বিজ্ঞাপন

মোটা বুদ্ধিতে কোটা আন্দোলন

July 13, 2024 | 7:50 pm

আবদুল মান্নান

সালটা সম্ভবত ২০১১। পাবলিক সার্ভিস কমিশনের মৌখিক পরীক্ষার সামনে ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠির একজন মেয়ে পরীক্ষার্থী হাজির হলো। জানা গেলো তার বাড়ী পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের এক দুর্গম পাহাড়ি এলাকায়। বাবা ওই এলাকায় একজন হতদরিদ্র কৃষক। একটা ভাঙ্গাচোড়া প্রাইমারি স্কুল আছে। শিক্ষক আছেন দুই জন। সেই স্কুল থেকে সে পাশ করে রাঙ্গামাটি শহরে এসে তার এক আত্মীয়ের বাড়ীতে থেকে মাধ্যমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায়ও সে পাশ করে । এরপর অনার্স ও মাস্টার্স পাশ করেছে উত্তরবঙ্গের একটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। অবাক হয়ে জানতে চাই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় নয় কেন? উত্তরে জানা গেলো, সে লিখিত পরীক্ষায় টিকেছিল কিন্তু ফাইনাল লিষ্টে টিকে নি। ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী কোটায়ও চেষ্টা করেছিল। কিন্তু সেখানেও হয়নি। ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীদের জন্য চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঁচ শতাংশ কোটা বরাদ্দ ছিল তখন। সেই পাঁচ শতাংশ আসে নির্বাচনী পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের মূল তালিকা হতে। দেশের সকল বিশ্ববিদ্যালয়েও একই ব্যবস্থা। ছাত্রীটি শেষমেষ ভর্তির সুযোগ পেলো উত্তরবঙ্গের সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে। অনার্স মাস্টার্স দুটি পরীক্ষায়ই তার ফলাফল খুবই ভালো। এরপর প্রস্তুতি নিয়ে সে বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে লিখিত অংশে পাশ করে মৌখিক পরীক্ষার মুখোমুখি হয়েছে। মৌখিক পরীক্ষার সদস্যদের সামনে লিখিত পরীক্ষার কোন নম্বর থাকে না। বোর্ডের সভাপতিসহ মোট পাঁচজন সদস্য থাকেন। সকলে পৃথক পৃথকভাবে নম্বর দেন। এরপর সবগুলো গড় করে লিখিত পরীক্ষার নম্বরের সাথে যোগ হয়ে চূড়ান্ত ফলাফল ঘোষণা করা হয়।

বিজ্ঞাপন

২০১৩ সালে প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী হয়ে জাপানে গেলে সেই মেয়ের সাথে আবার দেখা। সেই আমার প্রটোকল অফিসার। নিজ থেকে পরিচয় দিয়ে জানালো তার মৌখিক পরীক্ষার বোর্ডে আমি ছিলাম। এও জানালো আমি তার কাছে কী কী জানতে চেয়েছিলাম। চমৎকৃত হই সেই দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চলের মেযেটা বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে ফরেন সার্ভিসের একজন অফিসার। এর বছর দুই পর তার সাথে দেখা আমাদের ফরেন সার্ভিস একাডেমির এক প্রশিক্ষণ কোর্সে। জানালো সে জাপানে তার মেয়াদ শেষ করে এখন মন্ত্রণালয়ে সংযুক্ত আছে। পরবর্তী পোস্টিং কোথায় এখনো সে জানে না। এরপর থেকে তার সাথে আর কোন যোগাযোগ নেই।

বর্তমানে দেশে কোটাবিরোধী আন্দোলন চলছে। আন্দোলনকারীদের দাবি কোটা পদ্ধতি বাতিল করে সব নিয়োগ ‘মেধার’ ভিত্তিতে দিতে হবে। আন্দোলনকারী একজন মেয়ে টিভি পর্দায় বললো ‘মেয়েরা এখন ছেলেদের সাথে সাথে অনেক এগিয়েছে, তাদের কোটার প্রয়োজন নেই’। এই মেয়েটা দেশের বর্ণিত শ্রেণীর মেয়েদের কথা কি জানে? সে কি জানে আমাদের হাওড়, দুর্গম বা দ্বীপাঞ্চলেরর পড়ুয়ারা কত কষ্ট ও দারিদ্রের মধ্যে থেকে লেখা পড়া করে? না, জানে না। দুর্ভাগ্য হচ্ছে এরা দেশের সকলকে নিজেদের দৃষ্টিতে দেখে। তারা যেমন লাখ টাকার দামের মোবাইল ফোনের সাথে জন্ম হতেই পরিচিত, ঠিক সেভাবেই মনে করে দেশের সকল মেয়েরা এই সুবিধা ভোগ করে। তারা বুঝতে পারে না ঢাকা বাংলাদেশে নয়। সকলে তাদের মতো সুযোগ সুবিধা ভোগ করে না। এই দেশে যেমন চোখ ধাঁধানো প্রাচুর্য তেমন আছে দারিদ্র আর বৈষম্যের শিকার লক্ষ লক্ষ মানুষ। যেমন শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত স্কুল আছে তেমন চালা ছাড়া স্কুলও আছে।

নানা কারণে সমাজের বঞ্চিত জনগোষ্ঠীকে চাকুরি, শিক্ষা বা রাষ্ট্রের নানা ধরণের সুযোগ সুবিধা দেয়ার জন্য দেশে দেশে এই কোটা প্রথা চালু ছিল এবং এখনো আছে। যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশের কালো মানুষদের জন্য বিদ্যালয়ে ভর্তি থেকে শুরু করে বিভিন্ন ক্ষেত্রে কোটা ব্যবস্থা রয়েছে। এই সব বিষয় নিয়ে সেই দেশে একাধিক মামলা হয়েছে এবং তা আদালতের মাধ্যমে সুরাহা হয়েছে, কোন আন্দোলনের মাধ্যমে নয়। ভারতের কোটা পদ্ধতি অনেক ব্যাপক। সেখানে ৬০ শতাংশ সরকারি চাকুরি কোটার মাধ্যমে পূরণ করা হয়। সেনাবাহিনীতেও এই কোটার মাধ্যমে সেনা সদস্য নিয়োগ প্রাপ্ত হয়। একই ব্যবস্থা পাকিস্তানেও। দক্ষিণ আফ্রিকা, মেক্সিকো, ফ্রান্স, বৃটেনসহ ইউরোপের অনেক দেশেই নানা রকমের কোটা ব্যবস্থা ছিল ও আছে। কোনটা লিঙ্গবৈষম্য কমাতে, কোনটা হয়তো বয়স্ক মানুষকে চাকুরির সুযোগ করে দিতে। এই কোটা ব্যবস্থা সরকারি বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চালু আছে। অন্যদিকে জাতিসংঘসহ সকল আন্তর্জাতিক সংস্থায় বাংলাদেশসহ সকল সদস্য দেশের জন্য কোটা সংরক্ষিত আছে যা কদাচিৎ পূরণ হয়। কারণ বাংলাদেশের ‘মেধাবি’দের কাছে ওই সব চাকুরিকে প্রবেশের যে মাপকাটি আছে তা থাকেনা। যার অন্যতম হচ্ছে ইংরেজি ছাড়াও অন্য আর একটি ভাষা জানা। সাথে আছে কোন একটি বিষয়ের উপর একটি প্রেজেন্টেশন দেয়া। রাজপথে শ্লোগান দেয়া আর এই সব যোগ্যতা অর্জন করা ভিন্ন বিষয়। সেই সব পদ সাধারণত পূরণ হয় ভারতসহ এই অঞ্চলের দক্ষ ও মেধাবিদের দিয়ে।

বিজ্ঞাপন

পাকিস্তান আমলে সেনাবাহিনীর কথা বাদ দিলেও সরকারি অন্যান্য চাকুরিতে সর্বক্ষেত্রে পিছিয়ে পরা তৎকালিন পূর্ব বাংলার অধিবাসীদের জন্য বিভিন্ন সময়ে বাঙালি রাজনীতিবিদরা সরকারি চাকুরিতে বাঙালিদের জন্য কোটা সংরক্ষণের জন্য দাবি করে ব্যর্থ হয়েছেন। পাকিস্তানের ২৩ বছরের শাসনামলে কেন্দ্রীয় সরকারের চাকুরি পাওয়া ছিল বাঙালিদের জন্য সোনার হরিণ পাওয়ার মতো। তারপরও শ্রেফ মেধার গুণে কয়েকজন বাঙালি সর্ব পাকিস্তান পাবলিক সার্ভিস কমিশন পরীক্ষায় প্রথম হয়েছিলেন। এদের মধ্যে এ কে এম আহসান, শফিউল আজম, মনোওয়ারুল ইসলাম অন্যতম। আবার দু-একজন শীর্ষ তালিকায় স্থান দখল করা সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত চাকুরিতে যোগ দিতে পারেননি কারণ পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর দৃষ্টিতে তারা ‘কমিউনিস্ট’ ছিলেন। আজকে যারা বামপন্থী রাজনীতি করেন তারা কজনে জানেন বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবই বামপন্থীদের কমিউনিস্ট নাম নিয়ে এদেশে রাজনীতি করার অধিকার দিয়েছিলেন? পাকিস্তান আমলে প্রদেশগুলোর জন্য পৃথক একটি ক্যাডার সার্ভিস ছিল। পূর্ব পাকিস্তানের ক্যাডার সার্ভিসের বেশির ভাগ সদস্য ছিল ভারত হতে আসা উর্দুভাষী বিহারীরা। এই ইতিহাস আজকে যারা রাজপথে কোটা বাতিলের নামে মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলের আন্দোলেন করছেন হয়তো তাদের অজানা।

দেশ স্বাধীন হলে বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সরকারি চাকুরিতে এই কোটা পদ্ধতি চালু করেছিলেন। তাদের জন্য এটি কোন উপহার ছিল না। এটি ছিল দেশের জন্য তাদের যে অত্মত্যাগ, তার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ। যারা সরকারি চাকরিতে কর্মরত ছিলেন তাদের দুই বছরের জেষ্ঠ্যতা দেয়া হয়েছিল। এই সুযোগ অনেকই নেননি, কারণ তাদের যে মেধা বা দক্ষতা ছিল তাতে তারা ওই সুযোগ না নিয়েও ভাল অবস্থানে ছিলেন। ১৯৭২ সালে যখন আমাদের সংবিধান প্রণীত হয় তখন সংসদে নারীদের জন্য ১৫টি আসন সংরক্ষিত রাখা হয়। দেশের অনগ্রসর অংশের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা (কোটা) রাখার বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে আমাদের সংবিধানের ২৮(৪) ও ২৯(৩) অনুচ্ছেদে।

১৯৭৫ সালের পর ৩০ লক্ষ শহিদের রক্তবিধৌত এই বাংলাদেশে কোটাবিরোধী আন্দোলনের নামে যারা আন্দোলন করছে তাদের দাবি মুক্তিযোদ্ধাদের কোটা বাতিল করতে হবে। এই কোটা যদিও ৩০ শতাংশ তারা বলে ৫৬ শতাংশ। তারা হয়তো জানেনা এই পর্যন্ত এই মুক্তিযোদ্ধা কোটার গড়ে ১২ দশমিক ২ শতাংশের (২৭ থেকে ৩০তম) বেশি ব্যবহৃত হয়নি। ১৯৮৮ সালে তা শূন্য শতাংশে নেমে এসেছিল। বাকিটা প্রয়োজনে মেধা তালিকা হতে পূরণ করা হয়। ২৭ থেকে ৩০তম বিসিএসসে মেধা কোটার বাইরে অর্থাৎ সাধারণ মেধা তালিকায় চাকুরি পেয়েছে গড়ে ৬৭ দশমিক ৮ শতাংশ। বর্তমানের প্রায় ৭০ শতাংশই সাধারণ তালিকা থেকে হচ্ছে। তারপরও অনেক পদ খালি থেকে যায় কারণ মেধাবী বা যোগ্য প্রার্থী পাওয়া যায় না।

বিজ্ঞাপন

২০১৮ সালে এমন একটি কোটাবিরোধী আন্দোলন শুরু হয়েছিল। বাস্তবে তাও ছিল মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিল আন্দোলন। দুঃখের বিষয় হচ্ছে ১৯৭৫ সালের পট-পরিবর্তনের পর একাধিক প্রজন্ম বেড়ে উঠেছে যাদের কাছে ‘মুক্তিযোদ্ধা’, ‘মুক্তিযুদ্ধ’, ‘জয় বাংলা’ আর ‘বঙ্গবন্ধু’ শব্দ গুলো অনেকটা গালির মত শোনায়। তারা হচ্ছে ওই প্রজন্ম যারা কথায় কথায় বলে ‘I hate Bangladesh’। দেশের হাওয়া বাতাস খেয়ে মানুষ হওয়া এরা প্রথম সুুযোগেই দেশ ত্যাগ করে অন্য দেশে তৃতীয় শ্রেণীর নাগরিকত্ব গ্রহণ করার জন্য সুযোগ খুঁজে। এটি আমাদের সামষ্টিক ব্যর্থতা।
মুক্তিযোদ্ধা কোটাবিরোধী আন্দোলনকারীদের অনেকেরই মাথায় জাতীয় পতাকা ফেটি বা ব্যান্ড হিসেবে বাঁধা থাকে। তারা হয়তো জানে না ওই একটি পতাকার জন্য এই দেশের ৩০ লক্ষ মানুষ নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন। এই পতাকা ব্যান্ড হিসেবে বাঁধার জন্য নয় অন্তরে ধারণ করার জন্য আমাদের দিয়ে গিয়েছিল ওই শহিদরা। তারা হয়তো এও জানে না ১৯৭৫ সালের পর সকল সামরিক বেসামরিক সরকার অলিখিতভাবে এই কোটা ব্যবস্থা স্থগিত করেছিলো। শুধুমাত্র মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়ার ‘অপরাধে’ অনেককে চাকুরিচ্যুত করা হয়েছিল। ১৯৭৭ সালে সেনা অভ্যুত্থানের অজুহাতে জিয়া প্রায় চৌদ্দশ সেনা সদস্যকে শুধু বিনা বিচারে ফাঁসি দিয়ে হত্যাই করেনি, তাদের মরদেহটা পর্যন্ত স্বজনদের কাছে ফিরিয়ে দেননি। এরা প্রায় সকলেই ছিল মুক্তিযোদ্ধা। এটি ছিল একটি পরিকল্পিত রাষ্ট্রীয় গণহত্যা।

১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনা সরকার গঠন করার পর দীর্ঘ প্রায় ২১ বছর পর এই পরিস্থিতির পরিবর্তন শুরু হয়। তিনি এত বছরের ক্ষতিটা পুষিয়ে দেয়ার জন্য মুক্তিযোদ্ধাদের কোটা তাদের পরবর্তী প্রজন্ম পর্যন্ত সম্প্রসারণ করেন। তবে তাদের এই সুযোগ গ্রহণ করতে হলে মেধার স্বাক্ষর রাখতে হবে। এটি এমন নয় যে একজন এসে দাবি করলো সে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান বা মুক্তিযোদ্ধা তাকে চাকুরি দেয়া হোক। তাকে আগে মেধা যাচাইয়ের সকল প্রক্রিয়া শেষ করতে হবে। তার পরবর্তী ধাপে তাকে নিয়োগের বিষয়টি বিবেচনা করা হবে। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে একটি নির্বাচনী পরীক্ষায় ১০০ জন মুক্তিযোদ্ধা সন্তান প্রাথমিক ধাপে উত্তীর্ণ হলো। সেই ১০০ জন হতে প্রথম ৩০ জন চাকুরিতে প্রবেশের সুযোগ পাবে। বাকি ৭০ জন বাইরে থেকে যাবে। তারা যদি সাধারণ তালিকায় আসতে পারে আসবে। এই যে যাদের জন্য কোটা সংরক্ষিত আছে তারা সকলে এই কোটার সুযোগ গ্রহণ করে চাকুরিতে আসে না। তারা অন্যদের সঙ্গে লাইনে দাঁড়িয়ে সরকারি চাকুরিতে প্রবেশ করে। খোঁজ নিয়ে দেখা যাবে বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাপক হতে শুরু করে সচিব পর্যন্ত অনেকেই কর্মরত আছে যারা তাদের কোন কোটা ব্যবস্থার সুবিধা নেননি। আবার পারিবারিক সকল সুযোগ সুবিধা থাকা সত্ত্বেও সমাজের একেবারে উচ্চবিত্ত শ্রেণির সন্তানরা সরকারি চাকুরির প্রতিযোগিতায় টিকতে পারেন না। কারণ তারা তাদের একটি উল্লেখযোগ্য সময় ব্যয় করে ভোগ বিলাসে যা সমাজের সুবিধা বঞ্চিত শ্রেণির সন্তানরা পায় না। কিন্তু তারা কর্মজীবনের সকল প্রতিযোগীতায় ভাল করে। কোটা ব্যবস্থা অযোগ্যদের ঢালাও ভাবে সুযোগ দেয় তা কল্পনাপ্রসূত।

২০১৮ সালের কোটাবিরোধী আন্দোলন যখন দেশে একটি সরকারবিরোধী আন্দোলন চলছিল। সেই আন্দোলনে যারা সম্পৃক্ত ছিলো তারা কোটাবিরোধী আন্দোলনকে সমর্থন দিয়েছিল। দ্রুত সেই আন্দোলন তাদের হাতে চলে যায় এবং তা ভয়ানকভাবে একটি উচ্ছৃঙ্খল পরিস্থিতির জন্ম দেয়। এক পর্যায়ে এই আন্দোলনকারীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাসভবনে হামলা করে তা ধ্বংসস্তুপে পরিণত করে। ক্ষতি হয় কয়েক কোটি টাকার। তখন উপাচার্যের বাসভবনে চা পরিবেশন করার জন্য একটি কাপও অক্ষত ছিল না। বর্তমানেও সেই একই রাজনৈতিক দলগুলো এই কোটাবিরোধী আন্দোলনকারীদের সমর্থন দিয়েছে। পরবর্তী দৃশ্যের জন্য জাতি অপেক্ষা করছে। সেই আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা সংসদে এই কোটা ব্যবস্থা বাতিলের ঘোষণা করেন। এই প্রেক্ষাপটে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় একটি পরিপত্র জারি করে। এতে একজন মুক্তিযোদ্ধা সন্তান দেশের উচ্চ আদালতে একটি রীট দায়ের করলে আদালত তার পক্ষে রায় দেয়। এর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ সুপ্রিম কোর্টে আপিল করেছে যা এখনো নিষ্পত্তির অপেক্ষায় আছে। আন্দোলনকারীরা সে পর্যন্ত অপেক্ষা করতে নারাজ। তারা এখনই তা বাতিল চান। তা কিভাবে সম্ভব তা কারো জানা নাই। একটি মামলার সম্পূর্ণ আইনী প্রক্রিয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত তার সমাপ্তি হয়েছে বলা যাবে না। বঙ্গবন্ধুকন্যা তার পরিবারের ১৭ জন সদস্যের বিচারের জন্য যদি ৩০ বছর অপেক্ষা করতে পারেন তা হলে বর্তমান প্রজন্ম কেন কদিন অপেক্ষা করতে পারবে না।

গত রোববার একটি টিভি চ্যানেলে একজন আন্দোলনকারী নেতা আসল কথাটি বলে ফেললেন। সঞ্চালকের প্রশ্নের উত্তরে তিনি বেশ উচ্চ কণ্ঠে বলেন, এই সরকারের উপর মানুষের আস্থা নেই, আদালতের উপর আস্থা নেই। সরকার চাইলেই আদালতের বিষয়টি নিষ্পত্তি করে দিতে পারে। মেধার কী ভয়াবহ বিচ্ছুরণ! এক নেতা আবার সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘নির্বাহী বিভাগ চাইলে জারি করতে পারে নতুন পরিপত্র’। আদালতে মামলা নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত এমন পরিপত্র যে আদালত অবমাননার সামিল তা হয়তো সে বুঝতেই পারেনি। তাকে আবার ইন্ধন যুগিয়েছে কয়েকজন মতলবাজ আইনজীবী। তাদের উদ্দেশ্য সরকার এমন একটি পরিপত্র জারি করুক যা পরবর্তীকালে উচ্চ আদলতে বাতিল হয়ে যায় আর সৃষ্টি হয় নতুন সংকটের। কদিন আগে আন্দোলনকারীদের একটি মিছিল হাইকোর্টের সামানে দিয়ে যাওয়ার সময় ‘ভুয়া, ভুয়া’ বলে শ্লোগান দিয়েছে। সরকার ও আদালত নিয়ে সেই আন্দোলনকারী যে কথা গুলো বলেছেন এমন কথা প্রতিদিন সরকার উৎখাতে ব্যস্ত দলগুলো বলে থাকে। যখন ঢাকায় নিরাপদ সড়ক আন্দোলন চলছিল তখন সেই আন্দোলন এক পর্যায়ে ছিনতাই হয়ে গিয়েছিল। ২০১৮ সালের আন্দোলন দুএকজন স্বঘোষিত রাজনৈতিক নেতা সৃষ্টি করেছিল। এখন দেখার পালা বর্তমান আন্দোলন কজন এমন নেতা তৈরি করে।
বিদ্যমান কোটা ব্যবস্থার যে সংস্কার প্রয়োজন তা কেউ অস্বীকার করবেনা। সব দেশে তাই করা হয়। তবে তা রাজপথ দখল করে মানুষকে জিম্মি করে কেন করতে হবে তা আন্দোলনকারীদের চিন্তা করতে হবে। এই কোটা বা সংরক্ষণ ব্যবস্থা নিয়মিতভাবে যৌক্তিক ও বিজ্ঞান সম্মতভাবে সংস্কার করা উচিত।

বিজ্ঞাপন

লেখক: বিশ্লেষক ও গবেষক

সারাবাংলা/এজেডএস

Tags: ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন