বিজ্ঞাপন

৫ কারণে রাজধানীতে জলাবদ্ধতা, সমন্বয় নেই উন্নয়ন কাজেও

July 13, 2024 | 8:06 pm

রাজনীন ফারজানা, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা: বৃষ্টির পরিমাণ বাড়লেই ডুবে যাচ্ছে রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন এলাকা। কোথাও হাঁটু সমান পানি, কোথাও কোমর সমান। এতে বাড়ে জনদুর্ভোগ-ভোগান্তি। সর্বশেষ শুক্রবারও (১২ জুলাই) জলাবদ্ধতার নিদারুণ অভিজ্ঞতা পোহাতে হয়েছে নগরবাসীকে।

বিজ্ঞাপন

শুক্রবার মৌসুমের সর্বোচ্চ ৬০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাতে তলিয়ে যায় ধানমন্ডি, গ্রিন রোড, নিউমার্কেট, মতিঝিল, আরামবাগ, সেগুনবাগিচা, কাকরাইল, কাজীপাড়া, রোকেয়া সরণি, দক্ষিণখান, কল্যাণপুর, বিজয় সরণি, মালিবাগ, মৌচাকসহ ঢাকার অন্তত তিরিশটি এলাকা। ডুবেছে বিভিন্ন শপিং মার্কেটের দোকানপাট, জলমগ্ন ছিল বাসাবাড়িও।

এই পরিস্থিতির কারণ খুঁজতে গিয়ে দেখা গেল ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের সমস্যা প্রায় একই। স্টর্ম ওয়াটার ড্রেনে বর্জ্য জমে থাকা, খাল ভরাট ও কংক্রিট স্থাপনার আধিক্য, জনগনের অসচেতনতা ইত্যাদি জলাবদ্ধতার প্রধান কারণ। এ ছাড়া রাজধানীতে সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে উন্নয়ন কাজের সমন্বয় না থাকাও অন্যতম কারণ। মূলত এই পাঁচ কারণেই ডুবছে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা। সেই সঙ্গে রয়েছে নগর কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব পালনে অবহেলাও।

বিজ্ঞাপন

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সভাপতি ড. আদিল মুহম্মদ খান বলেন, ‘জলাবদ্ধতার অন্যতম প্রধান কারণ জলাশয় ভরাট করে করা উন্নয়ন। এই উন্নয়ন সমষ্টিগত এবং সরকারি পর্যায়ে। আগামী বছর যে, এটি থাকবে না তা বলার সুযোগ নেই। এ সব আমাদের নিয়তি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই আজাব আমাদের ভোগ করে যেতেই হবে।’

তিনি বলেন, ‘সিটি করপোরেশন অভিযান চালিয়ে খাল উদ্ধার করলেও তা নানা কারণে টেকসই হচ্ছে না। দখলদারদের বিরুদ্ধে আইন প্রয়োগের বিষয়টি পরিষ্কার না। অবৈধ দখলদারিত্ব উচ্ছেদ করা হলেও দোষীরা কারাদণ্ড বা অন্য শাস্তি পাবে কিনা তা আমরা জানি না। একদিকে উচ্ছেদ হচ্ছে, পাশেই অন্য ভবন দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। আমাদের বেসুমার উন্নয়নেরও কোনো মাপকাঠি নেই।’

এই নগর বিশেষজ্ঞ এর ভাষ্যমতে- জলাধারের পাশাপাশি সবুজ ধ্বংস করে স্থাপনা নির্মাণ করা হচ্ছে। পানি শোষণ করার জন্য পর্যাপ্ত মাটিও নেই। বেসরকারি পর্যায়ের পাশাপাশি সরকারিভাবেও শুধু ভবনই নির্মাণ করা হচ্ছে। হাতিরপুলে পানি উন্নয়ন বোর্ডের বিশাল বিশাল ভবন নির্মাণ হয়েছে, আজিমপুর কলোনিতেও একই অবস্থা। এভাবে গাছপালা ও মাটি ধ্বংস করে নির্বিচারে কংক্রিট স্থাপনা নির্মাণের ফলে পানি মাটির গভীরে শোষিত হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে না। এছাড়া ভবন নির্মাণের সময় ৪০ শতাংশ জায়গা ফাঁকা রেখে বাড়ি বানানর নিয়মও কেউ মানছেন না।

বিজ্ঞাপন

তিনি বলেন, ‘এখনই আমাদের পরিপূর্ণ বোধোদহয় না হলে ঢাকা শহরকে রক্ষা করা যাবে না। সিটি করপোরেশন, রাজউক সবাইকে সচেতন হতে হবে ও কাজ করতে হবে।’

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন: ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন বলছে, জলাবদ্ধতার পুরো দায় সিটি করপোরেশনের ওপর চাপিয়ে দিলে হবে না। এই জলাবদ্ধতার পেছনে সাধারণ মানুষ ও দখলদারদেরও দায় রয়েছে। এত জনবহুল একটি শহরে পুরনো ড্রেন নানাভাবে অকেজো বা ভরাট হয়ে গেলেও নতুন ড্রেন নির্মাণ হচ্ছে না।

দক্ষিণ করপোরেশনের প্রধান বর্জ্য কর্মকর্তা মোহাম্মদ নাছিম আহমেদ বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এমন বৃষ্টি এখন শুধু বাংলাদেশেই নয়, অন্যান্য দেশেও হচ্ছে। তারাও হিমশিম খাচ্ছে পানি সরাতে। রাজধানী ঢাকাতে শুক্রবার (১৩ জুলাই) যে পরিমাণ বৃষ্টি হয়েছে তা রেকর্ড পরিমাণ। এর ফলে আমরা পানি সরাতে হিমশিম খেয়েছি।’

বিজ্ঞাপন

তিনি বলেন, ‘আমরা উত্তরাধিকারসূত্রে যেসব ড্রেন পেয়েছি সেগুলো বর্জ্যে ঠাসা। বৃষ্টি হলেই শুধু নয়, এর বাইরেও আমরা পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রমও চালাই। আবার ভরাট হয়ে যাচ্ছে। ড্রেনের মধ্যে নির্মাণ সামগ্রির বর্জ্য থেকে শুরু করে এমন কোনো বর্জ্য নেই যে ফেলা হয় না। ড্রেনের মুখ খুললে প্লাস্টিকের প্যাকেট, ককশিট থেকে শুরু করে নানা কঠিন বর্জ্য থাকে। এ সব কঠিন বর্জ্যের কারণে দ্রুত পানি সরতে পারে না।’

ড্রেনের ধারণক্ষমতার পাশাপাশি নতুন ড্রেন নির্মাণ না হওয়া ও পুরনো কিছু ড্রেন নষ্ট হয়ে যাওয়ার কারণেও ঢাকা দক্ষিণের কিছু অংশে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়ে বলে জানান তিনি। এর মধ্যে মেট্রোরেল প্রকল্পের এমআরটি লাইন-৬ নির্মাণের সময় ঢাকা দক্ষিণের একটি বড় অংশের ড্রেনেজ ব্যবস্থাপনা ধ্বংস হয়ে গেছে বলে জানান তিনি। উত্তরা থেকে মতিঝিল রুটের এই রেলপথের কারওয়ানবাজার থেকে মতিঝিল অংশের পিলার বসেছে ড্রেনের ওপর। সেই ড্রেন আজও নতুন করে নির্মাণ করে দেওয়া হয়নি। বারবার চিঠি দিলেও মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ সেটি করে দিচ্ছে না বলে অভিযোগ। এর ফলে কারওয়ানবাজার থেকে মতিঝিল অংশের আশপাশের এলাকায় জলাবদ্ধতা দেখা দেয়।

তিনি জানান, পদ্মাসেতুর সংযোগ সেতু নির্মাণের সময় কমলাপুর স্টেডিয়ামের ওদিকের ড্রেনেজ ব্যবস্থা নষ্ট হয়ে যায়। সেটিও আজ পর্যন্ত ঠিক করা হয়নি। এর ফলে কমলাপুরের আশপাশের একটি বড় অঞ্চলে জলাবদ্ধতা দেখা দেয়। এসব সমস্যা সমাধানে খাল উদ্ধারে নিয়মিত অভিযান চলছে বলে জানান তিনি।

তিনি বলেন, ‘সীমিত মানবসম্পদ নিয়ে উচ্ছেদ ও অন্যান্য অভিযানে সংকট রয়েছে। খাল ভরাটে অনেক প্রভাবশালী জড়িত থাকায় অনেক বেগ পেতে হয়। তারপরও আমরা ছাড় দিচ্ছি না।’

বর্জ্য কেন ড্রেনে যায় ও এটি সরাতে কী উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে জানতে চাইলে ডিএসসিসির প্রধান বর্জ্য কর্মকর্তা বলেন, ‘আমরা সেকেন্ডারি ট্রান্সফার স্টেশন করার পরেও দেখা যাচ্ছে অনেকেই রাস্তাঘাটে ময়লা ফেলেন। বাসাবাড়ি, বাজার ও মার্কেট থেকে বর্জ্য সংগ্রহ করে এসটিএসে নেওয়া হয়। কিন্তু অনেকেই পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের কাছে ময়লা দিতে আগ্রহী নন। অনেকেই ভাবেন, ময়লা ফেলব, সিটি করপোরেশনের কাজ পরিষ্কার করা। কিন্তু ময়লা নেওয়ারও তো একটা সময় আছে। আমাদের পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা দিনে ময়লা নেয়, রাতে পরিষ্কার করে, রাস্তা ঝাড়ু দেয়। জনগণের মধ্যে এটুকু সচতেনতা আসতেই হবে।’

পর্যাপ্ত বিনের অভাব প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘রাস্তাঘাটে বিন থাকলে তার আশপাশ দিয়ে আরও ময়লা জমে। কিন্তু মার্কেট প্লেসে তো বিন থাকেই। তবে আমরা মার্কেটগুলোর সঙ্গে কথা বলছি সেখানে তালাবদ্ধ বিন রাখার স্থাপনের বিষয়ে। মার্কেটের দারোয়ান তো থাকেই তাই সেখানে অন্তত চুরি হবে না।’

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন: ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন বলছে, তাদের এলাকার জলাবদ্ধতার প্রধান কারণ ড্রেনে বর্জ্য, খাল ভরাট ও জনসচেতনতার অভাব।

প্রধান বর্জ্য কর্মকর্তা ক্যাপ্টেন ফিদা হাসান বলেন, ‘জলাবদ্ধতা নিরসনে আমরা সারাবছরই কাজ করে যাই। তারপরও আজকের মতো অতি বৃষ্টিপাতে ও অন্যান্য সময়ে জলাবদ্ধতা দেখা দিচ্ছে। এর তিনটি প্রধান কারণ পেয়েছি আমরা। প্রধান কারণ ড্রেনে বর্জ্য ফেলা। এত জনবহুল একটি নগরীর বর্জ্য ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত কঠিন। আমরা এত সিস্টেমেটিকভাবে বর্জ্য সংগ্রহ করে ল্যান্ডফিলে নিয়ে যাই। তারপরও মানুষ এখনও সচেতন নয়। এখনও সবাই সিটি করপোরেশনকে বর্জ্য দিতে প্রস্তুত নয়। দেখা যাচ্ছে রাস্তাঘাট, ড্রেন, খাল সব জায়গায় ময়লা ফেলে। সিটি করপোরেশনের কর্মীরা পরিষ্কার করার পরেও ফেলে। এর ফলে স্টর্ম ওয়াটার ড্রেন যেটি বৃষ্টির পানি বয়ে নিয়ে খালে ফেলবে সেই ড্রেনই থাকে ভরাট হয়ে। ক্যাচপিটগুলো খুললেই মেলে কঠিন বর্জ্য।’

এছাড়া পানি যেয়ে যে খালে পড়বে সেই খালগুলোও দখল হয়ে ভরাটের শিকার। হাউজিং কমপ্লেক্সগুলো নির্বিচারে খাল ভরাট করেছে। এর ফলে পানি বের হওয়ার জায়গা পায় না। আরেকটি কারণ হলো জনসচেতনতার অভাব। ড্রেনে বা খালে ময়লা ফেলে ভরাট করলে যে ক্ষতির শিকার হবেন তারাই, এটি মানুষ অনেক ক্ষেত্রেই বোঝেন না।

জলাবদ্ধতার সমাধানে উদ্যোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমরা খালের দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকেই নিয়মিত অভিযান চালিয়ে যাচ্ছি। দখলদারি যত প্রভাবশালীই হন না কেন, আমরা ছাড় দিচ্ছি না। সম্প্রতি আমরা খাল খননের উপযোগী এক্সকেভেটর ও অন্যান্য যন্ত্রপাতি কিনেছি। আশা করছি এই কাজ আরও গতি পাবে।’

এছাড়া জনসচেতনতা তৈরিতেও আমরা কাজ করে যাচ্ছি জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা বর্জ্য কিনে নেওয়ার পাশাপাশি সম্প্রতি প্রদর্শনী করেও দেখিয়েছি যে খালের মধ্যে কী না পাওয়া যায়। এতদিনের জঞ্জাল পরিষ্কারে কিছুটা সময় প্রয়োজন। প্রয়োজন কমিউনিটি এঞ্জেজমেন্ট। আশা করছি, দ্রুতই দৃশ্যমান পরিবর্তন চোখে পড়বে।’

রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ মো. আশরাফুল ইসলাম বলেন, ‘জলাবদ্ধতার জন্য আসলে একক কোন সংস্থার ওপর দায় চাপালে হবে না। অতিরিক্ত নগরায়নের ফলে এই শহরে মাটির অভাব, কংক্রিট স্থাপনা বেশি। ফলে পানি মাটির নিচে যাওয়ার সুযোগ পায় না। এছাড়া আমাদের ড্রেনেজ ক্যাপাসিটিও কম নগরের আকার ও মানুষের তুলনায়। ফলে আজকের মতো অতিবৃষ্টি হলে সেই পানি সরার সুযোগ পায় না।’

এছাড়া খাল দখল ও ভরাটকে দায়ী করে তিনি বলেন, ‘সিএস দাগ অনুযায়ী ঢাকায় ৫৭৪ কিলোমিটার খাল থাকার কথা যার অনেকটাই এখন আর দৃশ্যমান নয়। কোথাও কোথাও বক্স কালভার্ট করে খালের প্রবাহ সীমিত করা হয়েছে। যেমন সেগুনবাগিচা, পান্থপথ, ধোলাইরপার। ফলে পানি প্রবাহের ক্যাপাসিটি কমে গেছে।’

তিনি বলেন, ‘শুক্রবার (১২ জুলাই) ঢাকার মতোই একই পরিমাণ বৃষ্টি হয়েছে সাভার ও কেরানীগঞ্জে। কিন্তু সেখানে তো ঢাকার মতো জলাবদ্ধতা নেই। কারণ সেখানে পর্যাপ্ত সোকেবল গ্রিন (শোষণ করার মতো মাটি ও বনাভূমিও) আছে। ঢাকা শহরে সেটি না থাকার ফলেই এই দুরবস্থা।’

সমস্যা সমাধানে রাজউকের উদ্যোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমরা নতুন ড্যাপে বাড়ি তৈরির সময় ৪০ শতাংশ জায়গা ছাড়ার ব্যাপারে জোর দিচ্ছি যাতে সোকেবল গ্রিন নিশ্চিত হয়। এছাড়া ঢাকার মধ্যে ৫৫টি পুকুর খনন করা হবে সরকারি খাস জমিতে। এসব পুকুরও পানি ধরে রাখতে সাহায্য করবে।’

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআইপি)’র ২০২০ সালের এক গবেষণা অনুযায়ী একটি আদর্শ শহরে ১৫ থেকে ২০ ভাগ সবুজ এলাকা এবং ১০ থেকে ১৫ ভাগ জলাশয় থাকতে হবে। কিন্তু রাজধানী ঢাকার ৮২ শতাংশের বেশি মাটি কংক্রিটে ঢাকা আর জলাভূমির পরিমাণ মোট এলাকার ৪ দশমিক ৩৮ শতাংশ। তাই জলাবদ্ধতা, অতিরিক্ত গরম ও বৃষ্টিপাতের মতো সমস্যার সমাধানে প্রয়োজন এখনই সমন্বিত উদ্যোগ।

আরও পড়ুন:
জলাবদ্ধতা নিরসনে কাজ করছে রাজধানীর দুই সিটি করপোরেশন
সকাল থেকে বৃষ্টি, বিভিন্ন এলাকায় জলাবদ্ধতা
বৃষ্টি থামলেও আজও জলাবদ্ধতায় ভোগান্তি রাজধানীবাসীর
জলাবদ্ধতা নিরসনে ‘আশার বাণী’ নেই তিন সংস্থার প্রধানের কাছে
একটুখানি বৃষ্টিতেই নগরজুড়ে জলাবদ্ধতার ভোগান্তি
৬৫% কাজ শেষ, জলাবদ্ধতা সহনীয় থাকবে— আশ্বাস প্রকল্প পরিচালকের

সারাবাংলা/আরএফ/একে

Tags: , , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন