বিজ্ঞাপন

রাজপথের আন্দোলনে নয় আদালতেই কোটা নিয়ে সিদ্ধান্ত

July 14, 2024 | 2:52 pm

মাহমুদুল হাসান শামীম

পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে সমতার ভিত্তিতে এগিয়ে নিতে কর্মসংস্থানসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা দিতে সারা বিশ্বে কোটা সংরক্ষণ ব্যবস্থা প্রচলিত। বাংলাদেশেও মহান মুক্তিযুদ্ধের পর থেকেই এই ব্যবস্থা চালু করা হয়।

বিজ্ঞাপন

কোটা ব্যবস্থা চালুর একটি দীর্ঘ বঞ্চনার ইতিহাস রয়েছে। বৃটিশ আমলে সরকারি চাকরি-বাকরির সিংহভাগ ছিল ইংরেজদের দখলে। ব্রিটিশ থেকে এ অঞ্চলের স্বাধীনতার পর দেখা গেল দেশের চাকরিতে পশ্চিম পাকিস্তানীদের প্রাধান্য। কেন্দ্রীয় বেসামরিক চাকরিতে পশ্চিম পাকিস্তানীরা ৮৪%, বৈদেশিক চাকরিতে ৮৫%, স্থল বাহিনীতে ৯৫%, নৌবাহিনীতে ৮১%, নৌবাহিনী ( অকারিগরী) ৯১%, বিমানবাহিনী (বৈমানিক ) ৮৯% এবং সশস্ত্র বাহিনীতে ৯৬.১৫% । বাঙগালিদের ভাগে যথাক্রমে ১৬%, ১৫%, ৫%, ১৯%, ৯%, ১১% এবং ৪.৭৫% চাকরি। এ বঞ্চনার তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকেই স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু সংবিধানের আলোকে জাতির অনগ্রসর অংশের জন্য কোটা প্রথা চালু করেন। সংবিধানের তৃতীয় ভাগের ২৯ (১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে “প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদ-লাভের ক্ষেত্রে সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা থাকিবে। এই অনুচ্ছেদের ২৯ এর (৩) এর (ক) তে বলা হয়েছে, নাগরিকদের যে কোন অনগ্রসর অংশ যাহাতে প্রজাতন্ত্রের কর্মে উপযুক্ত প্রতিনিধিত্ব লাভ করিতে পারেন, সেই উদ্দেশ্যে তাহাদের অনুকূলে বিশেষ বিধান-প্রণয়ন করা হইতে, রাষ্ট্রকে নিবৃত্ত করিবে না।”

১৯৭২ সালের ৫ নভেম্বর এক নির্বাহী আদেশে সরকারি, আধাসরকারি, প্রতিরক্ষা এবং জাতীয়করণ করা প্রতিষ্ঠানে জেলা ও জনসংখ্যার ভিত্তিতে ৪০ শতাংশ জেলা কোটা, ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটা এবং ক্ষতিগ্রস্ত মহিলাদের জন্য ১০ শতাংশ কোটা পদ্ধতি প্রবর্তন করা হয়। ওই সময় সরকারি কর্মচারী নিয়োগে মাত্র ২০ শতাংশ নেওয়া হয়েছিল সাধারণ মেধা কোটায়। পরে বিভিন্ন সময় এ কোটা পদ্ধতির সংস্কার, পরিমার্জন ও পরিবর্তন করে সরকার।

মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য কোটা প্রবর্তন করে সরকার তাদের প্রতি সম্মান জানিয়েছে। কারণ তাদের আত্মত্যাগ ও মৃত্যুঞ্জয়ী যুদ্ধের ফলেই বাংলাদেশের জন্ম। পরবর্তিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটা মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তান ও বংশধরদের জন্য সংরক্ষণ করা হয়। এই ধরনের ব্যবস্থা পৃথীবির বহু দেশেই আছে। ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়েছে। কিন্তু ৭৯ বছর পর এখনও রাশিয়া, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, যুক্তরাস্ট্রসহ বিভিন্ন দেশে সেই যুদ্ধের শহীদ এবং বীরযোদ্ধাদের পরিবার , বংশধররা নানান ধরণের সরকারি সুবিধা ভোগ করে। এ ছাড়া পৃথিবীর যেসব দেশ মুক্তিযুদ্ধ বা সংগ্রামের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা অর্জন করেছে সেসব দেশে তাদের মুক্তিযোদ্ধারা, তাদের সন্তান-সন্ততি ও বংশধরেরা চাকুরিসহ নানা ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার পায়। ৩০ লক্ষ শহীদ এবং বীর মুক্তিযোদ্ধা যারা জীবন বাজী রেখে দেশকে স্বাধীন করেছেন মুক্তিযোদ্ধা কোটা তাদের প্রতি রাস্ট্রের এক ধরনের কৃতজ্ঞতা ও সম্মান।

বিজ্ঞাপন

৩০% ভাগ মুক্তিযোদ্ধা কোটা থাকা স্বত্বেও ১৯৭২ থেকে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত এ কোটায় মাত্র ২৫ জন চাকরি পেয়েছেন। এখনও প্রতিটি চাকরির নিয়োগের সময় দেখা যায় এই কোটা খালি থাকে। ৩৯ তম বিসিএস পরীক্ষা পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধাদের কোটার ৩০% শতাংশের মধ্যে একবার মাত্র ৮.৫ শতাংশ পূরণ হয়েছে। অধিকাংশ সময়েই ২%, ৩% কোটা পূরণ হয়েছে।

মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও নাতি-নাতনি ৩০ শতাংশ কোটা ছাড়াও সর্বশেষ ২০১৮ সালে সরকারি চাকরিতে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধী ১ শতাংশ, নারী ১০ শতাংশ, পশ্চাৎপদ জেলাগুলোর জন্য ১০ শতাংশ, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ৫ শতাংশ মিলিয়ে শতকরা ৫৬ ভাগ কোটা পদ্ধতি চালু ছিল। নাগরিকদের যে কোন অনগ্রসর অংশ যাতে প্রজাতন্ত্রের কর্মে উপযুক্ত প্রতিনিধিত্ব লাভ করতে পারে, সেই উদ্দেশ্যে তাদের অনুকূলে বিশেষ বিধান-প্রণয়ন করার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে সংবিধানের ২৯ অনুচ্ছেদে। ভারত, চীন, রাশিয়া, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, অস্ট্রেলিয়া, মালয়েশিয়াসহ পৃথিবীর সব সভ্য দেশে এই ধরনের ব্যবস্থা রয়েছে। সার্ক দেশগুলোর মাধ্যে বাংলাদেশেই কোটার সংখ্যা সবচেয়ে কম। ভারতের ৬০ শতাংশ, পাকিস্তানে ৯২.৫ শতাংশ, নেপালে ৪৫ শতাংশ, শ্রীলঙ্কায় ৫০ শতাংশ চাকরিতে এবং বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তিতে ৬০ শতাংশ কোটা চালু রয়েছে।

৩৩ থেকে ৪৩ তম বিসিএস এবং গত ১১ বছরে সব ধরণের সরকারি চাকরিতে গড়ে ১৩.০৯% কোটায় নিযুক্তি দেয়া হয়েছে। কোটার বাকী অংশ পুরণ হয়েছে জাতীয় মেধা তালিকা থেকে। কোটার বিপুল সংখ্যক পদ খালি থাকার কারণ কোটার জন্য উপযুক্ত প্রার্থী না পাওয়া। কোটা নিয়ে অনেকেরই বিভ্রান্তি রয়েছে। অনেকেই ভাবেন কোটা মানে মেধাবী বনাম অন্য কিছু। আসলে সেটি একদমই ঠিক নয়। কোটায় যারা আবেদন করেন তাদেরকেও অন্য সবার মতোই প্রিলিমিনারি পাস করে রিটেন ভাইভায় পাস করতে হয়। তারপরই কেবল কোটার সুবিধা পাওয়া যায়। মেধাবী না হয়েও, পরীক্ষা না দিয়ে বা পাস না করেই কেউ শুধু কোটার সুবিধায় চাকরি পায় এমনটি কখনও হয় না।

বিজ্ঞাপন

বাংলাদেশের কোটার ইতিহাস দেখলেই যে কেউ জানতে পারবেন ১৯৭২ সালে কোটা পদ্ধতি প্রবর্তনের পর সময় সময় কোটা পদ্ধতির সংস্কার, পরিমার্জন ও পরিবর্তন করেছে সরকার। সময়,পরিস্থিতি ও চাহিদার প্রয়োজনে কোটা পুনর্বিন্যাস অতীতে করা হয়েছে। আগামীতেও হবে। সব দেশেই তা হয়। এ জন্য আন্দোলন নয় আলোচনার মাধ্যমেই সমাধান সম্ভব।

তবুও ২০১৮ সালে রাজপথে কোটা সংস্কার আন্দোলন করে শিক্ষার্থীরা। এরই পরিপ্রেক্ষিতে সরকারি চাকরিতে নারী কোটা ১০ শতাংশ, মুক্তিযোদ্ধা কোটা ৩০ শতাংশ এবং জেলা কোটা ১০ শতাংশ বাতিল করে পরিপত্র জারি করে সরকার। ওই পরিপত্রের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ২০২১ সালে হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তান অহিদুল ইসলামসহ সাত জন। আবেদেনর চূড়ান্ত শুনানি শেষে গত ৫ জুন হাইকোর্ট মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলের পরিপত্র অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেন আদালত। সরকার এই রায়ের বিরুদ্ধে আপীল করে। অর্থাৎ আন্দোলনকারীরা যা চাচ্ছেন সরকারও তাই চেয়েছে।

কোটা বাতিলের প্রভাব খু্বই নেতিবাচক। ২০১৮ সালে কোটা বাতিলের পর থেকে গত কয়েক বছরে কোটা না থাকায় সরকারি চাকরিতে মেয়েদের অন্তর্ভুক্তি হতাশাজনকভাবে কমে গেছে। পুলিশে মাত্র চারজন নারী কর্মকর্তা নিয়োগ পেয়েছেন। পররাষ্ট্র ক্যাডারে পেয়েছেন দুজন। ২৩ জেলা থেকে কেউ পুলিশ ক্যাডার পায়নি। ৫০ টি জেলায় নারীরা বিভিন্ন ক্যাডারের চাকরির ক্ষেত্রে কোন সুযোগই পায়নি। যখন কোটা পদ্ধতি ছিল নারী চাকুরিপ্রার্থী কম বেশি ২৬ শতাংশের বেশী চাকুরি পেয়েছিলেন। কোটা ব্যবস্থা তুলে দেওয়ার ফলে এই চাকুরি প্রাপ্তি কোন কোন বছরে ১৯ শতাংশে নেমে এসেছে।

সংবিধান অনুযায়ী আদালতে বিচারাধীন কোন বিষয় নিয়ে নির্বাহী বিভাগ বা সংসদ আলাদাভাবে কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। রাস্ট্রপক্ষ হিসেবে সরকার তার অভিমত আদালতকে জানাতে পারে। এক্ষেত্রে সরকারপক্ষ, আন্দোলন কারীদের প্রতিনিধি, মূল রীট মামলা দায়েরকারি পক্ষ সহ সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের বক্তব্য শুনে আদালতই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেবেন। আদালতে বিচারাধীন বিষয়গুলো দেশের আইন অনুযায়ী নিয়ন্ত্রিত হয়। যথাযথ প্রক্রিয়া বা আইনি পদ্ধতি মেনেই আদলতের সিদ্ধান্ত পেতে হয়। আইন ও সংবিধান লংঘন করে আদালত পূর্ণাঙ্গ শুনানি ছাড়া কোন সিদ্ধান্ত দিতে পারেন না।

বিজ্ঞাপন

প্রধান বিচারপতি বলেছেন আন্দোলনকারিদের জন্য আদালতের দুয়ার খোলা। তিনি সবার কথা শুনবেন। আন্দোলনকারিরা তাদের দাবিগুলো আইনজীবিদের মাধ্যমে তুলে ধরতে পারেন। তিনি আরো বলেছেন নির্বাহী বিভাগের কাছে দাবী কেন? নির্বাহী বিভাগের সিদ্ধান্ত আদালতে চ্যালেঞ্জড হতে পারে।

এদিকে সরকারের কোটা বাতিল করে জারি করা পরিপত্রের বিরুদ্ধে রিটের রায় প্রকাশিত হয়েছে। এতে আদালত সব কোটা বজায় রাখতে বলেছেন। তবে প্রয়োজনে সরকার তা কমাতে বা বাড়াতে পারবে।“—(এর অর্থ কোটা সংস্কার। এটি অতীতে অনেকবারই হয়েছে। এখনও হতে পারে। এজন্য জনদূর্ভোগ সৃষ্টি করে রাজপথে আন্দোলনের দারকার নেই।)

আদালত আরো বলেছেন “যে কোন পাবলিক পরীক্ষার কোটা পুরণ না হলে সাধারণ মেধাতালিকা থেকে শূন্যপদ পূরণ করায় বিবাদীদের স্বাধীনতা রয়েছে।“— (এটি চাকরি নিয়োগে কোন দাবী-দাওয়া বা আন্দোলন ছাড়াই অনেকবারই করেছে সরকার।)

কিন্তু রাষ্ট্রপক্ষ ও দুই শিক্ষার্থীর আবেদনের ওপর শুনানি নিয়ে আপিল বিভাগ কোটার বিষয়ে পক্ষগুলোকে চার সপ্তাহের জন্য স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে নির্দেশ দিয়েছেন। এ সময়ে হাইকোর্টের রায় কার্যকর থাকবেনা। বিষয় বস্তুর ওপর স্থিতাবস্থার ফলে কোটা আপাতত কার্যকর থাকছে না।

ফলে আপিল বিভাগের রায়ের পরেই কোটার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে। বিচারাধীন বিষয়ে সংসদ বা নির্বাহী বিভাগ কোন সিদ্ধান্ত দিতে পারে না। সংবিধান ও সুপ্রিম কোর্টের প্রসিডিউর উপেক্ষা করে কোন দাবী আদায়ের জন্য রাজপথে জনদূর্ভোগ সৃষ্টি করার অর্থ হচ্ছে রাস্ট্রের অস্তিত্বকে চ্যালেঞ্জ করা। সংবিধান ও সর্বোচ্চ আদলতকে অসম্মান করা।

বিষয়টি বিচারিক প্রক্রিয়ায় সর্বোচ্চ পর্যায়ে আপীল বিভাগে পৌছায় এখন সরকারের করার আর কিছু নেই। আপীল বিভাগ যে রায় এবং নির্দেশনা দিবে সরকার কেবল তার আলোকেই পদক্ষেপ নিতে পারবে।

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও সংবাদ বিশ্লেষক

সারাবাংলা/এসবিডিই

Tags: , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন