা নিধনে নানা উদ্যোগ নিলেও সেগুলো কারিগরিভাবে সঠিক না। সিটি করপোরেশনগুলোর উদ্যোগ দেখলে মনে হয়, মশা মারতে কামান দাগানো হচ্ছে। তারা ফগিং করে, ড্রেন পরিষ্কার করে। আবার বলা হয় চিরুনি অভিযান। কিন্তু সত্যিকার অর্থে কাজের কাজ কিছু হচ্ছে না।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখা থেকে মৌসুমে যে তিনটি জরিপ করা হয়ে থাকে, সেটিও পূর্ণাঙ্গ নয় বলে উল্লেখ করেন এই বিশেষজ্ঞ। বিষয়টি ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, আজ এক জায়গায় আপনি অনেকগুলো পানিভর্তি কনটেইনার দেখলেন, যেখানে মশার লার্ভা আছে। এগুলো রিস্ক জোনে থাকবে। কিন্তু সেগুলো পরিষ্কার করে ফেললেই সেটি কিন্তু রিস্ক জোন থেকে বেরিয়ে আসবে। একইভাবে জরিপের সবগুলো ইনডিকেটরই পরিবর্তনশীল। এখানে আবহাওয়ার ভূমিকাও রয়েছে। তাই সঠিক চিত্র বোঝার জন্য এই জরিপ ঘন ঘন করা জরুরি। এটি সিটি করপোরেশন নিজে করলেই ভালো। এতে তারা বিপজ্জনক বা ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় বিবেচনায় দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে পারবে। ফলে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ করা সহজ হবে, ডেঙ্গু রোগীও কমবে।

নিজস্ব জরিপ চালানোর বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. ফজলে শামসুল কবির সারাবাংলাকে বলেন, আমাদের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে এখনো কোনো জরিপ করা হয়নি। ভবিষ্যতে করার চিন্তাভাবনা আছে। কিন্তু মাঠপর্যায়ে আমাদের যে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কাজ করেন, তারা অভিজ্ঞ। কোন কোন এলাকাগুলো লার্ভাপ্রবণ বা এডিসপ্রবণ, তা তারা চেনেন ও জানেন। সে হিসাবেই আমরা এডিস মশা নির্মূলে কাজ করে যাচ্ছি।

এ বিষয়ে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, এরই মধ্যে আমাদের একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি এডিস মশার লার্ভার ঘনত্ব নিয়ে জরিপের পাশাপাশি সার্ভিল্যান্সের কাজও করছে। কমিটির পরামর্শ অনুযায়ী কার্যকর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। আশা করছি সবাই মিলে এবার আমরা ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম হব।

সারাবাংলা/এসবি/টিআর

Tags: , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন